রং নির্বাচনে wrong করা যাবে না

ঘরের রং নির্বাচনে নিজের পছন্দকে গুরুত্ব দিন। মডেল: উর্মিছবি: প্রথম আলো

চোখ বন্ধ করে একটা ঘর কল্পনা করুন। চমৎকার রং করা সেই ঘরে এসে মিশেছে আলো। আরেকটা ঘর, সেখানে কোনো রং নেই। কী, দ্বিতীয় ঘরটি কল্পনায় আনতেই মন খারাপ হয়ে গেল? রঙের কত ক্ষমতা, বোঝার জন্য এই কল্পনাটুকুই যথেষ্ট।

দিন শেষে আপনি যেখানে ফিরে যান, সহজ কথায় সেটিই ঘর। আর সেই ঘরের রং কেবল ঘরকে সুরক্ষা দিয়ে সৌন্দর্যই বাড়ায় না, আপনার মনের ওপরও দেখায় তার জাদু। মানুষের ওপর ‘জটিল ও নাটকীয়’ প্রভাব ফেলে ঘরের রং।

মহামারি বদলে দিল রঙের ধারণা

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঘরবাড়িতে রঙের ব্যবহার সম্পর্কিত ধারণাই বদলে গেছে। এখন পুরো বাড়িতে এক রঙের পরিবর্তে একেক ঘরে একেক রং বা একই ঘরের একেক দেয়ালে একেক রং ব্যবহার করা হচ্ছে। আবার অনেক সময় একাধিক রঙের সমন্বয়ে দেয়ালে ফুটে উঠছে নকশা। বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশের বিপণন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক এ কে এম সাদেক নওয়াজ মনে করেন, বাড়ির ভেতরে বা বাইরে রঙের ব্যবহার নিয়ে মানুষের মনে কিছু ভুল ধারণা চালু আছে। বললেন, ‘আমরা মনে করি, রংটা কেবল সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য। অথচ রঙের প্রধান কাজ ঘরকে সুরক্ষা দেওয়া। রোদ, ঝড়, বৃষ্টি, ধুলা, ছাতা পড়া থেকে বাঁচানো। ’

তবে সাদেক নওয়াজের ধারণা, মনের ওপর রঙের প্রভাব নিয়ে মানুষের সচেতনতা বাড়ছে, ‘মহামারির পর ঘরের রং নিয়ে মানুষ আরও বেশি সচেতন।’ মহামারির সঙ্গে ঘরের রঙের সম্পর্ক নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মানুষ এখন স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনে আগ্রহী। আর ঘরকে জীবাণুমুক্ত করার ক্ষেত্রে রং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। হাঁচি, কাশির জীবাণু বা ব্যাকটেরিয়া শোষণ করে নিতে পারে, এমন রঙের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। প্রতি বর্গফুটে আড়াই টাকা বেশি খরচ করলেই সেটি সম্ভব। এটি দুই থেকে তিন বছর পর্যন্ত সুরক্ষা দেবে। এ ছাড়া বিধিনিষেধের পর মানুষ এখন ঘন ঘন ঘরের রং বদলাচ্ছে। একঘেয়ে ভাব কাটাতে ঘরে নতুনত্ব আনছে। এ জন্য নতুন প্রযুক্তিও এসেছে। যাতে ঘরের আসবাব না সরিয়েই, ঘর খালি না করে পুরোনো রং বা দেয়াল সিরিশ কাগজে ঘষার ফলে যে ধুলা তৈরি হয়, সেটি কমিয়ে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত দূষণ রোধ করে রং করা যায়।’

ঘরের ভেতরেই প্রাইভেট আর পাবলিক স্পেস

স্টুডিও মরফোজেনেসিস লিমিটেডের পরিচালক স্থপতি সায়কা ইকবাল জানান, একটা বাড়ির ভেতরের স্পেসকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। ব্যক্তিগত আর পাবলিক। বসার ঘর (ড্রয়িংরুম) পাবলিক, খাবার আর পড়ার ঘর সেমি পাবলিক। শোবার ঘরটা আবার ব্যক্তিগত। ঘরের ভেতরকার পাবলিক প্লেসে, মানে অতিথিরা যেখানে আসতে পারেন, সেখানে একটু উজ্জ্বল, ঝলমলে ‘এনার্জেটিক’ রংগুলো ব্যবহার করা যেতে পারে।

ঘরের দেয়ালের রঙের ক্ষেত্রে চলতি ধারা কোনটি? এ প্রশ্নের উত্তরে এই স্থপতি বলেন, ‘এখন অনেকে রঙের বদলে একটা সিমেন্টের আস্তর, লাল ইটের খোলা রূপ, প্যাস্টেল শেডের ওপর হাতের কাজ (হ্যান্ডিক্র্যাফট)—এগুলো ব্যবহার করছেন। অনেকে আবার ঘরের কোনো একটা কোণে নিজের পছন্দমতো বর্ণিল আলপনা বা পেইন্টিং করেন। দেয়ালে নিজের মনের মতো কিছুর প্রতিফলন রাখেন। এখন সারা বাড়িতে এক রং না করে একেক ঘরে একেক রং–ই ট্রেন্ড। এমনকি এক ঘরেও একাধিক রঙের ব্যবহার বাড়ছে।’

ঘরের ভেতর সাদা রং ব্যবহার করলে ঘর বড় দেখাবে। মডেল: মার্শিয়া ও বাপ্পা
ছবি: সুমন ইউসুফ

কোন ঘরে কী রং

বাজারে এখন এক রঙেরই হাজার হাজার শেড আছে। বসার ঘরে আপনি চাইলে গাঢ় রং ব্যবহার করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে শর্ত হলো, ঘরটি যথেষ্ট বড় হতে হবে। আর পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা থাকতে হবে। কেননা, গাঢ় রং ব্যবহার করলে বেশি আলোর প্রয়োজন হয়। ঘরের আসবাব আর পর্দার সঙ্গে মিলিয়ে একেক দেয়ালে একই রঙের বিভিন্ন শেডও ব্যবহার করতে পারেন। একটা দেয়ালে পছন্দমতো ডিজাইনও করতে পারেন। দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকতেই যে স্পেসটা চোখে পড়ে, সেখানে রং দিয়ে কিছু এঁকেও দেয়ালকে আকর্ষণীয় করা যায়। লাইট পিঙ্ক, ফ্রেঞ্চ গ্রে, ভায়োলেট, ক্রিম কালারও ব্যবহার করা যেতে পারে। হালকা, স্নিগ্ধ আমেজ আনে, শোবার ঘরে এমন রং থাকা উচিত। এ ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ রং যেমন সাদা বা লাইট ভায়োলেট, সবুজ, লেমন ইয়েলো, ফ্রেঞ্চ গ্রে, ক্রিম—এ রকম শীতল রং দেওয়া যায়।

শিশুর ঘরে তার পছন্দের কোনো চরিত্র থাকলে দেয়ালে সেটা আঁকিয়ে নিতে পারেন। ঘরে সবুজের ছোঁয়া চাইলে খাবারের ঘরে সেটা ব্যবহার করতে পারেন। সেই ঘরটা ছোট হলেও এখানে ব্যবহৃত জিনিসগুলো সবুজের সঙ্গে সহজেই মানিয়ে যাবে।

খুব ছোট ওয়াশরুমে গাঢ় রং ব্যবহার করলে জায়গাটা আরও ছোট মনে হয়। তবে অনেকে ইদানীং স্নানঘরের একটা বা দুটো দেয়াল ‘চিল্ড কালার’ রাখতে পছন্দ করেন। এক পাশ উজ্জ্বল হলো, আরেক পাশ একটু হালকা। এক পাশ আরেক পাশের পরিপূরক হলো আরকি। ঘরের সিলিংয়ের রং নিরপেক্ষ হওয়া উচিত। সিলিংয়ে সাদা বা দেয়ালের রং থেকে আরও হালকা রং ব্যবহার করলে ঘর উজ্জ্বল দেখায়।

বাড়ির বাইরের দিকের রং আশপাশের পরিবেশ বুঝে বাছাই করতে পারেন। পুরো বাড়িতে হালকা কোনো রং ব্যবহার করে বর্ডারে দিতে পারেন গাঢ় শেড।

ঘরের রঙে মন রঙিন

‘হাউ কালার এফেক্টস আর্কিটেকচার’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আর্ক ডেইলি ডটকম। সেখানে স্থাপত্যে বিভিন্ন রঙের প্রভাব নিয়ে স্থপতি ও মনোবিজ্ঞানীদের গবেষণার ফলাফল তুলে ধরা হয়েছে। এই যেমন নীল রং মানুষকে সজাগ রাখে, জেগে থাকতে সাহায্য করে। আবার কেউ যদি মন খারাপ ভাবটা উদ্‌যাপন করতে চান, তাহলে নীলচে রঙের একটা ঘরে গিয়ে এক কোনায় চুপচাপ বসে থাকতে পারেন। মানুষের একেকটি অনুভূতির সঙ্গে গভীর সম্পর্ক আছে একেক রঙের। যেমন লাল রং ভয় বা বিপদের সঙ্গে সম্পর্কিত। সেটি মানুষের রক্তের রং লাল হওয়ার কারণেও হতে পারে।

হলুদ হ্যাপি মুডের রং
ছবি: প্রথম আলো

আসক্তি, উত্তেজনা, উষ্ণতা, ভয়, রাগ এ রকম নানা কিছুকে নির্দেশ করে লাল। নির্ভর করে আপনি কোথায় লালের কোন শেড ব্যবহার করছেন। লালের গাঢ় শেডগুলো, যেমন মেরুন বা ওয়াইন রং প্রলুব্ধকর আবহ সৃষ্টি করে। আবার যদি একটু উজ্জ্বল বা নিয়ন লাল ব্যবহার করেন, সেটা বেশ বন্ধুভাবাপন্ন একটা আবহ সৃষ্টি করে। বিভিন্ন শেডের লাল রঙের ব্যবহার করে আবার অনন্য একটা মুড সৃষ্টি করা যায়। নিরপেক্ষ কোনো রঙের মাঝে লাল দিয়ে কোনো নকশা বা কিছু আঁকা হলেও সেটা আকর্ষণীয় হবে। তবে ঘরের আকার ছোট হলে লাল ব্যবহার না করাই ভালো। তাতে স্পেসটা আরও ছোট মনে হবে। কমলাও উজ্জ্বল রং, তবে লালের মতো চড়া নয়। আপনি যদি উজ্জ্বল রঙের ‘ফ্যান’ হন, সে ক্ষেত্রে বসার ঘরটিকে কমলায় রাঙিয়ে তুলতে পারেন। কাছাকাছি কয়েকটা শেড ব্যবহার করলে বেশি ভালো হবে।

হলুদ ‘হ্যাপি মুডে’র রং। এই রংটা দিয়েই আপনি ঘরের পুরোটাই রাঙিয়ে তুলতে পারেন। ‘শান্ত’ এ রঙের বৈশিষ্ট্যের কারণে বাচ্চার ঘর, দিবা পরিচর্যা বা কিন্ডারগার্টেনে ব্যবহার করা যেতে পারে। অনেকের মতে, হলুদ ক্ষুধা উদ্রেককারী রং। তাই অনেক রেস্তোরাঁতেও এখন হলুদের ব্যবহার চলে। এদিকে সবুজ খুবই আরামদায়ক (রিল্যাক্সিং) রং। বিশেষ করে নিয়ন সবুজ, কলাপাতা বা টিয়া সবুজ। সাদার পাশে সবুজ আরও অর্থপূর্ণভাবে ফুটে ওঠে। তাই ‘ফ্রেন্ডলি’ আবহ তৈরিতে সবুজ আর সাদার পাশাপাশি রেখে রাঙাতে পারেন আপনার দেয়াল। পাবলিক স্পেস যেমন ড্রয়িংরুমের জন্য অনেকেরই পছন্দ নীল। অন্যদিকে আপনি যদি দেয়াল পেইন্টিং বা নানা কিছু দিয়ে সাজাতে চান, সে ক্ষেত্রে সাদাই হবে সেরা। যাতে অন্য সব রং তার সক্রিয়তা নিয়ে ফুটে উঠতে পারে।