দেয়ালগুলো যদি কথা বলতে পারত, তবে আমাদের বসতবাড়ি হতো একটা দীর্ঘ উপন্যাস।
ময়মনসিংহের দেড় শ বছরের পুরোনো পৌরসভার ঠিক মাঝখানে ১৫–২০টি বাড়ি নিয়ে ছিমছাম একটা পাড়া—নও-মহল। সেখানে ষাটের দশকের শুরুর দিকে আমাদের বাড়িটাও তৈরি হলো; কয়েক বছর ধরে। তৎকালীন শহুরে মধ্যবিত্তের বাড়ি যেমন হতো, তেমনই আমাদের এই বাড়ি। প্রায় তিন কাঠা জায়গাকে তিন ভাগ করে মাঝখানে দোতলা বাড়ি। সামনের অংশে মূল রাস্তার পাশে ফুলের বাগান, পেছনে উঠান আর চারপাশে নারকেল, আম, জাম, পেয়ারা, বরই, চন্দন মিলে গোটা বিশেক গাছ। একসময় বাইরে থেকে বাগান আর গাছপালার ফাঁকফোঁকরের ভেতর দিয়েই আঙুর আর জুঁইয়ের লতায় ফ্রেমবন্দী বাড়িটাকে দেখা যেত। পেছনের উঠানের পূর্বধার ঘেঁষে প্রকাণ্ড এক মেহগনিগাছ ছিল। বাড়ি অন্ধকার করে ফেলার অভিযোগে তাকেও কেটে ফেলা হলো আশির দশকে এসে। পৌরসচিব চল্লিশোর্ধ্ব আমার বাবাই ছিলেন এই বাড়ির ডিজাইনার, আর্কিটেক্ট। তাঁর সঙ্গে ছিলেন কয়েকজন রাজমিস্ত্রি ও শ্রমিক। ছোট্ট বাড়িটা করতেও বাবাকে ব্যাংক লোন নিতে হয়েছিল; পরে যা ১৫ বছরে শোধ করেন। বাবা বাড়িটার নাম রেখেছিলেন ‘লা মাকান’ (স্থানহীনতা)।
আমাদের বাড়ির তিন দিকে প্রতিবেশীদের বাড়িগুলোরও চারপাশে খোলা জায়গা ছিল, তাই সব বাড়িতেই প্রচুর আলো-বাতাস ছিল। আকাশের দেখা পেতে ছাদে উঠতে হতো না। বাড়ির যেখানে–সেখানে চাঁদের ঝলক মিলত। বড় আর অর্ধগোলাকার বারান্দায় উঠলেই বাড়িতে ঢোকার তিনটা চয়েস—বাঁয়ে ড্রইংরুম, মাঝে অন্দরের সরাসরি প্রবেশপথ আর ডানে দোতলায় যাওয়ার সিঁড়ি। দরজাগুলো সব কাঠের, জানালাগুলোও তা–ই, শুধু কয়েকটি ঘরের জানালায় কাঠের ফ্রেমের মাঝখানে কাচ দেওয়া ছিল।
ওপর আর নিচতলা মিলে নয়টা ঘর। সামনের সঙ্গে পেছনের বারান্দাকে সংযুক্ত করেছে একটা করিডোর। আমাদের ১০ ভাইবোনের খেলাধুলার জন্য এই জায়গা কখনো কম মনে হয়নি। এরপর তো ক্রমে আমাদের ভাইবোনের সন্তানদের জন্যও বারান্দাগুলোই ছিল ছোট্ট মাঠের বিকল্প। আজকালকার বাড়ি হলে এই বারান্দা আর করিডোরের জায়গাতেই করে ফেলা হতো আরও কয়েকটি ঘর। এই বাড়ি নির্মাণে কংক্রিটের ব্যাবহার ছিল কিছু পিলার আর বিমেই। ইট-সিমেন্টের ১০ ইঞ্চি পুরু দেয়াল গ্রীষ্মে ঘরগুলো ঠান্ডা রাখতে বেশ কার্যকর ছিল।
গরমের দিনে বারান্দাগুলোতে আড্ডাও চলত দিনের যেকোনো সময়। বাইরে থেকে বাড়িতে এলেই মনে হতো কোথাও কোনো তাড়া নেই, চৈত্রের দুপুরে গা এলিয়ে পড়ে থাকার এমন সুখ আর কোথাও পাই না।
এই বাড়িতে হইহুল্লোড়, হট্টগোল, আনন্দ–বেদনায় জীবন কাটানো মানুষগুলো এখন একেকজন একেক স্থানে। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছেন তাঁরা। শুধু এই বাড়ি থেকে নয়, পৃথিবী থেকেই চিরবিদায় নিলেন আমার দাদি, বাবা, মা ও তিন ভাই।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়িটাও এখন পরিবর্তন হয়েছে। তবু যে বাড়িটার কথা সব সময় মনে গেঁথে আছে, সেটা শৈশবের বিশাল এক বাড়ি, যেখানে ডাইনিং টেবিলটা টেনিস কোর্টের মতো বড়, মায়ের বিছানা ছিল একটা সুইমিংপুল।
অনেক বছর পর ফিরে গিয়ে দেখি, হঠাৎ বাড়িটা খেলনার মতো ছোট হয়ে গেছে। দরজা-জানালার ওপরের চৌকাঠ হাত উঁচু না করেই ছোঁয়া যায়। যে করিডর পার হতে দৌড়াতে হতো অনেকটা সময়, সেটা হাঁটা শুরু না করতেই শেষ হয়ে যায়। আমার সঙ্গে সঙ্গে বাড়িটাও বড় হয়নি, রোজ যেন ছোট হয়ে যাচ্ছে, দূরে সরে যাচ্ছে।
যে বাড়িতে গেলেই টাইম মেশিনে চড়ে অতীতে ফেরা যায়, সেই বাড়ির মায়া কাটানো যে বড্ড কঠিন।