ব্যস্ত সময়ে থমকে যাওয়া নগরী

কর্মস্থলমুখী মানুষ প্রতিদিন অসহ্য যানজটে আটকা পড়েন। ছবিটি ২১ জানুয়ারি রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর আড়ং মোড় থেকে তোলা। ছবি: তানভীর আহাম্মেদ
কর্মস্থলমুখী মানুষ প্রতিদিন অসহ্য যানজটে আটকা পড়েন। ছবিটি ২১ জানুয়ারি রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর আড়ং মোড় থেকে তোলা। ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

বিশ্বের অনেক দেশেই যানজট একটি বহুল আলোচিত সমস্যা। এর কারণে শত শত সমস্যার জন্ম। এ কারণে অর্থনীতিতে প্রভাব অত্যন্ত নেতিবাচক। কয়েক বছর আগের হিসাবে ইউরোপে বছরে ২০০ বিলিয়ন ইউরো, যুক্তরাষ্ট্রে ১০০ বিলিয়ন ডলার নষ্ট হচ্ছে যানজটের ফলে। বিশ্বব্যাংকের এক জরিপে বলা হয়েছিল, যানজটের কারণে রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিন ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এর ক্ষতির পরিমাণ বছরে প্রায় ১১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার, যা দেশের মোট জিডিপির ৭ শতাংশের সমান। এসব পরিসংখ্যানের দিকে তাকাতে চাই না। আমার প্রায় ছয় কিলোমিটারের পথ পাড়ি দিতে এক দিনের ঘটনা বলতে চাই।

মঙ্গলবার (২৪.০৯.২০১৯) সকাল সাড়ে আটটায় উঠেছি বিআরটিসির দোতলা বাসের দোতলায়। কল্যাণপুর থেকে রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ততম এলাকা ফার্মগেট যাচ্ছি। গাড়ি কল্যাণপুর থেকে শ্যামলী গিয়ে আর যেন এগোচ্ছে না, ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। অনেকক্ষণ পর শ্যামলী থেকে একটু এগিয়ে প্রায় শিশুমেলার কাছে পৌঁছাল। দোতলায় বসে বসে দেখছি শিশুমেলা থেকে কলেজগেটের রাস্তা প্রায় ফাঁকা, তাও রাস্তা আটকে রেখেছে পুলিশ। কিছুক্ষণ পরপর ৫-১০টি করে গাড়ি ছাড়া হচ্ছে। কী অদ্ভুত ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছে পুলিশ!

শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও হাসপাতাল এলাকায় পৌঁছে সামনে তাকিয়ে দেখছি, এখানেও রাস্তায় জ্যাম থাকার যৌক্তিক কারণ নেই। যাত্রী ওঠানোর জন্য রাস্তার মধ্যে বা ডানে-বাঁয়ে এলোপাতাড়ি দাঁড়িয়ে আছে বাসগুলো। যেসব বাসে যাত্রীসংখ্যা চেক করা হয়, সেগুলো দ্রুত চেক শেষ করার জন্য এক লাইনে না দাঁড়িয়ে পুরো রাস্তা দখল করে আছে। অথচ এ কারণে ইতিমধ্যেই সৃষ্টি হয়েছে তীব্র যানজটের! ঠায় দাঁড়িয়ে আছে অন্য বাসগুলো। ঘড়ির কাঁটা কিন্তু থেমে নেই।

কলেজগেট থেকে আসাদগেটের দিকে যাচ্ছি, আবার থেমে গেল বাস। খেয়াল করলাম, সব গাড়ি বাঁশি বাজিয়ে মুহূর্তেই থামিয়ে বিপরীত রাস্তা থেকে আসা কালো রঙের একটি পাজেরো কার পার করে দিল পুলিশ। বুঝতে পারলাম, বিশেষ কোনো ব্যক্তি আছেন গাড়িতে, কিন্তু আইন তো সবার জন্য সমান; কোনো ব্যক্তি এককের জন্য তো ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করা ঠিক নয়! এ সমস্যার নাম হলো ভিআইপি সমস্যা।

অতিরিক্ত জনসংখ্যা ঢাকায় নানা কৃত্রিম সমস্যার সৃষ্টি করছে, যার মধ্যে অন্যতম যানজট। প্রথম আলো ফাইল ছবি
অতিরিক্ত জনসংখ্যা ঢাকায় নানা কৃত্রিম সমস্যার সৃষ্টি করছে, যার মধ্যে অন্যতম যানজট। প্রথম আলো ফাইল ছবি

যাক, আবার বাস চলতে শুরু করল। আসাদগেট পেরিয়ে সইজেই খেজুরবাগান মোড় পৌঁছানোর আগেই আবার জ্যাম। পেছনে তাকিয়ে দেখছি সারি সারি গাড়ি আসছে। ভাবছি, এবার কেন এত জ্যাম লাগল? দেখলাম, এক প্রাইভেট কারের সঙ্গে আরেক প্রাইভেট কার হালকা লেগেছে আর সেটা নিয়ে রাস্তায় শুরু হয়ে গেছে দেনদরবার। এখানে অবশ্য পুলিশ বারবার চেষ্টা করছিল দুই পক্ষকে পাশে নিয়ে যাওয়ার জন্য যেন জ্যাম লেগে না যায়। কিন্তু উভয় পক্ষ বিচার চাইছে মাঝ রাস্তায় হাজারো মানুষের সময় নষ্ট করে। এ দেশে যে সবাই রাজা এত রাজাকে প্রজা পুলিশ কীভাবে সামাল দেবে! যাক, অবশেষে দুটি গাড়ি চলতে শুরু করল, সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গে ফ্রি হলো রাস্তা।

এক মিনিট গাড়ি চলে আবার থমকে দাঁড়াল। এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীভর্তি একটি বাসকে শিক্ষার্থীরা তাড়াতাড়ি বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছার জন্য রং সাইডে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। শিক্ষার্থীদের কারণে এবং সোজা হয়ে থাকা বাস বাঁকা হয়ে রাস্তা দখল করায় আবার লেগে গেল জ্যাম! এবার পৌঁছে গেলাম খামারবাড়ি মোড়। এখানেও জ্যাম, তবে এখানে মেট্রোরেলের কাজ চলার কারণে রাস্তা সরু হয়ে যাওয়ায় অল্প অল্প করে গাড়ি যাচ্ছে। আমি যে বাসে বসে ছিলাম, সেই দোতলা বাস আগে যাওয়ার চেষ্টায় নিজ লেনে না থেকে পাশের লেনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অথচ পাশের লেনের রাস্তা ফাঁকা সত্ত্বেও পেছনে লেগে গেছে বিশাল জ্যাম। দোতলা থেকে নেমে নিচে বাসচালককে বললাম, ‘আপনি উল্টো লেনে এলেন কেন? আপনার কারণে এই লেনের গাড়িগুলো যেতে পারছে না? সোজা উত্তর, সবই উল্টো, আপনি আবার কোনো সিদা মানুষ আইছেন!’

আসলেই সব উল্টো। কল্যাণপুর থেকে খামারবাড়ি পর্যন্ত জ্যামের এবং কোটি মানুষের সময় নষ্টের যত কারণ চোখে পড়ল সবই অযথা। একমাত্র মেট্রোরেলের কারণে রাস্তা সংকীর্ণ হয়ে যাওয়ার কারণ ছাড়া সব অহেতুক কারণে কল্যাণপুর থেকে ফার্মগেট পৌঁছাতে ১ ঘণ্টা ৩০ মিনিট সময় লেগে গেল। কল্যাণপুর থেকে ফার্মগেট কি ১ ঘণ্টা ৩০ মিনিটের রাস্তা?

এ ছাড়া অল্প বৃষ্টিতে জ্যাম লেগে যায়, সঙ্গে আছে অন্যান্য কারণও। ট্রাফিক জ্যামের কারণে নষ্ট হচ্ছে কত সময়, ক্ষতি হচ্ছে মানুষের কাজের এবং শরীরের। অযৌক্তিক কারণেই প্রতিদিন ‘ব্যস্ত সময়ে থমকে যায় নগরী’!

* আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ যুবায়ের, কল্যাণপুর, ঢাকা