যে খুঁড়ে সেই কুয়ায় পড়ে

ফারাক্কা বাধ। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি
ফারাক্কা বাধ। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি

অন্যের জন্য কুয়া খুঁড়লে একদিন নিজেদেরই সেই কুয়ায় পড়তে হয়! বলা হয়, এটাই নাকি প্রকৃতির নির্মম প্রতিশোধ!

বাংলাদেশের জন্য ফারাক্কা বাঁধের অভিশাপ বহু পুরোনো। ফারাক্কার কারণে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ পানির হিস্যা থেকে বঞ্চিত হয়। ঘটনা এখানেই শেষ নয়, পানিপ্রবাহ না থাকায় উত্তরবঙ্গের বিরাট এলাকা মরুকরণের দিকে যাচ্ছে। অনেক নদী মরে যাচ্ছে এবং সেচের জন্য বিপুল ব্যয় হচ্ছে কৃষকের, মৎস্যজীবী অথবা পানির ওপর নির্ভরশীল লাখো মানুষ পেশা হারাচ্ছেন প্রতিদিন।

১৯৬২ সালেই পশ্চিমবঙ্গের সেচ ও জলপথ বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কপিল ভট্টাচার্য ফারাক্কার তিনটি অভিশাপের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। ১৯৬১ সালে তিনি লিখেছিলেন, ‘ফারাক্কা ব্যারাজের বিরুদ্ধে আমার হুঁশিয়ারি না মানার পরিণতিতে জনগণ দুর্ভোগের শিকার হবে।’ তিনি আরও বলেছিলেন, এই বাঁধ নদীর পলি-ভরাট হওয়া আরও বাড়াবে, ভাটির দেশ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পানিপ্রবাহ কমাবে এবং পশ্চিমবঙ্গের মালদা, মুর্শিদাবাদ আর বিহারের বেশ কটি জেলায় বন্যার প্রকোপ বাড়াবে। নদীর তাজা পানিকে সরাসরি সমুদ্রে পড়তে না দিলে তা ভারতের মৌসুমি বায়ুপ্রবাহেরও ক্ষতি করবে। তাতে করে আরও বেশিসংখ্যক মানুষ পানির কষ্টে ভুগবে। তাঁর তিন হুঁশিয়ারিই যে ফলে গেছে, তা আজ সর্বজনবিদিত। সে সময় ফারাক্কার বিরোধিতার জন্য ভারতীয় গণমাধ্যম তাঁকে পাকিস্তানের চর বলেছিল এবং পরিণামে সরকারি চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন এই নদীবিশেষজ্ঞ। আমৃত্যু তিনি তাঁর মতে অটল থেকেছেন এবং নিজের ভবিষ্যদ্বাণী নিজেই ঘটে যেতে দেখেছেন।

এখন ভারত সেই ফারাক্কার ‘কুয়ায়’ পড়েছে। বর্তমানে প্রবল বৃষ্টি থেকে সৃষ্ট বন্যায় প্লাবিত হয়েছে ভারতের বিহার, উত্তর প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গসহ ব্যাপক অঞ্চল। চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সেখানে দুর্যোগের কারণে কয়েক শ মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। নিখোঁজের সংখ্যা শতাধিক। বন্যা পরিস্থিতি প্রকট আকার ধারণ করায় ফারাক্কা বাঁধ ভেঙে দেওয়ার দাবি তুলেছেন বিহার রাজ্য সরকারের পানিসম্পদমন্ত্রী সঞ্জয় কুমার ঝা। চলতি বর্ষা মৌসুমে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ভারতে ২৫ বছরের মধ্যে সর্বাধিক বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। যার প্রভাবে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে মানুষের জীবন, আশ্রয়কেন্দ্র, পশুসম্পদ, ফসল এবং অবকাঠামো। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের মূল্যায়নে জানানো হয়েছে, প্রায় ২২ লাখ মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোতে মোট ৮ হাজার ৭০০টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।

ফারাক্কা বাঁধ। প্রথম আলো ফাইল ছবি
ফারাক্কা বাঁধ। প্রথম আলো ফাইল ছবি

এই পরিস্থিতিতে সম্প্রতি ভারত সরকার হঠাৎ করেই ফারাক্কা বাঁধের ১১৯টি স্লুইচগেট খুলে দিয়েছে। এতে মুর্শিদাবাদের একাংশ ও বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চলে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। ভেড়ামারা, দৌলতপুরসহ পদ্মা নদীবেষ্টিত অঞ্চল ইতিমধ্যে প্লাবিত হয়েছে। ভারত সরকারের হঠকারী এমন সিদ্ধান্তে প্রমত্তা পদ্মা নদীর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে অস্বাভাবিকভাবে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কথাও ঠিক যে ফারাক্কা বাঁধ নির্মিত না হলেও বর্ষার ভরা মৌসুমের এই পানি বাংলাদেশেই আসত। কিন্তু এটি তখন হতো প্রাকৃতিকভাবে। বর্ষা মৌসুমে বাংলাদেশে পদ্মা ও এর শাখানদীগুলোর গতিপথ, স্রোত ও গভীরতা তখন প্রাকৃতিকভাবেই নির্ধারিত হতো। প্রকৃতিকে নিজের মতো চলতে দিলে বন্যায় ক্ষতির চেয়ে লাভই বেশি হতো বাংলাদেশের।

বহু বছর ধরে শুকনো মৌসুমে গঙ্গা থেকে কম বা খুবই কম পানি পেয়ে বাংলাদেশের নদীকেন্দ্রিক ভূপ্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতিটা ফারাক্কা বাঁধ না থাকলে হতো না। শুকনো মৌসুমে এই বাঁধ দিয়ে পানি আটকে দেয় ভারত। বর্ষা মৌসুমে বাঁধের সব স্লুইচগেট খুলে পানি ছেড়ে দেয়। শুকনো মৌসুমে ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে যেভাবে পানি আটকে রাখা হয়, তা বর্ষা মৌসুমেও করা হলে বাংলাদেশে এতটা বন্যা হতো না।

কলকাতা বন্দরের নাব্যতা বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করা হয়। ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ৪১ দিনের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা বাঁধের সব ফিডার ক্যানেল চালুর কথা বলে ভারত। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ওই ৪১ দিনের পরিবর্তে ৪১ বছর পরও বাঁধটি চালু আছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, কলকাতা বন্দরের নাব্যতা বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে ফারাক্কা বাঁধ চালুর পর থেকেই বাংলাদেশ ক্রমাগতভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। ফারাক্কার মাধ্যমে শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানি প্রত্যাহার করে নিলে বাংলাদেশ পানিসংকটে পড়ে। আবার বর্ষা মৌসুমে বিহার ও মধ্যপ্রদেশকে বন্যার কবল থেকে রক্ষার অজুহাতে ফারাক্কা বাঁধের গেটগুলো খুলে দিলে বাংলাদেশের মানুষ বন্যায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাজনৈতিক কারণে কোনো অঞ্চলকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা গেলেও প্রকৃতিকে ভাগ করা যায় না। প্রকৃতিতে হস্তক্ষেপ করতে গেলে তার মন্দ ফল মানুষকে ভোগ করতে হয়। ভারতের জন্য এ কথা আজ শতভাগ প্রমাণিত, প্রকৃতির সঙ্গে কূটনীতি ও চাতুরির সুযোগ নেই।

বর্তমানে পৃথিবীর অধিকাংশ অঞ্চলে নদীকে ‘যৌথ সম্পদের’ মতো বিবেচনা করে অববাহিকার সব রাষ্ট্র মিলে সমন্বিতভাবে এর উন্নয়ন, ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনা করে থাকে। উদ্দেশ্যে থাকে যেকোনো দেশকে বড় ক্ষতি থেকে রক্ষা করা, নদীর পানির টেকসই ব্যবহার করা এবং নদীটির ও এর প্রতিবেশের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য বজায় রাখা। কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশ চিন্তা করছে, এই ক্ষতি এড়াতে নিজেরাই একটি গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণ করবে কি না। এর ফিজিবিলিটি স্টাডিও সম্পন্ন হয়েছে বছর পাঁচেক আগে। এর কাজ কত দূর তা অজানা।

*মোহাম্মদ আবু নোমান, কদমতলী, ঢাকা