নারিকেল জিঞ্জিরার টানে একঝাঁক মৎস্যপ্রেমিক

প্রবালদ্বীপে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন সায়েন্স বিভাগের শিক্ষার্থীরা। ছবি: সংগৃহীত
প্রবালদ্বীপে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন সায়েন্স বিভাগের শিক্ষার্থীরা। ছবি: সংগৃহীত

মাথার ওপরে নীল আকাশ আর চারদিকে স্বচ্ছ জলের নীল সাগর। নীল জলের সীমানা ধরে বালুময় সৈকত, প্রবালের প্রাচীর, কেয়াগাছের বেষ্টনী আর সারি সারি নারকেলগাছ, দূর থেকেই যা মন্ত্রমুগ্ধ করে আগত অতিথিদের। উত্তাল সাগরের লোনাজল যখন আছড়ে পড়ে কেয়াগাছের ফাঁকে, ঝিরিঝিরি বাতাসে তৈরি হয় সফেদ ফেনা, সে এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। প্রকৃতি যেন তার অপরূপ সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়েছে আপন মনে। বলছিলাম দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিনের কথা।

সময়টা ২৪ ফেব্রুয়ারি রাত নয়টা। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন সায়েন্স বিভাগের ১৩তম ব্যাচের ফিল্ড ট্যুরের গল্প।

কেউ এসেছিলেন হল থেকে, কেউ এসেছিল শহরের মেস থেকে। জড়ো হতে থাকেন ক্যাম্পাসের গোল চত্বরে। আনন্দ, হাসি, আড্ডা আর একবুক আশা নিয়ে টেকনাফের উদ্দেশে ছেড়ে গেল বাস। কিছু দূর যাওয়ার পর পথিমধ্যে হঠাৎ বাস থেমে যায়। দীর্ঘ সময় পেরোলেও বাস আগের জায়গায় থেমেই আছে। কী হলো! কী হলো! বলে সবার মুখে শব্দ শোনা যাচ্ছে। চালক বলে উঠলেন, বাসের একটি চাকা নষ্ট হয়ে গেছে! এদিকে সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে জাহাজ ছেড়ে যাবে। দুই ঘণ্টা পর বাস ঠিক হলে আবার শুরু হয় যাত্রা। আল্লাহর কী লীলাখেলা, জাহাজ ছাড়ার ঠিক ৫ মিনিট আগে সবাই জাহাজে উঠলাম।

সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশে জাহাজভ্রমণ শুরু। শুভ্র রঙের পাখিগুলো জাহাজের চারপাশ ঘিরেই চলছে ভ্রমণকারীর পথপ্রদর্শকের মতো। দূর থেকে কেউ পাখির দিকে চিপস ছুড়ে দিচ্ছে। যত দূর যায় দুচোখ, তাতে লেগে থাকে সবুজ পাহাড়, কোলজোড়া শুভ্র মেঘ, বালুকারাশি, সবুজ ঝাউবন, ফেনিল প্রমত্তা জলরাশি। কোলজুড়ে বর্ষার যৌবনবতী নাফ, ওপাড়ে মিয়ানমারের পাহাড়, এপারের তীরজুড়ে ছোট ম্যানগ্রোভ বন, আরেক পাশে আমাদের তারুণ্যদীপ্ত সবুজ পাহাড়, শেষ মাথায় টেকনাফ সৈকত।

সামুদ্রিক প্লাঙ্কটন বেনথোস সংগ্রহ
দুপুরের খাবার খেয়ে সামান্য বিশ্রাম নিয়ে কিছু সময়ের জন্য সমুদ্রসৈকতে ল্যাবের কাজ করতে চলে যায় সবাই। যেহেতু সকলে সমুদ্রবিজ্ঞান কোর্সের ল্যাবের অংশ হিসেবে ফিল্ড ট্যুরে আসছে, সেই হিসাবে কিছু সামুদ্রিক প্লাঙ্কটন বেনথোস সংগ্রহ করে। রাতের বেলায় হ‌ুমায়ূন আহমেদের সমুদ্র বিলাস ঘুরে বিচের পাড়ে বসে সমুদ্রের ঢেউয়ের গর্জনে আর গানের আসরে জমে উঠে বেশ আড্ডা।

সেন্ট মার্টিনে সমুদ্রের ঢেউয়ের গর্জনে আর গানের আসরে জমে উঠেছিল নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন সায়েন্স বিভাগের শিক্ষার্থীদের আড্ডা। ছবি: সংগৃহীত
সেন্ট মার্টিনে সমুদ্রের ঢেউয়ের গর্জনে আর গানের আসরে জমে উঠেছিল নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন সায়েন্স বিভাগের শিক্ষার্থীদের আড্ডা। ছবি: সংগৃহীত


দ্বিতীয় দিন
পরদিন সকালে ছেঁড়াদ্বীপের উদ্দেশ্যে ট্রলারযাত্রা শুরু হয়। সর্বত্র ছোট-বড় পাথর আর কেয়াগাছ। চারপাশ জুড়ে শুধু নীল পানির ঢেউ। সাগরে মাঝখানে ছোট্ট এক পাথুরে দ্বীপ। নাম তার ছেঁড়াদ্বীপ। গানের সুরে আর ইঞ্জিনের বিকট শব্দে পানির ঢেউয়ের তালে এগিয়ে চলছে ট্রলার। আশপাশে প্রচুর প্রবাল, পাথর, স্বচ্ছ পানিতে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি স্নিগ্ধ সাগরে। ছেঁড়াদ্বীপের ঘোরাঘুরি শেষে বিকেলে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে ফেরা। সন্ধ্যা ফেরিয়ে রাত ঘনিয়ে এলে শুরু হয় বারবিকিউ পার্টিতে সকলের আড্ডায় আনন্দ–উল্লাস একটু বেড়েই যায়। বারবিকিউ শেষ না হতেই আবারও জমে ওঠে গানের আসর। পুরো গানের সমসুরে স্মৃতির পাতাগুলো বাড়তেই থাকে।

আকাশের নীল আর সমুদ্রের নীল সেখানে মিলেমিশে একাকার, তীরে বাঁধা নৌকা, নান্দনিক নারকেলগাছের সারি আর ঢেউয়ের ছন্দে মৃদু হাওয়ার কোমল স্পর্শ—এটি বাংলাদেশের প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিনের সৌন্দর্য বর্ণনার ক্ষুদ্র প্রয়াস। বালু, পাথর, প্রবাল কিংবা জীববৈচিত্র্যের সমন্বয়ে জ্ঞান আর ভ্রমণপিপাসু মানুষের জন্য অনুপম অবকাশকেন্দ্র সেন্ট মার্টিন। স্বচ্ছ পানিতে জেলি ফিশ, হরেক রকমের সামুদ্রিক মাছ, কচ্ছপ, প্রবাল বিশ্বরহস্যের জীবন্ত পাঠশালায় পরিণত করেছে সেন্ট মার্টিন ও তৎসংলগ্ন এলাকাকে।

সৈকতের শামুক-ঝিনুক, স্বচ্ছ পানির নিচে রকমারি শৈবাল আর সাগর তীরের ঝাউগাছ মিলে সেন্ট মার্টিন যেন এক স্বর্গপুরী। ছবি: সংগৃহীত
সৈকতের শামুক-ঝিনুক, স্বচ্ছ পানির নিচে রকমারি শৈবাল আর সাগর তীরের ঝাউগাছ মিলে সেন্ট মার্টিন যেন এক স্বর্গপুরী। ছবি: সংগৃহীত


ভ্রমণের তৃতীয় দিন
ভ্রমণের তৃতীয় দিন সকালবেলা শুরু হয় সাইক্লিংয়ের পালা। দীর্ঘ আড়াই ঘণ্টা সাইক্লিং করে নারিকেল জিঞ্জিরা এপাশ থেকে ওপাশে ঘুরে এসে সকালের নাশতা শেষ করে সৈকতে ছেলেদের ফুটবল খেলার আনন্দ জমে উঠলেও মেয়েরা শাড়ি পড়ে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় ফটো তুলে সময় পার করে দেন।

প্রকৃতি নিজের মতো করে সেন্ট মার্টিনকে রাঙিয়ে তুলেছে ভিন্ন ভিন্ন রঙের বাহারি সংমিশ্রণে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর বাংলাদেশের মধ্যে সেন্ট মার্টিন উজ্জ্বল এক সৌন্দর্যভান্ডার। সমুদ্রের উঁচু-নিচু জলতরঙ্গের বুকে সবুজের চিরায়ত সমারোহ গায়ে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেন্ট মার্টিন দ্বীপটি। নীল জলরাশিবেষ্টিত একখণ্ড সবুজ ভূখণ্ড মুহূর্তেই মনে করিয়ে দেয় অপার সৌন্দর্যময়ী বাংলাদেশের কথা। সৈকতের শামুক-ঝিনুক, স্বচ্ছ পানির নিচে রকমারি শৈবাল আর সাগরতীরের ঝাউগাছ মিলে সেন্টমার্টিন যেন এক স্বর্গপুরী।

২৭ ফেব্রুয়ারি রাতের বেলা সেন্ট মার্টিনকে বিদায় জানিয়ে কেনাকাটা করতে আমরা চলে আসি কক্সবাজারে। রাতের খাবার খেয়ে রওনা হই নোয়াখালীর উদ্দেশে। আর তিন দিনে জমানো কিছু স্মৃতিকে বিদায় জানিয়ে ফেরা প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায়।

লেখক: শিক্ষার্থী, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।