করোনা মোকাবিলায় সমাজকর্মী ও উন্নয়নকর্মীদেরও এগিয়ে আসতে হবে

দিন যতই গড়াচ্ছে, করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা এবং মানুষের মধ্যে আতঙ্কও তত বাড়ছে। করোনাভাইরাস নির্ণয়, প্রতিরোধ ও প্রতিকারের চিন্তাও একই সঙ্গে করতে হচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, সংক্রামক এই ভাইরাস সমগোত্রীয় অন্যান্য ভাইরাসের তুলনায় অনেক বেশি ছোঁয়াচে এবং শক্তিশালী। তাদের মতে, যেহেতু এখন পর্যন্ত এই ভাইরাসের কোনো ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি, তাই প্রতিরোধই আপাতত একমাত্র সমাধান। যেহেতু ‘সামাজিক দূরত্ব’ বজায় রাখাই প্রাথমিক কর্তব্য। তাই করোনাভাইরাসের ভয়ে সবাই ঘরবন্দী হয়ে দিন কাটাচ্ছেন।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ডাক্তার-নার্স ছাড়া আর কারও কোনো দায়িত্ব বা কর্তব্য পালনের দরকার বা সুযোগ নেই। তবে একজন সমাজকর্মী কিংবা উন্নয়নকর্মী তাঁর পেশাগত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে করোনাভাইরাসের মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারেন। এই লেখায় আমরা আলোচনা করব একজন সমাজকর্মী কিংবা উন্নয়নকর্মী কীভাবে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে পারেন।

১. করোনা মোকাবিলায় সামাজিক ম্যাপিং জরুরি
সামাজিক ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে একজন সমাজকর্মী বা উন্নয়নকর্মী করোনাভাইরাসের ঝুঁকিতে থাকা এবং সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত বাসা, বাড়ি, প্রতিষ্ঠান, জনসমাগমের স্থান কিংবা এলাকাগুলো চিহ্নিত করতে পারেন এবং এর একটি তালিকা তৈরি করতে পারেন। একজন সমাজকর্মী বা উন্নয়নকর্মী কতটুকু এলাকায় কীভাবে সামাজিক ম্যাপিং করবেন? একজন সমাজকর্মী বা উন্নয়নকর্মী তাঁর পূর্বের কাজের গণ্ডি বা পরিধির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবেন এবং কেবল নিজের এলাকারই তালিকা করবেন। যেহেতু পুরো এলাকাই তাঁর পরিচিত, তাই অন্য যেকোনো পেশাজীবীর চাইতে তিনি অনেক ভালোভাবে এটি করতে পারবেন।

২. ঝুঁকিপূর্ণ, আক্রান্ত ব্যক্তি বা পরিবারের চাহিদা নির্ণয় করতে হবে
একজন পেশাদার সমাজকর্মী বা উন্নয়নকর্মী করোনাভাইরাসের বেশি ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তি ও পরিবারগুলো চিহ্নিত করবেন এবং তাঁদের কী ধরনের সহযোগিতা প্রয়োজন তা নির্ণয় করবেন। এখান থেকে ধারণা পাওয়া সম্ভব যে কার কোনো ধরনের সহায়তা প্রয়োজন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি পরিবারে কতজন সদস্য, বয়স্ক কতজন, কারা বাইরে যাতায়াত করেন, জরুরি প্রয়োজনে বাইরে যাওয়ার জন্য লোক রয়েছে কি না, প্রয়োজনীয় খাবার ও সরঞ্জামাদি কেনার সামর্থ্য আছে কি না, আশপাশের বাড়িতে, পাড়ায় কিংবা ওয়ার্ডে আক্রান্ত ব্যক্তি আছে কি না, প্রভৃতি বিবেচনা করা।

একজন পেশাদার সমাজকর্মী অবশ্য পূর্বে প্রস্তুতকৃত একটি তালিকার মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তি বা পরিবারের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, আর্থিক ও পরিবেশগত দিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে তাঁদের চাহিদা নির্ণয় করবেন। তথ্য সংগ্রহের জন্য ব্যক্তি বা পরিবারের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। পূর্বপরিচিতি, ফোনে যোগাযোগ কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে তা করা যেতে পারে।

৩. যত দ্রুত সম্ভব প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করতে হবে
করোনাভাইরাসের বেশি ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তি ও পরিবারকে তথ্য ও সরঞ্জাম প্রদানের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করবেন। তথ্য সহযোগিতা হিসেবে করোনাভাইরাস কী, কীভাবে ছড়ায় এবং প্রতিরোধ ও প্রতিকারে কী করণীয়, তা অন্তর্ভুক্ত থাকবে। আর প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম হিসেবে সাবান, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক, গ্লাভস, গাউন প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।

এ ছাড়া উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তি বা পরিবারকে বাজার থেকে তাদের প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী ক্রয় করতে সহযোগিতা করাও সহযোগিতার আওতাভুক্ত। আবার একজন সমাজকর্মী তাঁর এলাকার সমস্যার স্বরূপ ও চাহিদা সম্পর্কে নীতিনির্ধারক মহলের সঙ্গে লিয়াজোঁ বা যোগাযোগ ও করোনাভাইরাস প্রতিরোধে তাঁদের পরামর্শ দিতে পারেন। আমাদের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে বিবেচনায় নিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, চেয়ারম্যান, মেম্বার ও ধর্মীয় নেতাদের মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারেন। মনে রাখতে হবে, ঝুঁকিপূর্ণ এবং আক্রান্ত ব্যক্তি বা পরিবারের প্রয়োজন অনুযায়ী সহযোগিতা করতে হবে।

করোনাভাইরাসের (COVID-19) ভয়াল থাবায় সারা পৃথিবী লন্ডভন্ড। বাংলাদেশে বর্তমানে কমিউনিটি পর্যায়ে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনার বিস্তার রোধে ‘সামাজিক দূরত্ব’ বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। সারা দেশের মানুষ এক অস্বস্তিকর পরিবেশে আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। একজন পেশাদার সমাজকর্মী হিসেবে জাতির ক্রান্তিকালে এগিয়ে আসার এখনই সময়। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে দারিদ্র্যপীড়িত, অবহেলিত, রোগাক্রান্ত, মানসিকভাবে অসুস্থ এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সহায়তার জন্যই সমাজকর্মের উদ্ভব। বর্তমান বিশ্বে মানবিক ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সমাজকর্মের জ্ঞান ও দক্ষতা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। বিশ্ব সমাজকর্ম দিবসের ২০২০ সালের প্রতিপাদ্য ছিল ‘মানব সম্পর্কের গুরুত্বকে প্রচার করা’। মানুষের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা এবং বৈশ্বিক নীতি ও সেবা প্রদান প্রক্রিয়ার পরিবর্তনে সবার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যই এ প্রতিপাদ্য বেছে নেওয়া হয়েছিল। তাই একজন সমাজকর্মী কিংবা উন্নয়নকর্মী হিসেবে সবার সহযোগিতায় নিজেকে নিয়োজিত করার এখনই সময়।

*লেখক: মোস্তাফিজুর রহমান খান, অ্যাডজাংক্ট ফ্যাকাল্টি ও পিএইচডি ফেলো, ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটি, ইউএসএ। E-mail: [email protected]
মাহমুদুল হাসান, ইউরোপিয়ান মাস্টার্স ইন সোশ্যাল ওয়ার্ক উইথ ফ্যামিলিস অ্যান্ড চিলড্রেন, ইরাসমাস মুন্ডুস স্কলার। E-mail: [email protected]