এক মনোজ্ঞ প্রীতিব্যবস্থা, এক সজল উদ্যাপন

চলছে আষাঢ়, এখন বর্ষাকাল। ছবি: হাসান রাজা
চলছে আষাঢ়, এখন বর্ষাকাল। ছবি: হাসান রাজা

প্রকৃতিতে যখন বসন্ত আসে, মানুষের দেহমনেও প্রভাব পড়ে তার। বনে যখন ফুল ফোটে, ফোটে তখন মনেও। বাইরে যখন বৃষ্টি ঝরে, ছাট এসে লাগে গায়ে। মনে জাগে ঐকতান—ধীর, দ্রুত কিংবা মধ্যলয়ে, ধারাপাতের গতি ও ঝংকারের সঙ্গে সংগতি রেখে। দূর অতীত থেকে স্মরণে উঠে আসে পড়শিবাড়ির টিনের চালের ওপর সহসা ঝেঁপে আসা বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ আর তার সঙ্গে মেশানো সে বাড়ির মেয়েটির নামতাপাঠের সুর। বৃষ্টির ধারাবিবরণী আর মেয়েটির ধারাপাতপাঠ—উভয়ের মধ্যে ঘটে নিবিড় সুরসম্প্রীতি। পাশে তখন রেডিওতে হেমন্তের কণ্ঠে বর্ষার গান, ঠাকুরের সেই স্নিগ্ধ–নিবিড় বর্ষাসংগীত, ‘এমনও দিনে তারে বলা যায়...’। তখন ‘জগতে যেন কেহ নাহি আর’। তখন ‘যে কথা এ জীবনে রহিয়া গেল মনে, সে কথা আজি যেন বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়’। তখন বৃষ্টিতে ঝাপসা হতে হতে একসময় একেবারে মুছে যায় সমস্ত জগৎ। তখন শুধু ক্রিয়াপদে, শুধু ক্রিয়াকৌশলে নিষ্পন্ন হতে থাকে একেকটি বাক্য।

সেই প্রিয় পড়শিরা হায়, একদিন ওই টিনের চাল, জানালা, উঠান, রক্তজবা, তুলসীতলা—সবকিছু রিক্ত ও শূন্য করে দিয়ে চলে যায় সে কোথায় কোন দূরদেশে! সেই সঙ্গে একটু একটু করে হারিয়ে যায় আমারও শৈশব। পড়শিবাড়ির মেয়েটি অজান্তে নিয়ে চলে গেছে আমার সেই শৈশববৃষ্টির সৌগন্ধ, ব্যঞ্জনা ও অনুপ্রাস।

বিকেলে বৃষ্টি ঝরছে একটানা, অঝোর ধারায়। জানালার বাইরে মাঠ। মাঠের প্রান্তে সারি সারি তালগাছ। তাদের মাথার ওপর তালপাতার তৈরি ছাতা। গাছেরা দাঁড়িয়ে আছে প্রতীক্ষায়, কখন ছাতিয়ানতলির বিল থেকে, কচুরিপানার তলা থেকে, ধানখেত পেরিয়ে উঠে আসবে উল্লসিত সব কই মাছ, দু-চারটা মাগুর মাছও, অল্প জল জমা মাঠের উচ্ছল সবুজ ঘাসের মধ্য দিয়ে কানকো টেনে টেনে চলে আসবে গাছেদের দিকে। তারপর তালগাছের গা বেয়ে দু-একটা কই মাছ যেন উঠতে চাইবে আকাশের দিকে, যেখান থেকে ঝরে এমন ব্যাকুল করা মধুরসিক বৃষ্টি। কইবাহিনীর সে এক অপরূপ শোভাযাত্রা, এক অবাধ প্রীতিদৌড়ের প্রতিযোগ। প্রকৃতির এক মনোজ্ঞ প্রীতিব্যবস্থা।

পড়শিবাড়ির মেয়েটি সঙ্গে করে নিয়ে চলে গেছে আমার সেই শৈশববৃষ্টির সৌগন্ধ, ব্যঞ্জনা ও অনুপ্রাস।

এবং টিপটিপ বৃষ্টির সন্ধ্যা। সে এক আধো বাস্তব আধো অবাস্তব সময়কাল। চারপাশ যেন হয়ে ওঠে ঝাপসা আলো-আঁধারশাসিত সান্ধ্য রূপকথার দেশ। নতুন পানিতে ভরে ওঠা ডোবায় মত্ত দাদুর-দাদুরির বিরতিহীন মকমকি, কোটরনিবাসী প্যাঁচার ঘন ঘন ঘুৎকার, বাঁশঝাড়ে আধো ভেজা শেয়ালসম্প্রদায়ের হাঁকডাক, দূরে নৈশ স্টিমারের ভৌতিক ভেঁপু, মধ্যনদীতে পোঁতা বাঁশের আড়কাঠিতে রামতা মাঝির ঝোলানো জলপথ-নির্দেশক লণ্ঠন আর সেই লণ্ঠন-আলেয়ার মিটিমিটি হাতছানি...। এমনই এক টিপটিপ বৃষ্টি–উপদ্রুত অন্ধকার সন্ধ্যায় একা হাট থেকে ফিরছিলেন পিতামহ, জোড়া ইলিশ নিয়ে। পথিমধ্যে টের পান, ব্যাগ থেকে বের হয়ে থাকা লেজ ধরে কে যেন টান দিচ্ছে থেকে থেকে। এক সুরসিক ভূতাত্মা। শুধু টান দিয়েই ক্ষান্ত নয় ভূত। কিছুক্ষণ পরপর আবদারও জানাচ্ছে নাকি সুরে, ‘দিঁয়া যাঁ এঁকটা ইঁলিশ।’
ইলিশের প্রতি ভূতের লিপ্সা নিঃশর্ত ও অনিঃশেষ এবং বংশপরম্পরাগত। দাদুও নাছোড়। একপর্যায়ে হঠাৎ এক কালো, ভেজা বেড়ালের রূপ ধরে হাঁটতে থাকে ভূত, দাদুর আগে আগে। অদৃশ্য হয়ে যায় আবার। আবার বেড়াল। আবার অদৃশ্য। ভূতের এ রকম পরাবাস্তব আচরণে বিরক্ত হয়ে পিতামহ খপ করে ধরে ফেলেন ভূতের বিগ্রহটাকে। তারপর ছাতার ভেতর ভূতটাকে ঢুকিয়ে বগলতলায় ফেলে চাপতে চাপতে বাড়ি ফেরেন। ছাতাটা বাহিরবাড়ির বৈঠকখানার বেড়ার সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখে কলপাড়ে হাতমুখ ধুয়ে ঘরে ঢোকেন দাদু। বাড়ির ও পড়শিবাড়ির লোকজনের মধ্যে সারা রাত সে কী কৌতূহল আর চাঞ্চল্য! পরদিন ভোরবেলা উঠে সবার সামনে ছাতাটা ঝাড়লেন দাদু। ঝরে পড়ল মরা কালো এক দাঁড়কাক—অদৃশ্য ভূতের এক দৃশ্যমান, মিশিকৃষ্ণ রূপান্তর; এক ভিন্নতর ভূতবিগ্রহ।
মাধাইনগর হাইস্কুল। বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’ পর্ব চলছে। এমন সময় ঝমঝম করে বৃষ্টি। সবাই দৌড়ে গিয়ে উঠেছে লম্বা স্কুলবারান্দায়। ঠিক সে সময়ে এক তরুণ, খালি গা, এলোমেলো রুক্ষ চুল, পরনে জেলেদের মতো লুঙ্গি মালকোচা দেওয়া, হাত পা মুখ মাথায় ঘন কালিঝুলি মাখানো, মাছ ধরা জালে জড়ানো সারা শরীর। বৃষ্টির মধ্যে স্কুলের বারান্দার সামনে দিয়ে বাঁশি বাজাতে বাজাতে চলে যাচ্ছে কৃশকায় হারাবতী নদীর দিকে। বাঁশিতে কেমন অদ্ভুত এক সুর! সেই সুরে আবার এসে মিশছে মধুর বৃষ্টিনিনাদ। আর বৃষ্টিজলে দেহ থেকে কালিঝুলি ধুয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে।
রাস্তার ওপারে পাকুড়গাছ। ওই দিক থেকে এসেছে মানুষটা। সে কি এই স্কুলের ছাত্র, যেমন খুশি তেমন সাজোর একজন প্রতিযোগী, নাকি জেলেপাড়ার এক উদাসীন সুরপাগল তরুণ জেলে, গায়ে গাবের রসে ভেজানো জাল মুড়ি দিয়ে বৃষ্টির ভেতর শর্টকাট পথ ধরে চলে যাচ্ছে হারাবতীর দিকে—জানে না তা কেউই, কেউই চিনতে পারেনি তাকে।
বৃষ্টি থেমে গেছে সেই কখন। শেষ হয়ে গেছে প্রতিযোগিতার সব পর্ব। দিন শেষে পুরস্কার বিতরণ। যেমন খুশি তেমন সাজোতে ওই জালমোড়ানো বাঁশরিয়াই বিবেচিত হয়েছে শ্রেষ্ঠ পুরস্কারের জন্য। কিন্তু তার তো আর দেখা নেই। কে সে—কোন ক্লাসের ছাত্র, কী নাম, হঠাৎ উদয়ই-বা হয়েছিল কোত্থেকে বৃষ্টির ভেতর—জানে না কেউই। বৃষ্টির এ-ও এক রহস্য উসকানো কৃতি।

মানুষ, প্রকৃতি এবং এই যে জড় ও জীবজগৎ—কোন রূপে, কোন বিন্যাসে বিন্যস্ত হয়ে আছে এরা, কীভাবে নিষ্পন্ন হচ্ছে এদের নিরবচ্ছিন্ন আন্তযোগাযোগ, কোন ভাষ্যে লেখা হয়ে চলেছে আকাশ-মাটির মধ্যকার প্রেমের উপাখ্যান, কী উপায়ে ক্রমাগত চরিতার্থ হয়ে চলেছে বিশ্বের বিচিত্র অভিপ্রায়, আর কোন প্রক্রিয়ায়ই-বা মীমাংসিত হয়ে চলেছে জগতের নানা অসংগতি—মাঝেমধ্যে সেসব উন্মোচন করে দেখাতে চায় প্রকৃতি। বর্ষা যেন তারই এক সক্রিয় সজীব মহড়া, এক সজল উদ্‌যাপন।