
স্মৃতিময় মুক্তিযুদ্ধ ও আমার সামরিক জীবন শিরোনামের বইটি মাত্র তিন অধ্যায়ে বিভক্ত। প্রথম অধ্যায়ে লেখক এইচ এম গাফ্ফার তুলে ধরেছেন তাঁর শৈশব ও কৈশোরকাল এবং শিক্ষাজীবন শেষে তাঁর সামরিক বাহিনীতে যোগদানের কথা। কঠোর প্রশিক্ষণ শেষে তিনি যোগ দিচ্ছেন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল বা ‘বেবি টাইগার’ ব্যাটালিয়নে দ্বিতীয় লেফটেন্যান্ট পদে। এ-সম্পর্কে তাঁর গর্বমেশা মন্তব্য, ‘সেকালে কোনো বাঙালি সেনা অফিসারের জন্য ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কমিশন পাওয়াটা ছিল পরম আরাধ্য স্বপ্ন।...তাই স্বাভাবিকভাবে বহু বাঙালি অফিসারকেই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অন্যান্য রেজিমেন্টে কমিশন নিতে হতো। যা-ই হোক, চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলে “পোস্টিং অর্ডার” হাতে পাওয়ার সেই আনন্দঘন মুহূর্তে ভাবিনি যে এই ব্যাটালিয়নটির সঙ্গে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই আমাকে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে জাতির জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সেই অর্থে আমি সত্যি ভাগ্যবান।’
আসলে এ বইয়ের সারকথা শুরু হচ্ছে ‘দ্রোহের কাল’ শিরোনামের দ্বিতীয় অধ্যায় থেকে। অবাক লাগে, সামরিক বাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও তাঁর বোধের গোচরের বাইরে নেই বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের পূর্বাপর ইতিহাস-ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৭০-এর প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও তাতে নিহত-আহত লাখ লাখ উপকূলীয় মানুষের প্রতি পাকিস্তানের শাসকবর্গের নির্বিকার আচরণ, তার প্রেক্ষাপটে তখনকার পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশের জনগণের হতাশা ও ক্ষোভ, সেই ক্ষোভেরই চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ’৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ সেই দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিস্তানি শাসকবর্গের নানা টালবাহানার বিবরণও লেখককে আলোড়িত করছে। তারই প্রতিক্রিয়াজাত বিবরণ, ‘দেখতে দেখতে এল ঐতিহাসিক সাতই মার্চ।...আমরা বাঙালি অফিসার ও জওয়ানরাও গভীরভাবে বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ঘোষণার দিকে লক্ষ রাখছিলাম। কারণ আমরাও তত দিনে বুঝে গিয়েছিলাম যে পাকিস্তানের সঙ্গে সহাবস্থান আর সম্ভব হবে না। আমরা আরও বুঝতে পারছিলাম যে একটি মহাসংঘাত অবধারিত...।’ তারপরই তিনি বলছেন প্রস্তুতি নেওয়ার কথা।
>

স্মৃতিময় মুক্তিযুদ্ধ ও আমার সামরিক জীবন
এইচ এম আবদুল গাফ্ফার, বীর উত্তম
প্রচ্ছদ: অশোক কর্মকার * প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা
* প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ২১৬ পৃষ্ঠা * দাম: ৪০০ টাকা।
এর পরপরই অর্থাৎ পঁচিশে মার্চের পর থেকেই শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ। লেফটেন্যান্ট কর্নেল এইচ এম আবদুল গাফ্ফার সেই মহান যুদ্ধের একেবারে শুরু থেকেই কীভাবে অংশ নিলেন শত প্রতিকূলতা উজিয়ে এবং সামরিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা, সালদা নদী ও মন্দাবাগে যুদ্ধ পরিচালনা করে কীভাবে এলাকাগুলোকে মুক্ত করলেন, পাশাপাশি অন্যান্য এলাকায় পরিচালিত যুদ্ধেরও প্রায় চুলচেরা বিবরণ আছে এ বইয়ে। এবং তাঁর বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রধান সেনাপতি তাৎক্ষণিকভাবে তাঁকে বীর উত্তম খেতাব দেওয়ার সুপারিশ করেন। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে নানা সংকট ও সম্ভাবনার কথাও তিনি অকপটে তুলে ধরতে কসুর করেননি।
এ বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ এর শেষ অধ্যায়টি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড-পরবর্তী ঘটনাবলির প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে যে বিবরণ তিনি তুলে ধরেন, তা এত দিন অজানা অনেক সত্যকে তুলে ধরে। ১৯৭৫ সালের ৩ থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত সেনাবাহিনীতে সংঘটিত নানা আলোড়ক ঘটনার বিবরণও বাদ যায় না তাঁর কলম থেকে। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বঙ্গভবন থেকে বিতাড়নে যে ভূমিকা তিনি পালন করেছিলেন, এক কথায় তা সম্ভব হয়েছিল তাঁর নৈতিক সাহসের বলেই। বলতে দ্বিধা করেননি খালেদ মোশাররফের এ সময়কার দুর্বল ভূমিকার কথাও। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর সংবাদ শুনে জিয়াউর রহমানের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া কী ছিল, অকপটে তুলে ধরছেন তার বিবরণ। মূলত স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ সামরিক-বেসামরিক ক্ষেত্রে যেসব তীব্র সমস্যা মোকাবিলা করেছে এবং যেসব ক্ষেত্রে তাঁর ব্যক্তিগত ভূমিকা জড়িত ছিল, লে. কর্নেল গাফ্ফার তাঁর বইয়ের শেষ অধ্যায়ে তারও বিবরণ তুলে ধরেছেন খোলামেলাভাবে। তাঁর এসব বিবরণে রাখঢাকের বালাই নেই।
এইচ এম আবদুল গাফ্ফারের স্মৃতিময় মুক্তিযুদ্ধ ও আমার সামরিক জীবন বইটি এ কারণে বৈশিষ্ট্যের দাবিদার যে এর দালিলিক-সত্যতাকে অস্বীকার করার সহজ অবকাশ নেই। বইয়ের মুখবন্ধটি সুলিখিত।