
সারাটা দিন হাঁসফাঁস করা অস্বস্তিকর ভ্যাপসা গুমোট গরম ছিল। মধ্যরাতের দিকে শুরু হলো গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, সঙ্গে দমকা হাওয়া আর ঘন ঘন বিদ্যুচ্চমক, গতিক সুবিধার না, চারপাশের গন্ধ শুঁকেই আন্দাজ করতে পারল তার অভিজ্ঞ আত্মা, ভয়াবহ কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, খুব খারাপ ধরনের কিছু, নাক উঁচু করে আরেকবার বাতাসের গতিবিধি বুঝে নিয়ে ‘ঘোঁৎ’ শব্দ করে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। রাতের নিস্তব্ধতায় সেই দীর্ঘশ্বাসের শব্দ দুরন্ত বাতাস ভাসিয়ে নিয়ে গেল অনেকদূর পর্যন্ত। রাস্তায় এলোমেলো পদক্ষেপে ঘুরতে থাকা বেওয়ারিশ কুকুরগুলো সেই শব্দ শুনে চমকে উঠল, পান্থপথে কাঁঠালগাছের ঘন পাতার আড়ালে ঘুমিয়ে থাকা পাখিদের পলকা ঘুম সেই শব্দে ভেঙে গেল।
শুধু তার পায়ের কাছে প্লাস্টিকের নীল চাদর মুড়ি দিয়ে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে থাকা জয়নালের কানে সেই শব্দ পৌঁছুল না, অঘোরে ঘুমুচ্ছে সে। হালকা নাক ডাকছে। শ্বাস-প্রশ্বাসের ছন্দে ওঠানামা করছে বুক। অথচ, অন্যদিন এ রকম সময় ঘুমোনোর আগে কত যে আকাজের প্যাঁচাল পাড়ে জয়নাল, তার সীমা-পরিসীমা নেই।
‘জানোনি মামা, আমরার শম্ভুগঞ্জে বাঘ বলতে আছে দুই জাতের বাঘ, একটারে আমরা কই বাঘডাঁশ, আরেকটারে কই মাওছ্যা বাঘ। বাঘডাঁশ দেখতে অনেকটা বিলাইয়ের মতোই, তবে সাইজে বিলাইয়ের চেয়ে বড়, গলার নিচে আর লেজের মধ্যে বাঘের মতোই ডোরা কাটা দাগ আছে বাঘডাঁশের। রাইতের অন্ধকারে খোঁয়াড় থেইক্যা হাঁস, মুরগি চুরি করতে জুড়ি নাই ওইগুলির। কত দিন যে আমার মায়ের যত্ন কইরা পালা হাঁস মুরগি বাঘডাঁশ ধইরা নিয়া গেছে, তার ইয়ত্তা নাই।’
জয়নাল এমনভাবে বলত, যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে একটা তাজা বাঘডাঁশ গেরস্থের পালিত মুরগির ঘাড় দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে তর্ তর্ করে উঁচু গাছে উঠে যাচ্ছে।
‘কই বাঘ, আর কই বাঘডাঁশ! হুহ্! কিয়ের মধ্যে কী?’
শক্ত ঘাড়টা সামান্য নাড়িয়ে তাচ্ছিল্য প্রকাশ করত সে। বিরক্ত হতো জয়নালের এমন উদ্ভট তুলনা শুনে। কিন্তু জয়নালের আজাইরা প্যাঁচাল কি আর তাতে বন্ধ হয়? সে তার মতো বলেই যেত,
‘আরেক প্রকার বাঘ ছিল গ্রামদেশে, যার নাম মাওছ্যা বাঘ। এই বাঘগুলি থাকত নদীর পারে, যখন আমরার ব্রহ্মপুত্র নদী আসলেও জোয়ান বেডার মতো শক্তিশালী ছিল, তার কঠিন স্রোত যখন সবকিছু এক লগে ভাসায়া লৈয়া যাইত, সেই সময় সাঁতার দিতে ওস্তাদ মাওছ্যা বাঘরা নদীতে ঝাঁপ দিয়া মাছ ধরত, আর কচ্ কচায়া সেই কাঁচা মাছ খাইত। তবে এইসব মাওছ্যা বাঘের কুনো দিন মানুষ খাওয়ার রেকর্ড নাই। এরা মানুষের ঘরের হাঁস মুরগি খায়, নদীতে ভাসতে থাকা মাছ খায়, মাটির গর্তে লুকায়া থাকা ইন্দুর খায়, বাগে পাইলে নরম শরীরের খরগোশও খায়, হাতের কাছে ছোট পাখি টাখি পাইলে, তাও হয়তো খায়, কিন্তু না, মানুষ কখনো খায় না।’
রাগে চাপা হুংকার ছাড়ত সে।
‘কী যে বলিস না, বাঘডাঁশ আর মেছো বাঘের সঙ্গে কখনো রয়েল বেঙ্গল টাইগারের তুলনা চলে? হাঁদা দু পেয়ে কোথাকার, কোনো আক্কেল নাই তোর! আর জেনে রাখ, আমরা মাংস পছন্দ করি বটে, তবে মানুষের গায়ের নোনা মাংস না, হরিণের নয়তো শুয়োরের মাংস খাই আমরা...’
‘রাগ করলা নাকি মামা? হে হে হে আমার কাছে বাঘ আর বাঘডাঁশ সবই সমান...’
‘মূর্খ, বেয়াকুফ...’ রাগ আরও বাড়ত তার। সাথে সাথে বাড়ত জয়নালের দাঁত বের করা হে হে হাসিও। বলত, ‘যতই দেমাগ দেখাও মামা, তুমরা আসলে হইলা বিলাইয়ের বংশ...ম্যাও ম্যাও করা জাত, শইল্যে গতরে বিলাইয়ের চেয়ে বড়, এই তো?’
এর সঙ্গে কথা বলাই বৃথা ভেবে, রাগে আর কোনো উত্তর দিত না সে।
আজ হলো কী জয়নাল বেকুবটার? বৃষ্টির কয়েকটা ফোঁটা পড়ার পরই প্লাস্টিকের নীল চাদর গায়ে জড়িয়ে এমন ঘুম দিয়েছে...এদিকে, দমকা বাতাসের জোর বাড়ছে, খেপে গেছে প্রকৃতি, সবকিছু দুমড়েমুচড়ে একাকার করে দিতে চাইছে, বাতাসের ধাক্কা সইতে না পেরে একটা দুর্বল বিলবোর্ড কিছুক্ষণ চিকন গলায় কান্নাকাটি করে এখন আপসে মাটির ওপর হেলে পড়েছে, তবু বেকুবটার চেতন নাই, যেন মরণঘুমে, যেন কাল্ ঘুমে পেয়েছে তাকে। নিজের ভারী পা টেনে জয়নালের পাছায় কষে একটা লাথি বসাবে কি না ভাবে সে, আবার মায়াও লাগে ফাজিলটার ওপর, গাধাটা কম মার তো খায় না, প্রায়ই রাস্তায় টহল দেওয়া পুলিশের লাঠির গুঁতা খায়, রাস্তার পিচ্কা মাস্তানদের হুমকি-ধামকি খায়, বড়লোকদের চড়-থাপ্পর খায়। আর সেই সব মার খাওয়ার জ্বালা ভুলতেই হয়তো হে হে করে খামোকাই হাসে।
>মা ভীতসন্ত্রস্ত কণ্ঠে চিৎকার করতে থাকে, ‘পলা জয়নাল, তুই পলা, বাঘের হাতেই তোর মরণ লেখা আছে...বাঘ তোরে ছাড়ত না, খাইয়ালব...’
জয়নালকে কখনো কখনো তার নিজের মতোই শেকড় উপড়ানো এক নড়বড়ে অস্তিত্ব মনে হয়, যেন সে সর্বহারা এক উদ্বাস্তু, যাকে এই শহর টেনে এনেছে পেটের টানে, কাজের অজুহাতে। এই শহরে জয়নালের রাস্তা ছাড়া থাকার জায়গা নেই, দুটো ভালো-মন্দ কথা বলার কেউ নেই। একইভাবে এই শহর নিজের সৌন্দর্য বাড়ানোর নামে তাকে স্থাপন করেছে এই নিষ্প্রাণ ইট-পাথর আর ধু ধু ধুলার রাজত্বে, যেখানে আদৌ তার থাকার কথা নয়, তেমন বেখাপ্পা বেমানান একটা জায়গায়...একটা রঙিন তামাশার মতো, যেমন সে তেমনি ওই চালচুলোহীন জয়নাল—কদিন আগেও যে দিব্যি মাঠে-কাদায় এক মনে কাজ করত, ফসল তুলত নিজ হাতে, যার থাকার কথা ছিল সেই ধুলামাটির কাছাকাছি, তাকেও নিয়তি উপড়ে এনে ফেলে দিয়েছে পিচঢালা কালো রাস্তায় উন্মূল একাকী...
‘তে, বুঝছোনি মামা, আমার ছুডু বেলাত্ এক গণক আমার হাত দেখছিল। মায়েরে কইছিল, তোর পুত্ গাড়ি চালাইব। মায়ে তো খুব খুশি। বাপরে বাপ, গাড়ি? চাষার ব্যাটা তো তাইলে বিরাট উন্নতি করব। হে হে মামা, গাড়ি তো আমি ঠিকই চালাই, তবে তিন চাক্কার গাড়ি যার নাম ভ্যানগাড়ি। হে হে হে...
গণক মারে আরও কী কইছিল শুনবা? কইছিল, তোর পোলার হাতে একটা অদ্ভুত রেখা আছে রেজিয়া, অমঙ্গল রেখা, মনে হইতাছে, ওরে বাঘে খাইব।
কী, বাঘে খাইব? বাপে শুইন্যা হো হো কইরা হাসে। কয়, মিছা কথা। এই তল্লাটে বাঘ কই? বাঘডাঁশ আর মাওচ্ছা বাঘ কি আর মানুষ খায়? যত সব বুজরুকি! তবু মায়ের মন তো, অজানা ভয়ে তাঁর বুক কাঁপে। কথায় বলে, বনের বাঘে খায় না, মনের বাঘে খায়। মায়ের মনে সেই বাঘের ভয় চাপ দিয়া বসে। কিন্তু আমি তো এই জীবনে সত্যিকারের বাঘ দেখি নাই মামা, বাস্তবেও না, স্বপ্নেও না। ঘুরতে ঘুরতে এই আজব শহরে আইস্যা আঁতকা তুমারে পাইলাম, কিন্তু তুমিও তো দেখি আসল না...রড সিমেন্টের ওপর রং করা নকল বাঘ, নকল শরীর, নকল দাঁত...হে হে আমারে তাইলে কেমনে খাইবা? হে হে হে, খাইতে পারবা না...’
জয়নাল যা-ই বলুক, এই পান্থপথের ধূলিকণারা তো জানে, গভীর রাতে এই রড-সিমেন্টের ভেতরেই বাঘের মৃত প্রাণ রাজকীয় নিঃশব্দতায় জেগে ওঠে। তখন তার বহুদূরের সেই মহা অরণ্যের কথা মনে পড়ে। সেই ক্ষয়ে যাওয়া দুখিনী বনভূমি, সবুজের মায়া, মাটির ওপরে উঁকি দিয়ে থাকা গাছের শ্বাসমূল, যেখানে হাজার বছর ধরে বংশপরম্পরায় গর্বিত পা ফেলেছে তারা, নাকে এসে ঝাপটা দেয় কেওড়া আর সুন্দরী গাছের ঘ্রাণ। মনে পড়ে, গরান আর গেওয়ার ঘন ছায়া, নলখাগড়া আর গোলপাতার ঝোপ, জোয়ারের পানিতে ভেজা মাটির চাপা নোনতা গন্ধ, কানে বাজে চিত্রা হরিণ ও বন্য শূকরের ঝোপ-ঝাড় ভেঙে দ্রুত দৌড়ে যাওয়ার শব্দ, বেনে বৌ, হাঁড়িচাচা আর ফুলঝুড়ির অজস্র কিচিরমিচির, জলাশয়ের পানিতে সবুজ ব্যাঙের ঝাঁপ দিয়ে পড়ার মৃদু ধ্বনি, ঝরা পাতার ওপর সর্ সর্ করে বুক ঘেঁষে চলা ধূসর অজগরের নিঃশব্দ আনাগোনা, গাছের ডালে ঝুলতে থাকা চাক ঘিরে মৌমাছির ভোঁ-ও-ও গুঞ্জন, নদীর পানিতে নাক উঁচিয়ে ভেসে থাকা কুমির, কুমিরের কাঁটাঅলা পিঠ, শক্ত লেজ...।
দমকা বাতাসের তীব্রতা বাড়ছে। বাড়ছে তার দাপট। যেন উত্তাল নাচ নেচে যাচ্ছে মাতাল বাতাস, তার বিধ্বংসী দাপটে যেন সে আজ ধ্বংস করে দেবে সবকিছু, বুকের মধ্যে শূন্যতার হাহাকার জাগে তার...ভয় হয়...আদিম ভয়...।
জয়নাল কি টের পাচ্ছে না কিছুই? খুব কি ক্লান্ত সে আজ? সারা দিন ভ্যানে করে দালান বানানোর জন্য মানুষের ইট-সিমেন্ট টেনেছে, সেই পরিশ্রমে হাত-পা ভেঙে এসেছে তার, নিঃশেষ হয়ে গেছে শরীরের সমস্ত শক্তি, তাই প্রতিদিন রাতবিরেতে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের পায়ের কাছে শুয়ে যে রকম ইয়ার্কি ফাজলামি করত আজ স্বেচ্ছায় তাতে ক্ষান্ত দিয়েছে সে। পড়ে আছে হাত-পা ছেড়ে, মড়ার মতো নিঃসাড় হয়ে। আসলে ঘুমের মধ্যেই চোখ খুলে গেছে জয়নালের, সে স্বপ্ন দেখছে তার মাকে, মা যেন তালগাছের সমান লম্বা হয়ে গেছে, মায়ের কোলে একটা সাদা ধবধবে রাজহাঁস। ঘাড় উঁচু করে মাথার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা মাকে দেখল জয়নাল, আর মোহিত হয়ে গেল মায়ের চেহারা দেখে। যেন আলো ফুটে বেরুচ্ছে মায়ের মুখ থেকে।
‘তাড়াতাড়ি পলা জয়নাল, দিরং করিছ না। নাইলে বাঘ তোরে খাইয়ালব...’
‘উহু, বাঘে খাইত পারত না, এই বাঘের দাঁত নাই, নখ নাই, এইডা একটা নকল বাঘ, আমার দোস্ত, এর লগে আমি কথা কই, এর লগে ঘুমাই, ডরাইয়ো না মা, এ আমারে কিছু করত না...’
মা আরও লম্বা হতে থাকে, তার কোল থেকে রাজহাঁস ডানা মেলে উড়ে যায়। মা ভীতসন্ত্রস্ত কণ্ঠে চিৎকার করতে থাকে, ‘পলা জয়নাল, তুই পলা, বাঘের হাতেই তোর মরণ লেখা আছে...বাঘ তোরে ছাড়ত না, খাইয়ালব...’
জয়নাল দুহাত প্রসারিত করে মাকে জড়িয়ে ধরে তাকে আশ্বস্ত করতে চায়। কিন্তু মা যেন আরও লম্বা হয়ে, আরও সাদা হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।
প্লাস্টিকের চাদরের নিচে ঘুমন্ত জয়নাল ছটফট করে ওঠে।
বাঘ আশাবাদী হয়ে ওঠে, বুঝি এখনই যম ঘুম ভেঙে জেগে উঠবে জয়নাল। জেগে উঠে অন্য সব রাতের মতো হয়তো চিৎকার করে বলবে, ‘এই শহর আমারে ঠাইট খায়া ফালাইছে, সব রক্ত চুইষ্যা নিছে, ছিবড়া বানায়া ফেলছে, বুঝছ মামা, আমার এই হাড় জিরজিরা রক্তহীন দেহ খায়া কোনো বাঘই আর মজা পাইব না...হে হে হে’
কিছুক্ষণ পর হাসি থামিয়ে জয়নাল হয়তো উদাস ভঙ্গিতে বলবে, ‘শহর কিন্তু তোমারেও খায়া ফেলছে মামা, তোমার প্রাণ খায়া ফেলছে, শহরের জিহ্বা খুব লম্বা, সেই জিহ্বা তোমার জঙ্গল খায়া ফেলছে, তোমারে কঠিন পাথর বানায়া ফেলছে, টের পাইছ, কি পাও নাই?...হে হে হে’
রাতের রাগত বাতাসও যেন জয়নালের সাথে গলা মিলিয়ে হে হে করে বিদ্রূপের হাসি হাসছে।
জয়নাল ঘুমের মধ্যেই তার হারিয়ে যাওয়া মাকে ডেকে ডেকে ক্লান্ত হয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়েছে।
এদিকে, বেড়ে যাচ্ছে বুনো বাতাসের মাস্তানি। যেন আজ সে এক আত্মভোলা পাগল। কাউকেই চেনে না, কাউকেই মানে না, কারও ধার ধারে না, পরোয়া করে না কোনো কিছুই। আপন খুশিতে নিজের মনে হাত-পা ছুড়ে, শুধু নেচে যাচ্ছে। প্রলয় নাচন। তার প্রবল উসকানিতে পান্থপথের মোড়ে এত দিন স্থির দাঁড়িয়ে থাকা বাঘের মনে বহুদিন ধরে ঘুমিয়ে থাকা হিংসÊ উদ্দাম অরণ্যবোধ জেগে ওঠে। এক অজানা রাগে, দ্রোহে, ক্ষোভে তার রড-সিমেন্টের শক্ত শরীর মোচড় খায় প্রবল হাওয়ায়, তার বন্য অভিব্যক্তি স্বরূপে প্রকাশিত হয়, যেন আজ রাতে ভেজা বাতাসের সাথে মিলে প্রবল আক্রোশে চুরমার করে দিতে চায় আশপাশের সবকিছু।
ফলত সে তার ভারী শরীর নিয়ে বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে এদিক-ওদিক দোল খায়, কেঁপে কেঁপে ওঠে, আর একসময় সত্যি সত্যি তার স্থবির পা সিমেন্টের তৈরি পাটাতন থেকে আলগা হয়ে যায়। তখন তার পক্ষে ভারসাম্য রক্ষা করে আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হয় না। একসময় রয়েল বেঙ্গল টাইগারের পতন ঘটে। সে একপাশে কাত হয়ে পড়ে যায় ভ্যানের ওপর ঘুমিয়ে থাকা জয়নালের ওপরে। জয়নাল তখন দেখে তার তালগাছের মতো লম্বা সাদা মা আবার ফিরে এসেছে, কিন্তু এবার মা যেন বনের দেবী, বনবিবি, সবুজ পাতার পোশাকে ঢাকা তার শরীর, মায়ের বাহন এক অতিকায় বাঘ, আর হ্যাঁ, এই তেজি বাঘটিকেও তো সে চেনে, এ তো সেই বাঘ, যে পান্থপথের মোড়ে বহুদিন দাঁড়িয়েছিল বেরং, বিষণ্ন ও দুঃখিত হয়ে, এখন সেই দুঃখী বাঘের চেহারা থেকে বিষণ্নতা দূর হয়ে গেছে, তার চোখে-মুখে খেলা করছে মুক্তির আনন্দ, তার ডোরাকাটা চামড়ার নিচে ফুলে ওঠা সতেজ পেশিগুলো এক্ষুনি লাফিয়ে ওঠার জন্য চঞ্চল। বাঘটির মতোই চেহারায় আনন্দের ফুল ফুটিয়ে মায়ের কোলে কিংবা সত্যিকারের এক বুনো বাঘের পিঠে এক লাফে চড়ে বসে জয়নাল।