অন্য বঙ্গবন্ধু

মুজিব ভাই—এবিএম মূসা
প্রথমা প্রকাশন
প্রচ্ছদ: কাইয়ুম চৌধুরী
১০৪ পৃষ্ঠা
দাম: ১৭০ টাকা

মুজিব ভাই—এবিএম মূসা
মুজিব ভাই—এবিএম মূসা

রাজনীতিক শেখ মুজিব এবং ব্যক্তি শেখ মুজিব যে আলাদা মানুষ ছিলেন; সে কথা তাঁর সমসাময়িক এবং অগ্রজ-অনুজ সবাই স্বীকার করেন। রাজনীতিক হিসেবে নিশ্চয়ই তিনি সমালোচনার ঊর্ধ্বে ছিলেন না; রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁর গৃহীত সব সিদ্ধান্তের সঙ্গে অনেকেই দ্বিমত করবেন; কিন্তু একটা বিষয়ে একমত হবেন যে মানুষকে আপন করে নেওয়ার দুর্লভ গুণ ছিল তাঁর। ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে শেখ মুজিবকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘আপনার বড় গুণ কী?’ তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ‘আমি জনগণকে ভালোবাসি।’ পরের প্রশ্ন ছিল: ‘আপনার বড় দোষ কী ছিল?’ তিনি বলেছিলেন, ‘আমি আমার জনগণকে বেশি ভালোবাসি।’
নিজের জনগণের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা না থাকলে, তাদের চাওয়া-পাওয়ার বিষয়টি অন্তর দিয়ে অনুভব না করলে বড় নেতা হওয়া যায় না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সে রকমই একজন নেতা।
অন্যদিকে, এবিএম মূসার সাংবাদিকতা এবং শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবন সমান্তরাল না হলেও কাছাকাছি সময়ের। কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে তরুণ শেখ মুজিব ১৯৪৮সালে গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠনের যে উদ্যোগ নেন, তাতে সে সময়ের আরও অজস্র তরুণের পাশাপাশি শামিল হয়েছিলেন এবিএম মূসাও। গণতান্ত্রিক যুবলীগ স্থায়ী হয়নি; পরে পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। সে সময় মুজিব কারাগারে থাকলেও প্রস্তুতির কাজটি আগেই তিনি করেছিলেন (দ্রষ্টব্য অসমাপ্ত আত্মজীবনী: শেখ মুজিবুর রহমান)।
সাংবাদিক এবিএম মূসা রাজনীতিক ও ব্যক্তি শেখ মুজিবকে যেভাবে দেখেছেন, বুঝেছেন, তাঁরই লিখিত ভাষ্য মুজিব ভাই, যা অনেকটা ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্পর্কেরই দলিল হয়ে উঠেছে।
এবিএম মূসার মুজিব ভাই ঠিক স্মৃতিচারণা নয়, আবার মূল্যায়নধর্মী লেখাও নয়। এ দুইয়ের মিশেলে এমন সব ছবি এঁকেছেন, যা বিক্ষিপ্ত হলেও শেখ মুজিবুর রহমানের চরিত্রের স্বরূপ খুঁজে পাওয়া যায়। এবিএম মূসা কেবল ব্যক্তি শেখ মুজিবকে এ বইয়ে তুলে আনেননি; এনেছেন তাঁর পরিবার স্ত্রী, তিন পুত্রকেও। এ ধরনের স্মৃতিচারণায় যুক্তির চেয়ে আবেগের প্রাবল্য লক্ষ করা যায়, যা থেকে এবিএম মূসাও মুক্ত হতে পারেননি। তিনি তাঁর মুজিব ভাইকে দেখেছেন মুগ্ধ দর্শকের দৃষ্টিতে, সেখানে সমালোচকের চোখ নেই, আছে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।
লেখকের ভাষায় ‘গজফিতা দিয়ে হিমালয় সদৃশ শেখ মুজিবুর রহমানের শারীরিক উচ্চতা অনুমান করা গেলেও তাঁর ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা অথবা হূদয়ের বিশাল ব্যপ্তি কোনো মানদণ্ড দিয়ে মাপা অথবা দাঁড়িপাল্লায় ওজন করা সম্ভব ছিল না।’
এবিএম মূসা বেশির ভাগ লেখা লিখেছেন বঙ্গবন্ধু তিরোধানের অনেক পরে, শেখ হাসিনার দল ক্ষমতায় আসার পর কিংবা খালেদা জিয়ার শাসনামলে, ফলে পঁচাত্তরের আগের ও পরের রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পর্কেও পাঠক স্পষ্ট ধারণা পাবেন।
গ্রন্থভুক্ত ১১টি নিবন্ধ হলো: অন্তরঙ্গ কিছু স্মৃতি, রঙ্গরসে বঙ্গবন্ধু, প্রেরণাদায়িনী ফজিলাতুন নেসা মুজিব, স্মৃতিতে কামাল জামাল রাসেল, মাওলানা ও তার মুজিবর, সাতই মার্চের যুদ্ধ ঘোষণা, বঙ্গবন্ধুর ফিরে আসা এবং একটি সংশ্লিষ্ট কাহিনী, শেখ মুজিবের বিশাল হূদয়খানি, অকুতোভয় পিতা, নিবেদিত প্রাণ পুত্র, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ, দ্য ট্রয়াল অব হেনরি কিসিঞ্জার: রক্তাক্ত ১০ আগস্ট।
এসব নিবন্ধের বাইরে লেখক আমার কথা নামে কৈফিয়ত দিয়েছেন। সেই সঙ্গে যুক্ত করেছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক ও আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি গানের রচয়িতা আবদুল গাফফার চৌধুরীর একটি ভূমিকা। তিনি লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু যে বিশাল হূদয়ের মানুষ ছিলেন, বইটিতে তার প্রমাণ তুলে ধরা হয়েছে। পাকিস্তানের কারাগার থেকে স্বাধীন বাংলায় ফিরে আসার পর নিজের পরম রাজনৈতিক শত্রুদেরও ক্ষমা করে তিনি তাঁদের ব্যক্তিগতভাবেও গোপনে সাহায্য দিয়েছেন, তার একাধিক ঘটনা মূসা উল্লেখ করেছেন।’
কাহিনি সূত্রে বইয়ে সমসাময়িক আরও যেসব চরিত্র উঠে এসেছে, তাঁরা হলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আবুদল হামিদ খান ভাসানী, বেগম ফজিলাতুনেসা মুজিব, অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক, তাঁর পুত্র বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের দিক পরিবর্তনকারী ঘটনা যেমন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, সাতই মার্চের ভাষণ, ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তনও আলোচিত হয়েছে।
এবিএম মূসার ভাষা সরল ও সহজ। তিনি লিখেন অনেকটা কথা বলার ভঙ্গিতে, গল্পের ছলে। পাঠককে তিনি সেই গল্পের শ্রোতা করে নেন; এটি এবিএম মূসার লেখার প্রসাদ গুণ হিসেবেই স্বীকৃত।