
গেল ২৬ আগস্ট পথের পাঁচালী ছায়াছবি মুক্তির ষাট বছর পূর্ণ হলো। ১৯৫৫ সালের এই দিনে মুক্তি পেয়ে এই একটি মাত্র ছবি ভারতীয় চলচ্চিত্রের নাবালকত্ব ঘুচিয়ে তাকে পৌঁছে দিয়েছিল সৃজনশীল ছায়াছবির বিশ্বদরবারে। পরিচালক সত্যজিৎ রায় প্রথম ছবিতেই হয়ে যান বিশ্বনন্দিত, যা খুব কম নির্মাতার ভাগ্যে জোটে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অমর সৃষ্টি অপু-কাহিনি (পথের পাঁচালী, ১৯২৮ ও অপরাজিত, ১৯৩১) নিয়ে সত্যজিৎ তিনটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, পথের পাঁচালীর পরই ১৯৫৬ সালে অপরাজিত আর কিছু পরে ১৯৫৯-এ অপুর সংসার। পথের পাঁচালী ও অপরাজিত পরপর নির্মিত হওয়ায় দুটি ছবিতে কয়েকটি চরিত্রে অভিন্ন অভিনেতারা ব্যবহৃত হয়েছেন—বিশেষ করে অপুর বাবা হরিহর চরিত্রে কানু বন্দ্যোপাধ্যায় ও মা সর্বজয়া চরিত্রে করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ ছাড়া দুটি ছবিতেই পণ্ডিত রবিশঙ্করের সংগীতযোজনা যে অসামান্য আবহ রচনার কাজটি করেছিল, সে কথাটিও উল্লেখ না করলে নয়।
পথের পাঁচালী নিয়ে আলোচনা এ রচনার উদ্দেশ্য নয়। সে আলোচনা বিস্তর যোগ্য (কিছু অযোগ্যও হয়তো!) মানুষেরা করেছেন, আরও করবেন। ছবিটির কিছু অসামান্য দৃশ্য চলচ্চিত্রের নান্দনিক রূপায়ণের পাঠযোগ্য উদাহরণ হিসেবে আরও বহুকাল চর্চিত হবে, আর ১৯৫৬ সালে ফ্রান্সের কান চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ ‘মানবিক দলিল’ হিসেবে এর বিবেচনাটি আরও বহুকাল দর্শকের সংবেদকে স্পর্শ করবে।
পথের পাঁচালী প্রথম কবে দেখেছিলাম আজ আর মনে নেই, তবে বহুবার নানাভাবে দেখা হয়েছে, সে দেখা প্রতিবারেই নতুন রূপে প্রতিভাত হয়েছে। সত্যজিতের পরবর্তী সব ছবি দেখেও পথের পাঁচালীর মাদকতা ম্লান হয় না।
অপু-কাহিনির একটি মধ্যমণি চরিত্র সর্বজয়া। দারিদ্র্য, দুর্গার মৃত্যু, বাস্তুত্যাগ, স্বামীহীন হওয়ার পর পরিবর্তিত জীবনে ক্লিন্নতার সঙ্গে সংগ্রাম, অপুর সঙ্গে মানসিক বিচ্ছেদ, সর্বশেষ অসুস্থতা ও নৈঃসঙ্গ্যের মধ্য দিয়ে মৃত্যুতে মুক্তি। অপু-কাহিনি বিংশ শতকের প্রথম পর্বে বাংলার একটি প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম নেওয়া এক বালকের সেই সামান্য গণ্ডির সীমা ছাড়িয়ে বিশ্বলোকের যাত্রী হয়ে ওঠার গল্প হলেও পথের পাঁচালী আর অপরাজিত মূলত সর্বজয়ারও জীবনসংগ্রামের কাহিনি, এ লড়াইয়ের আঁচ অপুর গায়ে তেমন করে লাগেনি। সর্বজয়া নামটিই ইঙ্গিতপূর্ণ। শুরুতে ইন্দির-ঠাকুরণের প্রতি নির্দয় ব্যবহারে তাঁর প্রতি অপ্রসন্ন থাকলেও ক্রমেই সর্বজয়ার একাকী যুদ্ধের সঙ্গী হয়ে উঠি আমরা, এমনকি অপুর সঙ্গে যখন মানসিক দূরত্ব বাড়ছে (অপরাজিত ছবিতে সর্বজয়ার অসুখের বিবরণ শুনতে শুনতে অপুর ঘুমিয়ে পড়া), তখন নায়ক অপু নয়, তার মায়ের প্রতিই আমাদের সহানুভূতি হেলে পড়ে। পথের পাঁচালী দারিদ্র্যের করাল অস্তিত্ব সত্ত্বেও সংসারের স্নেহময় বাঁধন, দুটি বালক-বালিকার তুচ্ছ জীবনের হাসিকান্নার খণ্ডচিত্র আর প্রকৃতির ব্যঞ্জনাময় ব্যবহার দিয়ে সহজেই দর্শককে আবিষ্ট করতে পেরেছে। আমাদের দুর্ভাগ্য, সত্যজিতের আরও পরিণত চলচ্চিত্র অপরাজিত এক বালকের বয়ঃসন্ধি অতিক্রম করে নিজকে জীবনের বৃহত্তর বলয়ে স্থাপনের গভীর-জটিল কাহিনির অসাধারণ নির্মাণ হয়েও আমাদের দর্শক-সমালোচকের কাছে তেমন স্বীকৃতি পায়নি। দুটি ছবিই আমাদের অনুভবের গভীর তন্ত্রীকে স্পর্শ করে, এর অন্যতম উপাদান সর্বজয়া চরিত্রে করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংবেদী অভিনয়—এটি মানতেই হবে।
সত্যজিৎ তাঁর ছবিতে প্রতিষ্ঠিত রীতিবদ্ধ অভিনেতা না নিয়ে একেবারে আনকোরাদের দিয়ে অভিনয় করাতে চেয়েছেন, সম্ভবত প্রথানুগ অভিনয়ের বাইরে একটি সতেজ স্বাভাবিকতা নির্মাণের উদ্দেশ্যে। হরিহর চরিত্রে তাঁকে নিয়মিত অভিনেতা কানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের শরণাপন্ন হতে হয়েছে, কিন্তু এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র সর্বজয়ার ক্ষেত্রে করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নির্বাচন করে তিনি তাঁর নিরীক্ষার যাথার্থ্য যাচাই করলেন যেন। আমরা জেনেছি যে সত্যজিৎ বন্ধু সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়কে খানিকটা জোর করেই সর্বজয়ার চরিত্রে অভিনয় করতে রাজি করিয়েছিলেন। করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় এর আগে কিছু নাটকে অভিনয় করেছিলেন, তবে চলচ্চিত্রে এ-ই প্রথম। পথের পাঁচালীর পর তিনি সত্যজিৎ রায়ের অপরাজিত ছাড়াও দেবী (১৯৬০) ও কাঞ্চনজঙ্ঘা (১৯৬২) ছবিতে অভিনয় করেছেন। এর বাইরে ঋত্বিক ঘটকের কত অজানারে (১৯৫৯, মুক্তি পায়নি) ও মৃণাল সেনের ইন্টারভিউ (১৯৭১) আর কিছু বাণিজ্যিক ছায়াছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি।
চল্লিশ-বিয়াল্লিশ বছর আগের স্মৃতি ঝাপসা হয়ে এসেছে। যত দূর মনে পড়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ঢাকার ভারতীয় দূতাবাসে সম্ভবত তথ্যসচিব হয়ে এসেছিলেন সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, সঙ্গে স্ত্রী করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়। শিল্পী স্বপন চৌধুরীর সঙ্গে প্রথম আমি তাঁদের ধানমন্ডির বাসায় যাই মনে পড়ছে, সম্ভবত ’৭৩-এর প্রথম দিকে। সে-ই প্রথম করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখি। তখনকার ধানমন্ডির বাগান ও বৃক্ষশোভিত সুপরিসর দোতলা বাসাবাড়ি। দারোয়ান আমাদের বসতে বলে ওপরে তাঁদের ডাকতে গেল। সুব্রতবাবু এসে আমাদের পরিচয় জেনে আলাপ করলেন, চা দিতে বললেন। নিপাট ভদ্রলোক, কথা বলেন নিচু স্বরে। এর মধ্যে দোতলার সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়, হাইহিল খটখটিয়ে। উঁচু খোঁপা আর শাড়িতে দারুণ চটপটে ও ফ্যাশনেবল। সম্ভবত বাইরে যাচ্ছিলেন। আমাদের সঙ্গে সামান্য কুশল বিনিময় করে স্বামীর সঙ্গে কিছু প্রয়োজনীয় কথা সারলেন, বেশির ভাগ কথাই বললেন ইংরেজিতে। এরপর বেরিয়ে গেলেন।
আমাদের পথের পাঁচালীর সর্বজয়া এমন আধুনিকা আর স্মার্ট, কথা বলেন ইংরেজিতে—কল্পনার সঙ্গে একেবারেই মিলল না! তবে চেহারার মিল আর চকিত অভিব্যক্তিতে হঠাৎ হঠাৎ সর্বজয়া উঁকি মারছিলেন বৈকি। আমি আর্ট কলেজ থেকে সদ্য পাস করলেও মাঝেমধ্যেই ওখানে যেতাম আড্ডা দিতে। সেখানেও আমি কয়েকবার তাঁকে দেখেছি, আর্ট কলেজের করিডর দিয়ে জুতো খটখটিয়ে বেশ বেগে হেঁটে যেতেন সিরামিকস বিভাগের দিকে। স্বামীর সঙ্গে ঢাকায় এসে অলস বসে না থেকে কিছুদিন তিনি ওই বিভাগে কাজ শিখেছিলেন।
এর মধ্যে, তা-ও ১৯৭৩ সাল হবে, রটে গেল পথের পাঁচালীর ছোট্ট দুর্গা রুনকি বন্দ্যোপাধ্যায় ঢাকায় এসেছেন। খুবই সম্ভব, তিনি সুব্রত ও করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়েরই মেয়ে, এটি জানা ছিল। রুনকি দিল্লিতে কাজ করেন, তখন বয়স ২৪ থেকে ২৫ হবে, আমাদেরই মতো। পত্রিকাওয়ালারা হন্যে হয়ে চেষ্টা চালাচ্ছিলেন তাঁর ছবি ছাপানোর (তখন তো এত চ্যানেলের হুল্লোড় ছিল না) জন্য। যত দূর মনে পড়ে, রুনকি বেশ বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এগুলো এড়িয়ে চলেছিলেন। শিশুসাহিত্যিক এখলাসউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে আমার বেশ ঘনিষ্ঠতা ছিল। এখলাস ভাই জানালেন, ওই পরিবারের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘদিনের সম্পর্ক এবং বয়সের ব্যবধান সত্ত্বেও রুনকি তাঁর বন্ধু। আমি খানিকটা অবিশ্বাসে থাকলাম। আমি থাকতাম আজিমপুরে একটি বাসার গেস্টরুম ভাড়া নিয়ে, খাওয়াদাওয়া হোটেল-ভরসা। একদিন এখলাস ভাই সত্যি সত্যি রুনকি বন্দ্যোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে আমার ডেরায় চলে এলেন। আমি তো মহা-অপ্রস্তুত, পথের পাঁচালীর ফোকলা দাঁতের ছোট্ট দুর্গা আমার ঘরে! ব্যাচেলরের ঘর যতটা সম্ভব অগোছালো—মশারি অর্ধ-টানানো, বিছানা এলোমেলো, ছাদের ঝুল লম্বা হয়ে ঝুলে আছে। রুনকি জানতে চাইলেন, মশারি তুলি না কেন? বললাম, সারা দিন থাকি না, রাতেই ঘরে ঢুকি, তাই দরকার হয় না। আর ছাদের ঝুল? ওরা তো আমার কোনো অসুবিধা করে না,—জানালাম। রুনকি বেশ আমোদ পেলেন।
ঠিক হলো রুনকি আসাতে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার ময়নামতি বেড়াতে যাবে, সঙ্গে যাব আমি, এখলাস ভাই আর তাঁর ভাই ইকবাল আহমেদ। এক রাত থাকা হবে কুমিল্লার বার্ডে (বাংলাদেশ একাডেমি অব রুরাল ডেভেলপমেন্ট)। কূটনীতিকের সফর বলে সর্বোচ্চ সেবার ব্যবস্থা তো ছিলই। ময়নামতি সফরকালে করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কিছু কথাবার্তা হয়েছে, তবে তাঁর প্রখর ব্যক্তিত্ব আর ইংরেজি বোলচালের মধ্যে পথের পাঁচালী বা চলচ্চিত্র বিষয়ে কিছু প্রশ্ন করার সাহস হয়নি। বদলে শালবন বিহার দর্শনকালে আমি এ বিষয়ে আমার জ্ঞান কিছুটা জাহির করার সুযোগ পেয়েছিলাম। বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার তিনজন এক ঘরে, এখলাস ভাই, ইকবাল ভাই আর আমি এক ঘরে। তবে রুনকি অনেক রাত পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে গল্প করে কাটালেন। মনে পড়ছে, আমাদের ঘরের কমোডটি কিছুক্ষণ পরপর বিকট শব্দে আপনি ফ্ল্যাশ হয়ে যাচ্ছিল, আর সঙ্গে সঙ্গে উচ্চ হাসিতে ফেটে পড়ছিলেন রুনকি। কুমিল্লা বার্ডের নিসর্গশোভিত পরিবেশ, তার উন্নত ব্যবস্থাদি দেখে সুব্রতবাবুরা মুগ্ধ হয়েছিলেন, তখনকার বাংলাদেশে ঢাকার বাইরে এ রকম প্রতিষ্ঠান থাকতে পারে, সেটি তাঁদের ধারণার বাইরে ছিল। বিশ্বখ্যাত পথের পাঁচালী চলচ্চিত্রের দুই শিল্পী করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় ও রুনকি বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে এটুকুই আমার পরিচয়। তাঁদের সপ্রতিভ স্মার্টনেসের পাশে আমি নেহাত জড়সড় এক লাজুক সঙ্গী ছিলাম মাত্র।
এর পরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত। রুনকি ফিরে গেলেন তাঁর দিল্লির ব্যস্ততায়। সম্ভবত সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ও অল্পদিনের মধ্যে বদলি হয়ে চলে যান। আমি ঢাকা ছেড়ে চলে আসি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগ দিতে। তাঁদের সঙ্গে আর আমার দেখা না হওয়ারই কথা। তবে অবাক ব্যাপার হলো, সুব্রতবাবুর সঙ্গে আমার আবার দেখা হয় কলকাতায়, ২৪ বছর পর। ১৯৯৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা লাভের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে কলকাতায় বেশ বড়সড় আয়োজন হয়, সেখানে সেমিনারে নিবন্ধ উপস্থাপনের জন্য আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। হঠাৎ তাঁকে দেখতে পাই শ্রোতার সারিতে বসা। উঠে গিয়ে আলাপ করলাম, আমার পরিচয় দিলাম, তাঁর সঙ্গে ময়নামতি সফরের কথা বললাম। তবে বার্ধক্যে উপনীত মানুষটি কিছুই মনে করতে পারলেন না।
করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় মারা গেছেন ২০০১ সালে। সুব্রতবাবু ও রুনকির কোনো খবর আর জানি না। এখলাস ভাইও চলে গেলেন। পথের পাঁচালীর সর্বজয়া আর দুর্গার সঙ্গে আমার সামান্য স্মৃতি সময়ের প্রবাহে হারিয়ে গেছে খড়কুটোর মতো।