অস্বীকৃতির বেদনা কি বাজেনি তাঁর বুকে?

শেখ আবদুল হাকিম ( ১৯৪৬—২৮ আগস্ট ২০২১)

‘বইটি আমার কাছে ভালো লেগেছে বলেই এর প্রকাশনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছি আমি। ব্যবসার খাতিরে বইটিকে ভালো বলাই আমার পক্ষে স্বাভাবিক। ভালো বলছিও। কিন্তু কেউ যদি লেখক কাজী আনোয়ার হোসেনের আন্তরিক মতামত জানতে চান তাহলে আমি বলব, বইটি সত্যিই আমাদের সাহিত্যে একটি ব্যতিক্রম। বইটি পড়ুন। পাণ্ডুলিপিটি পড়ে আমি এতই বিস্মিত, মুগ্ধ ও উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলাম যে সারাটা দুপুর আমাকে বারান্দাময় পায়চারি করে বেড়াতে হয়েছিল।’

১৯৬৮ সালের জুলাই মাসে সেগুনবাগান প্রেসের প্রকাশনী বিভাগ থেকে বের হওয়া অপরিণত পাপ বইয়ের শেষ প্রচ্ছদে কাজী আনোয়ার হোসেনের লেখা এ কথাগুলো মুদ্রিত হয়। এটি ছিল সেবা প্রকাশনীর প্রথম উপন্যাস, পেপারব্যাকে ছাপা। প্রকাশিকা হিসেব নাম গিয়েছিল ফরিদা ইয়াসমিনের।

শিল্পী হাশেম খানের করা প্রচ্ছদটিও ছিল ব্যতিক্রমী। পানপাত্র হাতে এক তরুণের ঘোলাটে প্রতিচ্ছবিসংবলিত মূল প্রচ্ছদের ওপরের দিকে বাঁ অংশ লম্বাটে বৃত্তাকারে কাটা। সেই কাটার ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে লাল জবা ফুল আর সবুজ শাড়ি পরিহিতা এক নারীর মুখ। এ দুইয়ের মধ্যে লেখকের নাম সবুজ রঙে। মূল প্রচ্ছদ ওলটালেই নারীর ছবি পুরোটা ভেসে ওঠে যাকে ঘিরে অপরিণত পাপ বিভিন্নভাবে মুদ্রিত। সেবা প্রকাশনীর পুস্তক পরিচিতি পুস্তিকায় বা ক্যাটালগে বইটি সম্পর্কে লেখা হয়েছিল, ‘একটি ব্যতিক্রমধর্মী উপন্যাস। সস্তা চটক নয়, লেখকের অন্তর নিংড়ানো উপলব্ধি শিল্প হয়ে উঠেছে এর ছত্রে ছত্রে।’

এভাবেই তরুণ সাহিত্যিক শেখ আবদুল হাকিমের প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল, যখন তাঁর বয়স ২২ বছর! আর এর মধ্য দিয়ে তিনি জড়িয়ে গেলেন সেবা প্রকাশনীর সঙ্গে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে হুগলি জেলায় ১৯৪৬ সালে জন্ম নেওয়া হাকিম মা-বাবার সঙ্গে দেশভাগের কিছু পরে চলে আসেন ঢাকায়। লেখক হতেই চেয়েছিলেন তিনি, চেয়েছিলেন লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে নিতে। সেবা প্রকাশনীতে যুক্ত হলেন সেই প্রত্যাশায়। সেবা থেকে তখন ছোটদের জন্য ‘কুয়াশা’ আর বড়দের জন্য ‘মাসুদ রানা’ সিরিজ প্রকাশিত হচ্ছে। দুটোই জনপ্রিয়, যদিও ‘রানা’ স্বাভাবিকভাবেই এগিয়ে। প্রকাশনায় বৈচিত্র্য আনতে ও পাঠক টানতে ‘ভয়াল’ ও ‘রহস্য’ নামে আরও দুটো সিরিজ চালু করা হলো। কিন্তু এত বই লিখবে কে? কাজী আনোয়ার হোসেন একাধারে ‘রানা’ ও ‘কুয়াশা’ লিখছেন। আবার তিনিই প্রকাশনা ব্যবসা দেখছেন। দম ফেলার ফুরসত নেই তাঁর।

এ রকম একটা অবস্থায় হাকিম আড়াল থেকে ‘কুয়াশা’ সিরিজের বই লিখতে শুরু করলেন। অসাধারণ লেখার ক্ষমতাই তাঁকে একইভাবে ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের বই লেখার পথ খুলে দিল। ‘রানা’র স্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেন বা পাঠকের কাজীদা তাঁকে দেখিয়ে ও বুঝিয়ে দিলেন বিদেশি কাহিনি অবলম্বনে রূপান্তরের কৌশল। আর প্রতিটি পাণ্ডুলিপি কাজীদার হাত দিয়েই সম্পাদিত হতে লাগল। তাতে ‘রানা’ সিরিজের মূল বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ন রইল। সেবার ভাষারীতিও গড়ে উঠল এ সময়—কাজীদার নির্ভার গদ্যের সঙ্গে হাকিমের জাদুকরি ভাষাশৈলীর সমন্বয়ে।

আড়াল থেকে লেখার কাজটি হাকিম নির্ধারিত সম্মানীর বিনিময়েই করেছেন। এটা ছিল লেখকের সঙ্গে প্রকাশকের অলিখিত বা মৌখিক চুক্তির ভিত্তিতে নির্ধারিত। আরও কয়েকজন লেখকও আড়াল থেকে কয়েকটি ‘মাসুদ রানা’ লিখেছেন। এর পাশাপাশি স্বনামে কয়েকটি উপন্যাসও লেখেন শেখ আবদুল হাকিম। সেবা রহস্য সিরিজের দুষ্টগ্রহ, আমি কি হত্যাকারী বিপদ সংকেত পাঠক টেনেছিল বটে। দুই খণ্ডে প্রকাশিত উপন্যাস দড়াবাজ স্পাই তাঁকে আরেক ধাপ এগিয়ে দিয়েছিল। ‘বরিশালের অখ্যাত এক সার্কাস পার্টির সেই প্রতিভাবান তরুণ দড়াবাজ বাবলাকে মনে পড়ে? পড়ে না? দেখেননি ওর খেলা? তাহলে আজই সংগ্রহ করুন বই দুটি। চোখ বুজে বলে দেওয়া যায়, এমন খেল জীবনে দেখেননি আপনি আর’—এভাবেই পরিচিত ছাপা হয়েছিল উপন্যাসটির।

অনুবাদক হিসেবেও নিজের দক্ষতার প্রমাণ রেখেছেন শেখ আবদুল হাকিম। মারিও পুজোর বিখ্যাত বই দ্য গডফাদার চারখণ্ডে সেবা থেকে অনুবাদ করেছিলেন তিনি। প্রথম খণ্ড প্রকাশের পরই সাড়া পড়ে যায় পাঠকমহলে। সেটা সত্তরের দশকের একেবারে শেষের দিকের কথা।

এদিকে রকিব হাসান তত দিনে যুক্ত হয়েছেন সেবায়, অনুবাদে হাত পাকাচ্ছেন, লিখছেন উপন্যাস। ‘তিন গোয়েন্দা’য় তখনো হাত দেননি। তিনি কাজীদার পেছনে লেগে রইলেন রহস্যপত্রিকা প্রকাশ করার জন্য। ১৯৭০ সালের শেষ দিকে প্রকাশিত হয়েছিল প্রথম রহস্যপত্রিকা। তবে মাত্র চারটি সংখ্যা বের হয়েছিল। নবোদ্যমে পত্রিকাটি প্রকাশ শুরু হয় ১৯৮৪ সালের ১ নভেম্বর। এর পর থেকে এখন পর্যন্ত পত্রিকাটি প্রতি মাসে প্রকাশিত হচ্ছে। রহস্যপত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক কাজীদা। তিন সহকারী সম্পাদক হলেন শেখ আবদুল হাকিম, রকিব হাসান ও নিয়াজ মোরশেদ। ১৯৮৬ সালে উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় এই নিবন্ধের লেখক সেবা প্রকাশনীতে গিয়েছিলেন তাঁদের দেখা ও অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য। আর তখন থেকেই তাঁদের ভাই সম্বোধনে সুযোগ পান। রহস্যপত্রিকাতেই কেন ফলেটের আ ম্যান ফ্রম সেন্ট পিটার্সবার্গ বইটি ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করেছিলেন হাকিম আততায়ী নামে। পাঠক লুফে নিয়েছিল। আর তাই পরে দুই খণ্ডে বই হিসেবে সেবা থেকে বের হয়। রহস্যপত্রিকায় হাকিম ভাই দেখতেন গল্প, উপন্যাস, চিঠিপত্র, রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা, বিব্রতকর অভিজ্ঞতাসহ কয়েকটি বিভাগ। তাঁর হাত দিয়েই অনেক নতুন লেখক ও অনুবাদকের প্রথম লেখা এখানে ছাপা হয়েছে, যাঁদের কেউ কেউ পরবর্তীকালে স্বনামে খ্যাত হয়েছেন।

হাকিম ভাই সেবা ও পরে প্রজাপতির রোমান্টিক সিরিজের অনেক বইও লিখেছেন। লিখতেন দুহাতে। মাসে একাধিক বই নামাতে হতো। তখন কম্পিউটার আসেনি। কাগজের ওপর কলম চালানো ছেড়ে টাইপ রাইটারের চাবিগুলোয় খটাখট আঙুল চলত তাঁর। জীবন ও জীবিকার তাগিদে একাধারে এভাবে লিখে যাওয়া ও সম্পাদনা করার কাজটি ছিল বেশ কষ্টসাধ্য। বিনিময়ে প্রাপ্তিটা ছিল উতরে যাওয়ার মতো। তবে নিয়মিতভাবে নির্ধারিত সম্মানী বুঝিয়ে দেওয়ার সেবা প্রকাশনীর নীতির কারণে অনেকের মতো তাঁকে অনিশ্চিত অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয়নি কখনো। অবশ্য বাজারের চাহিদা-জোগানের ওঠানামার সঙ্গে সঙ্গে বা বই বিক্রির পরিমাণের ওপর এই সম্মানীর অঙ্কেরও হেরফের হতো।

এই হেরফেরই একসময় সেবা প্রকাশনীর সঙ্গে শেখ আবদুল হাকিমের সম্পর্কের অবনমনের অন্যতম কারণ হয়। যদিও প্রথমবার সেবার সঙ্গে সাময়িক বিচ্ছেদের পর আবার নিজের পুরোনো জায়গাতেই ফিরেছিলেন কিছুটা প্রত্যাশা নিয়ে। কিন্তু সেটি পূরণ হয়নি। বরং প্রায় চার দশকের পারস্পরিক নির্ভরতারও পরিসমাপ্তি ঘটে তিক্ততা নিয়ে। এই তিক্ততা চরমে ওঠে ‘মাসুদ রানা’র কপিরাইট ও তদনুযায়ী সম্মানী দাবি করে হাকিম ভাইয়ের কপিরাইট বোর্ডে দ্বারস্থ হওয়ার মধ্য দিয়ে। গত বছর কপিরাইট বোর্ড এক রায়ে ‘মাসুদ রানা’র স্রষ্টা হিসেবে কাজী আনোয়ার হোসেনকে উল্লেখ করলেও ‘রানা’ সিরিজের ২৫০টি ও ‘কুয়াশা’ সিরিজের ৫০টি বইয়ের মূল লেখক হিসেবে এগুলোর স্বত্বাধিকার বা কপিরাইট শেখ আবদুল হাকিমের বলে স্বীকৃতি দেয়। সব বই অবশ্য কাজী আনোয়ার হোসেনের নামেই প্রকাশিত হয়েছে। এর বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হন কাজীদা। বিষয়টি এখন সেখানে অনিষ্পন্ন অবস্থায় রয়েছে।

এদিকে সেবা থেকে বেরিয়ে আসার পর অন্য একাধিক প্রকাশনী থেকে শেখ আবদুল হাকিমের উপন্যাস ও অনুবাদ প্রকাশ হতে থাকে। এ সময় তিনি জাকি আজাদ নামে গোয়েন্দা চরিত্র সৃষ্টি করেন এবং কয়েকটি বই লেখেন। অনুবাদের কাজে এবার যোগ করেন নন-ফিকশন। যেমন দ্য ম্যান ফ্রম পাকিস্তান ও নুরেমবার্গ: ঈভিল অন ট্রায়াল ইত্যাদি। ফলে লেখক হিসেবে তিনি পাঠকের কাছে ঠিকই পৌঁছাতে থাকেন, তবে কোথায় যেন ছন্দ কেটে গিয়েছিল!

হাকিম ভাই শ্বাসকষ্টের রোগে ভুগেছেন বহু বছর। সেটা নিয়েই লেখালিখি করে গেছেন। বেশি মাত্রায় অসুস্থ হওয়ার আগপর্যন্ত লেখালেখিতে সচল ছিলেন। অবশেষে ৭৫ বছর বয়সে গত ২৮ আগস্ট চিরবিদায় নিলেন।

রহস্য সাহিত্যে মনোনিবেশ করায় শেখ আবদুল হাকিম কথিত মূলধারার সাহিত্য মহলে স্বীকৃতি পাননি। এটা বাংলাদেশের একটা বড় সমস্যা। তাঁর অনুবাদ, রূপান্তর, অ্যাডপটেশন বা দেশীয়করণ ও আড়াল থেকে লেখা বইগুলো সাহিত্যমূল্য পায়নি। তবে অনেক বড় বড় সাহিত্যিকের চেয়ে তিনি অনেক বেশি পাঠকের কাছে পৌঁছেছেন, নতুন পাঠক তৈরিতে বড় ভূমিকা রেখেছেন। যদিও হাকিম ভাই নিজেকে নিয়ে কখনোই সেভাবে চিন্তা করতেন না, ভাবতেন না তাঁর সাহিত্যপ্রতিভা ও লেখনীর ক্ষমতার স্বীকৃতি নিয়ে। প্রচণ্ড আড্ডাবাজ হয়েও নিজের সম্পর্কে বলতেন খুব কম। জীবদ্দশায় তাঁর একটিমাত্র সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে, সেটিও এমন কিছু নয়। তাঁকে নিয়ে হয়নি তেমন কোনো লেখালেখিও। ফলে পাঠকের ভালবাসা পেলেও নিরন্তর জীবনসংগ্রামে লিপ্ত একজন কর্মময় মানুষ হিসেবে বঞ্চনা আর অস্বীকৃতির বেদনা কি একেবারেই বাজেনি তাঁর বুকে?