আঁতুড়ঘর

আঁতুড়ঘরে ঢোকার আগে কর্ত্রী বলেছেন, আজ বৈশাখের পঁচিশ তারিখ। মনে রেখো। দাইবুড়ি মাথা নাড়ে।আঁতুড়ঘর ঠিক করার আগে কর্তাও তাকে একই কথা বলেছেন। বলেছেন, ছেলে হোক, মেয়ে হোক জন্মতারিখ ঠিকমতো মনে রাখতে হয়। আজ পঁচিশে বৈশাখ।দাইবুড়ি মাথা নেড়েছে একই ভঙ্গিতে। প্রতি মাসের, তারিখের হিসাব তার খুব মনে থাকে। কত ছেলেমেয়ের জন্ম হয় তার হাতে। তারিখ মনে না থাকলে তার চলবে কেন?কর্ত্রীর জন্য বিছানা গোছাতে গোছাতে দাইবুড়ি ভাবল, ব্যথা উঠলেই সঙ্গে সঙ্গে প্রসব হয়ে যাবে—এমন তো কথা নেই। কতজনেরই তো দেখেছে, ব্যথা ওঠার পরেও দুদিন গড়িয়ে গেছে। যাকেগ। দাইবুড়ি ভুরু কুঁচকে ভাবল, কর্তাগিন্নি দুজনই এবারে একটু অস্থির। কেন? তাঁরা কী ভাবছেন? এই নিয়ে গিন্নির চৌদ্দবার আঁতুড়ঘরে ঢোকা হলো। প্রসব তো প্রথম নয়। তাহলে অস্থিরতা কেন?বাইরে বটের ডালে বসে থাকা নিশাচর পাখি টিঁউ করে শব্দ করল। দাইবুড়ির বুকের ভেতর শব্দ তরঙ্গ তুলল। বুড়ি ভীষণ খুশি হয়ে নিজেকে বলল, নিশ্চয় ভাগ্যবান সন্তান হবে। ঠাকুরবাড়ির মঙ্গল হবে। জোড়াসাঁকোর মুখ উজ্জ্বল হবে।রাত বাড়ে। বেশ গরম পড়েছে। ছোট ঘরটির ভেতরে বাতাস চলাচল নেই। দরজা বন্ধ। দাইবুড়ি গরম পানির গামলা, পরিষ্কার কাপড়, মধুর শিশি ইত্যাদি গুছিয়ে রেখেছে। এখন অপেক্ষা করা ছাড়া তেমন কিছু করার নেই। দাইবুড়ি মাঝেমধ্যে পায়ের পাতায় হাত বুলিয়ে দেয়।মাথার কাছে বসে গিন্নিমাকে বাতাস করছে ক্ষণদা। তালের পাখা একই লয়ে নড়ছে। মাঝেমধ্যে জোর বাতাস দেয়। গিন্নিমা মাঝে মাঝে মাথা এপাশ-ওপাশ করেন। তাঁর মুখে ঘামের বিন্দু জমেছে। পাখার বাতাসে গরম তেমন কাটে না। তার ওপর প্রসবের বেদনায় শরীর নেতিয়ে আসে। দাইবুড়ি মনে মনে বলে, শরীর তো নেতিয়ে পড়বেই। আর কতবার আঁতুড়ঘরে ঢোকা! আহা বেচারি। তার ওপর এমন ছোট একটি আঁতুড়ঘর। দুজন মানুষ ঢুকলে তিনজনের আর জায়গা থাকে না। গিন্নিমাও একই কথা বলেন, এই ছোট ঘরটা আর কোনো দিন বড় হবে না। এভাবেই জীবন যাবে রে ক্ষান্তি।দাইবুড়ি আবার পায়ের পাতায় হাত রাখে। কেঁপে ওঠে শরীর। প্রসববেদনা বাড়ছে। রাত কত হয়েছে, কে জানে। বটের ডালে নিশাচর পাখি ডানা ঝাপটায়। দাইবুড়ি কান পাতে। মনে হয় চারদিক থেকে কারা বুঝি আসছে। না, ঠিক পায়ের শব্দ নয়। কেমন যে শব্দ বুঝতে পারে না। তবে আনন্দধ্বনি। ঢোল-মাদল বাজিয়ে নয়, তবে গান করতে আসছে বুঝি!কোথায় আসছে? কারা আসছে? ওরা কি জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে আসছে?গিন্নিমা উৎফুল্ল কণ্ঠে বললেন, আজ কৃষ্ণা ত্রয়োদশীর রাত। হ্যাঁ, মা। মনে হয় শেষ রাতের প্রথম প্রহরে ঢুকেছি আমরা। তাহলেই তো রাত পোহানোর আর বেশি সময় নেই। কী বলিস? আমার মনে হয় প্রসবের আগে রাত পোহাবে না। প্রসব হয়ে যাবে।আমারও মনে হয় শেষ রাতেই বোধহয় বাচ্চাটা পৃথিবীতে আসবে। এমনই টের পাচ্ছি। এখন প্রবল ব্যথার ধাক্কায় তিনি ঠোঁট কামড়ে ধরেন। তার পরও মৃদু শব্দ বেরিয়ে আসে মুখ থেকে।দাইবুড়ি সতর্ক হয়ে যায়। খানিকটা উৎকণ্ঠিতও হয়। সে সময়ের অপেক্ষা করে। আর ব্যথার সঙ্গে লড়ছে মা। ছোট্ট আঁতুড়ঘরে প্রদীপের মৃদু শিখায় আলোছায়ার খেলা। চারদিকে নিস্তব্ধ রাত। ঠাকুরবাড়ির কোনো কোনো ঘরে কেউ কেউ জেগে বসে আছেন। একটি জন্মের খবর শোনার জন্য তাঁদের রাত জেগে প্রহর গোনার সময় এখন। ঘুম তাঁদের চোখে নামবে না, যতক্ষণ না খবরটি পাওয়া হবে। ঘরের ভেতরে প্রদীপের মৃদু আলোয় প্রসববেদনায় কাতর মায়ের ঘেমে ওঠা মুখের স্বেদবিন্দু স্পষ্ট দেখা যায় না। দাইবুড়ি ভাবছে, যেকোনো সময় একটা কিছু হয়ে যেতে পারে।তখন শিশুটির নাড়ি কাটতে হবে। গর্ভফুল বেরিয়ে আসার অপেক্ষা করতে হবে। শিশুটিকে পরিষ্কার করতে হবে। আরকি, আর কী করতে হবে? যেন দাইবুড়ির ধাত্রীজ্ঞান হারিয়ে গেছে। সে কোথাও কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। নিজেকে খুব অসহায় লাগছে। আকাশসমান উঁচু একটি ছেলের জন্ম হলে তাকে কীভাবে ধরতে হবে, সে জ্ঞানই তো তার নেই। এই ছোট্ট ঘরে তাকে কীভাবে রাখতে হবে, সেই জ্ঞানই বা সে কোথায় পাবে? ও বিড়বিড় করে, বোশেখ মাসের কৃষ্ণা ত্রয়োদশীর রাত, উত্তর দাও। দাইবুড়ি দুই হাত নিজের বুকের কাছে জড় করে। ওহ্। অস্ফুট শব্দ করেন গিন্নিমা। প্রাণপণ চেষ্টায় তিনি প্রসববেদনাকে মোকাবিলা করেছেন। এই বেদনার অনুভব তো নতুন নয়, কিন্তু চমকে যাচ্ছে শরীর। আনন্দে আপ্লুত হচ্ছে মন। দাইবুড়ি বুঝতে পারে যে গিন্নিমার অস্থিরতা ফুরোয় না।তিনি আবার শব্দ করেন। এবার বেশ জোরে।গিন্নিমা আপনার সময় হয়ে এসেছে।ওহ, চারদিকে এত কথা বলে কে?কথা? কই, কোথাও কেউ নেই।আমি তো কথা শুনতে পাচ্ছি।ঘরে তো শুধু আমি আর ক্ষণদা, গিন্নিমা।কর্ত্রী চোখ বোজেন। ব্যথা কমে এসেছে। বুঝতে পারেন এরপর হয়তো প্রবল একটি ধাক্কা আসবে। সেই ধাক্কায় মাথা ঠেলে বেরিয়ে আসবে বাচ্চাটি।ওহ, বাচ্চা বাচ্চা। চৌদ্দতম বাচ্চা। ব্যথার কষ্টও আনন্দ। এ ব্যথা তো কষ্ট পাওয়ার ব্যথা নয়। গিন্নিমার বুকে স্নিগ্ধ হাসি জেগে থাকে। এ জীবনে যতটি শিশু তিনি পৃথিবীতে এনেছেন, তারা সবাই তাঁর জীবনে নতুন চাঁদ। এবার যে আসবে, তাঁর সঙ্গে বুঝি নতুন সূর্যও উঠবে। গিন্নিমা একটি প্রবল ব্যথা সামলানোর জন্য দাইবুড়ির হাত আঁকড়ে ধরেন। ব্যথা আবার স্তিমিত হয়ে যায়। দাইবুড়ি পেটের ওপর হাত রেখে বুঝতে পারে, বাচ্চার মাথা নিচের দিকে নেমে গেছে। সময় ঘনিয়েছে। যেকোনো মুহূর্তে হয়ে যাবে। গিন্নিমা চোখ বুজে বলেন, বাইরে যেন কারা শব্দ করছে।দাইবুড়ি কান খাড়া করে বলে, হ্যাঁ, আমিও শুনতে পাচ্ছি। আমার মনে হচ্ছে যে বাচ্চাটি জন্ম নেবে, তাকে আশীর্বাদ করার জন্য ওরা দাঁড়িয়ে আছে। ওহ, মাগো।প্রবল ব্যথায় বেরিয়ে আসে শিশুর মাথা। তারপর পুরো শরীর। দাইবুড়ির মুখে আনন্দের হাসি। উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে বলে, গিন্নিমা আপনার পুত্র হয়েছে। মায়ের ক্ষীণ কণ্ঠে কিছু একটা উচ্চারিত হওয়ার আগেই ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে শিশুর চিৎকার। ছোট ঘরটির সিটসিটে আলোয় শিশুটিকে ঠিকমতো দেখতে পান না মা। দুই কান ভরে ওর চিৎকার শোনেন। ও পৃথিবীকে বলে যাচ্ছে, ‘আমি এসেছি।’ ক্ষণদা আঁতুড়ঘরের দরজা খুলে দেয়। বলে, ঠাকুরবাড়ির সবাই জানুক যে ছেলেটির জন্ম হয়েছে। বোশেখ মাসের কৃষ্ণা ত্রয়োদশীর শেষ রাতে। দাইবুড়ি নাড়ি কাটে।মায়ের থেকে আলাদা হয়ে যায় শিশুটি। এখন এই পৃথিবীতে ও একা। পৃথিবীকে নিজের আগমন জানানো শেষ হয়েছে। ও এখন নিশ্চুপ। কেউ একজন দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। বলে, মহর্ষি জানতে চেয়েছেন, কী বাচ্চা হয়েছে?ছেলে। ছেলে হয়েছে।ক্ষণদা দরজা বন্ধ করে দেয়।আবার ছোট আঁতুড়ঘর একাকার হয়ে যায়। কিন্তু আকস্মিকভাবে গিন্নিমার মনে হয় আঁতুড়ঘরটা ছোট নয়। আগের মতোও না। যে ঘরটিতে বারবার ঢুকে তিনি বিরক্ত বোধ করতেন, এর হাঁকধরা গুমোট অস্বস্তির জন্য, সেটি এখন বিশাল। অনেক বড়। দরজা-জানালাগুলো এতই বড় যে চাঁদ-সূর্য ঢুকে যেতে পারে কিংবা ঢুকতে পারে পুরো দেশটা, এমনকি পৃথিবীও। তাঁর বুকের ভেতরের হাঁসফাঁস কেটে যায়। তিনি এক টুকরো কাপড় দিয়ে মুখের ঘাম মোছেন। মৃদুকণ্ঠে দাইবুড়িকে বলেন, ক্ষান্তি, ওর মুখটা আমাকে দেখাও। ক্ষণদা প্রদীপটা উঁচু করে ধরে। দাইবুড়ি পুরোনো কাপড়ে জড়ানো শিশুটিকে সামনে এনে মাকে দেখায়। দিগন্তবিস্তৃত হাসি মায়ের মুখে ভর করে। মা বলেন, ‘বেঁচে থাকো বাবা।’শিশুটির নির্মিলিত চোখের তারায় আশ্চর্য বিভা! একমাথা কালো চুল। প্রশান্তি থিতু করে মাকে। মা ভাবেন, চৌদ্দটি সন্তানের জন্ম দিয়ে সার্থক জীবন তাঁর। এ জীবনে আর কিইবা চাইবার আছে! যে আঁতুড়ঘরের ছোট জায়গা তাঁকে কষ্ট দিয়েছে, সে দুঃখ আজ ভুলে গেলেন। আজ তিনি বিশাল আঁতুড়ঘর পেয়েছেন। তাঁর আর কোনো দুঃখ নেই। তিনি অল্পক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েন।বাইরে রাতের প্রহর শেষ হয়ে যাচ্ছে। অল্পক্ষণে দেখা দেবে দিনের প্রথম আলো।তখন সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকে পিঁপড়ের সারি। বলে, ‘আমরা শিশুর জন্মের খবর শুনে মিষ্টি এনেছি।’ঝাঁক বেঁধে উড়ে আসে মৌমাছি। বলে, ‘আমরা শিশুটির জন্য মধু এনেছি।’একতলার স্যাঁতসেঁতে কোনা থেকে উড়ে আসে বাদুর। বলে, ‘আমরা ওর মুখে জল দিতে এসেছি।’নাচতে নাচতে আসে ঠাকুরবাড়ির আশপাশে ফুটে থাকা বুনোফুল। বলে, ‘আমরা ওর জন্য সৌরভ এনেছি।’বটের ডালে বসে ছেলেটির জন্মের অপেক্ষায় ছিল ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি।ব্যাঙ্গমি বলে, ‘ছেলেটার জন্ম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাড়া পড়ে গেছে চারদিকে। বাব্বা, ছেলেটার জন্য এত্তকিছু!’ হবেই তো। সাড়া তো পড়বেই। ছেলেটির বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িও বড় হতে থাকবে।ব্যাঙ্গমি হা হা শব্দে চারদিক সচকিত করে বলে, ‘এত্ত ছোট্ট আঁতুড়ঘরে কত্ত বড় একটি ছেলে জন্মাল।’ ব্যাঙ্গমির কথায় ব্যাঙ্গমা আমোদিত হয়। দরজায় টুকটুক শব্দ করে বলে, ‘দরজাটা খুলে দাও, দাইবুড়ি।’কেন দরজা খুলব?দিনের প্রথম আলো এই ঘরটাকে ভরে দিতে চাইছে। ব্যাঙ্গমি তড়িঘড়ি বলে, সূর্যের কি এত আলো আছে ব্যাঙ্গমা? আজ ভোরে এই ঘরটা এত বড় যে সূর্য তার সবটুকু আলো দিলেও ঘরটি ভরবে না। তাহলেও আলোকে ঢুকতে দাও। ছেলেটাকে ছুঁয়ে এলে আলোর পুণ্য হবে।ব্যাঙ্গমি আর ব্যাঙ্গমা মিলে দরজায় শব্দ করে। গিন্নিমা আচমকা জেগে উঠে বলেন, কারা যেন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। দরজাটা খুলে দাও, ক্ষান্তি। দাইবুড়ি দরজা খুলে দেয়।ছোট্ট দরজার বড় ফাঁক দিয়ে দিনের প্রথম আলো প্রবেশ করে। উজ্জ্বল হয়ে ওঠে আঁতুড়ঘর। গিন্নিমা মৃদু হেসে বলেন, আজ আমার বড় পুণ্যির দিন রে ক্ষান্তি।