>প্রচলিত মনসামঙ্গলগুলো সমন্বিত করে দ্য ট্রায়াম্ফ অব দ্য স্নেক গডেস নামে ইংরেজি ভাষায় একটি বই লিখেছেন কায়সার হক। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস থেকে বের হওয়া এই বইটি এর মধ্যেই আলোড়ন তুলেছে বিভিন্ন মহলে, হয়ে উঠেছে মনসামঙ্গল-এর নতুন এক সংস্করণ

বাংলার মধ্যযুগে (তেরো শ থেকে আঠারো শ সাল পর্যন্ত) লেখা মঙ্গলকাব্য নিয়ে আমাদের প্রচুর কৌতূহল। কৌতূহলের বিষয় অনেক—দেব-দেবীর স্তুতি আর তাঁদের সন্তুষ্টি লাভের আড়ালে সমাজ বাস্তবতার (জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ থেকে নিয়ে বাণিজ্য সংঘাত যুদ্ধের বর্ণনায় যা প্রতিফলিত) মিথ ও ইতিহাসের আলোকে সামাজিক আখ্যান রচনায় মঙ্গলকাব্য রচয়িতাদের আগ্রহ; মুসলমানদের আগমনের পর লেখা এসব কাব্যে নতুন ধর্ম সম্পর্কে উদ্বেগ এবং সনাতন ধর্ম ছেড়ে যাওয়া নিয়ে উৎকণ্ঠা; পুরোনো ও নতুন সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব এবং ভারসাম্যের চিন্তা; কাব্যগুলোর ভেতরে একধরনের প্রতিবাদী চেতনা এবং পুরাণের বিপরীতে এক ব্রাত্য অবস্থান, এবং এদের আখ্যানধর্মিতা। মঙ্গলকাব্যের ভেতর প্রধান-অপ্রধান বিভাজন ছিল: ধর্মমঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, মনসামঙ্গল—এসব ছিল প্রধান; শিবমঙ্গল, রায়মঙ্গল, শীতলামঙ্গল বা ষষ্ঠীমঙ্গল ছিল অপ্রধান। তবে এদের ভেতর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল মনসামঙ্গল। এর আখ্যান ছিল আকর্ষণীয়—তাতে লৌকিক-অলৌকিক, উচ্চ-নিম্নবর্গ, মানবিক-অতিমানবিকের দ্বন্দ্ব; প্রেম-বিরহ-বিষাদ-বিদ্বেষের জটাজাল এবং গীত বা পাঁচালির সুনিপুণ ব্যবহার লোকসমাজে এর প্রভাব নিশ্চিত করেছিল। তা ছাড়া মনসাপালা পরিবেশনার সময় ও পরিধি বিবেচনা করলেও অন্য সব মঙ্গলকাব্য থেকে এটি আকারে বড় ছিল বলে নিশ্চিত হওয়া যায়। মনসামঙ্গল-এর মূলে ছিল সাপের দেবী মনসা বা পদ্মাবতী বা পদ্মার (মনসাকে ভক্তরা অনেক নামে ডাকতেন) বন্দনা, এবং বেহুলা-লখিন্দর-চাঁদ সওদাগর-মনসার আখ্যানে তাঁর অবস্থান। বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদগুলোতে একসময় শ্রাবণ থেকে নিয়ে কার্তিক পর্যন্ত মনসাপূজার প্রচলন ছিল। মনসাপূজায় সাপদের উদ্দেশে ভোজ দেওয়া হতো, আষাঢ়-সংক্রান্তি থেকে শ্রাবণ-সংক্রান্তি পর্যন্ত মনসাপালা পরিবেশিত হতো। তবে অনেকের মতে, মনসামঙ্গল-এর গান পরিবেশিত হতো আট দিন সময় নিয়ে—এক মঙ্গলবার থেকে নিয়ে আরেক মঙ্গলবার পর্যন্ত। এ জন্য মনসামঙ্গল-এর নামকরণে মঙ্গল-এর অন্তর্ভুক্তি। তবে এই ‘মঙ্গল’ যে গায়েন-শ্রোতার মঙ্গল কামনা থেকেও উদ্ভূত হতে পারে, সে বিষয়টিও স্বীকৃত।
মনসামঙ্গল-এর রচয়িতা অনেক—কবি বিজয়গুপ্ত তাঁর মনসামঙ্গল বা পদ্মপুরাণ লেখেন ১৪৯৪ সালে। ১৪৯৫ সালে বিপ্রদাস লেখেন মনসা-বিজয়। নারায়ণ দেব তিন খণ্ডে সাজানো তাঁর পদ্মপুরাণ লেখেন ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিকে। কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ লেখেন মনসার ভাসান বা মনসামঙ্গল, দ্বিজবংশীদাস ও ষষ্ঠীবর অথবা ওডিশার কবি দ্বারিকাদাসও মনসামঙ্গল রচনা করেন। সাধারণত পয়ার ও ত্রিপদী ছন্দে—অক্ষরবৃত্তে মনসামঙ্গল লেখা হতো।

বলা বাহুল্য, প্রত্যেক কবি নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মনসার আখ্যানটি দেখেছেন, নিজস্ব কল্পনায় এর বিস্তার ঘটিয়েছেন। ফলে একটি মনসামঙ্গল থেকে আরেকটির পার্থক্য অনেক, যদিও মনসার জন্ম (সরাসরি শিবের বীর্য থেকে, কোনো মায়ের গর্ভ থেকে নয়), শিবের সঙ্গে তাঁর পুনর্মিলন, শিবের স্ত্রী চান্দি বা পার্বতীর সঙ্গে তাঁর সংঘাত, শিবের অশ্রু থেকে মনসার বোন নেতার উত্থান, মনসার বিরুদ্ধে চাঁদ সওদাগর বা চন্দ্রধারার কঠোর অবস্থান এবং শেষ অবধি পুত্র লখিন্দরকে মৃত্যু থেকে ফিরিয়ে আনার বিনিময়ে মনসার বশ্যতা স্বীকার করে নেওয়া—এসব বিষয় ঘুরেফিরেই প্রত্যেকের বর্ণনাতেই আসে। তারপরও মনসার গল্পের কোনো একক উৎস বা সূত্র নেই—বৈচিত্র্যই এর প্রধান পরিচয়।
এই বিষয়-বৈচিত্র্য এবং আখ্যানমহিমা মনসার গল্পের প্রতি আকর্ষণ তৈরি করেছে আরেক কবির, আমাদের সময়ের কায়সার হকের। প্রচলিত মনসামঙ্গলগুলোর একটি সমন্বিত সংস্করণ ইংরেজি ভাষায় তিনি করেছেন তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত দ্য ট্রায়াম্ফ অব দ্য স্নেক গডেস (২০১৫) অথবা সর্পদেবীর বিজয় বইটিতে। বইটি প্রকাশ করেছে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস। তবে পদ্যে নয়, গদ্যে বইটি লিখেছেন কায়সার হক। দুই ভাগে লেখা বইটির প্রথম ভাগ শুরু হয় সৃষ্টিতত্ত্ব দিয়ে, এবং স্বর্গ-নিখিল-দেবতামণ্ডল ঘুরে তা শেষ হয় মনসার পৃথিবীতে নেমে আসার মধ্য দিয়ে। প্রথম ভাগের নাম ‘দেবতালয়’ বা ‘স্বর্গের অঞ্চল’। দ্বিতীয় ভাগের নাম ‘সওদাগর রাজার রাজ্যে’। এই দুই ভাগজুড়ে মনসার কাহিনি হক বর্ণনা করেন তাঁর অসাধারণ গদ্যে, যার ভেতর কবিতার সুষমা আছে, কথন রীতির চমৎকার প্রকাশ আছে, চরিত্র বর্ণনায় মৌলিকত্ব এবং চমক সৃষ্টির বিষয়টি আছে। পড়তে বসলে মনে হয়, যেন ছবির পর ছবি সাজিয়ে মনসা আর তাঁর অবাক পৃথিবীকে আমাদের সামনে রং-রূপ আর রসে সাজাচ্ছেন কায়সার হক।
বইয়ের শুরুতে হক একটি জ্ঞানগর্ভ পূর্বকথন লিখেছেন, তাতে মনসামঙ্গল-এর ইতিহাস, নৃতত্ত্ব এবং দর্শন, মনসাসাহিত্যের সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা, পৌরাণিক থেকে লৌকিক কল্পনায় এর অধিষ্ঠান এবং তাঁর নিজের লেখা মনসামঙ্গল-এর স্বাতন্ত্র এবং এর সমন্বয়ধর্মিতার কিছু চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। হকের পূর্বকথনের আগে ওয়েন্ডি ডনিগার ২৮ পৃষ্ঠার এক ভূমিকার ২৭ পৃষ্ঠাজুড়ে ‘হিন্দুধর্মে সাপ ও সাপদেবীরা’ বিষয়ে পাণ্ডিত্যপূর্ণ কিছু কথা লিখেছেন, কিন্তু এক পৃষ্ঠারও কম জায়গা নিয়ে কায়সার হকের প্রশংসা করে বলেছেন, এটি একটি ‘আনক্রিটিক্যাল’ বা বিচারনিরপেক্ষ সংস্করণ; হক যা করেছেন তা হচ্ছে চমৎকার একটি অনুবাদ। তবে ডনিগার যে বললেন বইটি অনুবাদ, তা তো নয়, এটি ইংরেজি ভাষায় কায়সার হক রচিত মনসামঙ্গল। তাঁর সংস্করণের ভাষা গদ্য, তাতে মনসামঙ্গল-এ এর প্রথাগত পরিবেশন রীতি অনুপস্থিত—এখানে গায়েনের ভূমিকাটি এক আখ্যানলেখকের ভেতর লুপ্ত হয়েছে; কিন্তু মঙ্গলকাব্যের বিষয় গৌরব তা নিশ্চিতভাবেই ধারণ করেছে। হকের শ্রোতা নেই, আছেন পাঠক, যাঁরা, তাঁর আশা, সাহিত্য, মিথ, সংস্কৃতি বিদ্যার ছাত্রছাত্রী, অথবা মনসাগল্পে উৎসাহী যে-কেউ। সেলিম আল দীন তাঁর মধ্যযুগের বাঙলা নাট্য (১৯৯৬: ২৩২) বইয়ে লিখেছেন, মধ্যযুগে মনসামঙ্গল পরিবেশনায় ‘বাইশারীতি’র প্রচলন ছিল। ‘গায়েনগণ ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিভিন্ন কবির পদ “সংকলন সম্পাদন”পূর্বক পাঁচালি পরিবেশন করতেন।’ কায়সার হক আমাদের সময়ের বাইশারীতির ধারক, তাঁর উদ্দেশ্য একাডেমিক, সাংস্কৃতিক।
হক যা করেছেন: অনেক প্রস্ত মনসামঙ্গল পড়েছেন, সবার সুতো থেকে সূক্ষ্ম কিছু সুতো বের করে নিজের একটি গল্প বুনেছেন, এবং মঙ্গলকবিদের মতো, আখ্যান বর্ণনার মাহাত্ম্যের পাশাপাশি অনেক বিষয়ের অবতারণা করেছেন। তিনি ‘স্বর্গ’ খণ্ডে শিবের বর্ণনায় ভাষা-কল্পনা-সৌন্দর্য-শক্তি-যৌনতার উদ্যাপন করেছেন; পার্বতী-মনসা-গণেশ-কর্তিকের জন্মের আখ্যানে শাস্ত্রীয় আবহটিকে রসমণ্ডিত করেছেন, বাংলার মানুষের মনে মনসার অধিষ্ঠান-পরবর্তী সময়, ইতিহাস ও মিথকল্পনার সম্মিলনটিকে তাঁর বর্ণনার গুণে প্রাণবন্ত করেছেন। ইতিহাসের দিকে তাঁর চোখ ছিল বলে ইসলাম ধর্মের আগমনের পর সনাতন সমাজের ভেতরের অস্থিরতা ও নতুন সংস্কৃতির সঙ্গে দ্বন্দ্ব ও মানিয়ে চলার বিষয়টিকে হক গুরুত্ব দিয়েছেন। ‘সর্পদেবীর বিজয়’-এর একটি পরিচ্ছেদে তিনি মুসলমান শাসকদের সঙ্গে মনসার দ্বন্দ্বের বিষয়টি তুলে ধরেছেন। হাসান ও হোসেন নামে দুই শক্তিধর শাসক ছিলেন, যাঁরা ছিলেন দুই ভাই। তাঁদের সঙ্গে যুদ্ধ হলে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী মনসা ও তাঁর বোন নেতার জয় অনিবার্য হয়ে পড়ে। দুই ভাই পরাজিত হন, মনসার বশ্যতা মেনে নেন। তাতে শান্তি নামে। মৃতেরা প্রাণ ফিরে পান, এবং মনসা হাসান-হোসেনকে স্বাস্থ্য, সমৃদ্ধি ও শান্তির বর দেন। হক যেভাবে এই ঘটনার অবতারণা করেছেন, তাতে পাঠক ইতিহাসের এমন এক সময়ের সন্ধান পাবেন, যে সময়ে একদিকে মুসলিম শাসকেরা সমৃদ্ধ নগর ও জনপদের গোড়াপত্তন করছেন, মানুষের মধ্যে গতিশীলতা বাড়েছে, এবং হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে একটি গভীর আন্তসম্পর্ক দুই সম্প্রদায়কে এক ঐক্য প্রয়াসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, কায়সার হক যেমন দেখান, ব্রত্যদর্শনের সঙ্গে সম্ভ্রান্ত চাঁদ সওদাগরের দ্বন্দ্ব হিন্দু সমাজের ভেতরের বিভক্তি (এবং তার সমন্বয়) কে-ও তুলে ধরে। এসব কারণে মনসামঙ্গলকে হক ‘সাংস্কৃতিক ঐক্যের’ কাজ বলে বর্ণনা করেছেন।
দ্য ট্রায়াম্ফ অব দ্য স্নেক গডেস মনসার আখ্যানকে কয়েক শ বছরের দূরত্ব থেকে ফিরে দেখার এক অসাধারণ প্রয়াস। আখ্যান রচনার গুণ, বর্ণনার গতিশীলতা, ভাষার সুচারু নির্মাণ, কল্পনার সমৃদ্ধ বিস্তার এবং এক অপূর্ব রসবোধ বইটিকে অবশ্য পাঠ্য করেছে। শুধু মিথ নয়, মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস ও সমাজেরও এক সংবেদী বিবরণ এ বইটি।