আমারও একটা প্রেমকাহিনি আছে

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সংকোচে জানাই আজ; একবার মুগ্ধ হতে চাই।
তাকিয়েছি দূর থেকে। এতদিন প্রকাশ্যে বলিনি।
এতদিন সাহস ছিল না কোনো ঝর্ণাজলে লুণ্ঠিত হবার...
—জয় গোস্বামী

বাবা বললেন, ‘মা, শুভ ছেলেটাকে তোর কেমন লাগল বল তো।’
‘কেমন লাগল মানে?’
‘মানে আমার বেশ পছন্দ হয়েছে।’
‘তুমি কোথায় দেখলে তাকে?’
‘ওই তো আমাদের ইউনিভার্সিটির অ্যালামনাই প্রোগ্রামে।’
‘ওখানে দেখেই পছন্দ হয়ে গেল?’
‘দেখে। শুনে। সবচেয়ে ভালো লাগল নামটা। শুভ। মানুষের নামের একটা প্রভাব তার ওপরে পড়ে। শুভ নামের লোকজন তো শুভ হতে বাধ্য।’
‘মানুষের ওপরে তার নামের প্রভাব নিয়ে একটা কলাম লিখে ফেলো। পত্রিকায় দিতে পারবা।’
আমার বাবা মোটামুটি ব্যর্থ একজন লেখক। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স। জীবনে নানা কিছু চেষ্টা করেছেন। এর মধ্যে আছে অ্যাড ফার্মের ব্যবসা, কন্ট্রাক্টরি, চাকরি। কিন্তু কোনোটাই যে খুব ভালোভাবে করতে পেরেছেন তা নয়। তবে মানুষটা ভালো। এখন তাঁর অ্যাড এজেন্সি আছে। তাঁর এজেন্সির মাধ্যমে বিভিন্ন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ছাপা হয়। সেখান থেকে তাঁর আয় আসে। খুব ভালো না। খারাপও না হয়তো। তিনি সাহিত্য পড়তে পছন্দ করেন। পত্রিকায় কলাম লিখে পাঠান। কেউ ছাপে। কেউ ছাপে না। আবুল হাসান চৌধুরী নামে যে লেখকের লেখা আপনারা বিভিন্ন সময়ে পত্রিকায় দেখে থাকেন, তিনিই আমার পিতা।
আমার বাবার ওপর আমার রাগ আছে। এই রাগটা অবশ্য আমার বয়স যখন ১২-১৩, তখন থেকে। তার আগে বাবার ওপরে কোনো রাগ ছিল না। রাগ নাকি অভিমান? অভিমানটা এখনো আছে। কম কম। বাবা জানেন সেই অভিমানের খবর। তাই বাবা আমাকে একটু বেশিই আদর করেন।

বাবা বিয়ে করেছিলেন বেশি বয়সে। তারপর তাঁদের একটা ছেলে হয়। আমার বড়ভাই। তার নাম ছিল ইভান। আড়াই বছর বয়সে ইভান মারা যায়। তারপর মা গর্ভবতী হলেন। বাবা ভেবে রেখেছেন, ইভানই আবার জন্ম নিচ্ছে।
মা ক্লিনিকে। সন্ধ্যা। গোধূলির হলুদ আলো এসে পড়েছে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের বারান্দায়। মাকে ভেতরে নেওয়া হয়েছে, ডেলিভারির জন্য। হঠাৎ একটা কাক ডেকে উঠল। বাবার মনে তখনই কু ডাক। তার মানে কি ছেলে হবে না?
একটু পরে খবর এল ভেতর থেকে। মেয়ে হয়েছে। বাবা প্রস্তুত ছিলেন ছেলে হবে। তিনি আজান দেবেন। মেয়ে হয়েছে শুনে তিনি দোতলার লম্বা করিডর ধরে হাঁটতে লাগলেন। লেবার রুমে গেলেন না। সিঁড়ি ধরে নামতে লাগলেন। বেরিয়ে এলেন পথে। কাক ডাকছে। তিনি নবজাতিকাকে দেখলেন না।
তিনি হাঁটছেন। দূরে চলে যাচ্ছেন। তিনি নবজাতিকাকে দেখবেন না।
ওই নবজাতিকাটিই হলাম আমি।
আমার ১২-১৩ বছর বয়সে আমি সেই গল্প শুনি। আমার সেজ খালা আমাকে এই গল্প শোনান। এরপর থেকে আমি আর বাবার সঙ্গে সহজ হতে পারি না।
কিন্তু বাবা আমাকে আগেও আদর করেছেন। আমার অভিমান দেখে আদরের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাতে কী!
পরে আমার একটা ছোট ভাই হয়েছে। ইরশান। ও থাকে ক্যাডেট কলেজের হোস্টেলে। ও হয়েছে বিদ্রোহী টাইপ। বাবা-মায়ের আদর-টাদর তার ভালো লাগে না। ক্লাস সিক্সে থাকতেই সিগারেট ধরে ফেলেছিল। মাদক না ধরে ফেলে ভয়ে তাকে ক্যাডেটে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার তুলনায় আমি একটু লক্ষ্মী টাইপই আছি। ছবি আঁকতে পছন্দ করি। বাবা চেয়েছিলেন আর্কিটেকচার পড়ি। চান্স পাইনি। তারপর চারুকলা ইনস্টিটিউট। সেখানেও হলো না। হলো একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভালোই আছি। নিরিবিলি ক্যাম্পাস। অল্প ছাত্রছাত্রী। বেশি হইহল্লা নাই। ভালোই লাগে।
বাবা আর আমি বসে আছি আমাদের ফ্যামিলি লিভিং রুমে। সামনে টেলিভিশন।

বাবা বোধ হয় আমার কথায় একটুখানি দুঃখ পেলেন। আমি তাকে কলাম লেখার খোঁটা দিলাম! তিনি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘ছেলেটাকে তোর পছন্দ হয়নি?’
‘আরে কী খালি পছন্দ হয়নি পছন্দ হয়নি করছ, আমি কি তাকে বিয়ে করতে যাচ্ছি নাকি?’
বাবা বললেন, ‘পছন্দ না হলে আর বিয়ের কথা আসবে কোত্থেকে? পছন্দ হলে না হয় একটা কথা ছিল।’
‘পছন্দ হলে বিয়ের কথা আসবে নাকি?’
‘হ্যাঁ। তোর যাকে পছন্দ হবে, তার সঙ্গেই তো তোর বিয়ে দেব।’
‘আরে কী আশ্চর্য ঘটনা, আমার বিয়ের বয়স হয়েছে নাকি!’
‘হয়নি বলছিস, আচ্ছা হয়নি। কিন্তু যখন হবে তখন তো বিয়ে করবিই, নাকি?’
আমি ভ্রু কুঁচকে তীব্র চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ভদ্রলোকের মতলবটা কী!
মা এলেন এই সময়। বললেন, ‘টেলিভিশনে কী দেখছ তোমরা? আমি সিরিয়াল দেখব।’
আমি বললাম, ‘যা খুশি দেখো। আমরা টিভি দেখছি না।’
‘খুব ভালো।’ মা টেলিভিশনের রিমোটটা হাতে নিলেন।
বাবা বললেন, ‘ইভার বিয়ের ব্যাপারে আলাপ করছিলাম।’
মা টেলিভিশন অফ করে দিলেন। চোখেমুখে কৌতূহল ফুটিয়ে বললেন, ‘কী কথা হলো?’
বাবা বললেন, ‘তেমন কিছু না। ওই শুভ ছেলেটাকে তোমার মেয়ের কেমন লাগল, সেটা জিজ্ঞেস করছিলাম।’
মা বললেন, ‘কী বলল।’
বাবা বললেন, ‘আমাকে কিছু বলে নাই। তোমাকে নিশ্চয়ই বলবে।’
আমি বললাম, ‘তোমরা গল্প করো। আমি আমার ঘরে যাই।’
মা বললেন, ‘না না তোরা গল্প করছিলি কর।’
আমি বললাম, ‘না না। গল্প করছিলাম না। এমনিতেই বসে ছিলাম।’
বাবা বললেন, ‘শুভর বাবা তো এত মেরিটোরিয়াস ছিল না। তার ছেলে এত মেরিটোরিয়াস হয়ে গেল কীভাবে? একেবারে আইআইটিতে স্কলারশিপ পেল।’
মা বললেন, ‘না না। হাসনাত ভাইকে তো আমার ইন্টেলিজেন্টই লাগে।’
বাবা বললেন, ‘শুভ ছেলেটা পড়াশোনায় ভালো। পড়াশোনায় ভালো ছেলেদের সুবিধা হলো, তারা খারাপ ছেলেদের সঙ্গে মেশে না। এদের স্বভাবচরিত্রও ভালো হয়।’
আমি বললাম, ‘শোনো, এত কায়দা করে না জানিয়ে তোমরা একটা ক্যারাক্টার সার্টিফিকেট একবারে দিয়ে দাও।’
মা বললেন, ‘না না, আজকাল চারদিকে নানা ধরনের ঘটনা ঘটছে। কত কী শুনি। আজকালকার দিনে একটা ভালো ছেলে পাওয়া যা-তা কথা না। আমার বান্ধবীগুলানের কত জনের ছেলেমেয়েদের যে ডিভোর্স হয়ে গেল। কত ধুমধাম করে বিয়ে হয়, তারপর শুনি, না, আলাদা থাকে। অ্যাডজাস্ট হয় নাই। কাজেই সব সময় আল্লাহর কাছে দোয়া করি আমার মেয়েটার যেন একটা ভালো ছেলে জোটে।’
আমি বললাম, ‘মা, তোমার কি কোনো কাজ নাই? সব সময় এই একটা দোয়াই করছ যেন তোমার মেয়ের একটা ভালো ছেলে জোটে। ঘরে কি তোমার মেয়ের সংখ্যা বেশি হয়ে গেছে? বুঝলাম ছেলে চেয়েছিলে। পাও নাই। তাই মেয়েটাকে বিদায় করে দেবার জন্য একেবারে উঠে পড়ে লেগেছ।’
মা বললেন, ‘কিসের ভেতরে কী। আজকালকার ছেলেমেয়েরা তো অ্যাফেয়ার করবেই। ভুল জায়গায় ভুল মানুষের হাতে পড়ার চেয়ে একটা ভালো ছেলে দেখেশুনে বেছে নিলেই তো হয়। তাই না?’
‘সেটাকে অ্যাফেয়ার বলে না। সেটাকে বলে সেটল ম্যারেজ।’ বলে আমি উঠে চলে গেলাম আমার রুমে। শব্দ করে দরজার কবাট দিলাম ভেজিয়ে।
একটু পরে দেখি, মোবাইল ফোন ফেলে এসেছি। উঠতে হলো ফের। একটু দূরে দাঁড়িয়ে শুনতে পেলাম মা-বাবার কথোপকথন:
বাবা: তোমার কি মনে হয়, ইভার কোনো অ্যাফেয়ার আছে?
মা: না। আমার মনে হয় না। থাকলে আমি জানতাম।
বাবা: কীভাবে জানতে।
মা: মুখ দেখলেই বুঝতাম।
বাবা: ও তোমাকে মুখ দেখতে দিত। ও তো সারাক্ষণ ওর ওই গোস্সাঘরে নিজের মুখটা লুকিয়ে রাখে।
মা: তবুও। মা-মেয়ের একটা আলাদা ব্যাপার থাকে। সেটা তুমি বুঝবে না।
বাবা: শুভ ছেলেটা এত ভালো। ইভু যদি ছেলেটাকে পছন্দ করে এগিয়ে যেত, ভালোই হতো। কী বলো।
বাবা-মার এই উদ্দেশ্যটা আমি ঠিক ধরতে পারছি না। তাঁরা এই ছেলেটাকে কোত্থেকে কীভাবে ধরে এনে আমার সামনে ছেড়ে দিতে চাইছেন?
আমি কাশি দিলাম। স্যান্ডেল দিয়ে মেঝেতে শব্দ করলাম। তারপর বললাম, ‘আমার মোবাইল ফোনটা যে কই রাখলাম। ধেত্তেরি।’
আমার মুখ দেখে মা আসলে কচু বুঝবেন। আমি তো আসলে ওই শুভ ছেলেটার প্রতি আগ্রহী হয়ে পড়েছি। আমার মনে হয়, আরেকটু কথাবার্তা হলেই আমি ওর প্রেমে পড়ে যাব। মা আমার মুখ দেখে এইটা বুঝতে পারলেন না?

এবারের বইমেলায় প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত আনিসুল হকের উপন্যাস আমারও একটা প্রেমকাহিনি আছে থেকে একটি অধ্যায়