
আমি আজীবন শহরে মানুষ। ছোট হোক বড় হোক, সব শহরের চেহারা, মেজাজ গ্রাম থেকে ভিন্ন। গ্রামে আমি প্রায় কখনো থাকিনি। গ্রামের জীবনও তেমনভাবে ভেতর থেকে দেখার সুযোগ হয়নি। গ্রাম আমাকে তেমন আকর্ষণও করেনি। আমার দুটো কি তিনটের বেশি কবিতা হবে না, যার পটভূমি গ্রাম।
মনের সংবেদনশীলতাটা যখন সবচেয়ে বেশি, সেই সময়টা কেটেছে কলকাতায়। সৌভাগ্য যে কলকাতাকে আমি প্রথম জীবনেই পেয়ে যাই। আমাদের সময় কলকাতাই ছিল বাংলা সাহিত্যের তীর্থভূমি। প্রেসিডেন্সি কলেজে আমি অর্থনীতি নিয়ে পড়তে গেলাম, এরপর হয়ে গেলাম ওই কলেজের রবীন্দ্র সম্পাদক। ওখানে যাওয়ার পর প্রেমে পড়া, রবীন্দ্রনাথকে স্বয়ং চোখে দেখা কিংবা কবিতায় রুচিবোধ বদলে যাওয়া—এসব কি কলকাতাকে না পেলে হতো!
কলকাতাই তখন এ উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় শহর, নগর। এর মন ও মানসিকতায় ডুবে ছিলাম আমি। নাগরিকতা বলতে তো শুধু ইট, কাঠ, পাথর, কংক্রিটের ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, হাসপাতাল, হোটেল, ট্রাক, বাস, মোটর গাড়ি, ট্রেন ইত্যাদি বোঝায় না। নাগরিকতাটা আসলে মনের, গ্রামের মন থেকে যা ভিন্ন; এটি ধরা পড়ে বক্তব্যে, বিষয়ভঙ্গি ও কথা বলার ধরনে। আমার প্রথম দিকের যে কবিতাগুলো যেমন ‘ডাইনামো’, ‘ট্রেন’, ‘ডি এইচ রেলওয়ে’, ‘ঘোড়সওয়ার’, ‘বাংলার মেয়ে’—এগুলো কি কলকাতায় কিংবা শহরে না থেকে লেখা যেত?
অনেক দিন আগে একটা কবিতায় লিখেছিলাম, ‘প্রচুর পয়সা কখনো চাইনি, বিত্তের পিছে ছুটতে যাইনি।’ মানবিকতাবোধকেই জীবনের সারবস্তু মেনেছি। শহরের বৈচিত্র্য, বৈষম্য ঐক্য-অনৈক্য সংগতি, শৃঙ্খলা-বিশৃঙ্খলার মধ্যে বেড়ে না উঠলে কি এ বোধে পৌঁছতে পারতাম?
সেই ১৯৩৬-৩৭ থেকেই আধুনিক কবিতার সঙ্গে আমি সংশ্লিষ্ট। আমি তখন কলকাতাবাসী। আমি যদিও সুরেলা কবিতা লিখি না, কবিতা সম্পর্কে আমার নিজের ধারণা দানা বেঁধে ওঠার পর থেকে অন্তত সে রকম আর লিখিনি, তবুও ভুলিনি যে সব ভালো কবিতায় ছন্দ, ধ্বনি, অনুপ্রাস অপরিহার্য। তবে বেশি মিষ্টি কবিতায় থাকে বেশি মাত্রায় ভাবালুতায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা।
রবীন্দ্রবলয় থেকে যখন বেরিয়ে এলাম, তখনো আমার বয়স খুব কম। এইমাত্র যেসব কথা লিখলাম, ওই বয়সে এই কথা ভাবার সাহস পেয়েছিলাম তিরিশের কবিদের কাছ থেকে, তাঁদের সান্নিধ্যে। এসব তো আমার কলকাতার স্মৃতি—ভুলি কেমন করে! নতুন কবিতার আন্দোলন, আধুনিক বাংলা কবিতা, তখন সবে দানা বেঁধে উঠেছে।
মফস্বল শহর থেকে কলকাতায় এসে প্রেসিডেন্সি কলেজে ঢুকেছি। সমর সেন সেই কলেজ থেকে বেরিয়ে গেছেন কি বেরোননি। তাঁর লেখা নিয়ে খুব মাতামাতি হচ্ছে। অধ্যাপকেরা পছন্দ করছেন না, সুবোধ সেনগুপ্ত, সোমনাথ মৈত্র, গৌরী ভট্টাচার্যরা রবীন্দ্রনাথেই ঢুবে আছেন। ক্বচিৎ নজরুলের নাম করেন। কিন্তু সমর সেন মনের ভেতর ঢুকে তার কাজ করে গেছেন। গদ্যকবিতা তো রবীন্দ্রনাথ কত আগেই লিখেছেন। কিন্তু সমর সেন একেবারেই আনকোরা। তাঁর ভাষা, ছন্দ, বলার ভঙ্গি রবীন্দ্রনাথ থেকে যোজন যোজন দূরে। তাঁর কবিতায় কাব্য ছিল, কাব্যকল্পনা ছিল না। সমর সেনের গদ্য কবিতা যে কীভাবে সমগ্র বাংলা কবিতার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল! আফসোস, সে স্বীকৃতি তাঁর জোটেনি।
কলকাতা যাপন আমার কাছে জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় বলে মনে হয়। কারণ, দেশ ভাগ না হলে আমি হয়তো আরও ভালো লিখতে পারতাম—এই আক্ষেপ কি মুছে ফেলা যায়? তা না হলে িক বলতাম: ‘এই কি আমার প্রথম প্রেয়সী? ঘাসের গালিচা নেই, ঘামেভেজা পার্কে এসে বসি। স্মৃতির সুড়ঙ্গ দিয়ে তিন দশকের পোকাগুলো কিলবিল ক’রে আসছে ধেয়ে, কানের ভিতরে তুলো যত পাতলা হয়ে আসে। ওহে বিদেশিনী কল্লোলিনী, আমাকে প্রথম পাঠ দিয়েছিল যে ত্রস্ত হরিণী সে কোথায়? তুমি তাকে চেনো নাকি?’ (‘রবিঠাকুরের কাছে ঋণ’)।
কলকাতার পথের অলিগলি বেয়ে কত হেঁটেছি, কফির টেবিলে আড্ডা—সেই সব স্মৃতিময় দিন কি আর ফিরে পাওয়া যাবে! কলকাতার কথা মনে এলে আফসোস জাগে এভাবেই।
..........
প্রথম আলো থেকে লেখা চেয়ে অনুরোধ করলে সম্প্রতি অনুেলখকের সাহায্যে এই গদ্যটি লিখেছিলেন কবি।