
কলকাতার কবি রণজিৎ দাশ বাংলাদেশে এসেছিলেন কয়েক দিন আগে। সে সময় আধুনিকতা, নিজের কাব্যদর্শন, কবিতাসহ নানা বিষয়ে প্রথমআলোর মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলতাফ শাহনেওয়াজ
আলতাফ শাহনেওয়াজ: আপনার কবিতা পড়লে মনে হয়, কবিতা আপনার কাছে হাজির হয় প্রথমত আইডিয়ার মোড়কে, পরে আসে দার্শনিক উপলব্ধি। সর্বশেষ ধীরে ধীরে পুরো ব্যাপারটি কবিতা হয়ে ওঠে। কবিতাকে এই যে আইডিয়ার মধ্য দিয়ে আবিষ্কার করা, এবং তার ভেতরে দর্শনের উপলব্ধি—আপনার মধ্যে এটি কীভাবে ঘটে?
রণজিৎ দাশ: কবিস্বভাব থেকেই এই কাব্যদর্শন তৈরি হয়। কাব্যদর্শন মানে তো ঠিক দর্শন নয়। নিজের কবিতার দর্শন সম্পর্কে সহজ ভাষায় যদি বলি, আমার ধারণা, আমার ত্রিশ বছর বয়সের পর থেকেই আমি স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছি, একটা দার্শনিক মাত্রা ছাড়া জগতের কোনো বস্তু বা চিন্তা আমার কাছে কাব্যের বিষয় হিসেবে খুব অ্যাগ্রি করে না। অর্থাৎ ফিলিংকে থটে পরিণত করা। এটি সাহিত্যে খুবই আলোচিত বিষয়, যেটি এলিয়ট বিশদভাবে বলে গেছেন। তো, আমি ওসব লেখাপড়া করার আগে আপনা থেকেই এই প্রবণতা আমার মধ্যে ছিল। যেকোনো বস্তু, দৃশ্য, কল্পনা, অনুভূতি, আবেগ—সবকিছুর দার্শনিক মাত্রাটা কী—এটা বোঝার চেষ্টা করা আপনা থেকেই আমার কবিস্বভাবের অংশ হয়ে গেছে। সেখান থেকেই আমার কবিতার দার্শনিকতাটা এখনো চলছে।যত দিন লিখব, চলবে।
আলতাফ: আইডিয়া এবং দার্শনিকতা—আপনার যেটা শক্তি—কখনো সেটাই কি আপনার কবিতাকে সীমাবদ্ধ করে ফেলে না?
রণজিৎ: আমি এমনটি মনে করি না। কবিতায় যে আইডিয়ার কথা তুমি বলেছ, এটার সম্পর্কে তোমাকে হেগেলের একটা কথা বলি। তিনি বলতেন, কবিতা তো শব্দ দিয়ে তৈরি হয় না। কবিতা তৈরি হয় পোয়েটিক আইডিয়া দিয়ে। সুতরাং যেটা ভালো কবিতা সেটা যেকোনো ভাষায় লেখা যেতে পারে। হেগেলের এই তত্ত্ব একসময় বিরাট একটা বিক্ষেপ তুলেছিল ইউরোপে। তাঁর মতে, যে কবিতার ভালো অনুবাদ হবে, সেইটিই ভালো কবিতা। তাঁর তত্ত্বটা এ রকম। সেই তত্ত্বে আমি একেবারেই বিশ্বাস করি না। কিন্তু যে কথাটা, পোয়েটিক আইডিয়াটা কীভাবে আসে? আমার মনে হয়, এটা যার আসে তার আসে, যার আসে না তার আসে না। ছোটবেলা থেকে স্কুলের খাতায় লিখে লিখে আমার একটা ধর্ম তৈরি হয়েছে। আমার প্রবণতা আমাকে যে কবিতা লিখতে শেখায়, প্রেমের কবিতা, যৌনতার কবিতা, চিন্তার কবিতা, দার্শনিকতার কবিতা—এই চার রকমের তো আমার লেখালেখি—এই সবগুলোর মধ্যেই দর্শনচিন্তার একটা জায়গা আছে। এটা সীমাবদ্ধতা নয়। প্রত্যেক কবিই তাঁর কাব্যচরিত্রের দ্বারা সীমাবদ্ধ। রবীন্দ্রনাথ, গ্যেটে—এঁরাও সীমাবদ্ধ। কিন্তু দেখো, নক্ষত্রলোকের মতো তাঁদের বিশাল কাব্যজগৎ। সুতরাং সীমাবদ্ধতা একটা ভালো জিনিস। পিকাসো সারা জীবন কিউবিজমে একই জিনিস এঁকে গিয়েছেন—সেটিই তাঁর শক্তি। তাই এটি সীমাবদ্ধতা নয়, এটি শক্তি। এবং এটি স্পষ্ট করা উচিত।
আলতাফ: এক সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছেন, ‘আমি সত্যিই বিষয় ছাড়া কবিতা লিখতে পারি না, লিখতে চাইও না।’ বিষয় ধরে কি কবিতা লেখা সম্ভব?
রণজিৎ: তাহলে কী ধরে কবিতা লেখা সম্ভব? কবিতা যে মুহূর্তে একজন লিখছে, একটা বাক্য লিখছে, সেটার মধ্যে একটা বিষয় ঢুকবে, সে তুমি যত প্রহেলিকা লিখতে যাও না কেন। যত খুশি অনর্থ তৈরি করো না কেন। কবিতা কি এমন: একটা দুর্বোধ্য ভাব আসবে, তাতে ততধিক দুর্বোধ্য কবিতা হবে? শোনো, ওই সব দুর্বোধ্য কবিতা কেউ পড়েও না, আহা-উহুও করে না। আমি খুব সচেতনভাবেই বলছি, যে কবিরা প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, শুধু আমি নই, প্রত্যেকে, সেই আদিকাল থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত, প্রত্যেকের কবিতা অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাবার্থসম্পন্ন। সেই ভাবার্থটাই বিষয়। যে কল্পনাটি আসছে সেটি বিষয়, যে চিত্রকল্পটি আসছে সেটি বিষয়।
আলতাফ: গত শতকের সত্তরের দশকের শেষার্ধে কলকাতায় নতুন কবিতার দিকে যাত্রা শুরু করেছিলেন আপনারা। এর কিছুদিন পরে আশির দশকে বাংলাদেশে শুরু হলো নতুন রকম কবিতা লেখার চর্চা। একই বাংলা ভাষায় প্রতিবেশী দুই ভূখণ্ডে কাছাকাছি সময়ে নতুন ভাষায় কবিতা লেখার যে জোয়ার এল, এই ব্যাপারটি আপনি কীভাবে দেখেন? এটি কি কাকতালীয়, নাকি এর পেছনে কোনো ঐতিহাসিক সূত্র আছে?
রণজিৎ: সমাজ জীবনে কোনো কিছুতেই কাকতালীয় কিছু নেই। পরিষ্কারভাবে সাহিত্যের ঐতিহ্যের সূত্র থেকেই এই জিনিসগুলো ঘটে। রবীন্দ্রনাথ এলেন কীভাবে? তার আগে মঙ্গলকাব্য, সেখান থেকে বিহারীলাল চক্রবর্তী; কিংবা মাইকেল মধুসূধন দত্তের কথা ধরো, ভাবা যায়, তিনি মিল্টনের মতো কবিতা লিখে ফেললেন! অথচ মিল্টন পড়েনইনি। এগুলো তো আরও বৈপ্লবিক। তার তুলনায় আমাদের সত্তর-আশি দশকের যে বাঁকবদল, ভাষাবদল বা কাব্যের রহস্যময়তা, ইঙ্গিতময়তা ও সংকেতময়তা—এ তো অনেক মাইনর জিনিস। এটি তো ঘটতেই থাকবে। প্রত্যেক কবির দেখার চোখ পাল্টে যাচ্ছে, সমাজ বদলাচ্ছে। প্রবণতাও যাচ্ছে বদলে। বিদেশের সব কবিতা চলে আসছে। গিয়ম অ্যাপলেনিয়র চলে এসেছেন, পাবলো নেরুদার কবিতা চলে এসেছে। মোট কথা, বিশ্বসাহিত্যে একটা পরিবর্তন ঘটে গেছে তখন। সুররিয়ালিজম আসার পর সারা পৃথিবীর সাহিত্যে একটা বাঁকবদল ঘটে গেছে। বিশদভাবে বলতে গেলে এই সুররিয়ালিজমের ধারাই বিভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়েছে বিশ্বজুড়ে। এটি যেমন আফ্রিকার কবিতাতে ঢুকেছে, ভারতবর্ষের কবিতাতে ঢুকেছে, বাংলাদেশের কবিতাতেও ঢুকেছে। ফলে এটি সম্পূর্ণ সাহিত্যের এবং ঐতিহ্যের সূত্রমতেই ঘটেছে।

আলতাফ: আধুনিকতা—পশ্চিমা আধুনিকতা নিয়ে আপনার রয়েছে নিজস্ব মত। এমনকি নিজেকে ‘আধুনিক কবি’ বলতেও আপনি নারাজ। কেন?
রণজিৎ: সত্যিই আমি আধুনিক কবি নই। কারণ, আধুনিকতার তত্ত্বজ্ঞান দাঁড়িয়ে আছে অস্তিত্ববাদের ওপর। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে নাস্তিক্যবাদী অস্তিত্ববাদ। ইংরেজিতে একে বলে ‘অ্যাথিস্টিক একসিস্টেনশিয়ালিজম’, যার প্রথম প্রবক্তা জাঁ পল সার্ত্রে। কিন্তু এর শুরু হয়েছে কিয়ের্কেগার্দ থেকে। সব শিল্পীর আধুনিক জীবনের আধুনিকতার দর্শনটি দাঁড়িয়ে আছে এই অস্তিত্ববাদের ওপর। এই অস্তিত্ববাদের মূল কথা তো সুধীন্দ্রনাথ দত্ত লিখেই গেছেন, ‘বিরূপ বিশ্বে মানুষ মূলত একাকী’। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ’। এবার তুমি বলো, কোন পতাকাতলে তুমি যাবে? আনন্দযজ্ঞের পতাকাতলে আমি বহু আগে যোগ দিয়েছি। আমি জানি, এই পৃথিবীতে আনন্দের শেষ নেই। অপার রহস্যময় এই জগৎ। ঈশ্বরের ধারণা এখানে আসতে বাধ্য। এই যে আমার সন্তান কিংবা আমার বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে অথবা একটা ফুলবাগানে ঢুকে এত আনন্দ হয় আমার! এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো অলৌকিক শক্তি কাজ করছে। মানুষের চক্ষু দিয়ে তো কিছু বোঝা যায় না। এ কারণেই ধর্মকে আমি খুব শ্রদ্ধা করি। আমি মনে করি, মানুষের ধর্মবোধ মানবচেতনার একটা চূড়ান্ত জায়গা। কিন্তু দুঃখের সঙ্গেই বলি, সেই মানুষের চরিত্রে আজ পিশাচ ঢুকে আছে। সেই পিশাচ তাকে ধর্মান্ধতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ফলে ধর্মবোধটি একটি বিকৃত বিষাক্ত জিনিসে রূপান্তরিত হচ্ছে। যে কারণে সভ্যতার এখন এত সংকট। কিন্তু আসলে তো ধর্ম! ধর্মের নৈতিকতা, ধর্মের চেতনা, আধ্যাত্মিকতা—এগুলোকে ভীষণ মান্য করি আমি। এখানে আমি আধুনিকতা থেকে বিরাট দূরে। তবে বলা দরকার যে ধর্ম মানে আমার কাছে তথাকথিত হিন্দু বা মুসলমানের ধর্ম নয়।
সমাজে ব্যক্তি যে সময় ধর্মের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে নাস্তিকতায় আশ্রয় নিল, মানবধর্মে আশ্রয় খুঁজল—ইতিহাসে এটি অবশ্যই বিরাট ইতিবাচক ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত। কিন্তু এই ঘটনার চার শ বছর পরে সেই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ একটা চরম দানবিক চেহারা নিয়েছে। ব্যক্তি মানুষের অহং মানুষকে আজ অন্ধ করে দিয়েছে। প্রতিমুহূর্তে এখন সে মোবাইল ফোনে সেলফি তুলে বেড়াচ্ছে। অহংয়ে অন্ধ হওয়ার প্রকট প্রমাণ এটি। এই অন্ধত্বের যুগ শুরু হয়েছে বোদলেয়ারদের সময় থেকে। কী জন্য এ রকম ঘটেছে? মুহূর্তেই কিন্তু এ অবস্থা থেকে বের হওয়া সম্ভব, যদি রবীন্দ্রনাথ, গ্যেটে—এঁদের কবিতা পড়া যায়। দান্তের মহাকাব্য যদি পড়ো, সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারবে, হায়, আমি কোন গুহায় ঢুকে পড়েছি! আমি কি পানশালার অন্ধকারে বসে সারা জীবন একা একা কাটাব, বিয়ার সামনে নিয়ে? এত বড় জগৎ সামনে; তার বেদনাপ্রবাহ, আনন্দপ্রবাহ, মানুষে মানুষে সম্প্রীতি, তার ওপরে সমাজ চলছে, সেসব আমি কিছুই বুঝব না?
আলতাফ: আপনার এবং সাজ্জাদ শরিফের সম্পাদনায় প্রকাশিত বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কবিতা সংকলনটির তৃতীয় সংস্করণ বেরিয়েছে এ বছর। সংকলনটি নাকি পশ্চিম বাংলায় বেশ জনপ্রিয় হয়েছে? এ বিষয়ে একটু বিস্তারিত জানাবেন?
রণজিৎ: হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। এই সংকলন আমার জীবনের এক আশ্চর্য কাহিনি! ২০০৮ সালে বাংলাদেশের জাতীয় কবিতা উৎসবে যোগ দিতে এসেছিলাম ঢাকায়, তখনই মনে রোখ চেপেছিল যে এপার-বাংলা ওপার-বাংলা যুগ্ম সংকলনের একঘেয়েমি আর নয়, শুধু বাংলাদেশের কবিদের কবিতার একটি বড় সংকলন প্রকাশ করব কলকাতা থেকে। একেবারে পঙ্গুর গিরিলঙ্ঘনের বাসনা! কারণ, বাংলাদেশের কবিতা সম্পর্কে আমার বিস্তৃত জ্ঞান খুবই কম। সুতরাং যোগ্য সঙ্গী প্রয়োজন। ঢাকাতেই কবিবন্ধু সাজ্জাদ শরিফকে প্রস্তাব দিলাম সংকলনটির যুগ্ম সম্পাদক হওয়ার জন্য। সাজ্জাদ এক কথায় রাজি হয়ে গেল। ঠিক হলো, একেবারে কবি জসীমউদ্দীন থেকে শুরু করে আশির দশকের শেষ অবধি কবিদের বাছাই কবিতা নিয়ে তৈরি হবে সংকলনটি। কিন্তু এত বড় সংকলনের প্রকাশক কোথায় পাব? পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত কবিদের কবিতা-সংকলনেরই তেমন কাটতি নেই, সেখানে বাংলাদেশের অচেনা কবিদের সংকলন কে ছাপতে চাইবে? আমি কলকাতায় ফিরে ভয়ে ভয়ে প্রস্তাব দিলাম আমার বইয়ের প্রকাশক সপ্তর্ষি প্রকাশনের সৌরভ মুখোপাধ্যায়কে। আশ্চর্যের ব্যাপার, বিরাট আর্থিক ঝুঁকি সত্ত্বেও সৌরভ শুধু আমার মুখ চেয়ে এক কথায় রাজি হয়ে গেল! বাকিটা, যাকে বলে, ইতিহাস! সংকলনটির ব্যাপারে আমাকে আগাগোড়া উৎসাহ দিয়ে গেলেন কবি শঙ্খ ঘোষ, ২০০৯ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি কলকাতায় সংকলনটির আনুষ্ঠানিক প্রকাশও করলেন তিনি। সেই অনুষ্ঠানে আমরা নিয়ে গেলাম সস্ত্রীক সাজ্জাদ শরিফকে। এবং মাত্র আট মাসের মধ্যে সংকলনটির প্রথম সংস্করণ নিঃশেষিত হয়ে গেল! অকল্পনীয় ঘটনা, আমি ও সৌরভ হতবাক।
আলতাফ: এই সংকলন নিয়ে বাংলাদেশে বেশ আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে...
রণজিৎ: হ্যাঁ, সংকলনটি নিয়ে বাংলাদেশে প্রবল সমালোচনার ঝড় উঠেছে। অনেক যোগ্য কবি বাদ পড়ে গেছেন এবং অযোগ্য কবি ঢুকে পড়েছেন—এই অভিযোগে। আমার বক্তব্য হচ্ছে, কোনো সংকলনই সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত হয় না, আমাদেরটিও যে নয়, এ তো স্বাভাবিক। যা-ই হোক, বাংলাদেশের বিভিন্ন মহলের পরামর্শ নিয়ে আমরা দ্বিতীয় সংস্করণে আরও ২৫ জন কবিকে নিয়েছি। সব মিলিয়ে ৮০ জন কবির পাঁচ শতাধিক কবিতা সংকলিত হয়েছে দ্বিতীয় সংস্করণে, সেটি বেরিয়েছিল ২০১১ সালের জানুয়ারিতে। ইতিমধ্যে আনন্দবাজার পত্রিকাসহ বেশ কয়েকটি কাগজে সংকলনটির উচ্চ প্রশংসা বেরোল।
আলতাফ: কলকাতার তরুণ কবিরা সংকলনটিকে কীভাবে নিয়েছেন?
রণজিৎ: আমি নিজে কলকাতার একাধিক তরুণ কবির ফোন পেয়েছি। তারা বলল, ‘দাদা, কী দারুণ সংকলন করেছেন! বাংলাদেশের কবিতা যে এত ভালো আর বৈচিত্র্যময়, সেই কবিতার স্বাদ এবং শক্তি যে এত আলাদা, এ তো আমরা জানতামই না!’ তাদের কথা শুনে আমার সব কষ্ট সার্থক হয়ে গেল। এ ছাড়া সংকলনটি তার প্রথম সংস্করণেই ভারতের খ্যাতনামা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কম্পারেটিভ লিটারেচার’ বিভাগের পাঠ্যসূচির অন্তর্গত হলো। এবং কিছুদিন আগে শুনলাম সংকলনটি যাদবপুরের বাংলা বিভাগের পাঠ্যসূচিরও অন্তর্গত হয়েছে, স্নাতক স্তরে একটা সেমিস্টারে শুধু এ বইটিই পাঠ্য। আমাদের পক্ষে এর চেয়ে বেশি আনন্দের আর কী হতে পারে? কিছু ভুলত্রুটিসহ এই সংকলনে প্রায় সত্তর বছরের পরিসরে বাংলাদেশের কবিতাকে আমরা পশ্চিম বাংলার পাঠকদের কাছে এত সফলভাবে তুলে ধরতে পেরেছি, আমার ক্ষুদ্র কবিজীবনের এটি এক শ্রেষ্ঠ কাজ বলেই আমি মনে করি। এই সংকলনটি সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গে বাংলা কবিতা সংকলন প্রকাশনার ইতিহাসে একটি সবচেয়ে অভাবনীয় বেস্টসেলার! এবং এই আশ্চর্য ঘটনার সম্পূর্ণ কৃতিত্বই তো বাংলাদেশের কবিতার। তো, এই ২০১৬-তে বেরোল এটির তৃতীয় সংস্করণ, একই সঙ্গে হার্ডবাউন্ড এবং পেপারব্যাক সংস্করণে। জয় হোক বাংলা কবিতার!
আলতাফ: সাম্প্রতিক বাংলাদেশ বিষয়ে ভারতের বুদ্ধিজীবীদের ধারণা কী, সে বিষয়ে কিছু বলবেন?
রণজিৎ: দেখো, ভারত একটা বিশাল দেশ। এর বিভিন্ন প্রান্তের ও ভাষার বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশ সম্পর্কে কী ভাবছেন, তা জানা আমার পক্ষে অসম্ভব। আমি পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবীদের কথা বলতে পারি। তাঁরা প্রায় সবাই স্বাধীন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রগতিতে আস্থাশীল এবং বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশের সত্তা ও সম্ভাবনা বিষয়ে অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। বস্তুত আমরা অনেকেই বাংলাদেশকে অখণ্ড বাঙালি জাতিসত্তারই একটি সম্প্রসারিত সার্বভৌম রূপ হিসেবে দেখি, তাকে আদর করি, সমাদর করি, সম্মান করি। তার সুখ-দুঃখে শরিক হতে চাই। এ কথাটা সত্য। এবং এই কথাটা বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের কিন্তু বুঝতে হবে, কারণ এটি আমাদের অন্তরের সত্য আবেগের কথা। এই হৃদয়-সম্পর্কের জায়গাটিতে যেন কখনো আমাদের মধ্যে ভুল-বোঝাবুঝির অবকাশ না ঘটে। তাহলে আমরা দুতরফই শক্তিহীন এবং ভ্রাতৃহীন হব। আমি ঢাকার বন্ধুদের দেখাব বলে ভারতের বিখ্যাত চিন্তাবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী রামচন্দ্র গুহের বাংলাদেশ বিষয়ে একটি সাম্প্রতিক প্রবন্ধের কপি নিয়ে এসেছি, সেই লেখা থেকে দু-একটা কথা এখানে শোনাতে পারি। রামচন্দ্র গুহ ২০১৫ সালের নভেম্বরে প্রথম বাংলাদেশে এসেছিলেন। বহু সমস্যার মধ্যেও বাংলাদেশের উন্নতির লেখচিত্রটি বুঝতে পেরে অভিভূত হয়েছিলেন। এই প্রবন্ধে ভারতীয় পাঠকগোষ্ঠীকে তিনি সে কথাই জানিয়েছেন।
একসময় কলকাতার উন্নাসিক হিন্দু বাবু সম্প্রদায় যে পূর্ববঙ্গের মুসলমান ‘বাঙাল’দের হেয় চোখে দেখত, সে কথার ব্যঙ্গাত্মক উল্লেখ করে তিনি স্পষ্টভাবে ইংরেজিতে যা লিখেছেন, সেটি বাংলা করলে দাঁড়ায় এ রকম: (বর্তমানে) ‘এই ঘৃণিত বাঙালেরা একুশ শতকের জটিল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অনেক বেশি প্রস্তুত। বইপ্রেমী ভদ্রলোকেরা যেখানে মার্কিন অ্যাকাডেমির জন্য দলিলদস্তাবেজ তৈরি ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ লেখা লিখেই যাচ্ছেন, সেখানে বাংলাদেশের কৃষকেরা শ্রমিক ও উদ্যোক্তা হয়েছেন, যাঁরা দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রেখে যাচ্ছেন। বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন সৃষ্টি এবং তার প্রসারে এই মানুষদের প্রাণ ও কর্মশক্তি ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে... যেগুলোর সমকক্ষ প্রতিষ্ঠান ভারতে নেই।’ (দ্যটেলিগ্রাফ, কলকাতা, ২৮ নভেম্বর ২০১৫)। রামচন্দ্র গুহের মতো পণ্ডিতের সংযমী কলমে এমন পর্যবেক্ষণ এক প্রভূত প্রশংসা বৈকি।
একেবারে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, যখনই আমি কোনো সর্বভারতীয় সাহিত্য সম্মেলনে যাই, তখনই আমাকে সান্ধ্য আড্ডায় নানা রাজ্যের কবি-লেখকদের সঙ্গে প্রায়ই বাংলাদেশের সাহিত্য ও রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে হয়। কারণ, এসব সম্মেলনের পুস্তিকায় আমার পরিচিতিতে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কবিতা সম্পাদনার উল্লেখ থাকে। এসব আড্ডায় আমি প্রায় বাংলাদেশের সেলফ-স্টাইলড গুডউইল অ্যাম্বাসেডারের ভূমিকা নিই। সবাইকে বলি, ‘একবার অন্তত বাংলাদেশে বেড়াতে যাবেন। কী অপূর্ব সুন্দর দেশ! মানুষজন কত উষ্ণ আর আন্তরিক! নদীমাতৃক দেশ কাকে বলে, এই কথাটা ভৌগোলিক ও আধ্যাত্মিকভাবে বুঝতে হলে আপনাকে বাংলাদেশে যেতেই হবে।’ এসব আড্ডায় আমি দেখি, সব ভারতীয় লেখকের মনেই বাংলাদেশ সম্পর্কে এক আন্তরিক আগ্রহ, ইতিবাচক ধারণা। তাঁরা কেউ রাজনীতি বেশি বুঝুন কিংবা কম বুঝুন, প্রায় সবাই দুনিয়াজোড়া সন্ত্রাসবাদের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশকে একটি ব্যতিক্রমী আশার আলো হিসেবে দেখতে পান এবং দেখতে চান। বাকি দুনিয়ার উৎসুক চোখের সামনে এই আশার আলোটিকে জাগিয়ে রাখা বাংলাদেশের এক মহান দায়িত্ব।