আমেরিকার মাতৃসড়ক

গায়ে ছেঁকা দেওয়া মরুময় আবহাওয়া, লুক্সর নামের বিশাল পিরামিড আকৃতির হোটেলের সামনে স্ফিংকসের মূর্তি, অবিকল খেজুরগাছের মতো দেখতে পামবিথীসহ লাস ভেগাস শহরের আরবীয় আবহ ছাড়িয়ে বেশ কিছুদূর গেলে পথে পড়ে হুভার ড্যাম। গত শতাব্দীর ত্রিশের মহামন্দার সময় তৈরি কলোরাডো নদীতে দেওয়া এই বাঁধ জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করলেও নেভাদার উল্লেখযোগ্য ট্যুরিস্ট আকর্ষণও বটে। পথে যেতে যেতে বাসের গতি কমিয়ে প্রফেসরের মতো দেখতে আমাদের গাইড ম্যানুয়েল এককালে বোল্ডার বাঁধ নামে পরিচিত এই বাঁধটির মাহাত্ম্য বোঝাতে গিয়ে জানায়, এটির কারণে সৃষ্ট মিড হ্রদটি জল ধারণের পরিমাণে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় হ্রদ। ট্যুরিস্ট বাসের জানালা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মেরে বাঁধ সৃষ্ট জলাধারের একাংশ দেখতে পেলেও মূল বাঁধের কিছুই দেখতে পাই না। অবশ্য আমাদের গন্তব্য অন্য কোথাও বলে ভেতরে যাওয়ার কথা ছিল না, আর ভেতরে ঢুকলেও উল্লেখযোগ্য কিছু দেখা হতো কি না, কে জানে। ১৯৩৭-এ বাঁধটি তৈরির এক বছর পর থেকে এটা দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু ১৯৪১ সালে পার্ল হারবারে আচমকা জাপানি হামলার পর সংগত কারণে বন্ধ রাখা হয়। পরবর্তী সময়ে আবার চালু হলেও ২০০১-এ টুইন টাওয়ার ধ্বংসের জের ধরে নিরাপত্তার জন্য সাময়িক বন্ধ করার পর এখন যদিও খোলা হয়েছে, তবে ব্যবস্থা এমন কঠোর যে দর্শনার্থীদের প্রায় কিছুই দেখার থাকে না। সান্ত্বনা হিসেবে বাঁধ এলাকার বাইপাসের ব্রিজের ওপর বাসের গতি মন্থর করে আমাদের একঝলক কলোরাডো নদী দেখার সুযোগ করে দেয় ম্যানুয়েল। দুই পাশে বৃক্ষহীন খাঁড়া উঁচু পাথুরে পাহাড়ের মাঝে অনেক নিচে বয়ে যায় কলোরাডো নদীর স্রোত, অত উঁচু থেকে সাতটি অঙ্গরাজ্য পাড়ি দেওয়া প্রায় দেড় হাজার মাইল দীর্ঘ নদীটিকে নিস্তেজ নয়নজুলির মতো দেখায়। ম্যানুয়েল হয়তো আমাদের মনের কথা বুঝতে পেরে বলে, এটাকে এত গোবেচারা মনে করলে ভুল হবে, মনে রাখতে হবে এখন খরার মৌসুম, বৃষ্টি প্রায় হচ্ছেই না।

হুভার বাঁধ এলাকা পেরিয়ে একসময় আমরা হাইওয়ে ৯৩ থেকে ছোট শহর কিংম্যানে পৌঁছে ৪০ নম্বর মহাসড়ক ধরি। এই কিংম্যানে এসে ঐতিহাসিক হাইওয়ে ৬৬ এবং ৪০ পরস্পরকে ছুঁয়ে দিয়ে আবার আলাদা হয়ে গিয়েছে। এ পর্যায়ে ম্যানুয়েল আমাদের হাইস্কুলের ছাত্র গণ্য করে আমেরিকার মহাসড়কগুলোর একটা বৈশিষ্ট্য জানায়—জোড় নম্বরের মহাসড়কগুলো পূর্ব-পশ্চিম আর বেজোড় নম্বরেরগুলো উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত। এটুকু শুনে আমাদের সফরসঙ্গী সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকা সাই নামের ইসরায়েলের মেয়েটি অকারণে হেসে ওর মাঝারি সাইজের ট্যাবের দিকে মনোযোগ দেয়। তরুণ যিশুর মতো লালচে শ্মশ্রুমণ্ডিত ম্যানুয়েল হয়তো ওর ফিচেল হাসি দেখে কিছুটা হতাশ হয়। এহেন একাকী তরুণী পর্যটকের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য গলা খাঁকড়ে ম্যানুয়েল লাউড স্পিকারে বলে, আপনারা যাঁরা আমার কথা শুনছেন না, তাঁদের জন্য বলি, ফেরার পথে আমাদের পুরো পথে যা যা বলব তার ওপর কুইজ হবে। সাই ট্যাবের পর্দা থেকে ওর খয়েরি চোখের ওপরের অংশ তুলে হ্যান্ডসাম ম্যানুয়েলের দিকে একপলক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ঠোঁট টিপে হাসে। সেই হাসির প্রতিদান হিসেবেই হয়তো ম্যানুয়েল ঘোষণা করে, এখন আমরা যাব ঐতিহাসিক রুট ৬৬-এর শহর সেলিগম্যানে। সেখানে আমরা আধা ঘণ্টার জন্য থামব অ্যাঞ্জেল অ্যান্ড উইলমাজ গিফট শপে।
গিফট শপে যাওয়ার এই ঘোষণায় বোধ করি সাই আগ্রহী হয়ে ট্যাবটা পাশে নামিয়ে রেখে ম্যানুয়েলের ধারা বর্ণনার দিকে মনোযোগ ফেরায়। মেয়েটির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরে ম্যানুয়েল নতুন উদ্যমে আমাদের রুট ৬৬ ও সেলিগম্যান শহরের নরসুন্দর অ্যাঞ্জেল কীভাবে মৃতপ্রায় শহরটিকে পর্যটকপ্রিয় করে তোলেন, তার বিস্তারিত ইতিহাস শোনায়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই কর্নেল (পরবর্তী সময়ে প্রেসিডেন্ট) আইসেন হাওয়ার আন্তরাজ্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করার জন্য ওয়াশিংটন ডিসি থেকে সান ফ্রান্সিসকো পর্যন্ত সড়কপথে ভ্রমণ করেছিলেন। সে সময় আমেরিকার রাস্তাঘাটের এমনই বেহাল অবস্থা ছিল যে সে যাত্রায় তাঁর সময় লেগেছিল দুই মাস। সরকারি উদ্যোগে সড়ক উন্নয়নে কিছু কিছু কাজ শুরু হয় তখন। তার অংশ হিসেবে ১৯২৬-এ চালু হয় প্রায় চার হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ হাইওয়ে রুট ৬৬। এটিকে বলা হতো আমেরিকার ‘মেইন স্ট্রিট’ অথবা ‘মাদার রোড।’ পুবের শিকাগো থেকে শুরু হওয়া পশ্চিমের ক্যালিফোর্নিয়ার সান্তা মোনিকা অবধি বিস্তৃত এই সর্পিল মহাসড়ক আমেরিকার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। আমেরিকার আর কোনো হাইওয়ে নিয়ে এত মাতামাতি নেই, যেটি ঘটেছে ৬৬ নম্বর হাইওয়ের বেলায়। আমেরিকাকে পূর্ব-পশ্চিমে এফোঁড়-ওফোঁড় করা মহাসড়কটি শিকাগোর পর মিজৌরি, কানসাস, ওকলাহামা, টেক্সাস, নিউ মেক্সিকো, অ্যারিজোনার ওপর দিয়ে ক্যালিফোর্নিয়াতে পৌঁছে। দীর্ঘ এই মহাসড়কটি কেবল একটা রাস্তাই নয়, সাহিত্যে বা সংগীতে মন্দাক্রান্ত গৃহত্যাগী ভাগ্যান্বেষী মানুষের নতুন ঠিকানা হিসেবে উঠে এসে যেন আমেরিকার ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে।

১৯৩৯ সালে প্রকাশিত জন স্টাইনবেকের পুলিৎজার পাওয়া বিখ্যাত দ্য গ্রেপস অব রথ উপন্যাসে ৬৬ নম্বর সড়কের কথা আছে বহুবার। ১৯৩০-এর দশকে আমেরিকার মহামন্দায় সৃষ্ট অর্থনৈতিক দুর্ভোগ, ধূলিঝড় ও খরা ক্লিষ্ট নিরুপায় মানুষের ক্যালিফোর্নিয়া তথা অপেক্ষাকৃত সমৃদ্ধ পশ্চিম উপকূল অভিমুখী অভিযাত্রার মূল সড়ক ছিল রুট ৬৬।
স্টাইনবেক লেখেন, ‘৬৬ নম্বর হাইওয়ে হচ্ছে বাস্তুত্যাগীদের মূল সড়ক। মানচিত্রে ওপর-নিচ মৃদু ঢেউখেলানো, মিসিসিপি থেকে বেকারফিল্ড পর্যন্ত দেশের এপাশ-ওপাশ জোড়া দীর্ঘ পাকা রাস্তা ৬৬—লাল আর ধূসর মাটির ওপর দিয়ে পাহাড়ের গায়ের সর্পিল চড়াই আর নদীর অববাহিকা পেরিয়ে ঢোকে উজ্জ্বল ভয়ংকর মরুভূমির ভেতর, সেই মরু পার হয়ে আবার পাহাড়, তারপর সমৃদ্ধ ক্যালিফোর্নিয়া উপত্যকা।’
‘ধূলিময় ক্ষীয়মাণ ভূমি থেকে, ট্রাক্টরের গর্জন এবং হাতছাড়া মালিকানা থেকে, উত্তরমুখী ধীরগতি মরু আগ্রাসন থেকে, টেক্সাস অবধি ধেয়ে আসা পাক খাওয়া বাতাসের গর্জন থেকে, জমি উর্বর না করে বরং উর্বরতা শক্তি কেড়ে নেওয়া বন্যা থেকে উদ্বাস্তু দেশান্তরি মানুষের পথ হচ্ছে ৬৬। এসব কিছু থেকে পালাচ্ছে মানুষ, ৬৬-তে এসে পড়ছে তারা পাশের শাখা রাস্তা থেকে, ওয়াগনের চাকার দাগ ভরা গ্রামের পথ থেকে। ৬৬ হচ্ছে মাতৃসড়ক, দেশান্তরের পথ।’
‘এবং ৬৬ চলতে থাকে ভীতিকর মরুভূমির ওপর দিয়ে, সামনে ঝিকমিক করা দূরত্ব আর দূরে অসহনীয়ভাবে ঝুলে থাকে কালো পাহাড়। অবশেষে বারাস্তো এবং আরও মরুভূমি, যতক্ষণ পর্যন্ত না শেষের সুন্দর পাহাড়গুলো জেগে ওঠে আর ৬৬ এঁকেবেঁকে চলে ওগুলোর ভেতর দিয়ে। তারপর আচমকা এক গিরিপথ, নিচে সুন্দর উপত্যকা...।’
স্টাইনবেকের উপন্যাসটা যাঁদের পড়া তাঁদের স্মরণে থাকতে পারে, কেবল মহামন্দা সৃষ্ট অর্থনৈতিক বিপর্যয় নয়; খরা, ধূলিঝড়, ফসলহানি—এসব বিভিন্ন কারণে বিপর্যস্ত ওকলাহামার জোড পরিবার সেখানকার পাট গুটিয়ে নতুন জীবনের হাতছানিতে ক্যালিফোর্নিয়ার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। তাদের এই যাত্রাপথ ছিল রুট ৬৬, যার বর্ণনা স্টাইনবেকের উপন্যাস থেকে ওপরে উদ্ধৃত। কেবল জোড পরিবারের একার নয়, শুধু ওকলাহামা থেকে নয়, সন্নিহিত সমভূমির অগণিত পরিবারের পশ্চিমাভিমুখী ‘দেশান্তরের পথ’ ছিল এই ‘মাতৃসড়ক।’ ৬৬ নম্বর সড়ক ধরে যেতে যেতে এসব দেশান্তরি মানুষের ধীরে ধীরে মোহমুক্তি ঘটে, নতুন আশ্রয়ের লোকজন তাদের সহজভাবে গ্রহণ করে না, কারণ ভাগ্যান্বেষী এসব মানুষের সমাগমে ক্যালিফোর্নিয়ার শ্রমিকদের মজুরি কমে যায়, তাই ভাগ্য ফেরে না তাদের, অথচ পেছনে রুদ্ধ ফেরার পথ।
উপন্যাসটির গ্রহণযোগ্যতা, কাহিনি ও আবেদনের কারণে পরের বছর এটি নিয়ে সিনেমা তৈরি হয় হলিউডে, (যা বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রদর্শিত হয়েছিল ৭০ দশকের শেষে। উপন্যাসটির একটা বাংলা অনুবাদও প্রকাশিত হয়েছিল ঢাকা থেকে ৮০-এর দশকে)। এমনকি ১৯৬২ সালে স্টাইনবেক যখন নোবেল পুরস্কার পান, তখনো প্রশংসাপত্রে তাঁর অন্যতম কীর্তি হিসেবে এই উপন্যাসটির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল।
কেবল উপন্যাস কিংবা সিনেমা নয়, ১৯৪৬-এ আমেরিকান গীতিকার ববি ট্রুপ ৬৬ নম্বর সড়ক নিয়ে রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত গান, ‘ইফ ইউ এভার প্ল্যান টু মোটর ওয়েস্ট/ ট্রাভেল মাই ওয়ে, টেক দ্য হাইওয়ে দ্যাট ইজ বেস্ট।/গেট ইওর কিকস অন রুট সিক্সটি-সিক্স।’ ওকলাহামাতে এলভিস প্রিসলির প্রিয় থাকার জায়গাও ছিল রুট ৬৬-এর ওপর বেস্ট ওয়েস্টার্ন হোটেল।
ম্যানুয়েল অবশ্য স্টাইনবেকের উপন্যাস বা ববি ট্রুপ কিংবা বহু বছর পর ‘রোলিং স্টোন’-এর গাওয়া গানটার কথা বলেনি। ও জানায়, ১৯৭৮ সালে নতুন আন্তরাজ্য হাইওয়ে ৪০ চালু হওয়ার পর ঐতিহাসিক ৬৬-এর বহু অংশ পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। তেমনি একটা অংশ অ্যারিজোনার সেলিগম্যান শহর, রুট ৬৬-এর বদৌলতে শহরটির ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল চাঙা। লোকজন এখানে গাড়ি থামিয়ে খাওয়াদাওয়া করত, গাড়ির তেল নিত, কেউ কেউ এখানে বা পাশের উইলিয়ামসের মোটেলে রাত কাটিয়ে ভোরে রওনা হতো গন্তব্যে। অথচ মাত্র ১৬ মাইল দূর দিয়ে ইন্টারস্টেট ৪০ বেরিয়ে যাওয়ার ফলে শহরটা মরে যায়। বহু দোকান, রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে যায়, অনেক পরিবার এখানকার পাট গুটিয়ে চলে যায় অন্য কোনো শহরে, পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে থাকে বহু বাড়ি।

সেলিগম্যান শহরে চুল কাটার সেলুন ও স্নুকার পুল চালাতেন অ্যাঞ্জেল দেলগাদিলো। পিতৃপুরুষের পেশাকে বেছে নিয়ে ভালোই দিন কাটছিল তাঁর। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় কিশোর অ্যাঞ্জেল দেখেছেন রুট ৬৬ দিয়ে চলে যাওয়া মিলিটারি কনভয়, সাঁজোয়া যানবাহন, তারপর যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠন-প্রক্রিয়াও ঘটে তাঁর চোখের সামনে। কিন্তু অল্প দূর দিয়ে চলে যাওয়া একটা বাইপাসের কারণে মৃতপ্রায় শহরটির দুরবস্থা সহ্য হয় না অ্যাঞ্জেলের। বছরের পর বছর ধরে তাঁর চোখের সামনে ক্ষয়ে যাওয়া সেলিগম্যানের প্রাণ ফেরানোর কিছু একটা উপায় ভাবতেন তিনি। অবশেষে ১৯৮৭ সালে তিনি ও স্ত্রী উইলমা মিলে পরিত্যক্ত রুট ৬৬-এর উত্তর পশ্চিম অ্যারিজোনা অংশের জনা পনেরো নাগরিক নিয়ে গঠন করেন ‘ঐতিহাসিক রুট ৬৬ সমিতি, অ্যারিজোনা’। নিজেদের দোকানটিকে তাঁরা পরিণত করেন জাদুঘর ও স্যুভেনির শপে। অ্যাঞ্জেলের এই উদ্যোগের প্রতি সরকারি স্বীকৃতি হিসেবে রাজ্য সরকার কিংম্যান থেকে সেলিগম্যান পর্যন্ত সড়কটির নামকরণ করে ‘ঐতিহাসিক রুট ৬৬’।
দুপুর নাগাদ আমাদের বাসটি এসে দাঁড়ায় অ্যাঞ্জেলের গিফট শপের ঠিক সামনে। সামনে ফুটপাথ ঘেঁষে একটা বহু বছরের পুরোনো মডেলের ডজ পিকআপ দাঁড় করানো, সেটি আদৌ চালু নাকি স্যুভেনির হিসেবে রাখা, বোঝার উপায় নেই, মডেলটা বিশ্বযুদ্ধের সময়ের হলেও হতে পারে। গাড়ির মাথায় ব্যানারে লেখা ৬৬, সামনের উইন্ডশিল্ডের মাঝ বরাবর এলভিস প্রিসলি আর মেরিলিন মনরোর ছবি সাঁটা। দোকানটির ঠিক পাশের খালি জায়গায় আদ্যিকালের একটা কালো শেভ্রোলে হাফ ট্রাক, তার পাশে মোষের শিং ফিট করা প্রায় ঝুরঝুরে মরচে ধরা একখানা ডজ সেডান গাড়ি রাখা, রং বোঝার উপায় নেই। দুটোতেই পুরু ধুলোর আস্তরণ। পাশে সিমেন্টের উঁচু সাইন পোস্টে ‘টেক্সাকো’ কোম্পানির লোগো দেখে দূর থেকে মনে হয় কোনো গ্যাস স্টেশন বুঝি।
দোকানটির মূল নাম ‘অ্যাঞ্জেল অ্যান্ড উইলমাজ রুট ৬৬ গিফট শপ’। তবে ‘বারবার শপ’, ‘রুট ৬৬ মেমোরাবিলিয়া’, ‘রুট ৬৬ গিফট শপ’—এসব নামও লেখা আছে আরও অনেক কিছুর সঙ্গে। দোকানের ঢোকার দরজার পাশে দাঁড়ানো মেরিলিন মনরোর অতি পরিচিত লাস্যময়ী ভঙ্গিমার প্রমাণ সাইজের একটা কাট আউট। ভেতরে কয়েক কামরাজুড়ে ঠাসাঠাসি করে রাখা নানান ধরনের স্যুভেনির। টি-শার্ট, ক্যাপ, চাবির রিং, লাইটার—এ ধরনের অতি সাধারণ জিনিস ছাড়াও সাজানো আছে হরেক রকমের গাড়ির নম্বর প্লেট, সাইলেন্সার পাইপ, আগের কালের গাড়ির স্টার্ট দেওয়ার হ্যান্ডেল, নাম না জানা রাজ্যের যত পার্টস, রুকস্যাক ব্যাগ, হাইওয়ের ওপর বসানো বিভিন্ন ধরনের ফলক—সোজা বাংলায় বলতে গেলে সড়ক ও গাড়িসংক্রান্ত যা কিছু পাওয়া গেছে, সবই এনে জড়ো করা হয়েছে দোকানটাতে। আমেরিকানরা যেরকম হুজুগে জাতি, হয়তো দেখা গেল একটা মরচে ধরা সাইলেন্সার পাইপ কিনে নিয়ে যাচ্ছে হাজার ডলার দিয়ে। অন্য এক কামরার এক দেয়ালজুড়ে কয়েকটা গিটার, স্যাক্সোফোন, ট্রামপেট, ফ্লুট, খঞ্জনি, টেনিস, র্যেকেট, বেসবল ব্যাট, নানান ধরনের হেলমেট, হ্যাট, ক্যাপ—কোনো কিছুই বাকি নেই, তার ফাঁকফোকরে অবধারিতভাবে রুট ৬৬-এর নানা ধরনের লোগো।
অ্যাঞ্জেলের চুল কাটার সেলুনের অংশটা রেখে দেওয়া হয়েছে সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত, কামরাটার দেয়ালে চুল পরিমাণ জায়গা নেই, বিভিন্ন মানুষের বিজনেস কার্ড, পোস্টার, ছবি, এমনকি ম্যাগাজিন থেকে কেটে নেওয়া ফিল্মস্টারদের ছবিও সাঁটা চারপাশে। ভেতরে ঢুকে মনে হলো যেন এইমাত্র কোনো খদ্দের এসে বসবে ছেঁড়া রেক্সিনের ওপর স্কচটেপ দিয়ে তাপ্পি মারা চেয়ারটাতে, অ্যাঞ্জেল ‘হাই বাডি’ বলে মজার কিছু বলতে বলতে তার গায়ে জড়িয়ে দেবে সাদা চাদর। বলবে, ‘এবার মেলা দিন পরে এলেন, চুল বেজায় লম্বা হয়েছে দেখছি।’ তারপর গলা চড়িয়ে অন্য কামরায় বউ উইলমাকে বলবে, ‘হানি, একটা কফি প্লিজ, বহুদিন পর এলেন মিস্টার বিল।’ তবে কথাটা আসলেই সত্যি, দোকানের একজন কথায় কথায় জানালেন, অ্যাঞ্জেল এখনো মাঝেমধ্যে শহরের কারও খেউরি করে দেন, তবে সেটা কেবল ফান হিসেবেই। বয়স নব্বইয়ের কাছাকাছি হলেও তাঁর স্বপ্নের জায়গাটিতে একবার সকালে ঢুঁ মারবেনই তিনি। ম্যানুয়েল গলা নামিয়ে বলে, এটি হচ্ছে অ্যাঞ্জেলের মেয়ে জামাই। আমরা আরও সকালবেলায় এলে খোদ অ্যাঞ্জেলের সঙ্গে দেখা হয়ে যেত।
আমরা একবাস যাত্রী একসঙ্গে ঢোকায় ভেতরে বেশ সরগরম অবস্থা। ট্যুরিস্ট ও স্থানীয় মানুষজনের কল্যাণে গিফট শপটির বেচাবিক্রি মন্দ নয় বলে মনে হলো। আমাদের মেষের পালের মতো বাসে তোলার জন্য জড়ো করে ম্যানুয়েল বলে, অ্যাঞ্জেলের এই ঘটনার পর রুট ৬৬-কে ঘিরে আরও বহু কিছু শুরু হয়েছে, এখানে শত শত গাড়ি নিয়ে শোভাযাত্রা হয় প্রতিবছর। অ্যাঞ্জেল তো এখন রীতিমতো সেলিব্রিটি অথচ তিনি নিজেও জানতেন না, তাঁকে নিয়ে এত মাতামাতি হবে। আমরা এখন যে শহরে লাঞ্চ করব, সেই উইলিয়ামসও রুট ৬৬-এর ওপর। যে রেস্তোরাঁয় নিয়ে যাচ্ছি আপনাদের, সেটিও বেশ প্রাচীন—‘ক্রুজারস ক্যাফে ৬৬’।
ঘণ্টা খানেক দূরত্বে ঠা ঠা রোদের মধ্যে সদ্য বৃষ্টিস্নাত জনবিরল উইলিয়ামস শহরের ‘ক্রুজারস ক্যাফে ৬৬’-এর সামনে বড় বড় লাল ছাতার নিচে পাতা টেবিলগুলোর প্রায় সব কটাই দখল করে বসে আছে নানান জাতের মানুষ। ম্যানুয়েল আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় ভেতরের নির্জন এক কামরায়। ভেতরে বহু প্রাচীন জমিদার বাড়ির মতো একধরনের ম্লান বনেদিয়ানা বিছিয়ে আছে সবকিছুর মধ্যে। ধোঁয়ায় কালচে দেয়াল, কালো কাঠের বিম, দেয়ালে সাঁটা টায়ার আর তেল কোম্পানির সাবেকি ধরনের পোস্টার, পুরোনো ধাঁচের চেয়ার টেবিল—সবকিছু ১৯৫০-এ থমকে রয়েছে। কেবল এই রেস্তোরাঁ নয়, পুরো উইলিয়ামস শহরটাই যেন ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা, ছবিতে দেখা কাউবয় ফিল্মের একটা দৃশ্যপট। সে কারণেই লোকজন দূর-দূরান্ত থেকে এখানে কিংবা সেলিগম্যান শহরে ঘোরাঘুরি করে খুঁজে বেড়ায় সোনালি অতীত। ক্রুজারস ক্যাফের বাইরে—পেছন দিকে একটা পুরোনো পেট্রলপাম্প বসিয়ে রাখা, তার পোর্টিকোর ছাদের ওপর কোকাকোলার লোগো আঁকা আস্ত একটা লাল রঙের গাড়ির বডি বসানো, রাস্তার উল্টোদিকের কোণে ন্যাশনাল ব্যাংক অব অ্যারিজোনার অফিস, সবই দেখতে যেন চল্লিশের দশকের।
রাস্তার এক মোড়ে ‘সুলতানা বার’। ১৯১২ সালে চালু হওয়া এই পানশালাটি নাকি অ্যারিজোনার সবচেয়ে প্রাচীন আবগারি লাইসেন্সধারী। চালু হওয়ার বছর আটেক পর সেখানে যখন মাদক নিষিদ্ধ আইন জারি হয়, তখনো এই ঠেক থেকে পরিচিত খদ্দেরদের কাছে মদ বিক্রি করা হতো গোপনে। কেবল পানশালা নয়, এটিতে ছিল সেলুন, বিলিয়ার্ড রুম ও নির্বাক ছবি দেখার ছোট মিলনায়তন। এটির পেছনে নাকি একটা গোপন সুড়ঙ্গ ছিল, যেখানে মদ লুকিয়ে রাখা হতো, কখনো লুকিয়ে থাকত তখনকার ফেরারি আসামিরাও। দু-চারজন বারটেন্ডারের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়, এটাতে ভূতের উপদ্রবও আছে। ক্রুজারস ক্যাফে থেকে বের হয়ে একবার ঢুঁ মেরে স্তিমিত আলোর ভেতর সারি সারি সাজানো বোতলের লোভনীয় হাতছানি, তাকের মাথার ওপর বেশ বড়সড় এক বন বেড়ালের স্টাফ করা শরীর, সাবেক জমিদার বাড়ির কায়দায় দেয়ালে ফিট করা বাইসনের মাথা, বিলিয়ার্ড টেবিলের সশব্দ ঠোকাঠুকি—এসবের মধ্যে সুলতানা বারের ভূতদের সঙ্গে বসে দু–পাত্তর মারার সুযোগ মেলে না ম্যানুয়েলের তাড়ায়।