আয়না

অনুবাদ: রওশন জামিলজাপানি লেখক হারুকি মুরাকামির কাহিনির বিষয় অতিপ্রাকৃত, ফ্যান্টাসি, অদ্ভুতুড়ে ও মায়াবী জগৎ। ১৯৪৯ সালে জন্ম নেওয়া এই লেখকের পাঠকপ্রিয়তা জাপান থেকে উপচে পড়েছে সমগ্র বিশ্বে। তিনি এখন পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় ও অনূদিত লেখক। এই লেখা ভাষান্তর করা হয়েছে ফিলিপ গ্যাব্রিয়েলের ইংরেজি অনুবাদ থেকে।আজ রাতে তোমরা যেসব গল্প বলছ, সেগুলো মোটামুটি দুই ধরনের। একটা হলো, একদিকে তোমরা পাচ্ছ জীবিতদের দুনিয়া, আরেক দিকে মৃতদের এবং একটা শক্তি, যা এক দিক থেকে আরেক দিকে পার হতে দেয়। এর মধ্যে পড়ে ভূত, প্রেত বা এ ধরনের কিছু। দ্বিতীয় ধরনে রয়েছে অস্বভাবী, পূর্বাশঙ্কা, ভবিষ্যদ্বাণীর ক্ষমতা। তোমাদের সব গল্পই এ দুটি ধারার যেকোনো একটিতে পড়ে।সত্যি বলতে কি, তোমাদের অভিজ্ঞতার পুরোটাই মোটের ওপর এই দুইয়ের কোনো এক ধারায় পড়ে। আমি যা বলছি তা হলো, যেসব মানুষ ভূত দেখে, তারা শুধু ভূতই দেখে এবং তাদের কখনোই পূর্বাশঙ্কা হয় না। আর যাদের পূর্বাশঙ্কা হয়, তারা ভূত দেখে না। আমি জানি না কেন, তবে এর একটা বা অন্যটার প্রতি সব সময়ই ব্যক্তিগত পক্ষপাত থাকতে পারে। অন্তত আমার ধারণা সে রকমই।অবশ্য কিছু মানুষ কোনো শ্রেণীতেই পড়ে না। যেমন—আমি। আমার তিরিশ পেরোনো বয়সে একবারও কোনো ভূত দেখিনি, একটিবারের জন্য কোনো পূর্বাশঙ্কা বা দৈবস্বপ্ন হয়নি। একবার জনা কয়েক বন্ধুর সঙ্গে এলিভেটরে উঠছি, কসম কেটে ওরা বলল, একটা ভূত আমাদের সহযাত্রী হয়েছে, কিন্তু আমি কিছুই দেখিনি। তারা দাবি করল, ছাইরঙা স্যুট পরা এক নারী ঠিক আমার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল, অথচ আমাদের সঙ্গে কোনো নারীই ছিল না, অন্তত আমি যত দূর দেখেছিলাম। এলিভেটরে আমরা তিনজনই কেবল ছিলাম। ঠাট্টা না। আর এই দুই বন্ধু এমন ধরনের ছিল না যে তারা ইচ্ছে করে আমার সঙ্গে মশকরা করবে। পুরো ব্যাপারটাই ছিল অদ্ভুত, তবে সত্যি এটাই যে আমি কখনো ভূত দেখিনি।কিন্তু একবার—স্রেফ একবারই—আমার একটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল, যা ভয়ে আমার বুদ্ধি গুলিয়ে দিয়েছিল। এটা ঘটেছিল দশ বছর আগে, যার কথা আমি কখনো কাউকে বলিনি। এমনকি বলতেও ভয় করছিল। আমার মনে হয়েছিল, যদি বলি, তাহলে ব্যাপারটা আবার ঘটবে, তাই আর কখনোই ওই প্রসঙ্গ তুলিনি। কিন্তু আজ রাতে তোমরা প্রত্যেকেই নিজের ব্যক্তিগত ভয়ের অভিজ্ঞতার কথা বলেছ, ফলে এখন গৃহকর্তা হিসেবে আমি নিজের কিছু যোগ না করে এটাকে ঠিক স্মরণীয় রাত বলতে পারি না। তাই আমি ঠিক করেছি, সরাসরি গল্পটা বলব তোমাদের। এই হচ্ছে সেই গল্প।আমি হাইস্কুল পাস করি ১৯৬০-এর শেষে, ঠিক যে সময়টায় ছাত্র আন্দোলন ছিল তুঙ্গে। আমি ছিলাম হিপ্পি জেনারেশনের অংশ, তাই কলেজে যেতে অস্বীকার করলাম। এর বদলে সারা জাপান ঘুরে বেড়ালাম নানা ধরনের দৈহিক পরিশ্রমের কাজ করে। আমি প্রত্যয়ী ছিলাম, ওটাই হচ্ছে বেঁচে থাকার সবচেয়ে নৈতিক পথ। অনুমান করি, তরুণ ও হঠকারী—আমাকে এটাই বলবে তোমরা। এখন ফিরে তাকিয়ে অবশ্য মনে হচ্ছে, আমি একটা মজার জীবনই কাটিয়েছিলাম তখন। সেটা সঠিক পছন্দ হোক বা না হোক, যদি আবার আমাকে করতে হয় এটা, আমি সুনিশ্চিত তা করব।আমার সারা দেশ চষে বেড়ানোর দ্বিতীয় বছরের হেমন্তে, আমি এক জুনিয়র হাইস্কুলে মাস দুয়েকের জন্য নৈশপ্রহরীর চাকরি নিয়েছিলাম। স্কুলটা ছিল নিগাতা প্রিফেকচারের এক ছোট্ট শহরে। বেশ কাহিল হয়ে পড়েছিলাম গ্রীষ্মে কাজ করে, তাই কয়েকটা দিন একটু সহজভাবে নিতে চাইছিলাম। নৈশপ্রহরীর কাজটা একেবারে রকেট সায়েন্স নয়। দিনে জ্যানিটরের অফিসে আমি ঘুমাই; আর রাতে সবকিছু ঠিকঠাক আছে কি না, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য স্কুলের চারপাশ শুধু দুই চক্কর ঘুরে আসি। বাকি সময় মিউজিক রুমে গান শুনি, লাইব্রেরিতে বই পড়ি, জিমে একা একা বাস্কেটবল খেলি। রাতে স্কুলে একা থাকাটা নেহাত মন্দ নয়, আসলেই। আমি কি ভয় পেতাম? পাগল! তোমাদের বয়স যখন আঠারো কি উনিশ, কোনো কিছুকেই তোমরা ভয় পাও না।আমার মনে হয় না তোমাদের কেউ কখনো নৈশপ্রহরী হিসেবে কাজ করেছ, তাই আমার বোধ হয় দায়িত্বগুলো ব্যাখ্যা করা উচিত। রোজ রাতে দুবার চক্কর মারতে হবে তোমাকে, রাত নয়টায় আর রাত তিনটায়। এই হচ্ছে সূচি। স্কুলটা ছিল একটা প্রায় নতুন তিনতলা কংক্রিটের দালান, যেখানে আঠারো থেকে কুড়িটা ক্লাসরুম। এগুলো সচরাচর যেরকম হয়ে থাকে, এটা সেরকম বড় স্কুল ছিল না। ক্লাসরুম ছাড়াও ছিল মিউজিক রুম, হোম ইসি রুম, আর্ট স্টুডিও, স্টাফ অফিস ও প্রিন্সিপ্যালের অফিস। এ ছাড়া আলাদা ক্যাফেটেরিয়া, সুইমিং পুল, জিম আর অডিটোরিয়াম। আমার দায়িত্ব ছিল দ্রুত এগুলোর সব কটি একবার নজরদারি করা।চক্কর দেওয়ার সময়, কুড়িটা জিনিসের একটি চেকলিস্ট অনুসরণ করতাম আমি। প্রতিটি জিনিসের পাশে চেক মার্ক দিতাম—স্টাফ অফিস: চেক, সায়েন্স ল্যাব: চেক... আমার ধারণা ইচ্ছে করলে চক্কর দেওয়ার ঝামেলায় না গিয়ে, যেখানে ঘুমাতাম, সেই জ্যানিটরের কামরার বিছানায় থেকেই আমি চেক মার্ক দিতে পারতাম সবগুলোয়। কিন্তু আমি ঠিক এ ধরনের ফাঁকিবাজ লোক ছিলাম না। চক্কর দিতে খুব বেশি সময় লাগত না, আর তা ছাড়া, আমি ঘুমিয়ে থাকার সময় কেউ যদি তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকত, তাহলে হতাম আমিই।যা-ই হোক, নয়টা আর তিনটায় আমি চক্কর দিতাম সেখানে, বাঁ হাতে ফ্লাশলাইট আর ডান হাতে কাঠের কেন্দো তলোয়ার নিয়ে। হাইস্কুলে কেন্দো অনুশীলন করেছিলাম এবং যে কাউকে প্রতিহত করার ব্যাপারে আমার সামর্থ্য সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলাম। হামলাকারী যদি শৌখিন কেউ হতো, এমনকি তার কাছে সত্যিকারের তলোয়ার থাকত, তাহলেও আমি ভয় পেতাম না। আমি যুবক ছিলাম, সে কথা মনে রেখো। এখন যদি সে রকম কিছু ঘটে, আমি ঝেড়ে দৌড়াব।যাকগে, ব্যাপারটা ঘটেছিল অক্টোবরের শুরুতে এক ঝোড়ো রাতে। বছরের ওই সময়টার জন্য একটু গুমোটই ছিল সেদিন। সন্ধ্যায় ভনভন করে একঝাঁক মশা উড়ছিল। আমার মনে আছে, ওদের দূরে রাখতে আমি গোটা দুই মশার কয়েল জ্বেলেছিলাম। শনশন বাতাস বইছিল। সুইমিং পুলের গেটটা ছিল ভাঙা এবং বাতাসে ওটা একবার খুলছিল, আরেকবার বন্ধ হচ্ছিল। ওটা ঠিক করতে চেয়েছিলাম আমি, কিন্তু বাইরে ঘুটঘুটে আঁধার, তাই সারা রাত ওটা আছড়াতে থাকল।আমার রাত নয়টার চক্করটা ভালোয় ভালোয় শেষ হলো। আমার তালিকার কুড়িটা জিনিসই ঠিক পেলাম। সব দরজায় তালা দেওয়া, সবকিছু জায়গামতো রয়েছে। কোনো কিছুই অস্বাভাবিক লাগছে না। জ্যানিটরের কামরায় ফিরে গেলাম আমি, তিনটায় অ্যালার্ম দিলাম, তারপর ঘুমিয়ে পড়লাম দ্রুত।যখন তিনটায় অ্যালার্ম বাজল, ঘুম থেকে উঠে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো আমার। ঠিক ব্যাখ্যা করতে পারব না, কিন্তু আমার কেমন যেন ভিন্ন অনুভূতি হলো। উঠতে ইচ্ছে করছিল না—কিছু একটা যেন আমার বিছানা ছাড়ার ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রাখছিল। আমি হচ্ছি সেই ধরনের, যে সাধারণত লাফিয়ে শয্যা ত্যাগ করে, তাই বুঝতে পারছিলাম না ব্যাপারটা। জোর করে বিছানা ছাড়তে হলো আমাকে, চক্কর দেওয়ার জন্য তৈরি হতে হলো। পুলের গেটটা তখনো বাতাসে আছড়ে পড়ছিল, কিন্তু এখন আওয়াজটা অন্য রকম। কিছু একটা আসলেই রহস্যময়, ভাবলাম আমি, আর এগোতে ইচ্ছে করছিল না। তবে মন শক্ত করলাম, আমাকে আমার কাজ করতে হবে, যা-ই ঘটুক না কেন। তুমি যদি একবার কাজে ফাঁকি দাও, তুমি বারবার ফাঁকি দেবে, আর আমি ওই ফাঁদে পা দিতে রাজি নই। তাই আমার ফ্ল্যাশলাইট আর কাঠের তলোয়ারটা হাতে করে বেরিয়ে পড়লাম। সেই রাতটা ছিল বিদঘুটে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জোরালো হচ্ছিল বাতাস, সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল গুমোট ভাব। আমার গা চুলকাতে শুরু করল। আমি মনোযোগ স্থির করতে পারছিলাম না। ঠিক করলাম, আগে জিম, অডিটোরিয়াম আর পুলের পাশ দিয়ে চক্কর দেব। সবকিছুই ঠিক পেলাম। পুলের গেটটা বাতাসে আছড়ে পড়ল, পাগল যেভাবে পালা করে একবার মাথা ওপরে-নিচে এবং আরেকবার ডাইনে-বাঁয়ে করে—সেভাবে। এর কোনো মাথামুণ্ডু নেই। প্রথমে বার দুই ওপরে-নিচে—হ্যাঁ, হ্যাঁ—তারপর না, না, না...এভাবে তুলনা করাটা উদ্ভট জানি, কিন্তু ঠিক এটাই মনে হচ্ছিল।স্কুল ভবনের ভেতরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক। আমি ঘুরে ঘুরে দেখলাম সবকিছু, আমার তালিকার পয়েন্টগুলো মিলিয়ে নিলাম। স্বাভাবিকের বাইরে কিছুই ঘটেনি, আমার অস্বস্তিকর অনুভূতি সত্ত্বেও। হাঁফ ছেড়ে, জ্যানিটরে কামরার দিকে ফিরতি পথ ধরলাম। আমার চেকলিস্টের সব শেষের জায়গাটা হচ্ছে বয়লার রুম, দালানের পুব দিকে ক্যাফেটেরিয়ার পাশে, জ্যানিটরের কামরার উল্টো দিকে। এর অর্থ, ফিরতি পথে আমাকে একতলার লম্বা হলওয়ে ধরে হেঁটে যেতে হবে। নিকষ কালো অন্ধকার। যেসব রাতে চাঁদ ওঠে, হলওয়েতে আলো থাকে সামান্য, কিন্তু যখন থাকে না, তুমি কিছুই দেখতে পাবে না। কোথায় যাচ্ছি, জানার জন্য আমাকে সামনে ফ্ল্যাশলাইটের আলো ফেলতে হচ্ছিল। আর এমন রাত এটা, টাইফুন খুব বেশি দূরে ছিল না, তাই কোনো চাঁদই ওঠেনি। মাঝে মাঝে এখানে-ওখানে ফাটল ধরছিল মেঘে, কিন্তু পরক্ষণেই ডুবে যাচ্ছিল ঘুটঘুটে অন্ধকারে।হলওয়ে ধরে স্বাভাবিকের চেয়ে দ্রুতগতিতে এগিয়ে গেলাম, আমার বাস্কেটবল জুতাজোড়ার রাবার সোল লিনোলিয়াম মেঝেয় ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজ করছিল। মেঝেটা ছিল সবুজ লিনোলিয়াম, অস্বচ্ছ শ্যাওলা ঝাড়ের রং। এমনকি ছবিটা আমি এখনো দেখতে পাই।স্কুলের প্রবেশপথটা ছিল হলওয়ের মাঝামাঝি। ওটা পেরোনোর সময় আমি ভাবলাম, কী—ওটা? আমার মনে হলো, অন্ধকারে কিছু একটা দেখলাম যেন। ঘাম ছুটল সারা শরীরে। কাঠের তলোয়ারটা আরও শক্ত করে ধরে আমি ঘুরলাম, যেটা দেখতে পেয়েছি সেটার দিকে। জুতা রাখার শেলফের পাশের দেয়ালে ফ্ল্যাশলাইটের আলো ফেললাম।আরে ওই যে আমি। একটা আয়না, অন্যভাবে বললে। ওটা ছিল আয়নায় আমার প্রতিফলন। আগের রাতে ওখানে কোনো আয়না ছিল না। তার মানে, ওরা নিশ্চয় ওখানে ওটা রেখেছে তখন এবং এখনের মাঝখানের কোনো একটা সময়ে। বাপরে! চমকে গিয়েছিলাম একদম। লম্বা, পূর্ণদৈর্ঘ্য আয়না ছিল ওটা। আয়নায় ওটা আসলে আমি, এটা বুঝে হালকা হওয়ার পর, নিজেকে একটু বোকা বোকা মনে হলো এত অবাক হয়েছিলাম বলে। তো এটাই হচ্ছে ব্যাপার, নিজেকে বললাম। কী গর্দভ! ফ্ল্যাশলাইটটা নামিয়ে রাখলাম আমি, পকেট থেকে সিগারেট বের করে আগুন ধরালাম। একমুখ ধোঁয়া নেওয়ার সময় আড়চোখে তাকালাম আয়নাটার দিকে। বাইরে রাস্তার বাতি থেকে ক্ষীণ একটা আলো জানালা গলে ভেতরে এসে পড়েছে, আয়নাটা স্পর্শ করছে। আমার পেছনে সুইমিং পুলের গেটটা আছড়ে পড়ছে বাতাসে।বার কয়েক ধোঁয়া নেওয়ার পর, হঠাৎ বিদঘুটে একটা কিছু নজরে পড়ল। আয়নায় আমার প্রতিফলনটা আমি না। বাইরে থেকে ওটা দেখতে অবিকল আমার মতো, কিন্তু ওটা নিশ্চিতভাবেই আমি নই। না, ব্যাপারটা তা নয়। ওটা আমিই ছিলাম, তবে অন্য আমি—আরেকজন আমি, যা কখনোই থাকা উচিত নয়। আমি জানি না কীভাবে বলব এটা। কী রকম লাগছিল সেটা, ব্যাখ্যা করা সত্যিই কঠিন।একটা জিনিস আমি বুঝেছিলাম যে এই আরেকটা অবয়ব আমাকে ঘৃণা করে। ওটার ভেতরে কৃষ্ণসাগরে ভাসমান হিমশৈলের মতো ঘৃণা। সেই ধরনের ঘৃণা, যা কেউ কোনো দিন দূর করতে পারে না।কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি, বিমূঢ়ের মতো। আমার আঙুল থেকে সিগারেট খসে মেঝেয় পড়ে গেল। আয়নার সিগারেটটাও পড়ল মেঝেয়। আমরা দাঁড়িয়ে রইলাম সেখানে, একে অপরকে দেখছি। আমার মনে হলো যে আমার হাত আর পা বাঁধা, নড়তে পারছি না। অবশেষে নড়ে উঠল ওর হাত, ডান হাতের আঙুলের ডগা ওর চিবুক স্পর্শ করল এবং তারপর ধীরে ধীরে, ছারপোকার মতো, উঠে গেল ওর মুখ বেয়ে। সহসা খেয়াল হলো আমার, আমিও ঠিক তা-ই করছি। আমি যেন ওই আয়নার ভেতরকার প্রতিফলন এবং সে আমাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। আমার শেষ শক্তিটুকু নিংড়ে হুংকার ছাড়লাম একটা, যে বাঁধন আমাকে আটকে রেখেছিল ওখানে, সেটা ছিঁড়ে গেল। আমার কেন্দো তলোয়ারটা উঁচু করলাম আমি, সারা শরীরের শক্তি দিয়ে আয়নায় আঘাত করলাম। কাচ ভাঙার শব্দ পেলাম, কিন্তু দৌড়ে আমার কামরায় ফিরে আসার পথে আর পেছন ফিরে তাকালাম না। ভেতরে ঢুকেই তড়িঘড়ি বন্ধ করে দিলাম দরজাটা, চাদরের নিচে গিয়ে ঢুকলাম। মেঝেয় পড়ে যাওয়া সিগারেটটা নিয়ে দুশ্চিন্তা হচ্ছিল আমার, কিন্তু কিছুতেই আমি আর ফিরে যাচ্ছি না ওখানে। পুরো সময়টা গজরাচ্ছিল বাতাস, পুল গেটটা আছড়ে পড়ছিল। হ্যাঁ, হ্যাঁ, না, না, না...আমি নিশ্চিত, আমার গল্পের শেষটা অনুমান করে নিয়েছ তোমরা। ওখানে কখনোই কোনো আয়না ছিল না।যখন সূর্য উঠল, টাইফুন আগেই থেমে গেছে। বাতাস পড়ে গেছে, রোদঝলমলে একটা দিন। আমি প্রবেশপথটার কাছে গেলাম। আমার ফেলে দেওয়া সিগারেটের টুকরোটা পড়ে ছিল; আমার কাঠের তলোয়ারটাও। কিন্তু কোনো আয়না নেই। ওখানে কখনোই কোনো আয়না ছিল না।আমি যা দেখেছিলাম, সেটা ভূত ছিল না। ওটা ছিল স্রেফ—আমি নিজে। আমি কখনো ভুলতে পারব না সেই রাতে কী ভয় পেয়েছিলাম! আর যখনই আমার মনে পড়ে এটা, এই চিন্তাটা মনে আসে: পৃথিবীতে সবচেয়ে ভয়ংকর জিনিস হচ্ছে আমাদের নিজেদের সত্তা। তোমাদের কী মনে হয়?তোমরা খেয়াল করেছ নিশ্চয়, আমার ঘরে একটিও আয়না নেই। একটা আয়না ছাড়া দাড়ি কামানো শেখা খুব সহজ কাজ হয়নি, বিশ্বাস করো।