‘হ্যাঁ, আম্মা বলো’—ফোন ধরেই বলল আবিদ।
‘টিকিট পাইছিস?’
‘কাউন্টার খুলছে মাত্র। এত তাড়াতাড়ি হবে নাকি?’
‘লাইন কি অনেক লম্বা? ভোররাত থেকে না দাঁড়ায় আছিস?’
‘ভোররাত থেকে দাঁড়ায় থাকলেই কি টিকিট দিয়ে দেবে নাকি? রাখো ফোন। পাইলে জানাচ্ছি!’
বিরক্ত হয়ে ফোনটা কেটে দেয় সে। একদিন পরেই ঈদ। সাহ্রি করেই স্টেশনে চলে আসার কথা তার। কিন্তু বিছানায় গা–টা একটু এলাতেই দেখে সাড়ে সাতটা বাজে। তড়িঘড়ি করে স্টেশনে পৌঁছে বুঝতে পারে তার সিরিয়াল দুই শর পরে। অগত্যা সামনের দুজনের কথা শুনতে শুনতে এগোতে থাকে সে।
‘শুনছেন নাকি আমেরিকা কী বলছে?’
‘কী?’
‘সামনের ইলেকশনে কোনো পার্টিকে সাপোর্ট দেবে না।’
‘তো?’
‘আমেরিকার হাতেই তো সবকিছু। আমেরিকা যারে সাপোর্ট দেয়, সেই দলই জেতে। পাকিস্তানের অবস্থা দেখেন নাই? এবার খবর আছে। মিডনাইট, লেটনাইট কিছু করেই বুঝ দেওন যাবে না আমেরিকারে।’
‘আরে ধুর। চায়না কি চাইয়া চাইয়া দেখবে আমেরিকা কিছু করলে?’
হঠাৎ লাইন দাঁড়িয়ে যায়। কাউন্টারের সামনে ঝোলানো ‘আগামীকালের সব টিকিট শেষ।’ লোকজনের মধ্যে অস্থিরতা শুরু হয়। হইহল্লা বাড়তে থাকে।
আবিদ স্টেশনের বাইরে চলে আসে। ‘বাল, প্রতি ঈদেই এই সমস্যা’ বলে গজগজ করতে করতে সিগারেট ধরায় একটা। হঠাৎ পাশ থেকে হালকা আওয়াজ, ‘ভাইয়ের কি টিকিট লাগবে?’
ঘুরে তাকায় আবিদ। দেখে চেক শার্ট পরে এক লোক দাঁড়ানো।
‘আমার কাছে সিঙ্গেল টিকিট আছে একটা—নন–এসি। আমার ভাইয়ের যাওয়ার কথা, সে বাসে চলে গেছে গতকাল। আপনার কি একটাই লাগবে নাকি আরও?’
‘একটাই। কত?’—মানিব্যাগ বের করে আবিদ।
‘৯০০ পড়বে।’
‘৩৫০ টাকার টিকিট ৯০০ নেবেন কেন? পাগল নাকি? ৫০০ দিচ্ছি, ধরেন।’
‘না ভাই, ৫০০–তে হবে না। আপনি যা ভাবতেছেন, আমি তা না। আমার বাসা ধানমন্ডি। সিএনজি ভাড়াসহ হিসাব করে ধরছি।’
‘আররে ৬০০ দিচ্ছি, রাখেন!’
‘আর ১০০ টাকা দেন।’
‘টিকিটটা দেখান। কালকে কোন ট্রেন? ফটোকপি না তো?’
বলে ৭০০ টাকা বের করতেই দেখে অন্য এক ভদ্রলোক এসে সেই লোকের হাতে ৭০০ টাকা দিয়ে বলল টিকিটটা তাকে দিতে।
‘আমি তো ভাই ওনার কাছে বিক্রি করে ফেলছি!’
‘এখনো তো করেন নাই। আমার কাছে আগে আসছিলেন আমি আপনার ৭০০–ই দিচ্ছি, দেন।’
আবিদের মেজাজ গরম হয়ে যায়। লোকটার সঙ্গে তর্ক শুরু করে দেয় সে। নিলে ব্যাটা আগেই নিত, সে কেনার সময় কেন কিনতে আসবে। এরপর দুজনই চেক শার্টকে টাকা গছাতে যায়। চেক শার্টও টিকিট হাতে বুঝে উঠতে পারে না কী করবে না করবে।
টিকিট নিয়ে টানাটানি শুরু হয় তিনজনের। হঠাৎ স্টেশনে ‘পুলিশ পুলিশ পালাও’ রব তুলে এদিকে–ওদিকে ছুটতে থাকে কিছু লোক। ওরাও কিছু না বুঝেই দৌড় দেয়। এর মধ্যে বুদ্ধি করে আবিদ লোকটার বুকপকেটে টাকা ঢুকিয়ে দিয়ে টিকিটটা নিয়েই রাস্তার উল্টো দিকে দেয় দৌড়। দৌড়াতে দৌড়াতে এই গলি ওই গলি ছুটে একটা টংদোকানের সামনে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে দেখে আম্মার কল। আলগোছে রাখা টিকিটটা বুকপকেটে ভরে ফোনটা ধরেই বলে, ‘আম্মা, টিকিট পাইছি! জানো না তো কী কেয়ামত হইছে আজকে!’
‘পাইছিস? আলহামদুলিল্লাহ। কয়টায় ট্রেন?’
‘দাঁড়াও দেখি।’
আবিদ বুকপকেট থেকে টিকিট বের করে ট্রেনের সময় দেখতে গিয়ে দেখে টিকিটটা আড়াআড়ি মাঝখান থেকে ছেঁড়া। টানাটানিতে টিকিটের অর্ধেকটা তার কাছে রয়ে গেছে। আর বাকি অর্ধেকটা অন্য ভদ্রলোকের কাছে।