একটি অতিবিষণ্ন সন্ধ্যা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

কেরোসিন পাওয়া যায় না। হারিকেন সব তুলে রাখা হয়েছে। আর কেরোসিন দিয়ে কুপি জ্বালানোর কথাই ওঠে না। সরষের তেল দিয়ে প্রদীপ জ্বালানোর কথা দশবার ভাবতে হবে। আজকাল এক রকম লন্ঠন পাওয়া যায়। চারদিকে চারটি কাচ লাগানো, ভেতরে সামান্য একটু রেড়ির তেল দিয়ে যে প্রদীপটা জ্বালানো হয়েছে, তাতে দুহাত দূরের মানুষকেও দেখা কঠিন। নীলচে ঘন রেড়ির তেল জ্বলেও না, পুড়ে শেষও হয় না। তবে এক টাকায় সরু ষোলোটা মোমবাতি কিনতে পাওয়া যায়। সব সময় নিবুনিবু করছে। সামান্য একটু বাতাসের ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছে। তারপর একসময় নিভেই গেল। একটু জোর হাওয়া দিলে লন্ঠনটাও নিভবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রায় শেষের দিকে। কেরোসিন নেই। নুন নেই। চিনি নেই। গাঁয়ের বউ-ঝিদের জন্য পরনের শাড়ি পর্যন্ত গরমিল। কন্ট্রোলের দোকান খোলা হয়েছে। প্রত্যেক গৃহস্থের কাছে একটি করে রেশন কার্ড আছে। তাতে চৌকো চৌকো অসংখ্য ঘর। কাকে কী পরিমাণ নুন, চিনি, কেরোসিন বা শাড়ি সরকারের ধার্যমূল্যে বিক্রি করা হলো, তা লেখা থাকে। আর রেশনের দোকানে জমা হয়ে থাকে বস্তা-বস্তা অ্যামোনিয়া সার। জমিতে এই সার একনাগাড়ে ব্যবহারে করলে উর্বর জমির মাটি পাষাণ হয়ে যাবে, সবাই জানে। তবু এই ভয়ংকর সারই কৃষককে বাধ্য হয়ে ব্যবহার করতে হয়। জৈব সার মেলা কঠিন। মড়কে গাঁয়ের পর গাঁ—গাঁয়ের গরু-মোষ সাবাড় হয়ে গিয়েছে। নানা ধরনের ধানের চাষ ছিল জমিতে—কলমা, দুধকলমা, ঝিঙেশাল, চড়ুইঠুঁটি। নানা রকম পোলাওয়ের চাল কেউ আর ফলাতে চায় না এই সব ধানের ফলন খুব কম বলে। কলমা, দুধকলমা, বড়জোর ঝিঙেশালের বাইরে আর কোনো চাষি যেতে চান না। তাঁতের কাপড় বলে কিছু নেই। কোথায় তাঁত, সুতো, তাঁতি—কেউ নেই। আছে শুধু মিলের মোটা কোরা শাড়ি। তা-ও খোলাবাজারে নেই। এই কোরা শাড়ি শতবার পিটিয়ে কাচলে সাদা করা যাবে না, চিরকাল ময়লা মোটা চটের মতোই থেকে যাবে। তবে এই শাড়িই মহিলাদের পরতে হবে। ছেলেদের জন্য মোটা মার্কিন কাপড়—তাতে পাঞ্জাবি বানাও, হাফ শার্ট বা ফুল শাট জামা-ই বানাও। কন্ট্রোলের দোকানের যে মালপত্র তা-ও যে একেবারে নিয়মমাফিক আসে, তা তো নয়। আজকাল লোকের বাড়িতে হুট করে ঢোকা যায় না। ঘরের দরজা বন্ধ করে আধো উলঙ্গ মহিলারা আন্ধারে বসে আছে। সন্ধের পরে ঘরের বাইরে ভূতের মতো তাদের চলাফেরা। যুদ্ধ কবে শেষ হবে কেউ জানে না। মনে হয় কখনোই শেষ হবে না—চিরকাল চলবে। দিনের বেলা-রাতের বেলায় যখন-তখন উড়োজাহাজগুলো আসে। কখনো অনেক উঁচুতে গুড়গুড় শব্দ করে চলে যায়। কখনো যেন ঠিক মাথার ওপর দিয়ে কড়কড় শব্দে যেন বাজ ফেলতে ফেলতে চোখের আড়াল হয়।
কোথায় কী রকম যুদ্ধ কেউ জানে না। পৃথিবীর কোন কোন দেশ যুদ্ধ করছে, তা-ই বা কে জানে! হিটলারের নামটা অবশ্য সবাই জানে। হারামজাদার চার কোনা গোঁফটা চেনে না এমন লোক নেই। এখানে-সেখানে ছেলেবুড়ো সবার মুখে এক কথা—সা রে গা মা পা ধা নি, বোম ফেলেছে জাপানি। ওরা বর্মা পেরিয়ে ভারতে ঢুকল বলে। তখন আর কারও রক্ষে থাকবে না। জাপানি ফানুসের কথা সবাই বলে, আমি আর বুঝতে পারি না সে কেমন জিনিস। আমার কাছে আয়নার কাণ্ড নামে একটা বই ছিল। সেটা পড়ে মনে হয়েছিল, দুনিয়ার সব মানুষ এক রকম। একজন জাপানি গৃহস্থেরে বাড়িতে একটা আয়না ছিল। সে মারা যাওয়ার পর সেটা তার ছেলের হাতে এসে পড়ে। বাবাকে তার মনে পড়ে না। খুব ইচ্ছে হয়, একবার অন্তত সে তার বাবাকে যেন দেখতে পায়। তার ধারণা ছিল, বাবা তার আয়নার মধ্যেই আছে। আয়নাটা হাতে পাওয়ার পর সে তাতে দেখে, আরে! তার বাবা তো আলাদা কেউ নয়। সে নিজেই তার বাবা। অবিকল এক চেহারা তাদের। বড় হয়ে সে যে তার বাবার মতোই দেখতে হয়েছে, তা সে জানবে কী করে? এই বইটার নাম ছিল আয়নার কাণ্ড। যেখানে-সেখানে পড়ে থাকত বইটা। ওই যে সন্ধের কথা বলছিলাম, সেদিনও এই বিষণ্ন বইটা এক পাশে পড়ে ছিল বলে মনে পড়ছে।
কুপিটা তেলের অভাবে দপদপ করছে—এক্ষুনি নিভবে। রেড়ির তেলের পিদিম জ্বলল কি নিভল তাতে কিছুই যায়-আসে না। চারপাশের খোলা মাঠঘাট পেরিয়ে ঘন ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মতো অন্ধকার পাক দিয়ে দিয়ে গাঁয়ে ঢুকছে। ঘরের বাইরের উত্তর দিকের মাটির বারান্দায় লন্ঠন আর রেড়ির তেলের পিদিমের আলোয় বাড়ির লোকজন বসে আছে। প্রৌঢ়া-বৃদ্ধাদের পাশাপাশি বাড়ির পুরুষেরাও আছে বসে। আহ্, কী বিষণ্নতা! শুধু উত্তর পাশের কোঠাঘরের যে অংশটুকুতে মাটি দিয়ে বসবার উপায় করা হয়েছে, বাকিটায় শুধু তালগাছের কাঁড়ি বসানো—দুই ফুট, দুই ফুট দূরে দূরে; যেখানটায় বসা যায় সেখানে চায়ের আয়োজন নিয়ে বসে আছেন আমাদের নোয়া চাচা। চায়ের ব্যাপারে তিনি তাঁর মেজো ভাইয়ের মতোই বিলাসী ছিলেন। খেতেন তখনকার দিনের দামি ব্রুকবন্ড চা। খাঁটি সিসের মোড়কে ঢাকা। সেই সিসের মোড়ক খুলে হাতায় দিয়ে উনুনের আগুনে একটু গরম করলেই টলটলে সিসে বেরিয়ে আসত। আমরা তা দিয়ে কড়ি খেলার আঁটা তৈরি করতাম।
কোঠাঘরের দোতলায় বসে নোয়া চাচা দামি সুগন্ধি চা বানিয়ে তার প্রথম কাপটাই পাঠাতেন তাঁর মেজো ভাইকে, যিনি এই সংসারে চায়ের প্রচলনকারী। প্রথম কাপটি পাঠানো হলো আমার বড় বোন বুড়িকে দিয়ে। নিচের মেঝেয় বসে সেজো চাচা তামাক কাটার পর চিটে-গুড় মাখাচ্ছেন তাতে। মাহিন্দার মুনিষদের জন্য। আমি কিন্তু উত্তরের বারান্দায় ওই আধো অন্ধকারে পিদিম নিয়ে ইংরেজি কবিতা মুখস্থ করছি—‘অ্যাক্রস দ্য স্যান্ডস অব ডি ও মেরি, গো অ্যান্ড কল দ্য ক্যাটল হোম, অ্যান্ড কল দ্য ক্যাটল, অ্যাক্রস দ্য স্যান্ডস অব ডি...’। ঝড়-জলে মেরি আর কোনো দিন ফিরে এল না। কবিতাটা মুখস্থ হয়ে গেলেই পাঠিয়ে দিতে হবে কোঠাঘরের দোতলায়। সেখানে নোয়া চাচার পাশে বসে আমার চাচাতো ভাই শহীদুল পড়ছে। আমরা একই ক্লাসের। দুজনে মিলে একটা বই-ই পড়তাম। আমার হয়ে গেলে তাকে দিতে হবে।
আহ্, কী বিষণ্ন সন্ধ্যা! অন্ধকার নেমে আসা শনশন আওয়াজ শোনা যাচ্ছে যেন। কত দূর মাঠে শেয়াল হু হু শব্দে ডেকে উঠল, ধান পাক ধান পাক শব্দে ফেউ ডাকল বারে বারে। হট্টিটির ডাকও দু-একবার শোনা গেল। আর পুকুরের শালুক ফুলের দঙ্গলের ভেতর থেকে ডেকে উঠল ডাহুক। সব একবার করে। পৃথিবীর চঞ্চল হৃৎপিণ্ডের দুপদাপ আওয়াজ ধীরগতিতে নিচে নামল। চারদিকে চিরস্থায়ী জীবনের অচঞ্চল ধীরতা। আর যেন বিষণ্নতাই জীবন।

রাজশাহী, জুন ২০১৬