
ফুরফুরে লাগছে, নির্ভার। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি, কীভাবে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম সে কথা মনে নেই। শুধু মনে আছে ঘুমানোর আগে আমি স্বীকারোক্তি দিয়েছিলাম। স্বীকার করে নিয়েছি আমার যাবতীয় অপরাধের কথা। বলেছি, আমিই খুন করেছি জোহরা খাতুনকে, যার ডাকনাম শিউলি। শিউলিকে আমি খুন করেছি শ্বাস রোধ করে। মুখে কাপড় দিয়ে গলায় গামছার ফাঁস লাগিয়ে তাকে হত্যা করেছি। শরীরটা সম্পূর্ণ নিস্তেজ না হওয়া পর্যন্ত দুই হাতে দুই দিক থেকে গামছার ফাঁস টেনে রেখেছি শক্তভাবে। বাঁচার জন্য শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা কে না করে, মেয়েটা হাত-পা ছুড়ে পুরো শরীরের শক্তি দিয়ে আছাড়ি-পিছাড়ি খেয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ক্ষীণ তনুর ওপর তখন পুরোটাই চেপে বসেছিল আমার শক্ত-সমর্থ শরীরটা। দুই চোখ প্রায় বেরিয়ে আসার জোগাড়, সেই বড় বড় চোখ দুটিতে বিস্ময় যেমন ছিল, তেমনি প্রশ্নও ছিল অনেক। কিন্তু এসব প্রশ্ন বা বিস্ময়ের উত্তর জানার আগেই স্থির হয়ে গিয়েছিল। মৃত্যুর পরও সেই চোখ বন্ধ হয়নি। যেন তখনো সে জানতে চায় অনেক কিছু। আমি নিজের হাতে দুই চোখের পাতা বুজে দিয়েছিলাম।
ক্ষিধা লাগছে?—পুলিশ অফিসার জানতে চাইলেন।
জি।—মাথা নেড়ে জানালাম আমি।
পাশে দাঁড়ানো কনস্টেবলকে ইশারা করলেন অফিসার। কনস্টেবল বেরিয়ে গেল। হাজতঘরটা আলো-অন্ধকার। এখন সম্ভবত দিনের বেলা, কিন্তু এই ঘরে বসে দিনরাত্রির তফাৎ বোঝাটা একটু কঠিন, একটা অল্প পাওয়ারের আলো জ্বলছে মাথার ওপর, সিলিং থেকে নেমে আসা বৈদ্যুতিক তারের ওপর ঘোলাটে একটা বাল্বের আলো। অফিসারের চেহারায় এই প্রথম প্রসন্নতা দেখতে পেলাম আমি, এমনকি আমার প্রতি একধরনের মায়া বা করুণাও যেন আছে তাঁর চোখেমুখে।
ব্যথা আছে শরীরে?—বলা যায় সহানুভূতির সুরেই অফিসার জানতে চাইলেন।
প্রশ্ন শুনে এতক্ষণ পর শরীরের কথা মনে পড়ল আমার। সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়া প্রচণ্ড ব্যথা চাগিয়ে উঠল এবার। ঠোঁট বা চোখের নিচের অংশটা প্রায় অবশ, হাত-পায়ের আঙুলগুলো নিঃসাড়। আর, একটা অদ্ভুত দলা পাকানো যন্ত্রণা ঝনঝন করে একবার নিচের দিক থেকে শরীরের ওপর দিকে উঠছে, আবার নামছে।
ব্যথা আছে?—উত্তর না পেয়ে একই প্রশ্ন দ্বিতীয়বার করতে হলো তাঁকে।
কোনোমতে বললাম, জি, আছে।—কথাটা বোঝা গেল কি না কে জানে, উচ্চারণ ছাপিয়ে একটা কঁকিয়ে ওঠার শব্দ বেরিয়ে এল আমার মুখ দিয়ে।
ফর নাথিং।—অফিসারের গলায় এবার বিরক্তি বা কিছুটা আফসোস, ফর নাথিং আমাদের এত সময় নষ্ট করলা মিয়া, নিজেও কষ্ট পাইলা, শুরুতেই সব স্বীকার করলে...।
কনস্টেবল একটা প্লাস্টিকের কাপে চা আর খবরের কাগজের টুকরোয় মোড়ানো একটা পরোটা এনে দিল। হাত বাড়িয়ে নিতে গিয়ে ব্যথায় সমস্ত শরীরটা কেঁপে উঠল থরথর করে, হাতটা এগোল না। কনস্টেবল নিজে ধরে আমার এক হাতের ওপর চায়ের কাপ, অন্য হাতে পরোটা তুলে দিল। আমি পরোটায় কামড় বসানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা করলাম, কিন্তু ফোলা ঠোঁটের কারণেই বোধ হয় কষ বেয়ে লালা গড়িয়ে নামল, অনেক কসরৎ করে চায়ের কাপেও চুমুক দিলাম।
সম্ভবত আমার খাওয়ার দৃশ্যটি মোটেই তাকিয়ে দেখার মতো ছিল না এবং যে কারণে এ রকম একটি দৃশ্যের অবতারণা হলো, তা মনে করে অফিসার বিরক্ত কিংবা অনুতপ্ত হয়ে আবার বললেন, ফর নাথিং, শুরুতেই স্বীকার করলে...।
উঠে দাঁড়ালেন অফিসার। আলো-আঁধারি এই ঘরে বৈদ্যুতিক আলো ছাড়া আর যেদিক থেকে সামান্য দিনের আলো আসছিল, সেই দরজাটার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে কনস্টেবলকে নির্দেশ দিয়ে গেলেন—দুইটা প্যারাসিটামল খাওয়াই দিয়ো।
যে কারণে অফিসার বিরক্ত, এবং আমার মনে হলো তিনি কিছুটা অনুতপ্তও, তা হচ্ছে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য গত দুই দিনে আমাকে তিন দফা বেধড়ক পেটাতে হয়েছে। বিস্তারিত বিবরণে না গিয়ে শুধু এটুকু বলি, প্রথম দফার ভয়াবহতার পরই আমার গরগর করে স্বীকার করার কথা। কিন্তু এরপরও যে আমাকে আরও দুই দফা এ রকম কড়া ডোজ হজম করতে হলো, তার কারণ, যে বিষয়টা নিয়ে আমাকে মুখ খুলতে বলা হচ্ছিল সে বিষয়ে আমার বিস্তারিত জানা ছিল না। এমনকি যে মেয়েটাকে আমি খুন করেছি এবং খুনের আগে ধর্ষণ করেছি বলে আমাকে স্বীকার করতে হবে তার নাম যে জোহরা খাতুন ওরফে শিউলি, তা-ও জানা ছিল না আমার।
আসলে নিয়তি আমাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল মেয়েটির কাছে। ফিরিঙ্গিবাজার অভয় মিত্র ঘাট এলাকায় একটি কাঠ চেরাইয়ের কারখানার আমি ম্যানেজার। পদবিটি বলার জন্য যতটা সম্মানজনক, আমার চাকরি আসলে ততটা নয়। শুরুতে বারো হাজার ছিল, দুই বছরের মাথায় কাজে সন্তুষ্ট হয়ে মালিক ভদ্রলোক চৌদ্দ হাজার টাকা বেতন ধার্য করেছেন। এই বেতনে একজন বিএ পাস যুবককে যত ধরনের কাজ করানো সম্ভব তার প্রায় সবটাই করিয়ে নেওয়া যায় আমাকে দিয়ে। বড় বড় গাছের গুঁড়ি নিয়ে কারখানার সামনে এসে ট্রাক দাঁড়ালে, চালান ও রসিদের সঙ্গে মিলিয়ে সেই গাছের গুঁড়ি বুঝে নেওয়া, কী পরিমাণ কাঠ চেরাই হয়ে গুদামে জমা হলো তার একটা হিসাব রাখা, দরদাম করে কাঠের তক্তা বিক্রি করা এবং সেই টাকা নগদ কিছু মালিকের হাতে, কিছু-বা ব্যাংকে জমা দেওয়া ইত্যাদি পিওন টু কেরানির দায়িত্ব সামলে আমার কাজ শেষ হতে হতে সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত একাকার। কারখানার পাশেই হতশ্রী একটি কামরায় আমার থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন মালিক। নিজের স্বার্থেই দিয়েছেন, রাত-বিরাতে যাতে প্রয়োজন পড়লে হাতের কাছেই পাওয়া যায়। আমার কোনো অভিযোগ ছিল না, কারণ বোয়ালখালী কলেজ থেকে বিএ পাস করে শহরে এসে আমি চোখে যখন অন্ধকার দেখছিলাম, তখন আমার এক দূরসম্পর্কের মামা এই চাকরির সন্ধান দিয়ে আমাকে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছিলেন।
আমার বাবা নেই। নেই মানে, যে বয়সে পিতৃহীন হলে তিনি ছিলেন বলে মনে থাকে না, সেই বয়স থেকে নেই। মা আছেন আর চম্পাবু। এই বড় বোনটার ন্যাওটা ছিলাম আমি। চম্পাবু স্কুলে যাওয়া-আসার পথে একটি মনিহারি দোকানের মনোহর দোকানদারের প্রেমে পড়েছিল। বাংলা সিনেমা আসক্ত সেই তরুণ অনুকরণ করতে করতে চলনে-বলনে নিজেই প্রায় বাংলা চলচ্চিত্রের চরিত্র হয়ে উঠেছিল। এ ধরনের যুবকেরা বোধ হয় গ্রামের মেয়েদের দৃষ্টি আকর্ষণে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে থাকে। আমার ক্লাস টেনপড়ুয়া চম্পাবু পরিবারের সম্মতি না পেয়ে এই চরিত্রটিকে বিয়ে করেছিল পালিয়ে।
আমার মা জীবনে আর কখনো মেয়ের মুখ দেখবে না বলে কসম করেছিল। কিন্তু এখন মৃত স্বামীর একফালি ভিটেবাড়িতে সেই মেয়ে, জামাই আর নাতিকে নিয়ে মোটামুটি সুখেই দিন কাটছে তার। আমি নিজের খরচ বাঁচিয়ে মাঝেসাঝে বাড়িতে কিছু টাকাপয়সা পাঠাই। তাতে তারা খুশি না অসুখী তেমন বুঝতে পারি না।
শহরে আমার যাওয়ার জায়গা তেমন নেই। কারখানা আর কারখানার পাশে নিজের থাকার ঘরটাতেই আমার দিন কেটে যায়, রাত কেটে যায়। শুধু রাতে খাওয়াদাওয়ার পর প্রতিদিনই প্রায় কর্ণফুলীর তীরে গিয়ে বসি। কাছেই তো অভয় মিত্র ঘাট, কখনো সেই ঘাটের এক কিনারে, কখনো আরও কিছুটা পথ হেঁটে পোর্ট কলোনির পাশে প্রায় নির্জন এলাকায় ব্রিজঘাটে। ব্রিজঘাটে আগে জাহাজ ভিড়ত, এখন ভেড়ে না, তাই লোকজনের তেমন যাতায়াতও নেই। একা বসে সিগারেট ফুঁকি। তখন আমার নানা কথা মনে পড়ে। গ্রামের কথা, শৈশবের কথা, স্কুল-কলেজের বন্ধুদের কথা এমনকি গ্রামের হাটবাজারের কথা পর্যন্ত মনে পড়ে। যেন এগুলো গত জীবনের গল্প। আর মনে পড়ে শেফালীর কথা। কী আশ্চর্য, শেফালীর কথা মনে পড়লে প্রতিদিনই প্রায় কী করে যেন সিগারেটের শেষাংশের আগুন আমার আঙুলে ছ্যাঁকা দেয়, আমি চমকে উঠি, সিগারেট ছুড়ে ফেলি, আর অন্ধকার নদীর দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস নিয়ে আমি বর্তমানে ফিরে আসি।
কোনো দিন অভয় মিত্র ঘাট, কোনো দিন ব্রিজঘাট। যেদিন দু-একজন লোকের সঙ্গে দেখা হলে, তারা আমার কুশলাদি জিজ্ঞেস করলে নেহাৎ বিরক্তি লাগে না, সেদিন যাই অভয় মিত্র ঘাটে। এই ঘাটে দিবারাত্রি কিছু লোকজন থাকেই। আর যেদিন একা, নিজের সঙ্গে একেবারেই একা থাকতে ইচ্ছে করে সেদিন ব্রিজঘাটে, সেখানে কদাচিৎ এক-দুজন মানুষের দেখা মেলে, রাতে প্রায় ভুতুড়ে নির্জনতা ওই ঘাটে। কখনো অমাবস্যা, কখনো পূর্ণিমা, প্রতিদিন একই অভ্যাসে প্রায় একই রকম রাত বাড়ে। খুব বেশি ঝড়-বৃষ্টি না হলে নিয়মের হেরফের হয় না, বেশ রাত করে আমি ফিরে আসি। কিন্তু সেই রাতটা ছিল অন্য রকম। সে রাতে অভয় মিত্র ঘাটে গেলে কিছুই ঘটত না, কিন্তু আমি গিয়েছিলাম ব্রিজঘাটে। বন্দর-আবাসিকের একটি পরিত্যক্ত বাংলো পেরিয়ে ব্রিজঘাটের দিকে এগোতেই একটা তক্ষক ডেকে উঠেছিল, বিশাল অশ্বত্থগাছের কোনো এক ফোকর থেকে। এই প্রাণীর ডাক এমন অদ্ভুত, রোজ শুনি, তবু রোজ বুক কেঁপে ওঠে।
জনমানবহীন ব্রিজঘাটের এক কোণে সিমেন্টের রেলিংয়ের বসে সিগারেট ধরানোর জন্য ম্যাচের বারুদে কাঠি একবার ঠুকতেই ফস্ করে আগুনের ফুলকি জ্বলে উঠে নিভে গেল। ওই সামান্য আলোতেই যেটুকু দেখার দেখে ফেলেছি আমি এবং কাঁপতে শুরু করেছি। যে পথে এসেছি, সোজা সে পথেই ফিরে যাব কি না ভেবে এক কি দুই মুহূর্ত ব্যয় হলো। কিন্তু ভয় ছাপিয়ে কেন যে কৌতূহল বাড়ল! ভরা জোছনাও না, আবার ঘোর অমাবস্যাও না, মোটের ওপর যেটুকু অন্ধকার চোখে সরে যায় সে রকম আলো-আঁধারির মধ্যে দেখতে পেলাম ব্রিজের ওপর পড়ে আছে একটি নারীদেহ। কৌতূহলের কারণ ছিল, এত রাতে নিশ্চয় মেয়েটি এখানে ঘুমাতে আসেনি। তা ছাড়া সাধারণত পথে-ফুটপাতে যে মেয়েরা ঘুমায়, তারা এ রকম চিৎপাত হয়ে অর্ধউলঙ্গ অবস্থায় ঘুমায় না। প্রায় কাঁপতে কাঁপতে কী এক ঘোরের মধ্যে আমি মেয়েটির দিকে এগিয়ে গেলাম। কত হবে বয়স-বাইশ থেকে পঁচিশের মধ্যে। গরিব ঘরের মেয়ে, চেহারা ও পোশাক দেখে বোঝা যায়। তবে শ্যামলা মেয়েটি দেখতে ভারি সুন্দর, যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে থাকা মুখটির ভেতর থেকেও তার চেহারার সৌন্দর্য অনুমান করা সম্ভব। খুব কাছে গিয়ে, আমি বোঝার চেষ্টা করি মেয়েটি জীবিত না মৃত। শাড়িটা উঠে আছে প্রায় ঊরু পর্যন্ত, বোতাম ছেঁড়া ব্লাউজ বুকের দুই পাশে ছড়িয়ে আছে, আর স্তন দুটি যেন খুব ধীরে উঠছে আর নামছে। আমি প্রায় মুখের কাছে ঝুঁকে ভালো করে দেখার চেষ্টা করলে মেয়েটির ক্ষীণ কণ্ঠস্বর শুনতে পাই—পানি...।
মেয়েটি যে জীবিত বুঝতে পেরে একটু পানি কীভাবে জোগাড় করা যায় ভেবে উঠে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি, তখনই হঠাৎ বজ্র-বিদ্যুতের পর ঝোড়ো হাওয়ার মতো হেডলাইটের কড়া আলো জ্বালিয়ে বিকট শব্দে একটা জিপ এসে দাঁড়াল সামনে। গাড়ি থেকে দুদ্দাড় করে নামল দু-তিনজন পুলিশ। তারাও দ্রুত মেয়েটির কাছে গিয়ে বুঝতে চাইল, জীবিত না মৃত। ঠিক এ সময়টাতে একটা অদ্ভুত কাণ্ড করে বসল মেয়েটা, ডান হাতের একটা আঙুল তুলে আমাকে দেখিয়ে অস্ফুট স্বরে বলল, এই লোকটা...।
‘এই লোকটা’—বলে আমাকে দেখিয়ে জোহরা খাতুন আসলে কী বোঝাতে চেয়েছিল এই রহস্যটা আমার কাছে কিছুতেই পরিষ্কার হলো না। আর কখনো হবে না। কারণ মেয়েটিসহ আমাকে পুলিশের গাড়িতে তুলে নেওয়ার পর পথেই শিউলি মারা গিয়েছিল।
মৃত্যুর ঠিক আগে যে লোকটাকে ভিকটিম মহিলাটি শনাক্ত করে গেছে, সে-ই যে এ ঘটনার জন্য দায়ী এ বিষয়ে সংশয় থাকার আর কোনো কারণ থাকতে পারে না। পুলিশের কাজ সহজ হয়ে গেল। এখন তাদের শুধু জানা দরকার মেয়েটির সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী, আমি কেন তাকে ধর্ষণ ও হত্যা করেছি।
যে লোকটি প্রকৃতপক্ষে এই ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, সে নিশ্চয় মেয়েটির মৃত্যু নিশ্চিত করেই পালিয়েছিল। না হলে তার নাম আসতে পারত, অত কাঁচা কাজ তার করার কথা নয়। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য মেয়েটি আরও কিছুটা সময় বেঁচেছিল, আমার কাছে একবার একটু পানি চেয়েছিল, আর শেষ মুহূর্তে আমার দিকে আঙুল তুলে বলে গেল—এই লোকটা!
প্রথম দফা কিল-ঘুষি, লাঠি-পেটা আর বুট জুতার লাথি খেয়েই আমি এই খুন ও ধর্ষণের দায় নিতে রাজি হয়ে যাব সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কারণ, আমার উপলব্ধি হয়েছিল এই মৃত্যুযন্ত্রণার চেয়ে ফাঁসিতে ঝুলে পড়া অনেক কম কষ্টকর। কিন্তু ঘটনার কারণ সম্পর্কে তখনো ধারণা ছিল না বলে পূর্বাপর গুছিয়ে বলার মতো তথ্য আমার হাতে ছিল না। শুধু এই কারণেই আরও দুই দফা চরম বিভীষিকার মুখোমুখি হতে হয়েছে আমাকে। তৃতীয়বার মারধরের পর আমি যখন দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে চেতন-অবচেতনের মাঝামাঝি ঝুলে আছি, তখন পুলিশ সদস্যদের কথোপকথন আমার কানে এসেছিল। তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল, মেয়েটার নাম জোহরা খাতুন, ডাকনাম শিউলি। ইপিজেডের একটি গার্মেন্টস কারখানায় কাজ করত। ইপিজেডের কাছাকাছিই একটি দুই কামরার ঘরে অন্য একটি দরিদ্র পরিবারের সঙ্গে সাবলেট থাকত। মেয়েটির যেহেতু বিয়ে হয়নি, প্রেমিকের সঙ্গে বিবাদ বা বিশ্বাসভঙ্গের কারণে যে তাকে মরতে হয়েছে এমন অনুমানও করছিল আলাপরত পুলিশ সদস্যরা। তখনই মোটামুটি নিজের মতো করে গল্পটা সাজিয়ে নিয়েছিলাম আমি। এই ঘটনায় আমি কীভাবে জড়িত তার একটি বিশ্বাসযোগ্য গল্পও দাঁড় করাতে পেরেছি মনে মনে।
আমার দুই চোখের মাঝখানে কপালের কাছাকাছি একটা তীব্র আলো জ্বলছিল। আমি অস্পষ্ট স্বরে বলতে পেরেছিলাম, আলোটা নিভিয়ে দেন, আমি একটু ঘুমাব।
তখন একজন অফিসার এগিয়ে এসে বলেছিলেন, তোমাকে ঘুমাতে দেব, তুমি বিছানায় শুয়ে আরামে ঘুমাতে পারবে, তার আগে সব কথা স্বীকার করো...।
চেতন-অচেতন অবস্থায় শোনা তথ্যের ওপর নিজেকে দাঁড় করিয়ে বিশ্বাসযোগ্যভাবে এ ঘটনায় নিজের জড়িত থাকার গল্পটা বলতে পেরেছিলাম। বর্ণনাটা ভালোই দিয়েছি বলতে হবে। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল পুলিশ। আমাকেও ঘুমাতে দিয়েছিল নিশ্চিন্তে। এখন ঘুম থেকে উঠে আমি নির্ভার।
প্যারাসিটামল খাওয়ার পর ব্যথাটা একটু কমই মনে হচ্ছে। কিন্তু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে টয়লেটে যাওয়ার পর টের পেয়েছি শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অনেকটাই বিকল। আমার পেচ্ছাব বেরোচ্ছিল না।
অফিসার এসে বললেন, ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি দিতে হবে।
জি, দেব।
যা যা কইছ, ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে গিয়া সব ঠিকঠাক থাকব তো?
জি, থাকবে।
ঠিকঠাক মতো না কইলে, পরের ব্যবস্থা কী হবে বুঝতে পারছ?
জি, পারছি।
গাড়িতে তুলে কোর্ট বিল্ডিংয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের কক্ষে নিয়ে আসা হলো আমাকে। সুবেশী, সুদর্শন ম্যাজিস্ট্রেট কাগজপত্রে চোখ বুলিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি পুলিশ না, এখানে যা বলার কোনো চাপ ছাড়া, ভয়-ভীতি ছাড়া বলবেন। স্বীকারোক্তি দেওয়ার জন্য আপনাকে কি কোনো রকম চাপ বা ভয়-ভীতি দেখানো হয়েছে?
না স্যার।
তাহলে বলেন, সব কথা রেকর্ড হচ্ছে, ভেবে-চিন্তে বলবেন।
আমি ভেবে-চিন্তে সব কথা বললাম। সেই একই গল্প। কীভাবে শিউলিকে ধর্ষণের পর খুন করেছি তার বিস্তারিত বিবরণ।
সব শুনে কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ম্যাজিস্ট্রেট। তারপর একধরনের ক্ষোভ-দুঃখ মেশানো গলায় বললেন, কেন? কেন করলেন এসব?
শেফালী আমার সঙ্গে বেইমানি করছিল স্যার।
শেফালী না, মেয়েটার নাম তো শিউলি।
জি, ভুল বলছি, শিউলি।
কী বেইমানি করেছিল শিউলি?
শিউলির কথা মুছে গিয়ে তখন অনেক দূরের একটা মেয়ের কথা মনে পড়ল আমার। শেফালীর কথা। শেফালীকে ভালোবাসতাম আমি, শেফালীও বাসত আমাকে। বলা চলে, আবাল্য প্রেম। বোয়ালখালীর গ্রামে বারো ঘর এক উঠোনের বাড়িতে একসঙ্গে বড় হয়েছি আমরা দুজন। আমার বছর দুয়েকের ছোট শেফালী। কখন ভাব-ভালোবাসা হয়েছিল মনে নেই, যেন হাঁটতে-বলতে শেখার পর থেকেই জেনেছিলাম অন্য বালক-বালিকাদের চেয়ে আলাদা হয়ে আমরা দুজন পরস্পরের কাছের মানুষ। ‘সবুজ সাথী’ বই পড়ার সময় থেকে আমরা খেলার সাথি। শেফালী কী কখনো বলেছিল, আমিও কী বলেছি, কিন্তু আমরা যে ভালোবাসি কী করে দুজনই তা জানতাম। ওই বয়সে কে এসব জানাল আমাদের? ছোটবেলায় ঝগড়াঝাটি হতো, বড় হতে হতে অভিমান। কেমন করে যেন বড়রাও জানত, এই দুজনের সম্পর্কটা আলাদা। যখন কলেজে ভর্তি হলাম, শেফালী হাইস্কুলে তখন। বোয়ালখালীর অজস্র সুপারি বাগানের নির্জতায় গোপনে আমাদের এক-আধটু ধরা-ছোঁয়া, আদর, চুমু খাওয়া এসব হতো। কেউ কী আর দেখেছে, তবু সন্দেহের বশে শেফালী তার মায়ের কাছে মারধর খেত। যেদিন মারধর খেত, পরদিন শেফালীকে আমি আরও বেশি করে আদর করতাম, ও সব দুঃখ-ব্যথা ভুলে যেত। এসএসসি পরীক্ষায় পাস করার পর হঠাৎ শেফালীর বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। আমি তখন বিএ পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। শেফালী রাজি ছিল না। শেফালী বলেছিল, চলো শাহজাহান, আমরা পালিয়ে যাই।
আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না পালিয়ে আমরা কোথায় যাব, আমার তো টাকাপয়সা নেই। আমার মা শেফালীর মাকে অনেক বুঝিয়েছে, ছেলেটা বিএ পাস করলেই চাকরি পাবে...।
শেফালীর মা-বাবা শোনেনি, জোর করে ওর বিয়ে ঠিক করেছিল ভূমি রেজিস্ট্রার অফিসের এক কর্মচারীর সঙ্গে। ভেবেছিলাম বিয়ের আসরে আগুন জ্বালিয়ে দেব, পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে লাঠিপেটা করে বিদায় করব বরযাত্রীদের। কিছুই করতে পারিনি। দিন-তারিখ মতো বিয়ে হয়ে গেল শেফালীর। এসব ক্ষেত্রে যারা কিছুই করতে পারে না, ভাগ্যিস তাদের জন্য শরৎচন্দ্রবাবু এক লাইনের একটি সান্ত্বনা রেখে গিয়েছিলেন—‘বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না, দূরেও...।’ আমার কানামাছি, লুকোচুরির দিন, আমার সুপারি বাগানের অন্ধকারে শিউরে ওঠার মুহূর্তগুলো, সবকিছু সঙ্গে করে নিয়ে শেফালী শ্বশুরবাড়ি চলে গেল।
ফিরিঙ্গিবাজারের স মিলে চাকরি পাওয়ার পর প্রথম যেবার বাড়ি গিয়েছিলাম, সেবারই হঠাৎ দেখা হয়ে গিয়েছিল শেফালীর সঙ্গে। বাপের বাড়ি বেড়াতে এসেছিল।
জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেমন আছো শেফালী?
শেফালীর চোখের কোণে কালি, শেফালীর চেহারা অনুজ্জ্বল, উদাসীন, তবু বলল, ভালো আছি।
পরে অবশ্য ধীরে ধীরে সব বলেছিল। তার স্বামীর স্বভাব-চরিত্র ভালো না, নেশা করে, জুয়া খেলে আরও অনেক কিছু...। মধ্যরাতে বাড়িতে ফিরে বউয়ের গায়ে হাত তোলে।
বলেছিলাম, চলো পালিয়ে যাই শেফালী, যাবে আমার সঙ্গে?
শেফালী অদ্ভুত ভঙ্গিতে হেসে বলেছিল, বিয়ের আগেই পারো নাই, আর এখন...।
শহরে ফিরে আসার কয়েক দিন পর খবর পেয়েছিলাম শেফালী আত্মহত্যা করেছে। গ্রামের অনেকেরই নাকি ধারণা, আসলে তার স্বামী তাকে খুন করে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিয়েছে। কোনটা সত্য কে জানে।
ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বললেন, বলেন শাহজাহান সাহেব, কেন খুন করেছেন মেয়েটাকে, রেপ করলেন কেন?
আমি বললাম, শেফালী আমার সঙ্গে বেইমানি করেছিল স্যার, আরেকজনের সঙ্গে...
শেফালী তো না, শিউলি।
ও-ই একই তো কথা স্যার, শেফালী আর শিউলি একই কথা।
ম্যাজিস্ট্রেট গম্ভীর ও বিরক্ত হয়ে তাকালেন।
শেফালীকে আমি ভালোবাসতাম স্যার, ও আরেকটা লোকের সঙ্গে চলে গেল...আমি বিএ পাস করলেই চাকরি পাব বলেছিলাম, তবু...বিয়ের পর তো সুখ পায় নাই, পালিয়ে যেতে বলেছিলাম স্যার, শুনল না...।—বলতে বলতে আমার গলার কাছে কান্নার গমক দলা পাকিয়ে উঠছিল। গত দুটো দিন ধরে এত নির্যাতনের পরও আমার চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি বেরোয়নি দেখে পুলিশের লোকেরা অবাক হয়েছিল। এখন আমি আর সামাল দিতে পারছি না। মৃত্যুর মাত্র কয়েক দিন আগে শেফালীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ওর মৃতদেহটা দেখিনি, এখন অদেখা সেই নিথর দেহটি চোখে ভাসছে আমার। হু হু কান্নায় ভেঙে পড়লাম, পাড়ভাঙা নদীর পানির তোড়ে খড়কুটোর মতো ভেসে যাচ্ছি আমি।
ম্যাজিস্ট্রেট বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।