একটি ছবির পটভূমি

‘ম্যাডোনা’, শিল্পী: জয়নুল আবেদিন
‘ম্যাডোনা’, শিল্পী: জয়নুল আবেদিন

মেয়েটিকে আর কখনো আমি দেখিনি। জানি না, শেষ পর্যন্ত তার পরিণতি কী ঘটেছিল। কিন্তু প্রায়ান্ধকার সেই ব্যাফল-ওয়ালের আড়ালে সেদিন মূর্তিমতী মাতৃত্বের যে অবমাননা আমি দেখেছিলাম, সভ্যতার যে আর্তনাদে আমার শ্রবণেন্দ্রিয়কে সেদিন উচ্চকিত করেছিল, সেই দৃশ্য, সেই ধ্বনি যেন আমাকে আজও তাড়া করে ফেরে।
১৯৪৩ সালের কলকাতা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে এক বিশাল হাহাকারের রাজ্যে। আকাশে শকুনের ঝাঁক, বাতাসে হা অন্ন হা অন্ন শব্দের ঐকতান। গ্রামকে গ্রাম উজাড় করে ক্ষুধার্ত নর-নারীর মিছিল এসে ঢুকে পড়েছে প্রাসাদ নগরের অঙ্গনে। তারা আসছে, আসছে, আর আসছে। এ আসার যেন শেষ নেই। কিন্তু কিসের আশায় আসা? কে জানে? দুর্ভিক্ষের সর্বগ্রাসী থাবা থেকে কলকাতারও কি রেহাই ছিল? সংগতিসম্পন্ন নগরবাসী তাদের ডাইনিং রুমের জানালায় ভৌতিক মুখ দেখে শিউরে ওঠে। ফুটপাতের অজস্র অর্ধনগ্ন, কঙ্কালসার মানুষের কণ্ঠ থেকে ঝরে পড়ে আকুল ক্রন্দন: ফেন দাও, ফেন দাও! ডাস্টবিনের এঁটোকাঁটায় কুকুরের সঙ্গে আদম সন্তানের হাতাহাতির যেন শেষ হবে না কোনো দিন। এই তো তখনকার কলকাতা!
আর্ট কলেজ থেকে পাস করে বেরিয়ে আমি তখন সেখানেই শিক্ষকতা করি। থাকি সার্কাস রো-এর একটি ঘরে—একা। খাই কখনো হোটেলে, কখনোবা নিজে রেঁধে। মাঝেমধ্যে ঠিকে চাকরও রেঁধে দেয় অবশ্য। এ সময় বন্ধুবান্ধব বা চেনাজানা জনা কয়েক লোক একত্র হলেই আরম্ভ হয় দুর্ভিক্ষ-সম্পর্কিত যার যার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বর্ণনা। গা শিউরে ওঠা একেকটি ঘটনা। কেউ জানান, এঁটো কলাপাতা নিয়ে তিনি মানুষে মানুষে, স্বামী-স্ত্রীতে কিংবা কুকুরে-মানুষে কাড়াকাড়ি করতে দেখেছেন। কেউ জানান, নরমাংসভুক হিংস্র শকুনের নাকের ভেতর তিনি স্বচক্ষে দেখে এসেছেন এক বা একাধিক ছিন্নভিন্ন নরদেহ। আবার কেউ কেউ কম্পিত গলায় বর্ণনা করেন দুঃখেকষ্টে কারও ধুঁকে ধুঁকে শেষ হয়ে যাওয়ার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার করুণ কাহিনি।
এসব গল্প শুনতাম। গভীর রাতে একা একা বেরিয়ে পড়তাম রাস্তায়। কখনো শেয়ালদা, কখনো হাওড়ার পথে হাঁটতাম। হাঁটতে হাঁটতে দুর্ভিক্ষের একেকটা অবিশ্বাস্য খণ্ডছবি দেখে থমকে দাঁড়াতাম। কখনো সাদা কাগজের বুকে ওই সব জ্যান্ত ছবির কোনো কোনো অংশ স্কেচ করে নিতাম অনেকটা যেন আনমনেই। এ সময় এসব দুর্ভিক্ষের ছবি আঁকার একরকম ঝোঁকই আমার মাথায় চেপে বসেছিল বলা যায়। কিন্তু কাজটা চলত খুব গোপনে।
দুর্ভিক্ষ আমাকে বেদনার্ত করত। দুর্ভিক্ষের ছবিও আমি আঁকতাম। কিন্তু কেন আঁকতাম? নিজেকে এ প্রশ্ন করে নিজের কাছ থেকে যে জবাব পেয়েছি, তাতে একটা জিনিস খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে কেবল দুর্ভিক্ষের বীভৎসতা ফুটিয়ে তোলাই আমার প্রবৃত্তিকে প্ররোচিত করেনি। আমার স্কেচগুলো যেন একটি প্রসঙ্গকেই সোচ্চার করে তুলেছিল, যার অর্থ, এ দুর্ভিক্ষে যারা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, তারা মানুষ; যারা এই দুর্ভিক্ষের স্রষ্টা, তারাও মানুষ। এ যেন অনেকটা সেই ক্রিটিসিজম, যা সমাজের প্রতি, মানবতার প্রতি প্রযোজ্য।
১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষের ওপর স্কেচ করেছিলাম অনেক। আমার ‘ম্যাডোনা’ শীর্ষক স্কেচটিও তখনকার করা। ম্যাডোনা যখন আঁকি, তখন র্যা ফায়েলের ম্যাডোনার কথা আমার মনে হয়েছিল। মনে হয়েছিল, আমি বর্তমানের ‘শিল্পী’, ভবিষ্যতের ‘স্রষ্টা’ নই। র্যা ফায়েলের ম্যাডোনায় যৌবন আর তারুণ্যের যে উজ্জ্বলতা বিদ্যমান, আমার ম্যাডোনার যৌবনের উজ্জ্বলতা তার চেয়ে ম্লান ছিল না। মানবিকতার সেই অলৌকিক প্রতিকূল পটভূমিতে আমার ম্যাডোনার শাশ্বত রূপের কি তুলনা মেলে! ছবিটির জন্মকথা বলি।
একদিন গভীর রাতে হঠাৎ দেখতে পেলাম, একটা বাড়ির দিকে বহু লোক দৌড়ে যাচ্ছে। যুদ্ধের সময়। বড় বাড়িগুলোর নিরাপত্তার জন্য মাঝেমধ্যেই তোলা হয়েছে ব্যাফল-ওয়াল। দেখলাম সবাই তেমনই একটা ব্যাফল-ওয়ালের দিকে দৌড়ে যাচ্ছে। কৌতূহলী হয়ে আমিও সেদিকে পা চালালাম। আশ্চর্য ব্যাপার তো! অন্ধকার সিঁড়ির গোড়ায় নারীকণ্ঠের অস্ফুট গোঙানির শব্দ কানে আসতেই থমকে দাঁড়ালাম। উৎকর্ণ হয়ে অন্যরাও দাঁড়িয়ে পড়েছে ব্যাফল-ওয়ালের গা ঘেঁষে। কেউ কিছু বুঝতে পারছে না। গোঙানিটা একবার বাড়ছে, আবার হ্রাস পাচ্ছে। এমন সময় ওপর থেকে বোধ হয় গৃহকর্তার গলাই শোনা গেল, কী হয়েছে ওখানে? নিচ থেকে কে যেন জবাব দিল, পাগলটাগলের কাণ্ড বোধ হয়। বাড়ির মালিক সিঁড়ি ভেঙে নেমে এলেন। সবাই সিঁড়ির গোড়ার দিকে এগিয়ে গেল এবার। আবছা অন্ধকারে চাতালের ওপর পড়ে থাকা ছায়ামূর্তিটিকে একটি যুবতী বলেই মনে হলো। কিন্তু কে? সবার মনেই এক প্রশ্ন: অমন করছে কেন? ওপর থেকে বাড়ির গৃহিণীও বুঝি নেমে এলেন একসময়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সেখানে এসে জড়ো হলেন আশপাশের ফ্ল্যাটের নারীরাও।
আলো জ্বলে উঠলে দেখা গেল কঙ্কালসার এক যুবতী সেখানে পড়ে আছে। পরনের শতচ্ছিন্ন কাপড়ের আড়ালে ফুটে উঠেছে তার লাঞ্ছিত যৌবন। মেয়েটি প্রসবব্যথায় কাতর হয়ে পড়েছিল।
সমবেত নারীদের কথাবার্তা থেকেই বোঝা গেল, ক্ষুধার্ত মেয়েটি এই প্রথমবারের মতো প্রসবের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে। হাজার হলেও নারীমন! দেখতে দেখতে সেই দুর্ভিক্ষপীড়িতা রাস্তার মেয়েটির সেবাশুশ্রূষায় লেগে গেলেন সমবেত নারীরা।
ভোররাতের দিকে শুনতে পেলাম, মেয়েটির বাচ্চা হয়েছে। খবরটা শুনে কতজনে কত কথা বলল। কেউ বলল, অদৃষ্টের পরিহাস। কেউ বলল, মিলিটারিদের স্বেচ্ছাচারের ফল। কেউবা আবার বলাবলি করল যে স্বামীটা বোধ হয় আগেই মরেছে ইত্যাদি।
আমি যেন কেমন আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিলাম। দুর্ভিক্ষের কত করুণ, কত বীভৎস রূপ আমি প্রত্যক্ষ করেছি; কিন্তু মাতৃত্বের এমন মর্মস্পর্শী রূপ আমি আর কখনো দেখিনি।
ব্যাফল-ওয়ালের আড়ালে শায়িতা সেই বিশীর্ণ-যৌবনা, তার একটি পা আর এক পায়ের ওপর আড়াআড়িভাবে রাখা ডান হাতের শীর্ণ আঙুলগুলো তোবড়ানো টিনের থালার ওপর ছড়িয়ে আছে...সদ্যোজাত শিশুটি হাত বাড়িয়ে খুঁজছে যেন মায়ের বুকের নির্ভরতা...এই ছবিটা আমার মনে আলোড়নের সৃষ্টি করল।
বারবার আমার মনে হতে লাগল, মৃত্যুপথযাত্রী ওই যুবতী যেন বলছে, ‘আমি মানুষের কাছে রেখে গেলাম এই শিশু-মানুষকে।’
মেয়েটিকে আমি আর দেখিনি। জানি না, শেষ পর্যন্ত তার কী হয়েছিল। কিন্তু যে চিরন্তন মায়ের মূর্তিতে সেদিন তাকে দেখেছিলাম, সেই অনুভূতির ফলই আমার এই ‘ম্যাডোনা’ বা ‘মাতৃমূর্তি’।
১৯৬৯ সালের ১০ ডিসেম্বর ইত্তেফাক-এর ঈদসংখ্যায় লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়