একাত্তরের বর্ষাকাল

প্রকৃতিতে এখন বর্ষাকাল। ১৯৭১ সালে এই বৃষ্টিমুখর বর্ষাকাল কীভাবে সহযোগিতা করেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের? মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীর প্রহরে জানা যাক সেই বৃত্তান্ত।

মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি অবলম্বনেগ্রাফিকস মনিরুল ইসলাম

বাংলাদেশ ছয় ঋতুর দেশ। প্রতি ঋতুই আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে হাজির হয়। এর মধ্যে বর্ষাকাল হলো দ্বিতীয়। গাছের নতুন পাতা, ফুল, ফল আর পাখির গানসহ নানা কারণে বসন্তকালকে ঋতুরাজ বলা হলেও সৌন্দর্যের জন্য বর্ষাকালকেই অনেকে শ্রেষ্ঠ বলে থাকেন। কেউ আবার একে প্রকৃতির রানিও বলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে যে কতগুলো বিষয় সহায়ক অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করেছে, তার মধ্যে অন্যতম এই বর্ষাকাল। গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে অনবদ্য ভূমিকা রেখেছে প্রাণপ্রকৃতির এই মৌসুম।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম সম্পাদিত ‘বাংলাপিডিয়া’ থেকে জানা যায়, বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে আষাঢ়-শ্রাবণ (মধ্য জুন থেকে মধ্য আগস্ট) দুই মাস বর্ষাকাল। তবে বাস্তবে জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এর স্থায়িত্ব। বার্ষিক বৃষ্টিপাতের ৮০ শতাংশের বেশি হয় এ সময়। গ্রীষ্মের প্রখর উত্তাপে মৃতপ্রায় বৃক্ষরাজি বর্ষার শীতল বৃষ্টিতে নবজীবন ফিরে পায়। এ সময় নদীনালা খাল-বিল পানিতে থই থই করে (অবশ্য দখল-দূষণে মৃতপ্রায় অনেক নদী ও খালে বর্ষার এই সৌন্দর্য ইদানীং আর দেখা যায় না)। খালে-বিলে ফোটে জাতীয় ফুল শাপলা। বর্ষাকালে জমিতে পলি জমে, যা পরে চাষাবাদে ব্যাপক উপকারে আসে।
তবে নানা রূপে ও বৈশিষ্ট্যে বর্ষাকাল অনন্য হলেও এর নেতিবাচক দিক হলো প্রধানত বন্যা।

দুই.

মুক্তিযুদ্ধে বর্ষাকালের ভূমিকা ছিল বহুমাত্রিক; অনেক ক্ষেত্রে যুদ্ধে গতি-প্রকৃতি নির্ধারণ করেছে এই মৌসুম।
বর্ষাকাল সামনে রেখে বিশেষ রণকৌশল ও প্রস্তুতি নেয় বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী।

কারণ, দখলদার পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী এসেছিল শুষ্ক এলাকা থেকে। বর্ষাকালের বাংলাদেশজুড়ে পানিতে থই থই নদ-নদী, খাল-বিল ও জলরাশিতে ভেসে থাকা বিস্তীর্ণ গ্রামে যুদ্ধ পরিচালনায় অনভিজ্ঞ ছিল তারা। অপরদিকে বাঙালিরা হলো ‘পানির দেশের মানুষ’। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে কথাটি উল্লেখ করেছিলেন যে ‘পানির দেশের মানুষ আমরা, পানিকে বড় ভালোবাসি।’

বৃষ্টি ও পানি-কাদা উজিয়ে প্রতিনিয়ত যুদ্ধে অবিচল ছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা
ছবি: সংগৃহীত

বর্ষায় পাহাড়ি ঢল, বন্যা, কর্দময় পথঘাটের সঙ্গে লড়াই করেই বাঙালির বেড়ে ওঠা ও জীবন ধারণ। যেহেতু মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকাংশই ছিলেন গ্রামের কৃষকের ছেলে। বর্ষাকাল তাদের কাছে পানিভাত। তাই তারা বর্ষাকালের যুদ্ধের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করেছিল।

বর্ষাকালে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধকৌশল ও প্রস্তুতি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য পাওয়া যায় শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা শাফী ইমাম বীর বিক্রমের লেখা চিঠিতে। একাত্তরের ১৬ জুন শহীদ রুমী তাঁর মামা সৈয়দ মোস্তফা কামাল পাশাকে লেখা চিঠির এক জায়গায় উল্লেখ করেন, ‘ইতিমধ্যে আমাদের যুদ্ধ অনেক এগিয়ে গেছে। বর্ষা শুরু হলে আমরা আক্রমণের তীব্রতা বাড়িয়ে দেব।’ (‘একাত্তরের চিঠি’, পৃষ্ঠা: ২৬)
মার্কিন সাংবাদিক সিডনি শনবার্গ একাত্তরে ‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এর দিল্লি সংবাদদাতা ছিলেন। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের পর অন্য বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে সিডনি শনবার্গকেও জোরপূর্বক বিমানবন্দরে নিয়ে বাংলাদেশ ত্যাগে বাধ্য করা হয়। পরে তিনি দিল্লিতে থেকে বাংলাদেশে চালানো পৈশাচিক গণহত্যা, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব এবং লাখ লাখ শরণার্থীর দুঃখ-দুর্ভোগের কথা তুলে ধরেছেন বিশ্বের কাছে। যুদ্ধ চলাকালে তিনি একাধিকবার বাংলাদেশেও প্রবেশ করেন এবং রণাঙ্গন থেকে প্রতিবেদন পাঠান। সিডনি শনবার্গের প্রতিবেদনেও বর্ষাকালে পাকিস্তানি সেনাদের নাস্তানাবুদ করতে মুক্তিবাহিনীর পরিকল্পনার কথা বেশ গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি লেখেন, ‘...বাঙালিরা নির্ভর করছে বর্ষা মৌসুমের বৃষ্টির ওপর, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে যা শুরু হবে। পূর্ব পাকিস্তানের গ্রামাঞ্চলের জটিল পথ-গাঙ্গেয় ব্রহ্মপুত্র জলধারা ও সহস্র নদীর আঁকিবুঁকি-পশ্চিম প্রদেশের শুষ্ক ও পার্বত্য অঞ্চল থেকে আগত পাঞ্জাবি ও পাঠানদের কাছে অপরিচিত। বর্ষায় যখন নদী ফুলে-ফেঁপে উঠবে এবং মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বন্যায় পূর্ব পাকিস্তানের বিস্তীর্ণ এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়বে, তখন এ অপরিচিতি আরও বাড়বে।’

(সিডনি শনবার্গ, ‘ডেটলাইন বাংলাদেশ: নাইন্টিন সেভেন্টি ওয়ান’, মফিদুল অনূদিত, পৃষ্ঠা: ৩৫)।

সীমান্ত এবং বাংলাদেশের ভেতরে চার দিন সফর করে সিডনি শনবার্গ ওই প্রতিবেদন লিখে পাঠান। প্রতিবেদনের তথ্য সংগ্রহকালে বর্ষায় মুক্তিবাহিনীর প্রস্তুতি বিষয়ে সিডনি শনবার্গ কথা বলেন এক বাঙালি অফিসারের সঙ্গে। বাঙালি অফিসার তাঁকে বলেন, ‘আমরা এখন বর্ষার অপেক্ষায় রয়েছি...। তারা (পাকিস্তানি সেনাবাহিনী) পানিকে এত ভয় পায়, আপনি ভাবতেই পারবে না এবং আমরা হচ্ছি জলের রাজা। তারা তখন (বর্ষাকালে) ভারী কামান ও ট্যাংক নিয়ে চলতে পারবে না, জঙ্গি বিমান উড়তে পারবে না। প্রকৃতি হবে আমাদের দ্বিতীয় বাহিনী।’

‘আমরা এখন বর্ষার অপেক্ষায় রয়েছি...। তারা (পাকিস্তানি সেনাবাহিনী) পানিকে এত ভয় পায়, আপনি ভাবতেই পারবে না এবং আমরা হচ্ছি জলের রাজা। তারা তখন (বর্ষাকালে) ভারী কামান ও ট্যাংক নিয়ে চলতে পারবে না, জঙ্গি বিমান উড়তে পারবে না। প্রকৃতি হবে আমাদের দ্বিতীয় বাহিনী।’

অপরদিকে ভারতীয় সামরিক বাহিনীও আবহমান বাংলার বর্ষাকালকে সামনে রেখে আলাদা প্রস্তুতি ও রণকৌশল গ্রহণ করেছিল; এমন তথ্য পাওয়া যায় বিবিসি বাংলা প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ভারতের সামরিক বিশেষজ্ঞ ও মেজর জেনারেল (অব.) দীপঙ্কর ব্যানার্জির ভাষায়, ‘১৯৬২ সালের পর থেকে বিশেষ করে ইস্টার্ন সেক্টরে ভারতের প্রায় সব সেনাই প্রস্তুতি নিতেন চীনের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য। মাউন্টেন ওয়ারফেয়ার, হাই অল্টিচিউড লড়াইয়ের প্রশিক্ষণ নিত তারা। অস্ত্রশস্ত্র বা কৌশলও সেভাবেই জোগানো হতো। তাই নদীনালায় ভরা বাংলাদেশের জলাময় পরিবেশে যুদ্ধের জন্য তাদের আলাদাভাবে প্রস্তুতি নিতে হয়েছিল।’ (শুভজ্যোতি ঘোষ, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কী ছিল ভারতীয় সেনার সামরিক কৌশল?’, বিবিসি বাংলা, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬)

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দিনাজপুরে পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের খবরে উচ্ছ্বসিত মুক্তিবাহিনী।
ছবি: সংগৃহীত

১৯৭১ সালে লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান; পরে তিনি বাংলাদেশ-ভারতের সমন্বয়ে গঠিত মিত্রবাহিনীর প্রধান হিসেবে মনোনীত হন এবং যুদ্ধ পরিচালনা করেন। শুভজ্যোতি ঘোষের ওই প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, বর্ষাকালের বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়েই যুদ্ধটা জুনÑথেকে অক্টোবর পর্যন্ত ঠেকিয়ে রাখার পরিকল্পনা নেওয়া হয়, যার তথ্য যৌথ বাহিনীর প্রধান জেনারেল অরোরার ভাষ্যেও পাওয়া যায়।

ভারতীয় বাহিনীর এই সিদ্ধান্ত যে অত্যন্ত যৌক্তিক ও সময়োপযোগী ছিল, তার ব্যাখ্যায় মেজর জেনারেল (অব.) দীপঙ্কর ব্যানার্জি বলেন, ‘বর্ষাকালে আক্রমণ করাটা মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ হতো না, কারণ তখন গোটা বাংলাদেশ এক প্রকাণ্ড জলাভূমির চেহারা নেয়। কিন্তু বর্ষার সময়টা পূর্ব পাকিস্তানের ভেতরে থাকা বিদ্রোহীরা (মুক্তিবাহিনী) সেখানে পাকিস্তানি ফৌজের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি করতে পেরেছিল। পুরো বর্ষাটা তাদের ঘিরে রাখা হলো। তারপর যখন বৃষ্টি থামল তখন চারদিক থেকে তাদের আক্রমণ করা হলো। তারা তেমন প্রতিরোধ গড়তেই পারল না, খুব দ্রুত আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলো।’

তিন.

বর্ষাকালে মুক্তিবাহিনীর সফল অপারেশনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিল ১৫ ও ১৬ আগস্ট পরিচালিত অপারেশন জ্যাকপট। ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট পরিচালিত হয় মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকমান্ডো বাহিনীর প্রথম অভিযান অপারেশন জ্যাকপট। এদিন রাতে নৌকমান্ডোরা একযোগে মোংলা, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ বন্দর আক্রমণ করেন এবং পাকিস্তানি বাহিনীর ২৬টি পণ্য ও সমরাস্ত্রবাহী জাহাজ ও গানবোট ডুবিয়ে দেওয়া হয়। অত্যন্ত গোপনে পরিচালিত অপারেশন জ্যাকপটের পর বাংলাদেশের নদীবন্দর ও ফেরিঘাট অনেকটা অকার্যকর হয়ে পড়ে। এর সফলতা তখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেয়। বাঙালি নৌকমান্ডোরা এই অপারেশনের মাধ্যমে যুদ্ধের গতি সম্পর্কে বিশ্বকে ধারণা দিতে সক্ষম হন।

শুধু কুমিল্লার দাউদকান্দি ফেরিঘাটে অপারেশন পরিচালিত হয়েছিল ১৬ আগস্ট রাতে। নেতৃত্বে ছিলেন সাবেক সচিব শাহজাহান সিদ্দিকী বীর বিক্রম। ১৫ আগস্ট রাতে গোমতী ও মেঘনা নদীতে ঝড়বৃষ্টির কবলে পড়ে তাঁরা পথ হারিয়ে ফেলেন। তাই ১৬ আগস্ট রাতে অপারেশনটি পরিচালনা করেন এবং ফেরি ও পন্টুন ডুবিয়ে দেন। ১৯৭১ সালের ২০ আগস্ট ত্রিপুরার দৈনিক ‘সংবাদ’ পত্রিকার প্রতিবেদনে জানা যায়, বিস্ফোরণে পুরো ফেরিঘাট ধ্বংস হয়ে যায়। ফেরিঘাটে টহলদারি ছয়জন রাজাকার ও এক পাকিস্তানি পুলিশ নিহত হয়। (মো. আল-আমিন ও বাশার খান, ‘মুক্তিযুদ্ধে দাউদকান্দি’, পৃষ্ঠা: ৭৬)

অপারেশন জ্যাকপটে প্রকৃতির বুক পেতে সহায়তা

১৫ ও ১৬ আগস্ট রাতে একযোগে পরিচালিত অপারেশনে একটি অবাক করা বিষয় ছিল, প্রকৃতি যেন একেবারে বুক পেতে নৌকমান্ডোদের সহায়তা করেছে। এর দালিলিক তথ্য পাওয়া যায় ১৬ আগস্ট ১৯৭১, দৈনিক ‘ইত্তেফাক’-এ প্রকাশিত খবরে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৫ আগস্ট ঢাকাসহ সারা দেশে প্রবল বৃষ্টিপাত হয়। এদিন চট্টগ্রামে ৩.৭৪ ইঞ্চি, ফরিদপুরে ২.১২ ও মাইজদী কোর্টে ১.৬০ ইঞ্চি বৃষ্টিপাত হয়। ১৫ আগস্ট সন্ধ্যা ৬টা থেকে পরবর্তী ৩৬ ঘণ্টা সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনার কথাও বলা হয়। বৃষ্টির এই পূর্বাভাস সঠিক ছিল। লেখককে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে শাহজাহান সিদ্দিকী বীর বিক্রম জানান, ১৫ আগস্ট রাতে এত বেশি বৃষ্টিপাত হয় যে তাঁর নেতৃত্বাধীন নৌকমান্ডো দল গভীর রাতে অবস্থান নেওয়া ঘাঁটি বন্দরামপুর থেকে (টার্গেট পয়েন্ট থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে) নৌকাযোগে রওনা হলে বিশাল গোমতী-মেঘনা সংযোগ এলাকায় প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি ও ঢেউয়ে দিক হারিয়ে ফেলে। এমতাবস্থায় ভোরের আলোক রাশি দেখা দিতে শুরু করলে অভিযান স্থগিত করে তাঁরা ঘাঁটিতে ফিরে যান।

‘অপারেশন জ্যাকপট’-এ বিধ্বস্ত একটি জাহাজ
ছবি: সংগৃহীত

পরের দিন ১৬ আগস্ট রাতে সফল অপারেশন করেন। সে রাতেও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হয়েছিল। ডুবসাঁতার দিয়ে কচুরিপানায় নাক ভাসিয়ে নৌকমান্ডোরা যখন ফেরি ও পন্টুনের কাছে যেতে থাকেন, পাকিস্তানি প্রহরীরা টেরই পায়নি। বৃষ্টি আর স্রোত থাকায় ঘুরে ঘুরে আসা সার্চলাইটের আলোতেও কচুরিপানার নিচে যে নৌকমান্ডো আছে, এটি ন্যূনতমও টের পায়নি প্রহরীরা।

প্রবল বৃষ্টির কারণে নদীবন্দর ও ফেরিঘাটে পাকিস্তানিদের প্রহরা কিছুটা হলেও ব্যাঘাত হওয়া স্বাভাবিক। অপরদিকে নৌকমান্ডোদেরও বাংলার নদ-নদীতে বর্ষার ঝড়বৃষ্টিতে টার্গেট পয়েন্ট নিখুঁত অপারেশন পরিচালনায় উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ছিল। প্রশিক্ষিত নৌকমান্ডোদের দিয়ে নিখুঁত ও দুঃসাহসিক পরিকল্পনা এবং প্রকৃতির বুক পেতে দেওয়া সহায়তা—এই দুইয়ে মিলিয়ে পুরো অপারেশন জ্যাকপটে ব্যাপক সাফল্য আসে।

বর্ষাকালে মুক্তিবাহিনীর সফল অপারেশনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিল ১৫ ও ১৬ আগস্ট পরিচালিত ‘অপারেশন জ্যাকপট’। ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট পরিচালিত হয় মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকমান্ডো বাহিনীর প্রথম অভিযান ‘অপারেশন জ্যাকপট’। এদিন রাতে নৌকমান্ডোরা একযোগে মোংলা, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ বন্দর আক্রমণ করেন এবং পাকিস্তানি বাহিনীর ২৬টি পণ্য ও সমরাস্ত্রবাহী জাহাজ ও গানবোট ডুবিয়ে দেওয়া হয়। অত্যন্ত গোপনে পরিচালিত অপারেশন জ্যাকপটের পর বাংলাদেশের নদীবন্দর ও ফেরিঘাট অনেকটা অকার্যকর হয়ে পড়ে। এর সফলতা তখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেয়।

অপারেশন জ্যাকপটের আগে ও পরে মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্বে দেশের বিভিন্ন নদ-নদীতে ছোট-বড় অনেক গেরিলা অপারেশন পরিচালিত হয়। এসব অপারেশনে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মুক্তিবাহিনী আশানুরূপ সাফল্য পাওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরে মেঘনা নদীতে এক রাতে একটি সফল অপারেশন করে ১০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল। দলটির কমান্ডার ছিলেন সেনাসদস্য আবদুর রশিদ। এই দলের সহকারী কমান্ডার গাজীপুরের ভুরুলিয়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা হাতেম আলী জানান, এক রাতে পাকিস্তানি সেনাদের একটি লঞ্চ বাঞ্ছারামপুর আসার খবর পেয়ে তাঁরা লঞ্চে আক্রমণ করার প্রস্তুতি নেন। নদীর পানিতে নেমে কলাগাছ ধরে ভেসে কচুরিপানা দিয়ে মাথা ঢেকে অগ্রসর হন তাঁরা। রাত আটটার দিকে গ্রেনেড চার্জ করেন। এতে লঞ্চটিতে আগুন ধরে যায় এবং এক-দেড় শ পাকিস্তানি সৈন্য মারা যায়। এটাই ছিল ১০ মুক্তিযোদ্ধার ওই দলের প্রথম অপারেশন। (বাশার খান, ‘কচুরিপানা ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক অনুষঙ্গ’, মতিউর রহমান সম্পাদিত ‘প্রতিচিন্তা’, সংখ্যা: ডিসেম্বর-মার্চ ২০১৯) এ ছাড়া সেক্টর কমান্ডার ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাৎকার এবং সমকালীন সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে বর্ষাকালে নদীতে মুক্তিবাহিনীর অসংখ্য গেরিলা আক্রমণ এবং সেগুলোতে পাকিস্তানি সেনার হতাহত, ক্ষয়ক্ষতি এবং তাদের অস্ত্র মুক্তিবাহিনীর হস্তগত হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়।

বর্ষাকালে গেরিলা আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চলাফেরা সীমিত করা হয়। মফস্বলে অবস্থা এমন হয় যে রাতে ক্যাম্প থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দেয়। গ্রামের স্কুলে স্থাপন করা ছোট ছোট সাব-ক্যাম্প গুটিয়ে থানা সদরে স্থানান্তর করা হয়। বর্ষাকালে মুক্তিবাহিনীর একের পর এক আক্রমণে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এতটা নাজুক অবস্থা হয় যে একপর্যায়ে জলে আক্রমণ প্রতিরোধে নিজেরাই প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করে। পাকিস্তানি সেনা ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীতে মাথা কচুরিপানা দিয়ে ঢেকে বিভিন্ন ধরনের কসরত আয়ত্ত করার তথ্য পাওয়া যায় দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিমের ‘একাত্তরের দিনলিপি’তে। তিনি লেখেন, ‘খবর হচ্ছে, খান সেনারা কচুরিপানা মাথায় দিয়ে সদরঘাটে রাবার বোটে চড়ে বর্ষাকালে মুক্তিফৌজের মোকাবিলার কসরত আঁটছে। বর্বরের দল এমন মজার দৃশ্যটা টেলিভিশনের পর্দায় দেখাতেও সংকোচ বোধ করেনি।’ (সরদার ফজলুল করিম, ‘একুশ একাত্তর ও বঙ্গবন্ধু’, পৃষ্ঠা: ১৩৭)

অপরদিকে বর্ষাকালে বিপাকে পড়ে ভারতে আশ্রয় নেয় শরণার্থীরা। অনেক শরণার্থীর তাঁবু ও ছোট ঘর পানিতে ডুবে যায়। নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় অনেকে।

চার.

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে অল্প সময়ে বাঙালিদের ঠান্ডা করে দেওয়ার দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর যে পরিকল্পনা ছিল, তা শুরুতেই বাধাপ্রাপ্ত হয়। কারণ, ২৫ মার্চ রাতে আক্রমণের শুরুতেই ঢাকার পিলখানা ও রাজারবাগ পুলিশ হেডকোয়ার্টারসহ বিভিন্ন জায়গায় তারা বাঙালিদের দ্বারা প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়েছিল। বাঙালিরা প্রথমে ভারী অস্ত্রের মুখে টিকতে না পারলেও সময় যত গড়ায়, ততই প্রতিরোধের সক্ষমতা বাড়ে। ভারতে গিয়ে ছাত্র-যুবাদের মে-জুন মাসের প্রশিক্ষণ-পরবর্তী পাকিস্তানিদের ওপর গেরিলা আক্রমণে সফলতা আসতে থাকে। এই আক্রমণ তীব্রতর হয় বর্ষাকালে। যদিও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বর্ষার আগেই এপ্রিল-মে মাসে বাংলার গ্রামাঞ্চলেও তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিল। কিন্তু জলের রাজা বাঙালি মুক্তিফৌজের আক্রমণে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সেই প্রচেষ্টা ভেস্তে যায়। বাংলাদেশে বিভিন্ন জায়গায় গেরিলা আক্রমণে পাকিস্তানি সৈন্য প্রতিনিয়ত মরতে থাকায় তাদের সেনা সংখ্যা কমতে থাকে। পরাজিত সৈন্যের অস্ত্র মুক্তিবাহিনীর হস্তগত হতে থাকায় কমছিল তাদের অস্ত্রভান্ডারও। বর্ষাকালে জুলাই-অক্টোবর পর্যন্ত গেরিলা আক্রমণে পাকিস্তানি সৈন্য দল যখন বিপর্যস্ত এবং একেবারে হাঁপিয়ে ওঠা অবস্থা, তখন নভেম্বরে এসে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের গতি আরও বাড়ে। ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর বাংলাদেশের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী সম্মিলিতভাবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ সূচনা করে। পরে ৩ ডিসেম্বর রাতে বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ বাহিনীর আক্রমণে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হলে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী তেমন কোনো প্রতিরোধই গড়তে পারেনি। ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় তারা। বিশ্ব মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।