সম্প্রতি প্রয়াত হলেন জীবনানন্দ দাশ–গবেষক, কবি ভূমেন্দ্র গুহ। তাঁকে শ্রদ্ধা

১৯৫৪-এর অক্টোবরের এক শীতার্ত মধ্যরাত-উত্তীর্ণ সময়ে কবি জীবনানন্দ দাশের মৃত্যু হয়েছিল। কিন্তু কার্যত তিনি বেঁচে ছিলেন; না—তাঁর স্ত্রী-পুত্র বা কন্যার মাধ্যমে নয়; বোন সুচরিতা, ভাই আশোকানন্দ বা ভ্রাতুষ্পুত্র অমিতানন্দের মধ্য দিয়ে নয়, তিনি এতকাল খানিকটা সশরীরেই বেঁচে ছিলেন যাঁর মধ্য দিয়ে—তাঁর নাম ভূমেন্দ্রনাথ গুহ, সংক্ষেপে ভূমেন্দ্র গুহ।
১৯৫৪-এর ২২ অক্টোবর মধ্যরাতে শম্ভুনাথ হাসপাতালে মৃত্যু বা সপ্তাহ খানেক আগে ১৫ অক্টোবর বাড়ির একেবারে কাছেই ট্রামের তলায় চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কিংবা একদিন আগে আকাশবাণীতে ‘মহাজিজ্ঞাসা’ কবিতাটি পাঠ করা অবধি তাঁর প্রকাশিত কবিতার সংখ্যা সাকল্যে ২৭০টি। তিনি যে উপন্যাস বা ছোটগল্প লেখেন নিয়মিত, সে হদিসটি পর্যন্ত জানা ছিল না কারও। এখন তাঁর প্রকাশিত কবিতার সংখ্যা পনেরো শ ছাড়িয়েছে (সব মুদ্রিত হলে সংখ্যাটা ২২ কি ২৩ শ ছাড়িয়ে যাবে অনুমিত হয়), ২০টি উপন্যাস আর ১২২ ছোটগল্প প্রকাশিত হওয়ার পর স্বীকার করে নিতেই হচ্ছে জীবনানন্দ শুধু বিংশ শতকের বাংলা ভাষার প্রধান আধুনিক কবিই নন, একাধারে অন্যতম প্রধান কথাসাহিত্যিকও বটে। আর যে মানুষটি শত শত রুলটানা এক্সারসাইজ খাতা খুঁজে খুঁজে পড়ে, ভারী পাওয়ারের চশমায় না কুলোলে আতশ কাচের সাহায্য নিয়ে, জীবনানন্দের জড়ানো অনতিস্পষ্ট হস্তাক্ষরের প্রতিরোধ উপেক্ষা করে অগণিত অপ্রকাশিত কবিতা, গল্প, উপন্যাস পাঠোদ্ধার করে প্রকাশের ব্যবস্থা করেছেন—তিনিই ভূমেন্দ্র গুহ।
কবির মৃত্যুর পর বাংলা ভাষার সবচেয়ে জনপ্রিয় কাব্য রূপসী বাংলা, জীবনানন্দের সপ্তম কাব্য সংকলন বেলা অবেলা কালবেলা, প্রবন্ধ সংকলন কবিতার কথা এবং প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস মাল্যবান-এর পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করেছিলেন তিনি। প্রতিক্ষণ পাবলিকেশনস ১৯৮৫ সালে ১২ খণ্ডে জীবনানন্দ সমগ্র প্রকাশ শুরু করে—যার ভিত্তিও ভূমেন্দ্র গুহের তৈরি করা পাণ্ডুলিপি। হে প্রেম তোমাকে ভেবে ভেবে, ছায়া-আবছায়া, সফলতা-নিষ্ফলতা ইত্যাদিরও পশ্চাৎ কারিকর তিনি। ভূমেন্দ্র গুহ কেবল লেখা খাতা থেকে মুদ্রণযোগ্য পাণ্ডুলিপিই প্রস্তুত করেননি, জীবনানন্দের অজস্রÊলেখার খাতাগুলোকে চির অবলুপ্তির হাত থেকে বাঁচিয়েছেন; ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত লেখার খাতাগুলো সযত্নে আগলে রেখেছিলেন নিজের টানে—যত দিন না তাঁর কলকাতার বাইরে চলে যাওয়ার ডাক এসেছিল।
হাজার হাজার পাতার লেখার পাঠোদ্ধারের কাজটি কী রকম দুর্বিষহ ও একঘেয়ে হতে পারে, তা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। ভূমেন্দ্র গুহর অসাধ্যসাধন দেখে মনে হয়, মৃত্যুর পর জীবনানন্দকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই যেন তাঁর জন্ম হয়েছিল; যেন জীবনানন্দের লেখার পাঠোদ্ধার ব্যতিরেকে তাঁর আর কোনো উপাসনা ছিল না। এই পরিচয়ের গভীর আড়ালে তিনি যে প্রধানত একজন কবি—এই সত্যটি যেন হারিয়েই গিয়েছিল। অথচ এই কাজটি যে খুব আগ্রহবশে আগ বাড়িয়ে নিয়ে নিয়েছিলেন তা-ও নয়। তাঁর ভাষায়: ‘ঘটনাচক্রে এ দায়টি আমার ঘাড়ে এসে পড়েছিল।’ আমরা বুঝি, তিনি কেবল মাথা ঝাঁকিয়ে ঘাড় নির্ঞ্ঝাট করার কাজটি থেকে বিরত ছিলেন।
তাঁর লেখা জীবনানন্দ ও সঞ্জয় ভট্টাচার্য এবং দূর সমুদ্রের বেলাভূমিগুলি নামীয় দুটি বইয়ের উপরি ঢাকনার ভাষ্য থেকে পাঠক জানবেন যে তাঁর পোশাকি নামছিল ড. বি এন গুহরায়। জন্ম ১৯৩৩ সালের ২ আগস্ট, ভারতের মধ্যপ্রদেশের বিলাসপুরে। তবে বলে রাখা দরকার, জীবনানন্দেরই মতো পৈতৃকসূত্রে তিনিও বরিশালেরই মানুষ। ডাক্তারি পাসের পর শল্য চিকিৎসায় স্নাতকোত্তর করেছেন, পরে বিশেষভাবে বক্ষদেশের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, হৃৎপিণ্ড ও ভাসকুলার সার্জারিতে এমসিএইচ। ১৯৬২-তে ভারতের প্রথম ওপেনহার্ট সার্জারির অপারেশন থিয়েটারে উপস্থিত ছিলেন সে সময়ের তরুণ চিকিৎসক ভূমেন্দ্র গুহ। এরপর এ বিষয়ে তিনি অনেক গবেষণা করেছেন, তাঁর দেড় শরও বেশি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক সাময়িকীতে। শেষ জীবনে কলকাতা মেডিকেল কলেজের বক্ষদেশে থোরাসিক বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন।
কলকাতায় পঞ্চাশ দশকের বিখ্যাত সাহিত্যপত্র ময়ূখ-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ভূমেন্দ্র গুহ। জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে পরিচয়ও পত্রিকাটির জন্য কবিতা সংগ্রহের সুবাদে। ময়ূখ-এর জন্য সাকল্যে একটিই কবিতা দিয়েছিলেন জীবনানন্দ। কিন্তু জীবনানন্দের বাসায় তাঁর যাতায়াত ছিল নিয়মিত, একটি চিন-পরিচয়ের সম্পর্ক দাঁড়িয়ে গিয়েছিল পুরো পরিবারের সঙ্গেও। এই সম্পর্ক স্থায়ী আত্মীয়তায় পরিণত হয়েছিল ট্রাম দুর্ঘটনায় আহত হয়ে জীবনানন্দ শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে ভর্তি হলে। ময়ূখ-এর জীবনানন্দ স্মরণ সংখ্যা বের করার জন্য কী কষ্ট করেছিলেন ভূমেনদা ও তাঁর সঙ্গীরা, সে এক অবিশ্বাস্য গল্প, কেবল শরীরের রক্ত বেচার কাজটিই বাকি ছিল।
দুই
কবি ভূমেন্দ্র গুহের কবিতাগ্রন্থ ১১টি। প্রথম কবিতা বইয়ের নাম যম। শ্রেষ্ঠ কবিতা প্রকাশিত হয় ২০০৫-এ। রাহুল পুরকায়স্থর সম্পাদনায় তাঁর কবিতা সমগ্র বেরিয়েছে দু-খণ্ডে, এই কদিন আগে। সেই ১৯৫০-এ বাংলা ভাষায় তিনিই প্রথম স্যাফোর কবিতা অনুবাদ করেছেন, তারপর হেনরি মিলারের ঘাতকদের সময় (বলে রাখা দরকার, অনুবাদের জন্য লেগেছে ১৩৮ পৃষ্ঠা, আর ভূমিকা-টীকার জন্য বাকি ২৭৪ পৃষ্ঠা)। জীবনানন্দের ধূসর পাণ্ডুলিপির বর্ধিত সংস্করণের পাণ্ডুলিপিও তাঁরই করা, আরও আছে সমরেশ ও অন্যান্য গল্প। কেবল জীবনানন্দকে নিয়ে তাঁর বই একটিই—আলেখ্য: জীবনানন্দ দাশ। বাংলা ভাষার একটি উল্লেখ্যযোগ্য গদ্যগ্রন্থ। জীবনানন্দের লিটেরারি নোটস দিনলিপি শিরোনামে চার খণ্ডে প্রকাশ করেছিলেন। অধিকন্তু কিছু লেখার খাতার ফ্যাকসিমিলি প্রকাশ করেছেন শেষ ছ’বছর শিরোনামে। কবি হিসেবে তিনি কেমন ছিলেন তাঁর মূল্যায়ন হয়নি এখনো, হবে কখনো। তাঁর একটি কবিতা এ রকম:
চোখে যে গড়াবে জল, সে-রকম সাহসিক নই,
সেই চোখ যা এখন বিস্তীর্ণ আকাশ খুঁজে দেখে:
নক্ষত্রেরা আছে কি না মৃতপ্রায় দিকের সন্ধানে;
আরেকটু হেঁটে গেলে ভোর হবে, প্রথম প্রতুষা;
জনৈক মৃতের ছবি দেয়ালে আয়নাই রাখা হবে।
মধ্য রাত পার হলে দুইটি বছর, মানে কাল
দুইদিকে চ’লে যাচ্ছ, যাচ্ছ আমাদের প্রেম যেন;
পিঁপড়ের মতন পায়ে দুঃখ বাসা বাঁধছে হৃদয়ে।
হেঁটে যাচ্ছি—অন্ধকার, অন্ধকার পথের দু’পাশে
যে সব শ্মশান আছে শুভ্রতায় ভুলে যাচ্ছি তা-ও;
এখন বিকেল, আর সামান্য প্রভেদ মেনে নিলে
অন্ধকার মাঝামাঝি দীর্ঘশ্বাসটুকু:
যা গিয়েছে তার থেকে রাত্রিটিকে খুলে নিয়ে এসে
দেখেছি যে, এইমাত্র কবজির নিকটে রক্ত নাচে;—
অবশেষে এইটুকু বিশ্বাস জমাই ইহকালে—
সে-সময় জানো তুমি যদি না অসত্য ব’লে থাকো।
তিন
কালি ও কলম সম্পাদক আবুল হাসনাতের উদ্যোগে জীবনানন্দ দাশের কবিতার মূলানুগ পাঠের একটি সংকলন গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি করতে সম্মত হয়েছিলেন ভূমেন্দ্র গুহ। কাজ চলছিল সেই ২০১২ থেকে। তাতে শ্রেষ্ঠ কবিতাসহ জীবনানন্দের সাতটি কাব্যগ্রন্থ থেকে বাছাই করা কবিতা, জীবনানন্দের মৃত্যুকালে অপ্রকাশিত ৭৯টি কবিতা ও সরাসরি ৩২টি লেখার খাতা থেকে ১৪৩২টি কবিতা (পূর্বোল্লিখিতগুলো বাদ দিয়ে) পত্রস্থ করার আয়োজন ছিল। কবিতা-সংবলিত ৬৮৭ পৃষ্ঠার প্রথম খণ্ডের পর ৪৯৬ পৃষ্ঠার দ্বিতীয় খণ্ডে ভূমেন্দ্রদার লেখা পেল্লাই ভূমিকা ও টীকা-টিপ্পনীর বিশাল বহর। ভূমেন্দ্রদা একটু সলজ্জ হেসে বলেছিলেন, ‘এ যেন বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচি।’
দু-খণ্ডে ছাপা-বাঁধাইয়ের কাজ হয়ে শেষ হেয় প্রকাশের আয়োজন। হাসনাত ভাইয়ের ইচ্ছা ছিল প্রথম কপি ভূমেন্দ্রদার হাতে তুলে দিয়ে তবেই বাজারে দেবেন দু-খণ্ড, আর ফেব্রুয়ারিতে (২০১৬) ঢাকায় বইমেলার মৌসুমে একটা প্রকাশনা অনুষ্ঠান করবেন। হাসনাত ভাই যখন কলকাতায় পৌঁছালেন কে-২/৬ করুণাময়ীর দোতলার ফ্ল্যাটবাড়িতে, তখন আর ভূমেন্দ্রদা নেই, ১৪ ডিসেম্বর কলকাতা মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে তাঁকে, গুরতর অসুস্থ। ১৮ তারিখে অজ্ঞান হয়ে পড়লেন, লাইফ সাপোর্ট সংযোজন করা হলো। ২০ ডিসেম্বর প্রত্যুষে গভীর নিদ্রার ভেতর তাঁর প্রয়াণ হলো। তিনি আশা করেছিলেন, নিদ্রার ভেতরেই তাঁর মৃত্যু হবে, সকালে সবাই দেখবে তিনি আর চোখ খুলছেন না, (তাঁর নিজরেই ভাষায়) ‘ডাক্তার গুহরায় তাঁর বিছানার ফ্রেমে আঁটা একটা মূর্তি হয়ে গিয়েছেন। পাশে পুরোনো লেফাফার ওপর লেখা কবিতার চার লাইন: “কী কারণে-যে ঘুম আসতে চায় না, তা বুঝতে পারি না/রাস্তার কুকুরগুলি ডাকতে থাকে সারা রাত ধরে একা-একা/কেন ডাকে? একজন কাঁদলে পরে অন্যজন কাঁদে হয়তো/আয়নায় নিজের মুখ দেখেছি অনেকবার চুপি-চুপি: রাস্তার কুকুর।”’—কেবল এখানেই হয়তো ব্যতিক্রম হলো; হাসপাতালের বেডের পাশে ওরকম কবিতার কোনো চিরকুট পাওয়া গেল না: আরেকটি কবিতা মুসাবিদার আগেই পৌঁছে গেলেন ‘শ্মশানের নিকটের নদীর কাছে’।
নিজের মৃত্যু-পরবর্তী অবস্থা নিয়ে অনবদ্য একটি লেখা আছে ভূমেন্দ্রদার। তার একটি অংশ এ রকম: ‘(...একজন) সরল-সহজভাবে ভালো মানুষের মতো নিজেকে মরে যেতে দিলেন বি এন গুহরায়। এই বাড়ির কর্তা ছিলেন তিনি, একজন মহিলার স্বামী, একজন মেয়ের বাবা; কিন্তু কর্তা-স্বামী-বাবা—এ স্ব প্রণীত ভূমিকা তাঁর নিজেরই তৈরি যদিও, তিনি তাঁর এই সব ভূমিকা নিয়ে কখনোই সৎ ছিলেন না। তিনি স্বার্থপর ছিলেন, অতি মাত্রায় স্বার্থপর। কথাটা ঠিক যে অত্যন্তই গরিব পরিবার থেকে তিনি এসেছিলেন, গরিব হয়ে থাকাটা তাঁর বরং পছন্দেরই ছিল, কিন্তু ব্যক্তিগত তাৎক্ষণিক নাম-খ্যাতি-ক্ষমতা-যশের লোভটা তাঁর এতটাই বেশি ছিল যে তিনি কখনো পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখেননি তাঁর সংসারটা কীভাবে চলছে, তাঁর মেয়ে কীভাবে বড় হয়ে উঠছে, সে তার বাবাকে কতটুকু সময় কাছে পাচ্ছে। তাঁর স্ত্রী একটা মাস্টারির চাকরি করতেন বলে সংসার চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়টা যেন তাঁরই। ডাক্তার গুহরায়ের নিজের পড়াশোনা ছিল, লেখালেখি ছিল, সপ্তাহে চার-পাঁচ দিন হাসপাতালে পড়ে থাকা ছিল, নতুন ডিপার্টমেন্ট গড়ে তোলার ব্যাপারে দৌড়াদৌড়ি করা ছিল—শুধু রাইটার্স নয়, সেই দিল্লি-বোম্বাই অবধি, সারাটা ভারতবর্ষে সার্জারি-শিক্ষার বিষয়ে সরদারি করে বেড়ানো ছিল। শেষ বয়েসে, যে কটা টাকা মাইনে পেতেন হাসপাতালের নানান উপরি-কাজে খরচ করে ফেলতেন, সংসারে একটা পয়সা ছোঁয়ানো ছিল না।’
নিজের সম্পর্কে কী ধারণা ছিল তাঁর, সেটাও তৃতীয় পুরুষে বলে গেছেন এভাবে: ‘তাঁর নিজের অর্থে তিনি একজন নিরীহ গোছের মানুষ ছিলেন, ভালো মানুষ ছিলেন, জীবনভর অনেক মানুষের প্রতি যথাযথভাবে অনুরাগী ছিলেন—আর, কখনো নিজেকে শুদ্ধ করে নেবার জন্য, নিজের অস্তিত্বের অর্থবান সম্পূর্ণতার জন্য তাঁর কোনো বিশেষ দাওয়াইয়ের দরকার ছিল না—যা আমাদের অনেকেরই দরকার হয়, আমরা বামুন-পুরুত খুঁজতে বেরোই। কেন যে তিনি মারা গেলেন, তার কোনো কারণ আছে বলে বুঝে ওঠা যায় না, এমন একটা লোকের, যিনি সে রকম নিচু এলাকায় সে রকমভাবে বাস করে বেশ সুখে ছিলেন—যে এলাকায় বাস করে আমাদের অনেকেই খুব অসুবিধেয় থাকি, আমাদের ভেতরে অনেকেই মোটামুটি সুখেও থাকি না; তাঁর নিচু অবস্থা নিয়ে ডাক্তারবাবুকে খোঁটা খেতেও শুনেছি।’
কয়েক মাসে আগে যখন তাঁর সঙ্গে দেখা হয়, তখন ভগ্নস্বাস্থ্য ভূমেনদাকে আর দেয়াল ধরে ধরে হাঁটতে হয় না, বাসার গণ্ডির ভেতর হাঁটতে-চলতে পারেন। জীবনানন্দের লিটেরারি নোটসের খাতাগুলো দেখালেন। বইয়ের তাকে রাখা আমার করা কয়েকটি বই দেখিয়ে বললেন, কিনে সংগ্রহ করেছেন। আবদুল মান্নান সৈয়দের কাজের খুব প্রশংসা করলেন। হাসনাতের ভাইয়ের কথা, অবসর প্রকাশনীর আলমগীর রহমানের কথা বারবার বলছিলেন। কথা বলছিলেন খুব ধীর লয়ে, মৃদু কণ্ঠে। বারবার ডুকরে উঠছিলেন। টেবিলে এক গোছা বিড়ি। একটি ধরিয়ে বললেন, ‘সিগ্রেট খাওয়ার পয়সা আর নেই, এখন বিড়ি টানি।’ ওই ভগ্নদশাতেই জীবনানন্দের লিটেরারি নোটস ‘কপি’ করছেন, প্রকাশ করবেন বলে। জীবনানন্দের আরও যে পাঁচ-সাত শ কবিতা আছে—৩৪ নম্বর-পরবর্তী খাতাগুলোয়, সেগুলোসহ সব কবিতার—সব মিলে বাইশ-চব্বিশ শ—একসঙ্গে সংকলন বের করার আগ্রহের কথা বললেন। প্রথম আলোর সাজ্জাদ শরিফ আমার কাছ থেকে ভূমেন্দ্রদার কথাটি শোনামাত্রই প্রস্তাবটি অনুমোদন করলেন—প্রথমা প্রকাশন থেকে সংকলনটি প্রকাশ করবেন। কিন্তু জীবন তাঁকে অতটা সময় আর দিল না।
আমি তাঁকে পাঠক সমাবেশ থেকে প্রকাশিত কৃষ্ণাদশমী বইটি উপহার দিলাম। এটি জীবনানন্দ দাশের পরিকল্পিত কবিতা সংকলন। আর দিলাম অন্যপ্রকাশ প্রকাশিত জীবনানন্দ দাশের চিঠিপত্র; আমারই সম্পাদনা। শেষোক্তটির উৎসর্গপত্রের লেখাটি এ রকম: ‘গভীর জীবনানন্দ অনুরাগী/পরিশ্রমী ও একনিষ্ঠ জীবনানন্দ-গবেষক/কবি ও অনবদ্য গদ্য লেখক/পরম শ্রদ্ধেয় ডা. ভূমেন্দ্র গুহ-কে/পরম মমতায় জীবনানন্দ দাশকে ভালোবেসে/তাঁর অকাল তিরোধানের পর লেখার খাতা পাঠ করে/হাজার কবিতার পাঠোদ্ধার করে/রূপসী বাংলা বইটির পাণ্ডুলিপি তৈরি করে/তাঁর দুষ্পাঠ্য দিনলিপি পাঠোদ্ধার করে/যিনি সমগ্র বাঙালি জাতির কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন।’