এলিয়েন বা বহির্জাগতিক প্রাণ নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই। সেই ১৮৭৪ সালের ডিসেম্বরে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন এ নিয়ে, ‘গ্রহগণ জীবের আবাসভূমি’। চলচ্চিত্র বা কল্পবিজ্ঞানের মুখরোচক উপাদান এলিয়েন নিয়ে ভাবতে বাধ্য হয়েছেন বিজ্ঞানীরাও। জিওর্দানো ব্রুনো থেকে শুরু করে স্টিফেন হকিং—কে ভাবেননি এ নিয়ে? তবে বিজ্ঞানীরা শুধু ভাবেন না, তাঁরা যেকোনো বিষয় তলিয়ে দেখতে চান। কিন্তু এলিয়েন নিয়ে তলিয়ে দেখার উপায় কী? এলিয়েন আছে কি নেই—এ প্রশ্নের বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান কীভাবে করেন বিজ্ঞানীরা? সে প্রশ্নের জবাব মিলবে ফারসীম মান্নান মোহাম্মদীর এলিয়েনের সন্ধানে বইয়ে।
বাংলায় এলিয়েন নিয়ে বইয়ের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। তবে এলিয়েনের বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান, সত্যিকার অর্থে বিজ্ঞানীরা যেভাবে সমীকরণ নিয়ে বসে, অঙ্ক কষে এলিয়েনের সম্ভাবনা ও নানা দিক নিয়ে কাজ করেন, সেসব নিয়ে আলোচনা বাংলা ভাষায় খুব বেশি নেই। এ বইয়ে সে বিষয় আছে।
লেখক শুরুটা করেছেন রবীন্দ্রনাথের ওপরিল্লেখিত লেখাটি দিয়ে। তারপর চলে গেছেন এনরিকো ফার্মির বিখ্যাত সেই হেঁয়ালিতে, ‘তারা কোথায়?’ অর্থাৎ এলিয়েন যদি থেকেই থাকে, তারা কোথায়? এই হেঁয়ালিটি একদিকে আমাদের মহাবিশ্বের বিশালত্ব এবং নিজেদের ক্ষুদ্রতা নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে, আরেক দিকে ‘গ্রেট ফিল্টার’ বা বড় যেসব বাধা পেরিয়ে প্রাণের বিকাশ ঘটতে হয়, টিকে থাকতে হয়, সেসব বাধা পেরিয়ে আমরা কত দিন টিকে থাকতে পারব, ভাবতে বাধ্য করে তা নিয়েও।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও আছে। বহির্বিশ্বে প্রাণ থাকতেই পারে। প্রাণ মানে শুধু বুদ্ধিমান প্রাণী নয়, এককোষী ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াও এর অন্তর্গত। এককোষী প্রাণ থাকলে তাদের সন্ধান আমরা কীভাবে করব? কিংবা বহু বহু দূরে কোনো বুদ্ধিমান প্রাণ যদি থেকেও থাকে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগের উপায় কী? আমাদের পক্ষে কি এমন যোগাযোগ আদৌ সম্ভব? এ রকম বুদ্ধিমান কতটি প্রাণ থাকার সম্ভাবনা আছে আমাদের মহাবিশ্বে? বিজ্ঞানীরা এই সম্ভাবনা হিসাব করেন ড্রেক সমীকরণ দিয়ে। এই সমীকরণের আদ্যোপান্ত থাকছে বইটির তৃতীয় অধ্যায়ে।
ড্রেক সমীকরণে আছে বেশ কিছু পদ। এসব পদ বুদ্ধিমান প্রাণের বিভিন্ন শর্ত নিয়ে আলোচনা করে। বইটির বাকি অধ্যায়গুলো এসব শর্ত নিয়ে। একটি গ্রহের পরিবেশ ও জলবায়ু কেমন হলে তা প্রাণ ধারণের উপযোগী হবে, সেটা একটি বিষয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ‘গোল্ডিলকস গ্রহ’। কোনো গ্রহ তার নক্ষত্রের বেশি কাছে থাকলে প্রচণ্ড উত্তাপে অসহনীয় হয়ে উঠবে সে গ্রহে জীবনের বিকাশ, আবার বেশি দূরে থাকলে জমে যাবে গ্রহটির সবকিছু। তাই এমন একটি অবস্থানে থাকতে হবে, যেন গ্রহটিতে পানি তরল অবস্থায় থাকতে পারে। সহজে বলা যায়, ‘নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল’। এ রকম অঞ্চলকে বলে গোল্ডিলকস জোন। আর এ ধরনের অঞ্চলে যেসব গ্রহ থাকে, তারাই গোল্ডিলকস গ্রহ। এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ আমাদের পৃথিবী।
এ রকম কতটি পৃথিবী আছে আমাদের গ্যালাক্সিতে? কয়টি এ রকম পৃথিবীর সন্ধান পেয়েছি আমরা?
প্রশ্নের শেষ নেই। আছে এ নিয়ে নানা মত, নানা বৈজ্ঞানিক সম্ভাবনা বা প্রকল্প, অর্থাৎ হাইপোথিসিস। এসবই উঠে এসেছে বইটিতে। পরিশিষ্টে সংযোজিত হয়েছে হকিংয়ের শেষ বই ব্রিফ আনসার্স টু বিগ কোশ্চেনস থেকে এলিয়েনবিষয়ক একটি রচনা।
ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী বিজ্ঞান বইয়ের জগতে পরিচিত নাম। এই বইয়েও স্বাদু গদ্যে নানান বিষয় তুলে এনেছেন তিনি। তারপর প্রতিটি জিনিস ব্যাখ্যা করেছেন বিজ্ঞানের ভাষায়, সহজ করে। এলিয়েন বা বহির্জাগতিক প্রাণ নিয়ে বাংলা ভাষায় বইটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন বলতেই হবে। এ ধরনের বইয়ের যে অভাব এত দিন ছিল, তা পূরণে ভূমিকা রাখবে বইটি। তবে এলিয়েনবিষয়ক অবৈজ্ঞানিক, আধিভৌতিক ধরনের কিছু আশা করে বইটি পড়তে বসলে হতাশ হতে হবে।
উচ্ছ্বাস তৌসিফ
এলিয়েনের সন্ধানে: ড্রেক সমীকরণ, গোল্ডিলকস পৃথিবী ও অন্যান্য প্রতিবন্ধকতা
ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: ডিসেম্বর ২০২১, প্রচ্ছদ: আরাফাত করিম, ১২০ পৃষ্ঠা, দাম: ২০০ টাকা।
বইটি পাওয়া যাচ্ছে
prothoma.com এবং মানসম্মত
বইয়ের দোকানে।