ঐতিহ্যের প্রতি অঙ্গীকার

কামরুল হাসান, ১৯৮১
ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

বাংলাদেশের আধুনিক পথিকৃৎ শিল্পীদের অন্যতম কামরুল হাসানের (১৯২১-৮৮) শতবর্ষ পূরণ হয়েছে। শুধু সৃষ্টিশীলতা নয়, আচরণ-উচ্চারণেও তাঁর দেশাত্মবোধ ছিল প্রবল। ছবি আঁকার পাশাপাশি সব সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে বিপুলভাবে নিয়োজিত থেকে তিনি দেশের অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন। সর্বদাই ছিলেন সামাজিক দায়বোধে উচ্চকিত। এই দায়বোধ থেকেই তাঁর সত্তায় মূলীভূত হয়েছে ঐতিহ্যের প্রতি অঙ্গীকার। প্রগতির ধ্যানধারণায় আমৃত্যু বাঙালিত্বের সাধনা ও সত্য উচ্চারণের নির্ভীকতায় মহিমান্বিত তাঁর জীবন।

বাল্যকাল থেকেই প্রবলভাবে শিল্পের প্রতি অনুরাগী কামরুল হাসান কলকাতা আর্ট স্কুলে পড়ার সময়ই জড়িয়ে পড়েন নানান সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে, যা তাঁর দেশাত্মবোধকে করে তোলে তীক্ষ্ম ও গভীর। ব্রতচারী আন্দোলন, এআরপি, গণনাট্য আন্দোলন, ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ, ফরোয়ার্ড ব্লক, ছাত্র ফেডারেশন, মণিমেলা, মুকুল ফৌজ প্রভৃতি সংগঠনে তাঁর সক্রিয়তার বিষয়টি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তবে লোক ঐতিহ্যের প্রতি অনুরাগ ও স্বজাত্যচেতনার জাগরণে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে গুরুসদয় দত্তের ব্রতচারী আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর সংযোগ। এর মাধ্যমে পটচিত্র ও পটুয়াদের সঙ্গে নিবিড় পরিচয়সূত্রে লোকশিল্পের তাৎপর্য তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করেন। ১৯৪৭-পূর্বকালে গঠিত শিল্পীমানসের এসব বৈশিষ্ট্য পরবর্তীকালেও অক্ষুণ্ন ছিল। ১৯৪৭-৭১ কালপর্বে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও স্বাধিকার আন্দোলনের পক্ষে প্রথম সারির সাহসী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন। স্বাধীন বাংলাদেশপর্বে তাঁর এ ভূমিকা অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পায়।

কামরুল হাসানের শিল্পকর্মও সর্বদা তাঁর এ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চেতনার অনুগামী হয়েছে। ১৯৪৭-পর্বে পাকিস্তানি চেতনার রক্ষণশীল দিকটিকে যেমন তিনি কার্টুনের মাধ্যমে সমালোচনা করেছেন, তেমনি ভাষা আন্দোলনকালে একই মাধ্যমে বাংলা ভাষাবিরোধীদের মুখোশ উন্মোচন করেছেন। ১৯৭১ সালে এঁকেছেন সামরিক শাসক ইয়াহিয়ার দানবমূর্তিসংবলিত কার্টুন। ১৯৭৬ সালে শিয়ালের প্রতীকে এঁকেছেন বাংলাদেশি নব্য সামরিক স্বৈরাচারের ধূর্তরূপ। আর জীবনের শেষ লগ্নে আরেক সামরিক স্বৈরশাসককে প্রতীকায়িত করেন ‘বিশ্ববেহায়া’রূপে।

ঐতিহ্য-অনুরাগ

উঁকি, গোয়াশ, ১৯৬৭

চিত্রশিল্পী হিসেবে তাঁর বড় কৃতিত্ব হলো, তিনি বাংলাদেশের লোকশিল্পের সঙ্গে আধুনিক শিল্পরীতির এক সার্থক সমন্বয় ও সংশ্লেষণ ঘটিয়েছেন। তাঁর শিল্পকর্মে লোকশিল্পের বৈশিষ্ট্যগত প্রভাব অনেক গভীর ও ব্যাপক। তাঁর ঐতিহ্য–অনুরাগের ইতিহাস অনুসন্ধান করলে এর কয়েকটি উৎসবিন্দুকে চিহ্নিত করা সম্ভব।

প্রথমত, উপনিবেশবাদের বিপক্ষে বাঙালির গৌরবময় ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গড়ে ওঠা ব্রতচারী আন্দোলনের আদর্শের প্রতি তিনি আমৃত্যু ছিলেন আস্থাশীল। ব্রতচারী শিবিরেই তিনি আমাদের প্রাচীনতম শিল্পধারা হিসেবে পটচিত্রের গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত হন। পটুয়াদের মৌলিক রং ব্যবহারের রীতি, অবয়বের পার্শ্বদৃশ্য অঙ্কনের পদ্ধতি, দ্বিমাত্রিক চিত্রবৈশিষ্ট্য, রেখার স্বতঃস্ফূর্ত ব্যবহার প্রভৃতি তাঁকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করে। ব্রতচারী শিবিরেই তিনি বীরভূমের রায়বেঁশে নৃত্য শেখেন এবং এর মধ্য দিয়ে বাঙালির শক্তিমত্তা প্রদর্শনের প্রয়াসের সঙ্গে একাত্ম হন।

দ্বিতীয়ত, এই ঐতিহ্য-অঙ্গীকারের প্রশ্নে যামিনী রায় ও নন্দলাল বসুর চিত্রাদর্শও কামরুল হাসানের ওপর প্রভাব ফেলে। পঞ্চাশের দশকে ইউরোপফেরত জয়নুল যখন বলেন, পাশ্চাত্যমুখী হয়ে নয়, আমাদের শিল্পে আধুনিকতার জাগরণ ঘটাতে হলে লোকশিল্পের সঙ্গে সমন্বয় সাধন জরুরি, তখন তাতে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি নতুনভাবে উজ্জীবিত হন। সত্তর-আশির দশকে এসে তিনি লোককলার সঙ্গে আধুনিক শিল্পবৈশিষ্ট্যের সংশ্লেষণের ক্ষেত্রে বিপুল দক্ষতা অর্জন করেন।

তৃতীয়ত, তাঁর ঐতিহ্য অনুরাগ পূর্ণায়ত রূপ লাভ করে ডিজাইন সেন্টারে যোগদানের (১৯৬০) পর। ডিজাইন সেন্টারে নিযুক্ত হলে দেশের লোকশিল্প ও কুটিরশিল্প ব্যাপকভাবে পর্যবেক্ষণ, এসবের বৈশিষ্ট্য অনুধাবনের সুযোগ লাভ করেন। এভাবে তাঁর চিত্রে লোকশিল্পের নানা মোটিফ ও ভাষা এসে গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নেয়। পুতুলের ফর্ম, রাজশাহীর শখের হাঁড়ির পাখি ও মাছ; শিয়াল, সাপ, কুমির, গিরগিটি, শকুন প্রভৃতির পাশাপাশি প্যাঁচা, ময়ূর, মোরগ, গরু, ঘোড়া, হাতি, কচ্ছপ, বিড়াল; এমনকি বকের মতো নিরীহ প্রাণীও এসে ভিড় জমায় তাঁর শিল্পে।

সমন্বয়ধর্মিতা

লোককলা থেকে বিষয় ও শৈলীগত উপাদান তিনি সংগ্রহ করেছেন সত্য, কিন্তু তাঁর চিত্রাবলি লোকশিল্প দ্বারা আদৌ আচ্ছন্ন নয়। তাঁর ছবিতে লোককলার রীতি ও উপাদানের সঙ্গে আধুনিক পাশ্চাত্য শিল্পের বৈশিষ্ট্যাবলি মিলেমিশে একাকার হয়েছে। এই দুই ধারার মধ্যে অপূর্ব সমন্বয় সাধনের মাধ্যমেই তিনি স্বাতন্ত্র্য অর্জন করেছেন। পটচিত্রের দ্বিমাত্রিক বৈশিষ্ট্যকে গ্রহণ করেও তার মধ্যে ত্রিমাত্রিক আবেদন সৃষ্টি করেছেন তিনি। পটচিত্রীদের মতো টোনাল ভেরিয়েশন সৃষ্টির চেষ্টা না করে সমতলীয় পদ্ধতিতে কামরুল হাসানও কখনো কখনো বর্ণ লেপন করেছেন। কিন্তু এরই মধ্যে তিনি আধুনিক পাশ্চাত্য শিল্পীদের মতো একই সমতলে পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের বর্ণলেপনের মাধ্যমে রঙের পরিপ্রেক্ষিত সৃষ্টি করেছেন যাতে ছবির বিভিন্ন অংশের মধ্যে দূরত্ব বা ক্ষয়-বৃদ্ধির বোধ তৈরি হয়।

তাঁর ড্রয়িংয়ের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। লোকশিল্পীদের মতো সাধারণত মুখের পার্শ্বদৃশ্য অঙ্কনের রীতিটি গ্রহণ করেও এমনভাবে রেখার ব্যবহার করেছেন যাতে ছবির দ্বিমাত্রিকতা বজায় থাকে, একই সঙ্গে ত্রিমাত্রিকতাসহ ছবিতে ভলিউমও সৃষ্টি হয়। তিনি সচেতনভাবেই এ ব্যাপারে কিউবিস্ট রীতির দ্বারস্থ হয়েছেন। বিশেষত পাবলো পিকাসোর প্রভাব এ ক্ষেত্রে স্পষ্ট। পিকাসো যেভাবে একটি মুখাবয়বকে পার্শ্বদৃশ্য ও সম্মুখদৃশ্যের সমন্বয়ে উপস্থাপন করেছেন, কামরুল হাসানও সেভাবে প্রচেষ্টায় সাফল্য দেখিয়েছেন। তা ছাড়া পিকাসোর অনুসরণেই যেন একটি চোখকে তিনি কখনো কখনো মুখের বাইরে নিয়ে স্থাপন করেছেন। কিউবিস্ট শিল্পীদের মতো ব্যাপকভাবে অবয়ব ভাঙার, অবয়বের একাংশকে আরেকটি অবয়বের অংশের মধ্যে অনুপ্রবেশ করিয়ে ছবির বহুমাত্রিক আবেদন সৃষ্টির প্রয়াস তাঁর মধ্যে ছিল। লোকজ শিল্পধারার সঙ্গে আধুনিকতার এই সমন্বয় সাধনের বিষয়ে তিনি ছিলেন প্রতিনিয়ত নিরীক্ষারত। ফলে তাঁর ছবিতে লোকচিত্রের স্বতঃস্ফূর্ত রেখার পাশাপাশি আধুনিক শিল্পীদের মতো সচেতন জ্যামিতিক রেখার উপস্থিতি সহজেই লক্ষণীয়।

যামিনী রায় ইউরোপীয় রীতির আড়ম্বর ও জটিলতা পরিহার করে পটচিত্রের করণকৌশল, প্রয়োগের পদ্ধতি ও বর্ণনাধর্মিতার রীতিসহ লোকশিল্পীদের দ্বিমাত্রিক বৈশিষ্ট্য বজায় রাখার চেষ্টা করেছেন। চিত্রকে দ্বিমাত্রিকতায় পূর্ণতা দানই ছিল তাঁর শৈলীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। লোকশিল্পের অনুসরণে ধর্মকাহিনির আশ্রয় নেওয়াসহ আলংকারিকতাও হয়ে ওঠে তাঁর শিল্পের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু কামরুল হাসান ইউরোপীয় চিত্রের আধুনিক রীতির জটিলতার মিশ্রণ ঘটাতেই সচেষ্ট থেকেছেন। যামিনী রায়ের ক্ষেত্রে কখনো কখনো লোকশিল্পের সঙ্গে আধুনিকতার সমন্বয় সাধনের প্রয়াস নিশ্চয়ই লক্ষ করা যায়। তবে কামরুল হাসানের ক্ষেত্রে এই প্রয়াস যতটা কাঙ্ক্ষিত ও সুস্পষ্ট, যামিনী রায়ের ক্ষেত্রে ততটা নয়। কামরুল হাসান সমকালীন জীবনকে আশ্রয় করেই আলংকারিকতা পরিহার করেছেন।

নারীরূপ

মা ও শিশু, জলরং, ১৯৫০

কামরুল হাসান বাঙালি নারীর বিচিত্র রূপ ও ভঙ্গিকে অজস্রভাবে এঁকেছেন। শিল্পী হিসেবে এক দুর্নিবার রূপতৃষ্ণা তাঁর মধ্যে ছিল এবং তাঁর সৌন্দর্যপিপাসার সঙ্গে এই রূপতৃষ্ণা একাত্ম হয়েছিল। তাঁর নারীচিত্রে আবহমান বাংলাদেশ যেন প্রতীয়মান। নারী ও নিসর্গ তাঁর ছবিতে যেন একাত্ম। প্রকৃতির পটভূমিতে নারীরূপ অন্বেষণের মধ্যে আধুনিক মনোভঙ্গি ও সৌন্দর্যবোধের একটি উচ্চমাত্রার সন্ধান পাওয়া যায়। তবে তাঁর নারীসম্পর্কিত চেতনা কোনো একটি বিন্দুতে স্থির নয়, কয়েকটি পর্যায়ে তা বিভক্ত। এই বিভাজনের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিজীবনের আনন্দ-বেদনার একটি নিগূঢ় সম্পর্ক আছে। যেমন, প্রথম পর্যায়—পঞ্চাশের দশক: প্রণয় ও বিবাহপূর্ববর্তী কাল; দ্বিতীয় পর্যায়—পঞ্চাশের শেষ থেকে সত্তরের দশকের সূচনা: সুখী দাম্পত্যজীবন; শেষ পর্যায়—দাম্পত্য বিচ্ছিন্নতার কাল।

প্রথম পর্যায়ের কাজে নারীর প্রণয়ীরূপ নয়, জননী কিংবা গৃহিণী রূপটিই প্রধান। যে গ্রামীণ পরিবেশে এসব নারীকে উপস্থাপন করা হয়েছে, তার মধ্যে একধরনের স্মৃতিভারাতুর অনুষঙ্গ আছে, মাতৃরূপের ধ্যান আছে। প্রণয়, বিয়ে, সুখী দাম্পত্যজীবন ও কন্যাসন্তান লাভের ঘটনাসমৃদ্ধ তাঁর দ্বিতীয় পর্যায়টি নারীভাবনার ক্ষেত্রে নবতর মাত্রায় উচ্চকিত। এ পর্যায়ে নারীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের অন্তরঙ্গতা এবং সেই সূত্রে নারীর হৃদয় ও আবেগ অনুধাবনের প্রয়াস হিসেবে এ পর্যায়ের চিত্রগুলো বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। তৃতীয় পর্যায়টি দাম্পত্যজীবনের সংকট ও বিচ্ছিন্নতা দ্বারা চিহ্নিত। এ ধরনের পরিস্থিতি তাঁর মানসিক পীড়ার কারণ হলেও বিরামহীন এক সৃষ্টিপ্রক্রিয়ায় রত থেকে তিনি এ সময়ে অনিঃশেষ রূপতৃষ্ণার পরিচয় দিয়ে নারীসৌন্দর্যের আরাধনা করেছেন, যা এক পরিমাপহীন সৌন্দর্যের আকর হয়ে উঠেছে।

বিচিত্র সৃষ্টিসুখ

নানা মাধ্যমে কামরুল হাসান কাজ করেছেন। তেলরং ও জলরং ছাড়া গোয়াশ ও টেমপারা পদ্ধতিসহ ব্যবহার করেছেন প্যাস্টেল ও পোস্টার কালার। ছাপচিত্রের বিভিন্ন পদ্ধতিরও আশ্রয় নিয়েছেন; যেমন, কাঠখোদাই, লিনোকাট, এচিং, সেরিগ্রাফ, লিথোগ্রাফ প্রভৃতি। তা ছাড়া ভাস্কর্যও নির্মাণ করেছেন।

দ্বিতীয়ত, বইয়ের প্রচ্ছদ-অলংকরণ ও পত্রিকার ইলাস্ট্রেশনের কাজে চল্লিশের দশকের শেষ থেকে কামরুল হাসান ব্যাপকভাবে নিয়োজিত হয়ে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেন। ফলে তাঁকে এ দেশে কমার্শিয়াল কাজের অন্যতম পথিকৃৎ বলা যায়। চারুকলায় তিনি গ্রাফিক ডিজাইনের শিক্ষক ছিলেন। এরূপ কাজে বিষয়ানুসারী ড্রয়িং, তদনুরূপ মোটিফ ও রং এবং স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত ক্যালিগ্রাফি ব্যবহারের ফলে তাঁর এই শিল্পচর্চাও স্পর্শ করেছে উন্নত মান।

তৃতীয়ত, সৃষ্টিশীল প্রতিভার আরেক তাৎপর্যময় দিক উন্মোচিত হয়েছে তাঁর খেরো খাতায়। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৪২টি খেরো খাতায় তিনি নিয়মিত লিখে গেছেন তাঁর রোজনামচা। সমসাময়িক ঘটনাবলির বিবরণ-বিশ্লেষণের পাশাপাশি ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতির নানা অপ্রকাশ্য প্রান্তও উন্মোচিত হয়েছে এতে। লেখার মান ও গুরুত্ব ছাড়া খাতাগুলোর প্রতিটি পৃষ্ঠাই তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে শিল্পীর সৌন্দর্যবোধের স্বাক্ষরে। বিভিন্ন রঙিন কলমের ছোঁয়ায় সুন্দর হস্তলিপিসহ লেখার প্রতিটি পৃষ্ঠাকেই তিনি নানা ড্রইং ও ডিজাইনের মাধ্যমে সজ্জিত করায় এর প্রতিটি অংশই হয়ে উঠেছে একেকটি শিল্পকর্ম।

কলসি কাঁখে নারী, জলরং, ১৯৭৪

স্বাদেশিকতা

স্বদেশানুরাগ সূত্রে কামরুল হাসানের ব্যক্তিজীবন ও চিত্রকর্মে শিলীভূত রাজনৈতিক সচেতনতার প্রসঙ্গটিও বিবেচ্য। চল্লিশের দশকে যে রাজনৈতিক চেতনার সৃষ্টি হয়, আমৃত্যু তা অক্ষুণ্ন ছিল। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে সংঘটিত রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক ছিল খুবই ঘনিষ্ঠ। ষাটের দশকে বাংলা বর্ণমালাশোভিত শাড়ির নকশায় বাঙালি জাতিসত্তার পরিচয় তুলে ধরা, ১৯৬৯ সালে ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ’-এর ব্যানারে গণজাগরণে যোগদান ও বাংলা একাডেমিতে অক্ষরবৃক্ষের উপস্থাপন এবং ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের অসহযোগে অংশগ্রহণসহ মুক্তিযুদ্ধের বিপুল কর্মযজ্ঞে আত্মনিবেদনার্থে কলকাতা গমনের মধ্য দিয়ে তাঁর রাজনৈতিক বোধের চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে। মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁর অমর সৃষ্টি: ইয়াহিয়ার দানবাকৃতিসংবলিত কার্টুনচিত্র সমগ্র মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়ে।

কামরুলের রাজনৈতিক ভাবনা স্ফটিকায়িত হয়েছে তাঁর ‘ইমেজ ’৭৪’ শিরোনামের চিত্রমালায়। সদ্য স্বাধীন দেশে আমলা, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও শাসক শক্তির মধ্যে তিনি ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারে ন্যায়নীতি বিসর্জনের যে বিপুল কর্মপ্রয়াস লক্ষ করেন, তা তাঁর মধ্যে সৃষ্টি করে প্রচণ্ড ক্ষোভ ও মনঃপীড়া। নবসৃষ্ট অশুভ শক্তির প্রতীকী পরিচর্যায় সমৃদ্ধ হয়েছে ‘ইমেজ ’৭৪’-এর চিত্রমালা। প্রতীক হিসেবে অন্বিষ্ট হয়েছে সাপ, গিরগিটি, শৃগাল প্রভৃতি। ‘দেশ আজ বিশ্ববেহায়ার খপ্পরে’ (১৯৮৮) শীর্ষক কামরুল হাসানের সর্বশেষ কার্টুনচিত্রটিও তাঁর রাজনৈতিক সচেতনতা ও স্বদেশানুরাগের নিদর্শন হিসেবে উল্লেখযোগ্য।

লোক ঐতিহ্যের প্রতি অঙ্গীকার ও তাঁর রাজনৈতিক চেতনা দুটিই পরস্পরের পরিপূরক। দুটি চেতনাই শেকড়সন্ধানী, জীবনসংলগ্ন ও স্বদেশবাসীর প্রতি দায়বদ্ধ। আধুনিকতা মানে ইউরোকেন্দ্রিকতা নয়, স্বদেশ থেকে বিচ্ছিন্নতা নয়, নিজ মাটি ও মানুষের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন নয়। আধুনিকতা মানে লোকজীবনের সঙ্গে, লোকসমাজসৃষ্ট শিল্পের সঙ্গে আরও লগ্ন হওয়া; ওই শিল্পের অন্তর্গত ঐতিহ্যিক রসকে সমকালীন বোধের সঙ্গে জারিত করে নতুনভাবে উপস্থাপন করা। কামরুল হাসান সেটাই অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সাধন করে প্রকৃত আধুনিক হয়ে উঠেছেন।

কামরুল হাসান

জন্ম: ২ ডিসেম্বর ১৯২১, বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

মৃত্যু: ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮, ঢাকা, বাংলাদেশ

পুরো নাম: আবু শরাফ মোহাম্মদ কামরুল হাসান পরিচিত ছিলেন ‘পটুয়া’ নামে

কর্মজীবন: ১৯৪৮ সালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সঙ্গে মিলে ঢাকায় চারুকলা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা পালন; ১৯৬০ সালে পূর্ব পাকিস্তান ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশনের নকশাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা; ১৯৭১ সালে প্রবাসী সরকারের তথ্য ও প্রচার দপ্তরের শিল্প বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন; ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশনের নকশাকেন্দ্রের পরিচালক হিসেবে অবসর

খ্যাতনামা চিত্রাবলি: ‘তিন কন্যা’, ‘উঁকি’, ‘কলসি কাঁখে নারী ’, ‘নাইওর’, ‘নারী, নিসর্গ ও পাখি’, ‘নবান্ন’, ‘স্তন্যদান’, ‘ষাঁড়’, ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’, ‘দেশ আজ বিশ্ববেহায়ার খপ্পরে’ প্রভৃতি

অন্য উল্লেখযোগ্য কাজ: বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার চূড়ান্ত নকশা, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সরকারি মনোগ্রাম ও বিমান বাংলাদেশের লোগো তৈরি করার সঙ্গে যুক্ত; ছবি এঁকেছেন চার হাজারের মতো