কবিকে জন্মশতবর্ষের শ্রদ্ধা

আহসান হাবীব: (২ জানুয়ারি ১৯১৭-১০ জুলাই ১৯৮৫), ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম
আহসান হাবীব: (২ জানুয়ারি ১৯১৭-১০ জুলাই ১৯৮৫), ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

পিরোজপুরের শঙ্করপাশায় ১৯১৭ সালের ২ জানুয়ারি যে কবি জন্মগ্রহণ করেন, এ বছরের (২০১৭) ২ জানুয়ারি সেই কবি আহসান হাবীবের জন্মশতবর্ষ। অদ্বৈত মল্লবর্মণ একাদশ শ্রেণির ছাত্র থাকার সময় কলেজের পাট শেষ না করেই জীবনের সন্ধানে কলকাতায় চলে যেতে বাধ্য হন। আর আহসান হাবীব উচ্চমাধ্যমিকের পর আর পড়তে না পেরে একই কারণে কলকাতায় এসে হাজির হন। এই উভয় কবি ও লেখক মহানগরে এসে সাংবাদিকতা পেশায় যোগ দেন। এই মহানগরে প্রথমে পড়তে ও পরে কর্মে যোগ দিতে আসেন আরেকজন লেখক শওকত ওসমান। তাঁর কাছে কলকাতা অবশ্য তেমন পর ও দূরের নয়। কারণ, তিনি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা। অবশ্য ভারত ও বঙ্গবিভক্তির পর আহসান হাবীব ও শওকত ওসমান দুজনই পূর্ববঙ্গে চলে আসেন। একই তারিখে জন্ম হলেও আহসান হাবীব মারা যান ১৯৮৫ সালের ১০ জুলাই। আর শওকত ওসমানের মৃত্যু হয় ১৯৯৮ সালের ১৪ মে।
আহসান হাবীব নিজেই তাঁর কবি হওয়ার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে নিজের কবিতার পঙ্‌ক্তিতে লিখেছেন:
শহর পিরোজপুর
সরকারি স্কুলের খেলার মাঠ
পশ্চিমে প্রশাসকদের বাড়িঘর
পূর্বে স্কুল-বাড়ি, সামনে বাগান,
|তার সামনে পুকুর|
উত্তরে আদালত কাছারি,

        দক্ষিণে উকিল মোক্তার ইত্যাদি

মাঠে রাত নয়টার অন্ধকার,

        দু-হাঁটুতে জোড়া হাত

তার ওপর কপাল

আমি একদিন কেঁদেছিলাম।

তখনকার সাম্প্রদায়িক বাস্তবতায় তাঁর শিক্ষক বরদা চক্রবর্তীও কোনো মুসলমান ছেলের ‘কবি’ হওয়ার বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি। শ্লেষে ঝলসে উঠে শ্রেণিকক্ষে সবার সামনে তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তুই কপি হয়েছিস, কপি?’

কিন্তু বৈরী ও বন্ধুর পথ মাড়িয়ে ও তা পেরিয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন। উত্তরকালে পূর্বকালের কথা মনে রেখে ‘দুই হাতে দুই আদিম পাথর’ কবিতায় তিনি লিখেছেন:

সেই যে সময়, জীবনের একমাত্র সময়, যখন

হঠাৎ একজন পথে উৎসাহে

        তর্জনী তুলে সঙ্গীকে বলেন,

 ‘ওই যে ছেলেটি, ওই শাদা শার্ট, বই হাতে

এ নাকি এখনই সুন্দর কবিতা লেখে

মাঝে মাঝে শহরের পত্রিকায় ছাপা হয়, তুমি

দেখে নিও, ও একদিন বড় হবে।’

জীবনের নানা দর্পিত সময়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছেন বলে শেষ পর্বে তাঁর কবিতার বইয়ের নাম হয়েছে বিদীর্ণ দর্পণে মুখ। কিন্তু প্রথম পর্বে যখন তাঁর কবিতার বইয়ের নাম হয় আশায় বসতি, তখন বোঝা যায়, এই কবির প্রসন্ন মুখ ও স্মিত হাসি তাঁকে জীবনের দিকে ডাকে। পরে যে তিনি তাঁর কবিতার বইয়ের নাম রাখেন মেঘ বলে চৈত্রে যাবো, তখন সুন্দর ও অসুন্দরের দ্বন্দ্বের যে দ্বৈরথ চলে, তা তাঁকে অগ্রসর জীবনের আহ্বান জানায়।

দুই.

মূলত কবি হলেও আহসান হাবীব কেজো পৃথিবীরও বাসিন্দা ছিলেন। তাঁর গদ্যের যেমন মাধুর্য ছিল, তেমনি ছিল তার ঋদ্ধ গঠনশৈলী ও যুক্তিপরম্পরা। খুব বেশি গদ্য না লিখলেও তা পড়া ছিল আমাদের জন্য অভিজ্ঞতা। তাঁর উপন্যাস অরণ্য নীলিমা জাফরানী রং পায়রা পড়ে বোঝা যায়, জীবনের শুদ্ধতা ও সূক্ষ্মতা যেমন ছিল তাঁর অন্বিষ্ট, তেমনি সব বিরুদ্ধতার মধ্যেও জীবনের রস নিংড়ে নেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা তিনি জানতেন। উপন্যাস ছাড়াও লিখেছেন কয়েকটি গল্প। তাঁর গদ্যে ছিল যুক্তির জোর। সাংবাদিক ও কেজো গদ্যেও তাঁকে চেনা যেত।

 দৈনিক পাকিস্তান থেকে দৈনিক বাংলা পর্যন্ত সাহিত্য পাতা সম্পাদনায় তিনি যে মান ও রুচি তৈরি করে দিয়েছেন, তা আজও অনুসরণযোগ্য ও প্রেরণাদায়ী বলে মনে হয়। একটি উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টিকে আরও ভালোভাবে বোঝা যেতে পারে। পূর্বাশা সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্য সম্পর্কে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বলেছেন, সম্পাদক হিসেবে অত্যন্ত কড়া মেজাজের মানুষ ছিলেন সঞ্জয় ভট্টাচার্য। নীরেন্দ্রনাথের বয়স যখন ১৭, তখন তিনি ৩৩ বছর বয়সের। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বলেছেন, ‘তারাশঙ্কর, অচিন্ত্যকুমার এঁরা সকলেই সঞ্জয় ভট্টাচার্যকে সমীহ করে চলতেন। সম্ভ্রম করতেন হুমায়ুন কবিরও।’ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতা পূর্বাশায় প্রথম ছাপানোর সময় সঞ্জয় ভট্টাচার্য বলেছিলেন, ‘একেবারে রবীন্দ্রনাথের ছাঁচে-ঢালা কবিতা। কোনো নিজস্বতা নেই।’ কিন্তু তারপরেই বলেছিলেন, ‘এটা ছাপব কিন্তু এখান থেকে বেরিয়ে আসুন।’ (‘সঞ্জয় ভট্টাচার্যের জীবন’, সঞ্জয় ভট্টাচার্য: একটি পরিক্রমা, শাশ্বতী গঙ্গোপাধ্যায়, কলকাতা)।

এ রকমই স্পষ্ট বক্তা ছিলেন আহসান হাবীব। ফলে তা তাঁর সম্পাদনা-মানও তৈরি করে দিয়েছিল। প্রসঙ্গত, কবিতা রচনার শুরুর দিকে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী আহসান হাবিবের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে এসেছিলেন। তিনি অগ্রজ কবির কাছে জানতে চাইতেন, কবিতা কী, কেন কেউ কবিতা লেখে, কবিতা কবি ও পাঠককে কী দেয়, ছন্দ কবিতার কতটুকু, তাকে ছাড়া কবিতার আদৌ অথবা কতটা চলে, সে তার ভূষণ, অলংকার না প্রাণ?

লেখকজীবনের শুরুতে আমার দুটি লেখা তিনি নির্বাচন করেছিলেন। একটি কবিতা, ‘যখন তোমাকে দেখি’। সেই বিশেষ সংখ্যায় গল্প লিখেছিলেন পরবর্তীকালের নাট্যকার সেলিম আল দীন। আরও কবিতা লিখেছিলেন সালেহ চৌধুরী, তাঁর তখকার ‘আবু ওবায়দা’ ছদ্মনামে। আর অন্য সংখ্যায় গল্প ‘নিয়ত ইচ্ছায়’ দুর্গাপূজার আবহে সুহাস ও বিনতার মিষ্টি প্রেমের গল্প ছিল এটি।

 আহসান হাবীবের সম্পাদনায় দুটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যার কথা এখনো মনে পড়ে। একটি হচ্ছে ম্যাক্সিম গোর্কি সংখ্যা। আন্তরিক প্রণোদনা না থাকলে পাকিস্তান আমলে এ ধরনের সংখ্যা সম্পাদনা করা সম্ভব ছিল না। কলকাতা আমলে বাম ঘরানার সংযোগ ও তার অন্তঃপ্রেরণাই তাঁকে দিয়ে গোর্কির জন্মশতবর্ষের এ সংখ্যাটি সম্পাদনা করিয়ে নিয়েছিল বলে মনে হয়।

অন্য সংখ্যাটি ছিল মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর মৃত্যু-পরবর্তী ওয়ালীউল্লাহ সংখ্যা। প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ওয়ালীউল্লাহর বিষয়ে কোনো কিছু প্রকাশই যখন ছিল ঝুঁকিপূর্ণ (প্রসঙ্গত, পাকিস্তান সরকারের রোষানলে পড়ে মৃত্যুর আগে ওয়ালীউল্লাহ চাকরি হারিয়েছিলেন), তখন একাত্তরের অক্টোবরে তাঁর ওপর একটি সংখ্যা প্রকাশ শুধু শিল্পরুচিরই নয়, একটি অত্যন্ত সৎ সাহসেরও দৃষ্টান্ত ছিল।

তিন.

আহসান হাবীব প্রত্যক্ষভাবে জীবনের রূঢ়তা ও দারিদ্র্য দেখেছেন। তাঁর কবিতায় এর সাক্ষ্য ও স্বাক্ষর রয়েছে। ‘বাড়ি নিয়ে এক সের বারো জনে খাই’ অথবা ‘আহত সন্ধ্যায়’ বোঝা যাচ্ছে এ ‘রাত্রি দুঃস্বপ্নের’।

কিন্তু তবু কলকাতায় হারু মিয়ার বস্তিতে তিনি স্বপ্ন দেখেছেন, এ রাত্রি শেষ হবে। ভেবেছেন, ‘নদীর জলে ঝলকে উঠবে মুক্তি।’ প্রথম পর্বের ‘আশায় বসতি’র পর শেষ পর্বে ভেবেছেন, ‘ডাক বিলি হয়েছে কি হয়নি জানি না/ তার উত্তরের আশায় বসে আছি, টলেনি বিশ্বাস।’

এই কবিকে তাঁর জন্মশতবর্ষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই।