কাছের আকাশ

.
.

ভূমিকা
বাংলাদেশের খুব কাছের দেশ যেগুলো, দক্ষিণ এশিয়ার এসব দেশের সীমানা ইতিহাসের পরিক্রমায় যেমন নানাভাবে পাল্টেছে, তেমনি সমাজ-সংস্কৃতি ও রাজনীতির ধারাও বিভক্ত হয়েছে নানা স্রোতে। তবু এই পড়শি দেশগুলোর কবিতার জগৎ যেন একই ধাতুতে গড়া। যেন ভাষার দূরত্ব ডিঙিয়ে কবিতার দর্পণে ভেসে ওঠে একই রকম মুখ। কালিদাসের মেঘদূতের মেঘ উড়ে উড়ে পার হয়ে গেছে এসব দেশেরই কোনো কোনো সীমানা। তেমনি সীমা ডিঙিয়ে বয়ে যায় অভিন্ন নদী আর আলো ছড়ায় একই সময়ের সূর্য। অন্যদিকে, বৈশ্বিক মেরুকরণ দেশগুলোকে এনে ফেলেছে পরস্পরের কাছাকাছি। তবে এসব দেশের বহুমাত্রিকতা ও বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করা যায় না। আর এটাই স্বাভাবিক যে, কবিতার অস্থিমজ্জায়ও থাকবে তার অনিবার্য প্রভাব। হয়তো কবিতার অন্তঃপ্রকৃতির কারণেই—কবিতা শিল্পের অভিন্ন এক ভাষা বলেই তারা পরস্পরের কাছের। প্রেম-অপ্রেম, দুঃখ-বেদনা নিয়ে এখানকার মানুষজনের বাঁচার ধরন এ অঞ্চলকে দিয়েছে এক স্বতন্ত্র চেহারা, তৈরি হয়েছে কবিতার এক আলাদা ভূগোল। কাছের দেশ হলেও ভাষার দূরত্ব পরস্পরকে আড়াল করে রাখে। আমরা দেখতে পাই না কবিতার পড়শিরা কী লিখছেন। সাম্প্রতিক কয়েক দশকের এই কবিতাগুলো থেকে দক্ষিণ এশীয় কবিতার একটা আলাদা মানচিত্রকে হয়তো চিহ্নিত করা যায়।

ভারত
অনামিকা
দরজা
আমি ছিলাম একটি দরজা।
যত জোরে তারা ধাক্কা দেয়
তত প্রশস্ত হয়ে আমি খুলে যাই
তারা ভেতরে ঢোকে আর দেখে
মস্ত এক মহাজাগতিক নাগরদোলা
যখন ক্যাচ ক্যাচ শব্দ থামে, পাক খাওয়া শুরু হয়
যখন পাক খাওয়া থামে, সেলাই করা শুরু হয়
এটা নয়তো ওটা, সমস্ত দিন, বিরামহীন।
আর শেষে গিয়ে আমার ঝাড়ু সমস্ত কিছুকে ঝাঁট দেয়
ঝাঁট দেয় আকাশের তারাগুলিকে
পাহাড়, গাছ আর পাথরগুলিকে
সৃষ্টির সময়ের ছিটে-ছাটা সব টুকরা
কুড়িয়ে নেয় ঝুড়িতে
সেগুলোকে জড়ো করে
গহিন মনের
নিরিবিলি এক কোণে।

অনামিকা
অনামিকা

অনামিকা
হিন্দি ভাষার কবি। জন্ম ভারতের বিহারে, ১৯৬১ সালে। তিনি সমাজকর্মী ও ঔপন্যাসিক। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সত্যবতী কলেজে শিক্ষকতা করেন। বীজাক্ষর, অনুষ্টুপ, শহুরে সময় তাঁর কবিতার বই। কবিতাটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন ঋতু মেনন।

মিয়ানমার
জেইয়ার লিন
রাজাদের উপাখ্যান
বাবা ছিলেন মেজাজি। সব সময় একটি চাবুক
তাঁর সহজ নাগালে।
খেয়ালের এক বজ্র। ছোট ভাইটি তাঁকে এড়িয়ে উঠে যায়
গাছে। তবু তাকে তো নেমে আসতেই হয়েছে।
বাবা কেটে ফেলেছেন সেই গাছ।
মায়ের শরীর ছিল এক শরণার্থীশিবির।
অদ্ভুত, সব ভাইবোন বড় হয়েছে সেখানে।
মা মারা গেলেন, বাবা তাঁর মৃতদেহটা ধরে
ঝাঁকালেন পাগলের মতো।
তারপর...তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
আর কোনো রকম খবর নেই।
তার সব ছেলেমেয়ের এখন নিজেদের পরিবার আছে।
কার শিশুটি তার দেহধারণ করবে?
তার ছায়ার পাহারাদার হয়ে আমরা থেকে যাই।

জেইয়ার লিন
জেইয়ার লিন

জেইয়ার লিন
জন্ম মিয়ানমারে, ১৯৫৯ সালে। তিনি সমালোচক, অনুবাদক ও ভাষাশিক্ষক। বাস করেন রেঙ্গুনে। পোয়েট্রি ওয়ার্ল্ড পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক। কবিতার বই স্বতন্ত্র চেহারা (২০০৬), বাস্তব/জীবন: গদ্যকবিতা (২০০৯) ও কিলিমাঞ্জারো (২০১০)। জেইয়ার লিন কবিতা লেখেন ইংরেজি ভাষায়।

শ্রীলঙ্কা
ভিভিমেরি ভান্দেরপুরতেন
গোলকধাঁধা
সুতরাং স্বপ্নটা ছিল এই
যা আমি দেখেছিলাম কাল রাতে
যে, আমি হারিয়ে গেছি এক গোলকধাঁধার ভেতর
এবং তোমাকে খুঁজে পাবার চেষ্টা করছি
অনেকগুলো দেয়ালের এক জালের মাঝখানে
দেয়ালগুলো উধাও হয়ে গেল
এবং
আবার সেগুলোকে দেখা গেল
আর যেহেতু আমি খুঁজে পেলাম না
তোমাকে
আমি রেখে দিলাম তোমার হাতের ছাপ
নরম শাদা একটা পৃষ্ঠার ওপর
যা ছাপটাকে রেখে দিল রক্তসন্ধি করে
তাই আমি আর তোমাকে খুঁজতে থাকলাম না
পেছন থেকে
বারবার

পুরোনো সেই দেয়ালগুলো নয়
বরং হাতের ছাপগুলোই উধাও হয়ে গেল
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে
আবার তাদেরকে দেখতে পাওয়া গেল
শিগগির, স্বপ্ন যেন শেষ হলো

সুতরাং কোনো শেষ ছিল না
তোমাকে খুঁজে বেড়ানোর
এবং কোনো শুরু ছিল না
তোমাকে খুঁজে পাওয়ার।

ভিভিমেরি ভান্দেরপুরতেন
ভিভিমেরি ভান্দেরপুরতেন

ভিভিমেরি ভান্দেরপুরতেন
সিংহলি-বেলজীয় বংশোদ্ভূত এই কবি বড় হয়েছেন শ্রীলঙ্কার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রাজধানী শহর কুরুনেগালায়। যুক্তরাজ্যের উলস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়েছেন পিএইচডি ডিগ্রি। বর্তমানে শ্রীলঙ্কার উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা, সাহিত্য ও ভাষাতত্ত্বের শিক্ষক তিনি। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ কোনো কিছুই তোমাকে প্রস্তুত করে না (২০০৭) গ্রাটিয়ায়েন পুরস্কার পায়। ২০০৯ সালে তিনি পেয়েছেন সার্ক কবিতা পুরস্কার। কবিতাটি নেওয়া হয়েছে তাঁর দ্বিতীয় কবিতার বই সেলাই করো তোমার চোখের পাতা (২০১০) থেকে। ভান্দেরপুরতেন ইংরেজি ভাষায় কবিতা লেখেন।

আফগানিস্তান
কামরান মির হাজার
এক ঘোটকীর চিৎকার একটা প্রজাপতি হয়ে উঠেছে প্রায়
ক্রমাগতভাবে জল, দিগন্ত,
ফালি করা নদী
আর বিভাজিত অক্সাসের ওপর
সোজা হয়ে দাঁড়াচ্ছে কেউ;
কিংবা হয়তো
একজন হিন্দু ইন্দ্রজাল ছড়াচ্ছে বালির ওপর,
চলছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে পথে পথে আর থামছে
শব্দের পাদদেশে;
প্রতিবার হয়ে উঠতে চাইছে কথা, যুক্ত হতে কিংবা
বিযুক্ত হতে;
ভেজা এক কালির দোয়াত,
কাচপাত্রের ভেতর পাকিয়ে ওঠা কুণ্ডলি,
নিজেকে যুক্ত করছে নিজের সত্তাকে ফেলে যেতে গিয়ে,
মাটির পেয়ালার পরিধিকে স্পর্শ করে কুণ্ডলিত নিশ্বাস,
পঞ্চ ইন্দ্রিয় হয়ে ওঠে ত্রিমাত্রিক,
কুঞ্চিত, অকুঞ্চিত হচ্ছে বন্ধ ঠোঁটের আবেগে,
ভবঘুরে এক লোক ক্যানসার বয়ে নিয়ে চলে পথে পথে;

চায়ের কাপে জিরিয়ে নেয় বাষ্পায়িত নিশ্বাস
চাহনিগুলো বাঁধা পড়ে একসঙ্গে,
সাথে মিষ্টি চীনা সুগন্ধের বিষণ্নতা;
আমাদের দেহের একাংশ চলে গেছে তিব্বতের উদ্দেশে,
এক ঘোটকীর চিৎকার একটা প্রজাপতি হয়ে উঠেছে প্রায়।

কামরান মির হাজার
কামরান মির হাজার

কামরান মির হাজার
১৯৭৬ সালে আফগানিস্তানে জন্ম। তিনি সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী। বর্তমানে নরওয়েতে বাস করছেন। ২০০৮ সালে আমেরিকান হিউম্যান রাইটস ওয়াচ থেকে হেলম্যান/হেলমেট গ্রান্টসহ পেয়েছেন অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা। তাঁর দুটি কবিতার বই মেহর-পুস্তক ও এক ঘোটকীর চিৎকার একটি প্রজাপতি হয়ে উঠেছে প্রায়। কবিতাটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন নুশিন আরবাবজাদাহ।

পাকিস্তান
ইশরাত আফরিন
গজল
এবারের বৃষ্টিরা আসো, বাগানে রোপণ করা হবে জোনাকি,
বিধবা কৃষাণিদের অশ্রু।

ভূস্বামীর হাবেলিখানায় কত আর রক্তপাত হবে?
কত দিন আর গোলাপি চিবুক রোপণ করা হবে তার গোড়ায়?

নভঃলোক জানে ডাকিনী পড়েছে আমার সবুজ খেতে।
পুঁতে দেয়া হবে কবজ আর রোপণ করা হবে জাদু।

উর্বর জমি চুষে শুকিয়ে ফেলেছে যারা, এখনো বেঁচে আছে,
আমার তরুণেরা তাদের রক্তের ফোঁটাগুলিকে রোপিত
হতে দেবে।

যে হাতগুলি ফুল ফোটায় মন থেকে মনে আর
স্বপ্ন থেকে স্বপ্নে,
রংধনুর রং, চাঁদ, গানের সুরের সুগন্ধ
রোপণ করা হবে এসবই।

ইশরাত আফরিন
ইশরাত আফরিন

ইশরাত আফরিন
উর্দু ভাষার কবি, নারী অধিকার কর্মী। পাকিস্তানের সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারী ও স্বতন্ত্র ধারা সৃষ্টিকারী নারী কবিদের একজন। রুখসানা আহমেদ সম্পাদিত আমরা পাপিষ্ঠা নারী: সমকালীন নারীবাদী উর্দু কবিতা (১৯৯১) সংকলন থেকে অনূদিত কবিতাটি নেওয়া হয়েছে। কবিতাটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন রুখসানা আহমেদ।

নেপাল
মঞ্জু কাঞ্চুলি
যদি
যদি হোঁচট খেয়ে না থাকি তো পড়ে যেতে পারি

ছোট ওই ভুল যদি না করি আমি
কত ভুলে ভরা হতে পারে আমার জীবন

হৃদয়ের গভীরতা মাপতে গিয়ে কত-না বার
আমি বিভ্রান্ত হয়েছি দূর থেকে আসা হৃৎস্পন্দন শুনে

ছোট নদী আমাকে যদি ভাসিয়ে না নিত
বাড়তে থাকা জোয়ার টেনে নিয়ে যেত আমাকে

বিড়াল যদি খামচি না দিত
বাঘের মুখে পড়তাম আমি

বেসক্যাম্পেই যদি না আমি হোঁচট খেতাম
২৯০০০ ফুট উঁচু থেকে পড়ে যেতাম আমি

যদি আমি হোঁচট না খাই
সব সময়ের জন্য আমাকে চিনে রাখবে এক দুর্বিপাক

একটা ছোট ভুল যদি আমি না করি
কত ভুলে ভরা জীবন হতে পারে আমার

মঞ্জু কাঞ্চুলি
মঞ্জু কাঞ্চুলি

মঞ্জু কাঞ্চুলি
জন্ম নেপালে। ইংরেজি ও মনোবিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষকতা করেছেন। তাঁর রয়েছে বেশ কয়েকটি কবিতার বই। এই কবিতাটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন ওয়েনে আমৎজিস ও কবি নিজে। ১৯৯৬ সালে দ্য মিনেসোটা রিভিউ-এ কবিতাটির ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে।