কাজী মোতাহার হোসেনের 'সঞ্চরণ', চিন্তার পরিধি ও ব্যাকরণ

কাজী মোতাহার হোসেন (৩০ জুলাই ১৮৯৭—৯ অক্টোবর ১৯৮১)  ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম; বর্ধমান হাউস, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, মে ১৯৭৮
কাজী মোতাহার হোসেন (৩০ জুলাই ১৮৯৭—৯ অক্টোবর ১৯৮১) ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম; বর্ধমান হাউস, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, মে ১৯৭৮

কাজী মোতাহার হোসেনের প্রথম প্রবন্ধের বই সঞ্চরণ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৭ সালে। বইটি বহু পাঠকের মনোযোগ কেড়েছিল। অন্য অনেকের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বইটির প্রশংসা করেছিলেন এর ‘প্রাঞ্জল ভাষা’, ‘বলবার সাহস এবং চিন্তার স্বকীয়তা’র জন্য। রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই প্রবন্ধগুলোতে নিজের চিন্তার গভীর অনুরণন টের পেয়েছিলেন; গ্রন্থকারকে লেখা চিঠিতে তিনি অবশ্য সে কথার উল্লেখ করেননি। যাকে আমরা চিন্তামূলক বা সাহিত্যিক প্রবন্ধ বলি, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং প্রমথ চৌধুরীর চর্চায় তার বেশ শক্ত-পোক্ত ধারা বাংলায় গড়ে উঠেছিল। গুণে-মানে ইতরবিশেষ থাকলেও কাজী মোতাহার হোসেন এবং তাঁর সতীর্থ শিখা গোষ্ঠীর লেখকেরা সেই ধারারই অন্তর্গত। এগুলো ঠিক দার্শনিক রচনার মতো পদ্ধতিমাফিক রচনা নয়, গবেষণামূলক প্রকল্পধর্মী রচনাও নয়। কাজী মোতাহার এবং তাঁর বন্ধুদের প্রবণতায় প্রবন্ধকে ‘সাহিত্য’ করে তোলার চেষ্টা ছিল। এ ক্ষেত্রে ওই প্রজন্মের সামষ্টিক সাফল্য বাংলাদেশে পরে আর কখনো দেখা যায়নি।
সঞ্চরণ-এর চিন্তা আর শৈলীগত মূল্য ফুরিয়ে যায়নি। তবে আজ প্রায় সাত দশক পরের পাঠের ক্ষেত্রে বইটির ঐতিহাসিক মূল্যই আমাদের কাছে প্রধান হয়ে ওঠার কথা। এ কেতাবের প্রকাশ সাল ১৯৩৭-ও বিশেষভাবে মনে রাখার মতো। এ বছর বাংলার ক্ষমতাকাঠামোয় বড় ধরনের বদল ঘটেছিল। আর তার প্রত্যক্ষ প্রভাবে দুই বাংলায় দুই সম্প্রদায়ের স্বাতন্ত্র্যবাদী চিন্তা খুব জোরালো হয়ে উঠেছিল। বাংলা অঞ্চলের বুদ্ধিবৃত্তিক বয়ানে অবশ্য অন্যায্যভাবে কেবল মুসলমান পক্ষের স্বাতন্ত্র্যবাদের কথা প্রচারিত আছে। ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল আরও কয়েক বছর আগে। কিন্তু কাজী মোতাহার হোসেন এবং ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’-এ তাঁর সহকর্মীরা এ সময়ের সন্তান নন। তাঁরা আগের প্রজন্মের মানুষ। বলা যায়, তাঁরা নজরুল-প্রজন্মের মানুষ। কী এ প্রজন্মের বৈশিষ্ট্য? হুমায়ুন কবির বিখ্যাত বাংলার কাব্য গ্রন্থে নজরুল সম্পর্কে কয়েকটি শনাক্তিমূলক মন্তব্য করেছিলেন। তার একটি ছিল এ রকম: নজরুল অসহযোগ আন্দোলনের কবি। এ মন্তব্য যে শুধু নিগূঢ়ভাবে সারবান তাই নয়; বলা দরকার, জসীমউদ্দীনসহ সমকালীন মুসলমান লেখকদের খুব বড় অংশ এবং পুরো শিখা গোষ্ঠীর লেখকদের সম্পর্কেও কথাটা গভীরভাবে প্রযোজ্য। সঞ্চরণ-এর প্রবন্ধগুলো মোটের ওপর ১৯২৭ থেকে ১৯৩৭ সালের মধ্যে লেখা। এ সময়ের মুসলমান লেখকদের প্রতিনিধিত্বমূলক প্রায় সব বৈশিষ্ট্যই বইটিতে আছে। বিষয়ের দিক থেকে আছে আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ—সংগীত ও বিজ্ঞান।
কাজী মোতাহার কয়েকটি ক্ষেত্রে ছাড়িয়ে গেছেন আর সবাইকে। তাঁর সতীর্থরা ছিলেন কলা আর সমাজবিজ্ঞানের মানুষ। তিনি বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের। পরে গেছেন ফলিত গণিতে। সেখানে বিশ্বমাপের কাজ করেছেন। দাবায় তাঁর অনুরূপ কৃতিত্ব সমান পঙ্ক্তিতেই বিবেচ্য। সংগীতে তাঁর বিশেষ ব্যুৎপত্তি ছিল। কয়েকটি প্রবন্ধে তিনি সেই পাণ্ডিত্যকে রসযোগে পরিবেশন করেছেন। সাংগঠনিক প্রতিভা অবশ্য তাঁর দলের আরও কারও কারও মধ্যে ছিল। যেমন আবুল হুসেনের। তবে তিনি পরে প্রতিষ্ঠান গড়ায় আর প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণার সিলসিলা প্রতিষ্ঠায় যে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন, তার জুড়ি মেলা ভার। তাঁর একজন জীবনীকার আবদুল্লাহ আল-মূতী তাঁকে যথার্থই রেনেসাঁ-পুরুষ বলে আখ্যায়িত করেছেন। আখ্যাটা সুপ্রযুক্ত হয়েছে—তাঁর প্রতিভা ও সাফল্যের বৈচিত্র্যের দিক থেকে, কর্মতৎপরতার দিক থেকে এবং জনগোষ্ঠীর নিরন্তর কল্যাণকামনার দিক থেকে। শেষোক্তটি খুব জোরালো ছিল বলেই কলা ও সমাজচর্চা তাঁর কাছে কখনোই বিকল্প কাজ বলে গণ্য হয়নি। সাহিত্যচর্চাকে তিনি বস্তুত জনকল্যাণের প্রধান উপায় মনে করতেন এবং একই সঙ্গে জন-উৎকর্ষের প্রধান নিরিখও মনে করতেন। সঞ্চরণ-এর প্রবন্ধগুলো তাঁর বিষয়বৈচিত্র্য আর সাহিত্যপ্রাণতার কার্যকর সাক্ষ্য।
‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’-এর অন্য সহকর্মীদের মতো কাজী মোতাহার হোসেনেরও মূল অবলম্বন ছিল মুসলমান সমাজ। কথাটা সতর্কতার সঙ্গে পাঠ করা দরকার। মুসলমান সমাজকে বাংলার হিন্দু সমাজ থেকে আলাদা করে পড়বার এই ধারা মুসলমানদের আবিষ্কার নয়। উনিশ শতকের উপনিবেশিত কলকাতায় এর যাবতীয় এনতেজাম সমাপ্ত হয়েছিল। ওই শতকে বাংলার ইতিহাস-সংস্কৃতি-সাহিত্যে এবং রাজনৈতিক চর্চায় বিভাজিত ভাষা-পরিভাষা এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে মুসলমান লেখকদের পক্ষে কোনো সার্বিক সম্বোধন সম্ভবপর ছিল না। তাই শিখা গোষ্ঠীর এতটা ‘অসাম্প্রদায়িক’, এতটা ‘উদারনীতিবাদী’, এতটা ‘মানবতাবাদী’ তরুণগোষ্ঠীকেও সম্প্রদায়গত নাম নিয়েই কাজ করতে হয়েছে। দ্বি-ধারা বিভাজন আগেই তৈরি হয়েছিল।

কাজী মোতাহার হোসেন যখন দাবা খেলায় মগ্ন। ছবি: নাসির আলী মামুন
কাজী মোতাহার হোসেন যখন দাবা খেলায় মগ্ন। ছবি: নাসির আলী মামুন

সঞ্চরণ-এর সংশ্লিষ্ট প্রবন্ধগুলো সাক্ষ্য দেয়, কাজী মোতাহার এই ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। কিন্তু তিনি আর তাঁর বন্ধুরা চেয়েছিলেন বিভেদ যথাসম্ভব কমিয়ে মৈত্রীর পথ তৈরি করতে। ‘বাঙালীর সামাজিক জীবন’ এবং ‘বাংলা সাহিত্যের স্বরূপ’ প্রবন্ধ দুটিতে লেখক স্পষ্টতই দ্বি-বিভাজিত সমাজ ও সংস্কৃতিরই পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু যেমন শিরোনামে, ঠিক তেমনি প্রবন্ধের অন্তঃস্থ অভিপ্রায়েও সমন্বয়ের আকাঙ্ক্ষা জোরালোভাবে প্রকাশ পেয়েছে। বাস্তবে দুই সমাজের কোথাও এই আকাঙ্ক্ষাটা প্রবল ছিল না। তাই রাজনীতির হাওয়া বইতে-না-বইতেই দুই সমাজ দুই জাতির মূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করতে দেরি হয়নি।
সঞ্চরণ-এর প্রবন্ধগুলো যখন লেখা হচ্ছিল, তখন বাংলা অঞ্চল রীতিমতো দাঙ্গা-কবলিত। ১৯২৬ থেকে ১৯৪৬ পর্যন্ত বছরগুলোতে উপমহাদেশ সবচেয়ে বেশিবার দাঙ্গার মুখোমুখি হয়েছে। মোতাহার হোসেন এ বাস্তবতার উল্লেখ করেছেন। দাঙ্গার পেছনে যে ক্ষমতা-সম্পর্কের প্রত্যক্ষ বোঝাপড়া কাজ করছে, সে বিষয়ে তিনি সচেতন ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে এর ঐতিহাসিক-সাংস্কৃতিক কারণগুলোও উল্লেখ করতে ভোলেননি। প্রশ্ন হলো, তাহলে তাঁর সমন্বয়-আকাঙ্ক্ষার যৌক্তিক ভিত্তি কী? আসলেই কিন্তু তিনি বা তাঁর সহকর্মীরা বাস্তবের ভিত্তিতে এ জাতীয় কোনো কর্মসূচি প্রণয়ন করেননি। তাঁরা কাজ করেছেন বিশুদ্ধ সাংস্কৃতিক যুক্তিতে। সংস্কৃতি বলতে তাঁরা জনসংস্কৃতি বুঝতেন না কিংবা নৃবিজ্ঞান বা সমাজবিজ্ঞান শাস্ত্রে যাকে সংস্কৃতি নামে ডাকা হয়, তা বুঝতেন না, বরং জনগোষ্ঠীর বিকশিত অংশের অনুভূতি ও চর্চার প্রকাশ বুঝতেন। মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ‘সংস্কৃতি কথা’ প্রবন্ধে প্রস্তাবিত সংস্কৃতির যে সংজ্ঞা বাংলাদেশে প্রায় কিংবদন্তিতুল্য প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, তা ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’-এর সাধারণ সংজ্ঞা হিসেবে গৃহীত হতে পারে। সঞ্চরণ গ্রন্থের নানা প্রবন্ধে সংস্কৃতি শব্দটির এ রকম ব্যবহারই আছে। এই বড় প্রকল্পটি তাঁরা সরাসরি পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে।
‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’-এর তরুণদের সঙ্গে তরুণ নজরুলের সম্পর্কের ধরন বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে। মুসলমান সমাজের সমালোচনা এবং কল্যাণ কামনার দিক থেকে এঁদের সঙ্গে নজরুলের গভীর মিল আছে। একে প্রত্যক্ষ প্রভাবও বলা যেতে পারে। হিন্দু-মুসলমান মিলনের আকাঙ্ক্ষার দিক থেকেও তাঁরা সমধর্মী। কিন্তু পদ্ধতির দিক থেকে তাঁরা একেবারেই আলাদা। নজরুল প্রত্যক্ষত রাজনৈতিক এবং সে রাজনীতি সর্বার্থেই বিপ্লবী ঘরানার। অন্যদিকে শিখা গোষ্ঠী বস্তুত বিপ্লববিরোধী; তাঁদের কর্মসূচি সংস্কারমূলক ও সংস্কৃতিনির্ভর। সঞ্চরণ গ্রন্থে নজরুল কার্যত অনুপস্থিত। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আছেন—নামে অনেকবার, আর বেনামে গ্রন্থটির প্রায় সর্বত্র। খোন্দকার সিরাজুল হক তাঁর মুসলিম সাহিত্য-সমাজ: সমাজচিন্তা ও সাহিত্যকর্ম (বাংলা একাডেমি, ১৯৮৪) নামের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থে যথার্থই শনাক্ত করেছেন, চিন্তাপদ্ধতির দিক থেকে কাজী মোতাহার হোসেন এবং তাঁর সহকর্মীরা রাবীন্দ্রিক বলয়েরই বাসিন্দা। রবীন্দ্রনাথের দুটি সুপরিচিত সিদ্ধান্ত সঞ্চরণ-এর অনেকগুলো প্রবন্ধের ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। একটি হলো, সমষ্টির মুক্তির প্রাথমিক শর্ত ব্যক্তির মুক্তি। দুই. বিকশিত মনই ক্রমশ সঞ্চারিত হবে চারপাশে; আলোকিত করবে বহু মানুষকে। রবীন্দ্রনাথ হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের সমস্যা নিয়ে যে বিপুল প্রবন্ধ রচনা করেছেন, তাতে ব্যাপারটাকে মুখ্যত ব্যক্তিগত ও সামাজিক কুসংস্কার আর অন্ধত্ব হিসেবেই দেখা হয়েছে। কোনো কাঠামোগত বিবেচনা সেখানে প্রাধান্য পায়নি। পরিপ্রেক্ষিতগত খানিকটা ফারাক থাকলেও কাজী মোতাহার হোসেনের বিবেচনাও একই ঘরানার। তিনি চেয়েছেন, বিকশিত হিন্দু সমাজের মতো মুসলমান সমাজও এগিয়ে যাক। তাতেই কেবল কাঙ্ক্ষিত সমন্বয় সম্ভবপর হবে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,কাজী নজরুল ইসলাম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,কাজী নজরুল ইসলাম

অবশ্য সাধারণভাবে ধর্মের তাত্ত্বিক বিচার-বিশ্লেষণের প্রতিও তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল। নিজে তিনি ধর্মকর্ম করতেন। ধর্ম পালন কীভাবে উদারনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে, সেই তত্ত্বতালাশ করাকে তিনি সম্ভবত দায়িত্ব হিসেবেই নিয়েছিলেন। সঞ্চরণ গ্রন্থভুক্ত ‘নাস্তিকের ধর্ম’, ‘ধর্ম ও সমাজ’, ‘আর্টের সহিত ধর্মের সম্বন্ধ’, ‘মানুষ মোহাম্মদ’ প্রভৃতি প্রবন্ধ এ ব্যাপারে তাঁর নিবিড় আগ্রহ আর বিশ্লেষণ-ক্ষমতার সাক্ষ্য বহন করছে। এর মধ্যে ‘নাস্তিকের ধর্ম’ প্রবন্ধের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই। এ প্রবন্ধে তিনি যেভাবে নাস্তিককেও ধর্মবলয়ের অঙ্গীভূত করে নিয়েছেন, তা তাঁর উদারনীতির শক্ত ভিত্তিরই নিশ্চয়তা দেয়। উল্লেখ্য, উদারনীতি কথাটা এখানে বিশেষ সংজ্ঞা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, মূল্যবিচার অর্থে নয়। পার্থ চট্টোপাধ্যায় উনিশ শতকের প্রথমাংশের কলকাতায় শনাক্ত করেছেন এক উদারনীতিবাদী আধুনিকতা, আর শতাব্দীর শেষাংশে কলোনিয়াল আধুনিকতা, যার প্রধান প্রকাশ জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে। এর অনুসরণে ঢাকার শিখা গোষ্ঠীর চর্চাকে লিবারেল আধুনিকতা আর পরের প্রজন্মের চর্চাকে জাতীয়তাবাদী আধুনিকতা নাম দেওয়া চলে। সঞ্চরণ গ্রন্থটি এই লিবারেল বা উদারনীতিবাদী আধুনিকতার প্রকৃষ্ট নজির।
কথাটা প্রবন্ধগুলোর চিন্তাপদ্ধতির দিক থেকেও গভীরভাবে সত্য। লেখক সাধারণভাবে কোনো আদর্শ ধরে নিয়ে অবরোহী পন্থায় বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। সমাজের বাস্তবতা তাঁর বিবেচনায় ছিল, এমনকি কোথাও কোথাও তাঁর উচ্চারণও অভিজ্ঞতাবাদীদের মতো; কিন্তু সেগুলো তাঁর চিন্তার দিক-নির্ণায়ক হয়ে ওঠেনি। আদর্শ নির্ধারণে স্বভাবতই কলকাতার প্রতিষ্ঠিত বয়ানের ওপরই তিনি নির্ভরশীল ছিলেন। যেমন ‘বাঙালীর গান’ প্রবন্ধের যাবতীয় ভাষ্যই কলকাতার ভাষ্য। এ কারণেই পূর্ব বাংলার গানের ধারা একপ্রকার অনুল্লিখিতই থেকে গেছে। এমনকি লালন বা হাসন পর্যন্ত। অবশ্য সেকালের বাস্তবতা মনে রাখলে একে অস্বাভাবিক মনে হবে না। অবরোহী পন্থার উদাহরণ হিসেবে ‘আনন্দ ও মুসলমান গৃহ’ প্রবন্ধটি পড়া যেতে পারে। পশ্চাৎপদ মুসলমান সমাজের প্রতি সহানুভূতিই যে প্রবন্ধটির উৎস তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ‘আনন্দ’ কথাটি এখানে ব্যবহৃত হয়েছে সার্বিক সংজ্ঞা হিসেবে। ধরে নেওয়া হয়েছে, আনন্দের সর্বজনীন কোনো রূপ আছে এবং বাঙালি মুসলমান তা থেকে বঞ্চিত। এ প্রবন্ধ থেকেই আরেকটি সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়, যা পুরো গ্রন্থেরই বৈশিষ্ট্য। এই যে আনন্দের সার্বিক রূপটি স্থির করা হলো, তাতে প্রান্তের কি কোনো ভূমিকা আছে? প্রান্তস্থ মানুষ যে ধরনের আনন্দ-উদ্যাপন করে, ধরা যাক এ প্রবন্ধের গরিব বাঙালি মুসলমানেরা, তার কোনো উপাদান, কোনো অনুভূতি বা কোনো প্রকাশভঙ্গি কি আনন্দের সংজ্ঞায়নে ব্যবহৃত হয়েছে? লিবারেল ডিসকোর্সে এ ধরনের চর্চা বিরল এবং কাজী মোতাহার হোসেনও তা করেননি। তিনি বহুবার উল্লেখ করেছেন, সমাজে ভেদাভেদ প্রাকৃতিক ব্যাপার এবং এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে উপকারীও। আদর্শ সঞ্চিত হবে উচ্চকোটির ব্যক্তির মধ্যে এবং সঞ্চারিত হবে দশের সীমানায়। খাঁটি উদারনৈতিক পদ্ধতি। খোদ বইটির নাম—সঞ্চরণ—সেই ইচ্ছারই প্রকাশ।
সঞ্চরণ গ্রন্থে সাহিত্যকে যে খুব উঁচু মূল্য দেওয়া হয়েছে, অন্য যে কোনো কিছুর চেয়ে বেশি, তার কারণও কিন্তু একই দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি নিজে, আগেই বলেছি, সাহিত্যিক প্রবন্ধই লিখতে চেয়েছেন। এমনকি বিজ্ঞানের বিষয় নিয়েও। এ গ্রন্থভুক্ত ‘কবি ও বৈজ্ঞানিক’ উৎকৃষ্ট সাহিত্যিক প্রবন্ধ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ‘অসীমের সন্ধানে’ প্রবন্ধে মহাবিশ্বের প্রাঞ্জল পরিচয় আছে। ‘শব্দ ও তাহার ব্যবহার’ প্রবন্ধটি তিনি লিখেছিলেন, তাঁর ভাষায়, ‘উচ্চ-বিজ্ঞানের কথাও যে বাংলা ভাষায় সহজেই লেখা যায়, তা দেখাবার জন্য।’ মনে রাখা দরকার, এগুলো কিন্তু বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা নয়, বরং বাংলা ভাষায় ‘বিজ্ঞান-রস’ পরিবেশন। কাজটা চূড়ান্ত বিচারে সাহিত্যধর্মী। গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞান-লেখক জগদীশ চন্দ্র বসু এবং সত্যেন বসু এই উদ্দেশ্যেই বাংলায় বিজ্ঞানবিষয়ক লেখালেখি করতেন। বাংলাদেশের জনপ্রিয় বিজ্ঞান-লেখক আবদুল্লাহ আল-মূতী লিখেছেন, বাঙালি মুসলমানের মধ্যে এ ব্যাপারে কাজী মোতাহার হোসেন অগ্রদূত। এখানে বলার কথাটা হলো, লেখালেখির এ ধরনটা সাহিত্যধর্মী এবং তার লক্ষ্য জনশিক্ষা। সাহিত্যে উন্নত ও বিকশিত মন প্রকাশিত হয় এবং দশের মধ্যে সঞ্চারিত হওয়ার জন্য অপেক্ষায় থাকে—এই লিবারেল দৃষ্টিভঙ্গি সঞ্চরণ গ্রেন্থর যুগপৎ প্রধান আধার ও আধেয়।
বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক-জ্ঞানতাত্ত্বিক বিকাশ ঠিকমতো এগোলে সঞ্চরণ গ্রন্থটিকে আমরা বহু আগেই ছাড়িয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু তা হয়নি। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা বরং পিছিয়েছি। যেমন বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার আকাঙ্ক্ষা কিংবা লিবারেল ডিসকোর্সে ধর্মের পর্যালোচনার ক্ষেত্রে। এ কারণেই সঞ্চরণ গ্রন্থটি তুলনামূলক বেশি প্রাসঙ্গিক থেকে গেছে। যে সমাজের উন্নতির আকাঙ্ক্ষা বইটিতে মুদ্রিত হয়ে আছে, তার নিরিখে এ বাস্তবতা হতাশার। খোদ লেখকের জন্যও।