কান্নার শব্দ কি অতদূর পৌঁছাবে!

>

.
.

মোনালি—আন্দালিব রাশদী, প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ৯৬ পৃষ্ঠা, দাম ২২০ টাকা।
মোনালির যে স্থবির ছবি আমাদের চোখে ভেসে ওঠে, তা যেমন করুণ, তেমনি হৃদয়স্পর্শী

প্রথম পুরুষে মোনালি উপন্যাসের কাহিনির শুরু এবং শেষও। এর কথক যে মোনালি, সেটা জানা যায় অনেক পরে। সে-ই উপন্যাসটির কেন্দ্রবিন্দু। ঘটনার কাছে সে কখনো যায়, কখনো ঘটনা তার কাছে চলে আসে, কখনো-বা নিজেই ঘটনা হয়ে ওঠে মোনালি। আন্দালিব রাশদী চলমান সময়ের পটভূমিতে এমন কিছু চরিত্রকে বেছে নিয়ে মোনালির কাহিনি দাঁড় করিয়েছেন, এত নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন তাদের স্বভাব-বৈশিষ্ট্য, মনে হয় না শুধু উপন্যাস পড়ছি, সমভাবে মনে হয়, রূঢ় এক বাস্তবের মুখোমুখিও হচ্ছি।

এই উপন্যাসের কোনো চরিত্রই নিপাট সহজ-সরলগোছের নয়, প্রত্যেকের জীবনই আঁকবাঁকে ভরা। যেমন মোনালিদের পরিবারের কথাই ধরা যাক। মোনালির বাবা বি এইচ মাহমুদ আলী যেদিন বিয়ে করতে গিয়েছিলেন, গিয়ে দেখেন কনে পালিয়েছে। ওই একই অনুষ্ঠানে তাঁর বাবা যাকে বিয়ে করে আনেন, তিনিই মোনালির মা। তার মায়ের জীবনও ছিল জট পাকানো। বড় ভাই রুদ্র—চিকিৎসক, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। মোনালির আগের বোনটিও কিছুটা ছন্নছাড়া। আর মোনালি তৃতীয়। এর পরেও একটি বোন আছে তার, মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী-গোছের। আরও বলে রাখি, মোনালির একটা পা কৃত্রিম। এক সড়ক দুর্ঘটনায় পা হারিয়েছিল সে। তারা থাকে বিশাল এক অ্যাপার্টমেন্টের একটা ব্লকে। বাবা ক্যানসারের নামকরা বিশেষজ্ঞ ডাক্তার।

আখ্যানের শুরুটা বেশ কৌতুকপ্রদভাবে। ব্যক্তিগতভাবে আমি আগেও লক্ষ করেছি, আন্দালিব তাঁর উপন্যাসের নারী চরিত্রদের পারতপক্ষে কখনোই মুখরাহীন করে রাখেন না; কিংবা তাদের সেভাবে আঁকেন না। এখানেও ব্যতিক্রম কিছু ঘটেনি। ফলে উপন্যাসের একেবারে শুরুতেই আমরা মা-মেয়ের কথা-কাটাকাটি শুনতে পাই।

আগেই বলা হয়েছে, চিকিৎসক বাবার মেয়ে মোনালি। চিকিৎসার নামে ব্যবসা হোক—মোনালির বাবা বি এইচ মাহমুদ আলী এর ঘোর বিরোধী, সোচ্চারও। ফলে কর্মক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে যায় তাঁর বিরোধী পক্ষ। তাদেরই ষড়যন্ত্রে চাকরি হারাতে হয় তাঁকে। অল্পদিনের মধ্যে টের পাওয়া যায়, তিনি মানসিক ভারসাম্য হারাতে চলেছেন। ক্রমেই শিকার হতে থাকেন স্মৃতিবিভ্রমের। হনও। এমন অবস্থায় একদিন মাহমুদ আলী তাঁদের অ্যাপার্টমেন্টেরই এক মহিলার ফ্ল্যাটের শোবার ঘরে ঢুকে পড়েন, হয়তো নিজের ফ্ল্যাটঘর মনে করেই। মহিলার হাঁকডাকে অতঃপর পুলিশ আসে। তাঁকে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে জেলে যেতে হয় মাহমুদ আলীকে। সেখানেই ধরা পড়ে তিনি স্মৃতিবিভ্রমের শিকার। অনেক চেষ্টার পর অবশ্য জেল থেকে তাঁর মুক্তি মেলে। শুরু হয় স্মৃতিবিভ্রম রোগের চিকিৎসাও। কিন্তু চিকিৎসকেরা মোনালিকে বলে দেন, ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে ওর বাবার অবস্থা। এর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান মোনালির মা। বস্তুত এই সব ঘটনাপ্রবাহের ভেতর দিয়ে দেখা যায় ক্রমশ একা এবং নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছে মোনালি।

কিন্তু ঘটনার শেষ কোথায়? না, একটা পরিণতির দিকে এগোতে থাকে মোনালির জীবন। ওর বাবা জেলে থাকতে অপরাধী যে কিশোর ছেলেটিকে আদর-ভালোবাসা দিয়েছিলেন, জেল থেকে ছাড়া পেয়ে একদিন মোনালিদের বাসায় এসে হাজির হয় সে। কৃতজ্ঞতাবশত ছেলেটি একটা দামি মোবাইল সেট প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও মোনালিকে উপহার দেয়। সেই মোবাইল সেটটি মোনালি আবার দেয় তনু নামে একজনকে। সেই তনু, যাকে সে প্রাইভেট পড়ায়। এই দুই চরিত্রের অন্তরঙ্গতার যে বিবরণ লেখা হয়েছে আখ্যানে, তা অনবদ্য, অনন্য। তো, তনু সেই মোবাইলের ক্যামেরা দিয়ে এমন এক ব্যক্তি ও তার বউ-বাচ্চার ছবি তুলে মোনালিকে দেয়, ছবি দেখে সে নিজের মনেই বলে ওঠে, ‘ফৈয়াজ ভাই, আমি যখন আপনাকে বিয়ে করতে চাচ্ছিলাম তখন তো আপনার বউ-বাচ্চা সবই আছে। আমাকে বললেই পারতেন।’

মোনালির আরও কথা, ‘আমি কান্না থামাতে চাই, নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চাই, কাউকে এতটুকুও বুঝতে দিতে চাই না। আমি এ কালের আধুনিক মানুষ।’

তবে এ কালের ‘আধুনিক মানুষ’ মোনালির বুক-ভাঙা কান্নার আরেকটি উপলক্ষ আসে। বয়সের ব্যবধান সত্ত্বেও যে তনু মোনালির হৃদয়ের গভীরে ঠাঁই নিয়েছিল, সেই তনুর বাবা একদিন আসেন মোনালির কাছে। কথায় কথায় ওকে জানান, ‘গতকাল ডিএইচএল সার্ভিসে তনুর সব কাগজ স্পনসরশিপ টিকিট চলে এসেছে।’ দাঁড়ালেই ভিসা, অর্থাৎ তনু তার আসল মা লুডমিলার কাছে আমেরিকার আটলান্টায় চলে যাবে। সৎ মা তাকে আর দেখতে পারছে না।

এসব শুনে মোনালি বলছে, ‘আমি কান্নার আর একটা সুযোগ পেয়ে গেলাম।...কোথায় আটলান্টা আর কোথায় ঢাকার ড্রিম আর্কেড অ্যাপার্টমেন্ট। আমার কান্নার শব্দ কি আর এতদূর পৌঁছাবে?’

ঔপন্যাসিক আন্দালিব রাশদীর অসামান্য লেখনী শক্তিতে নিঃসঙ্গ মোনালির যে স্থবির ছবি আমাদের চোখে ভেসে ওঠে, তা যেমন করুণ, তেমনি হৃদয়স্পর্শী। তাই উপন্যাস শেষে নামচরিত্র মোনালির উদ্দেশে বলতে ইচ্ছে করে একটিই কথা: মোনালি, তোমার দুচোখে কান্নার কত জল!