ক্রন্দনশীল বাস্তবের জ্বালাময় অশ্রু

হাসান আজিজুল হক
ছবি: নাসির আলী মামুন/ফটোজিয়াম
গল্পভাষার ভেতর কবিতার আর্দ্র সেঁক আর গদ্যের পেশিমত্ততা দেখানোয় তিনি মহত্তমদের একজন। তিনি হাসান আজিজুল হক। গতকাল প্রয়াত হয়েছে বাংলা ভাষার এই মহান লেখক। এ লেখায় রয়েছে তাঁর কথাসাহিত্যের সুলুকসন্ধান।

সব ছেড়ে একজন যখন লেখক, তখন ভাষাই তাঁর অভিজ্ঞতা, ভাষার শুঁড় বাগিয়েই তিনি শ্বাস নেন, প্রশ্বাস ছড়ান ভাষারই আকাশে। হাসান আজিজুল হকের মৃত্যুতে শোক করবে বাংলা ভাষা। অক্ষরের সিথানে সুরমার মতো শোক জমবে। বলবে, ‘অ্যাহন তুমি কাঁদতিছ? অ্যাহন তুমি কাঁদতিছ? অ্যাহন কাঁদতিছ তুমি?’ গল্পভাষার ভেতর কবিতার আর্দ্র সেঁক আর গদ্যের পেশিমত্ততা দেখানোয় তিনি মহত্তমদের একজন।

দক্ষিণ আমেরিকীয় সাহিত্যিক বোর্হেস ভাবতেন, জীবনে কল্পনা থাকা জরুরি। কল্পনা ছাড়া জীবন নিরঙা ও অর্থহীন হয়ে যেত। হাসান আজিজুল হক কল্পনা করবেন কি, স্মৃতির খামচানি খাওয়াই তো শেষ হয়নি তাঁর। তাঁর সাহিত্যে কল্পনা কম, হারানো দেশের স্মৃতি আর নতুন দেশের ক্রন্দনশীল বাস্তবই সেখানে লেখকের মুখপাত্র। আত্মজার কাঁদন কাঁদে সেখানে একটি করবীগাছ, মানুষ কাঁদে পাতালে, হাসপাতালে। সেই কান্নায় নুনের চেয়ে জীবন উগলানো বিষের ভাগই বেশি। জীবন সেখানে বিষাদের জ্বলাভূমি, দুর্ভাগ্যের ঘের। তার এক পাশে অরণ্যঘেঁষা গাঁয়ে মা-মেয়ের সংসারে চলে বিধবাদের কথা, আরেক পাশে দেখা যায় মাইল মাইল নাড়াকাটা মাঠে হঠাৎ জ্বলে ওঠা জীবনঘষা আগুন। আইয়ুব খানের সময়ে সেখানে আবহমান কালের শোষক শকুনের চেহারায় ধরা পড়ে গেছে যুবকদের হাতে। সন্ধ্যার দিকে, খেতের আইলে ফণা তোলা সাদা গোখরার চোখে নিয়তিকে দেখে থতমত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে বাংলার কৃষক। দূরে দূরে মৃদু মফস্বল, যুদ্ধে থেঁতলে যাওয়া জীবন। পরিচয় হারানো আগন্তুকের ‘ফেরা’ হয়, কিন্তু থেকে যায় নামহীন–গোত্রহীন। যুদ্ধে বিজয়ের এক দশক পরও তাঁর গল্পের বিপ্লবী যুবক উরুতে গাঁথা বুলেট নিয়ে অন্ধকার গাছের তলে অপেক্ষা করছে রক্ষীবাহিনীর জন্য।

হাসান আজিজুল হকের বই

ষাট দশকের লেখক হাসান আজিজুল হক। লেখা মানেই বাস্তবতা সৃষ্টি করা তখন। মানিক বন্দোপাধ্যায় কি সতীনাথ ভাদুড়ী, জগদীশ গুপ্ত কি অমিয়ভূষণ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বাদে সবাই যেন নতুন আবিষ্কৃত বাস্তবে মাথা খুঁড়ছেন। জীবনের গহিনে লুকানো গল্পের গুপ্তধন আবিষ্কারে মত্ত তখন বাংলা সাহিত্য। সে রকম সময়েই ‘সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য’ গল্পমালা নিয়ে আবির্ভাব এক দেশান্তরী যুবকের। বইয়ের নামটা রোমান্টিক অথচ গল্পগুলো করুণ ও কঠিন। রাঢ়বঙ্গের রুখা মাটিতে হাঁটা শক্ত পা তিনি ফেলেছেন পূর্ব বাংলার নরম মাটিতে। কিন্তু তখনো রয়ে গেছেন রাঢ়বঙ্গের মতোই মোহহীন বাস্তবের বাসিন্দা। বলা হয়, শৈশবের স্মৃতিই লেখকের আজীবনের সম্পদ, কুবেরের ধনের মতো সেই স্মৃতিচূর্ণ রচনার পর রচনায় চিকচিক করে। রাঢ়ের সেই অকহতব্য বাস্তবের নোঙর হাসান জীবনে আর ছাড়েননি। বয়সে যতই পরিণত হয়েছেন, ততই ফিরে গেছেন অতীতে। তাঁর পরিণত উপন্যাস দুখানি ‘আগুনপাখি’ ও ‘সাবিত্রী উপাখ্যান’ তাঁরই শৈশবের আবহে দেশভাগের আগুনের ভিয়েনে সিদ্ধ করা। ‘সাবিত্রী’ যেমন আর ঘর ফিরে পায়নি, লেখকের মায়ের জবানিতে বলা ‘আগুনপাখিরও দেশ হারানো যাত্রা আছে, পৌঁছানোর শান্তি নেই।

উপন্যাসে জীবনের অর্থকে সময়ের প্রবাহে খোঁজা হয়। গল্পের পরিণতি না–ও থাকতে পারে, গল্প একটা বিন্দুতেই স্থির থেকে সৃষ্টি করে যেতে পারে চরিত্রকে, খুঁড়ে দেখতে পারে ঘটনাকে। কিন্তু উপন্যাসের মনে হয় একটা পরিণতি চাই, একটা রূপান্তর চাই কাহিনির শেষে। হাসানের উপন্যাসে সেই পরিণতি, সেই রূপান্তর দেখা যায় না কেন? কেন ‘আগুনপাখি’র দেশ হারানো সেই মা, দেশান্তরে অনিচ্ছুক সেই নারী ইতিহাসকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে নিজেও সেখান থেকে আর নড়েন না? কাহিনির শুরু ও শেষ যেন সাপের লেজ গিলতে থাকার মতো বৃত্তাকার; নিজেতেই শুরু, নিজেতেই শেষ। ‘সাবিত্রী উপখ্যান’–এর সাবিত্রীও আটকে থাকে স্মৃতির গুমটিঘরে। দেশ হারানোর বেদনার সঙ্গে দেখা হয় না দেশ পাওয়া মানুষের। বাস্তবকে যিনি সাহিত্যের কষ্টিপাথর জ্ঞান করেন, তাঁর কাছে তো প্রশ্ন রাখাই যায়, ‘আগুনপাখি’র হাহাকার তো বাংলাদেশের মানুষের নয়! দেশ বা জমি পাওয়ার ভরসা ও তা ধরে রাখার জেদ ‘আগুনপাখি’তে নেই। উপন্যাসের হাসান আজিজুল হক এ কারণেই বোধ হয় গল্পের হাসানের চেয়ে কম সফল। তবু ‘আগুনপাখি’ দেশভাগের সাহিত্যে প্রায় একমাত্র মুসলিম জননী, যিনি সন্তান ও স্বামীকে দুই দেশে হারিয়ে নিঃস্ব। রাঢ়ের স্মৃতির উদ্‌যাপন, দেশভাগের যন্ত্রণার নির্বাপণ হাসানের সাহিত্যে শেষ হয় না। তিনি যেন বর্তমানে পৌঁছাতে হিমশিম খান। যেন তাঁর ‘ব্যথার পূজা হয়নি সমাপন’। এই স্মৃতিবন্দী থাকার কারণেই কি বাংলাদেশের উপন্যাস তিনি লিখে উঠতে পারেননি? আগুনপাখি ও সাবিত্রীকে নতুন মানবজমিনে রোপণের এই ব্যর্থতাই কি তাঁর উপন্যাসের একিলিস হিল, নাজুক গোড়ালি?

ষাট দশকের লেখক হাসান আজিজুল হক। লেখা মানেই বাস্তবতা সৃষ্টি করা তখন। মানিক বন্দোপাধ্যায় কি সতীনাথ ভাদুড়ী, জগদীশ গুপ্ত কি অমিয়ভূষণ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বাদে সবাই যেন নতুন আবিষ্কৃত বাস্তবে মাথা খুঁড়ছেন। জীবনের গহিনে লুকানো গল্পের গুপ্তধন আবিষ্কারে মত্ত তখন বাংলা সাহিত্য। সে রকম সময়েই ‘সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য’ গল্পমালা নিয়ে আবির্ভাব এক দেশান্তরী যুবকের। বইয়ের নামটা রোমান্টিক অথচ গল্পগুলো করুণ ও কঠিন। রাঢ়বঙ্গের রুখা মাটিতে হাঁটা শক্ত পা তিনি ফেলেছেন পূর্ব বাংলার নরম মাটিতে। কিন্তু তখনো রয়ে গেছেন রাঢ়বঙ্গের মতোই মোহহীন বাস্তবের বাসিন্দা।

শিক্ষকতার সুবাদে দীর্ঘ সময় তিনি দক্ষিণের সুন্দরবন জনপদ (খুলনা-বাগেরহাট-সাতক্ষীরা) আর উত্তরের বরেন্দ্রভূমির জীবন দেখেছেন। এই দুই বিশিষ্ট অঞ্চল তাঁর গল্পে ভূগোল ও জীবন নিয়ে প্রতিষ্ঠিত। হ্যাঁ, রাঢ়ের সুদীর্ঘ ছায়াপাত তাঁর প্রায় সব লেখার ওপর পড়লেও নতুনের গাঢ় সমাচার তাতে ঢাকা পড়তে পারেনি। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের সাহিত্যকে হাসান বলেছিলেন, ‘আঞ্চলিকতার পটে জীবনের বয়ান’। আপন সাহিত্যকর্ম বিচারের একটা নিরিখ তিনি নিজেই এ ধরনের কয়েকটি লেখায় রেখে গেছেন। যেমন তিনি লিখেছেন, ‘মানুষ যে সমাজে জীবন যাপন করে, সেই সমাজের বিন্যাসকে একটি নির্দিষ্ট ভূগোলে আটকে ফেললে জীবনযাপনের চেহারাটা খুব কাছ থেকে দেখা যায়। তার শক্তি, তাপ, স্ফুরণ, বিকাশ, ক্ষয়, আলোছায়া, অন্ধকার, রং, রেখা কিছুই বাদ পড়ে না। মানুষের জীবনযাপনকে অতি স্পষ্ট করে তোলা যায়…আসলে কথাসাহিত্যে জীবনকে সুনির্দিষ্ট করা ছাড়া উপায় কিছু নেই এবং সেদিক থেকে দেখতে গেলে, জীবনের সমান্তরগামী কথাসাহিত্যমাত্রই আঞ্চলিক। (‘প্রবন্ধসমগ্র ২’, পৃষ্ঠা ৮৩, ২০১১)
হাসান আজিজুল হকের কথাসাহিত্য জীবনের সমান্তরগামী ও সুনির্দিষ্ট, ফলত আঞ্চলিক। খটখটে রাঢ়, ঊষর বরেন্দ্র আর নোনা সুন্দরবনীয় জনপদ অবিশ্বাস্য বাস্তবতায় চিরজীবিত হয়ে ওঠে হাসানের হাতে। রাঢ়ের হাসান অতীতমুখী, বাংলাদেশের হাসান নতুন অভিজ্ঞতার শ্বাসরোধকারী ঢেউয়ের সারেং।

তারাশঙ্করের মতো আঞ্চলিক হওয়া সত্ত্বেও হাসান বিশ্বাস করতেন, ‘অন্যপক্ষে এমন অসাধারণ সাহিত্যকর্মও সৃষ্টি হতে পারে, যেখানে জীবনের নির্দিষ্ট আধারটিকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে, অদৃশ্য করে ফেলা হয়েছে তার ভূগোল, মুছে দেওয়া হয়েছে মাটি ও আকাশের বর্ণ, আলোছায়ার স্তরগুলি, প্রকৃতির দৃশ্যমান সমস্ত রেখা, জীবনকে করে তোলা হয়েছে বিমূর্ত, শুধু জীবনের মূল, গভীর অতল স্বরূপকে বিচার করে দেখার জন্য।’ হ্যাঁ, এই কাজই করেছেন তিনি মুক্তিযুদ্ধের পটে লেখা ‘নামহীন গোত্রহীন’ বইয়ের গল্পগুলোয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের এই গল্পের নায়ক কখনো যেন কাফকা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে মৃত্যুশাসিত নগরের অলি-গলির অন্ধকারে। পরাবাস্তব সেই জগৎ যেন অমানবিকতা থেকে পালানো মানবের চিরায়ত যাত্রা। যুদ্ধকালীন যেকোনো সময়ের, যেকোনো দেশের সর্বজনীন হাহাকার এভাবে রচিত হয় ভূগোল ও সময় মুছে ফেলার পারদর্শিতায়, ‘শুধু জীবনের মূল, গভীর অতল স্বরূপকে বিচার করে দেখার জন্য’!
মানিকের মতো বাস্তবদীর্ণ হয়েও প্রকৃতি তাঁর সাহিত্যে বিভূতিভূষণের মতো বাঙ্ময়। ‘অল্প বাতাসে একটা বড় কলার পাতা একবার বুক দেখায়, একবার পিঠ দেখায়’।

হাসান আজিজুল হক
ছবি: অন্য আলো

আমৃত্যু আজীবন গল্পে বৃষ্টিলাঞ্ছিত গ্রামীণ প্রকৃতি আদিম নির্জনতাকে ফুটিয়ে তোলে। ‘বাঘ, ফুলি ও শেয়াল’ গল্পে এক কিশোরীর দেহে যৌবনের প্রথম অঙ্কুর যেন সুন্দরবনের শ্বাসমূলীয় বৃক্ষের নির্জ্ঞান শেকড়ের মতো আধা জাগরুক, আধা ডুবন্ত।

ফুলি ও বাঘের প্রেম আমাদের নিয়ে যায় বাস্তবতা ডিঙানো রোমহর্ষের দিকে। প্রথম জীবনের সারা দুপুর গল্পের কিশোরের বিষণ্নতাকে সঙ্গ দেয় প্রথম ঋতুকালীন রোমাঞ্চ ও ভয়ে থরথর নোনাজলের মেয়ে ফুলি। ‘মা-মেয়ের সংসারে’ গণধর্ষণে বিধ্বস্ত ও অন্তঃসত্ত্বা দুটি নারী থাকে সুন্দরবনের কোলের এক চালাঘরে। এক রাতে ‘একটির পর একটি স্তম্ভ, যেদিকে চোখ যায়, রক্তাক্ত জলস্তম্ভ। সমুদ্র ফুলে ওঠে, হরিণঘাটার মোহনা মাথা-শিং ঝাঁকি দিয়ে বুক ফুলিয়ে দাঁড়ায়।’ তাদের দুটি সদ্যোজাত শিশু নিয়ে সিডরসমান ঘূর্ণিঝড়ের পর তারা দেখে, ‘হাজারে হাজারে তারা আসে, ইলিশের ঝাঁকের মতো, মা-মেয়ের থেকে অনেক তফাৎ দিয়ে তারা চলে যায়, অনেকটা নেচে নেচে মঞ্চ থেকে বিদায় নেওয়ার ভঙ্গিতে। গাছের গুঁড়ির সঙ্গে, পৃথিবীর পাথরের সঙ্গে, মোটা মোটা ডালে থুতনি আটকে কখনো একটু থামে তারা। তারপর ঝাঁক থেকে আলাদা হয়ে যায় এক লাশ, একটু আসছি বলে, ডুবতে ডুবতে, ভাসতে ভাসতে, পাক খেতে খেতে সে এগিয়ে আসছে মা-মেয়ের কুঁড়ের চালের দিকে। কাছাকাছি এসে লম্বা একটা ডুবসাঁতার দিয়ে সে কুঁড়েঘরের চালাটির একটি প্রান্ত স্পর্শ করে থামে। মা–মেয়ের এক রাতের কথা মনে পড়ে। উদোম, ছোরা ওঁচানো, হিংস্র ডোরাকাটার মতো এক পশু। একটা মুহূর্ত শুধুÑ লাশ আবার বলেশ্বরের পথ ধরে নিচে নেমে যায়।

বঙ্গোপসাগরের হাঙরেরা অপেক্ষায় থাকে। মা-মেয়ে নিশিন্ত মনে ঘুমায়। দানোর বাচ্চাটি চিল চেঁচিয়ে সারা হয়।’

যখন বাস্তব স্বপ্নহীন, যেই স্বপ্ন তিনি ‘আমরা অপেক্ষা করছি’তেও জিইয়ে রেখেছিলেন, ‘মা-মেয়ের সংসারে’ এসে অসহ্য অবিচারের ক্রোধ নিয়ে তিনি পৌরাণিক প্রতিশোধে আস্থা রাখেন। ঘূর্ণিঝড়ে ধর্ষক দানো মৃত, তার জন্য অপেক্ষা করছে বঙ্গোপসাগরের হাঙরেরা, কিন্তু দানোর বাচ্চাটি চিৎকার করে জানিয়ে যায়, তবুও জীবন থাকবে। বাঘ ও ফুলির গল্পে সুন্দরবনে কাঁকড়া-শামুক কুড়াতে যাওয়া কিশোরী জঙ্গলের পাতার ফাঁক দিয়ে চেয়ে থাকা বাঘের চোখে চোখ রাখতে রাখতে প্রথম প্রেমের পুলকে নারী হয়ে ওঠে। ফেরার পথে তাকে নৌকা থেকে নামিয়ে দুই যুবক যখন ধর্ষণোদ্যত, তখন সেই প্রেমিক বাঘ ঝাঁপিয়ে পড়ে মুণ্ডু আলাদা করে দেয় ধর্ষকের। চলের যাওয়ার সময় বিহ্বল ফুলির উরুতে আলতো করে নখের আদর রেখে যায়। নিরাবেগি হাসান এভাবে আবেগ মোছার দাগ রেখে যান বর্ণনার ভেতর।

বাস্তব থেকে কল্পনায়, খটখটে অভিজ্ঞতা থেকে জাদুবাস্তবতার রহস্যে হাসানের এই মেরাজ মনে করিয়ে দেয়, বনের ভেতর দুদিকে চলে যাওয়া রাস্তার অন্যটিকে। বাস্তবে আস্থা হারিয়ে, পরিবর্তনে হতাশ হয়ে তিনি শোধ নিয়েছেন কল্পনায়।

গল্পকে তিনি ঘনিয়ে তোলেন পরিবেশের বর্ণনায়, সংকটকে তিনি ফলিয়ে তোলেন অবিস্মরণীয় সব সংলাপে। সেই সংলাপ সবচেয়ে মোক্ষমভাবে উচ্চারিত হয় গ্রামীণ নিম্নবর্গের কণ্ঠে। হাসানের মধ্যবিত্ত নিষ্প্রাণ ও মেরুদণ্ডহীন। ‘আমরা অপেক্ষা করছি’তে সবল মধ্যবিত্তীয় চরিত্র দেখা গেলেও ‘পাতালে-হাসপাতাল’ বই থেকে তিনি দেখানো শুরু করেন তাদের ভীরুতা ও কাপুরুষতা। এ ব্যাপারে তিনি এতটা নির্দয় না হলেও পারতেন, হুমায়ূন আহমেদের গল্প-উপন্যাসের তুলনায় এ কথা বলা বোধহয় অন্যায় হবে না। জাতীয় সাহিত্য বলে যদি কিছু থেকে থাকে, তবে তার মধ্যে সমিল কিছু থিম বা প্লট দেখা যায়, দেখা যায় কাছাকাছি কিছু চরিত্র। ‘হাঁসুলী বাঁকের ইতিকথা’, ‘ঢোঁড়াই চরিতমানস’, ‘গড়শ্রীখণ্ড’, ‘কুরপালা’ প্রভৃতি উপন্যাসে ৫০-৬০ দশকের শক্তিমান লেখকেরা গ্রামসমাজের ভাঙন, জাতীয়বাদের উত্থান, গোত্রপিতা-প্রবাদপুরুষের পতনের বিপরীতে নতুন নায়কের উত্থানকে যাঁর যাঁর মতো করে বর্ণনা করেছেন। তেমনি বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত ও কৃষক মিলিয়ে যে জাতীয় জীবন, তা থেকে কাছাকাছি চরিত্র তৈরি করেছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক ও হুমায়ূন আহমেদ। কিন্তু লেখকের সমাজদৃষ্টির গুণে বা দোষে তাঁরা রওনা হয়েছে আলাদা আলাদা অভিমুখে। তবে তাঁদের মধ্যে সংলাপের রাজা বলা যায় হাসান আজিজুল হককে। একটা উদাহরণই আপাতত যথেষ্ট হোক:
‘বাঘে নিলি নেবে, তুই অমন করিস কেন মা?

আমার তুই আছিস, তুই মরলি আমি আছি।
আর আমরা দুজনে মরলি আমাদের কেউ নেই।’

(মা-মেয়ের সংসার)
বাস্তবতা থেকে জাদুবাস্তবতায় গমনাগমন ছাড়াও আরেকটা রূপান্তর বোধ হয় তাঁর ভেতরে ঘটছিল। প্রথম জীবনের মার্কসবাদী হাসান, বামপন্থী লেখক সংগঠন ‘বাঙলাদেশ লেখক শিবির’–এর সভাপতি হাসান ক্রমেই জাতীয়বাদী হয়ে উঠছিলেন। রাজনৈতিক বক্তব্য বা দলীয় সভাসঙ্গ করা থেকে নয়, এর ভাবান্তর দেখা যাবে তাঁর কিছু গল্পে। ‘বিধবাদের কথা’ই ধরা যাক। উপন্যাসোপম এই গল্পে থাকে দুই বিধবা ও সন্তানহারা মায়ের গল্প। তারা দুই বোন, একজন সাদা, আরেকজন কালো বর্ণের।

দুজনেরই বিয়ে হয় দুই সাদা-কালো ভাইয়ের সঙ্গে। ইমামের ভুলে সাদার সঙ্গে কালো আর কালোর সঙ্গে সাদা ভাইয়ের বিয়ে হয়ে গেলে আর কিছু করার থাকে না। তাদের ঘরে জন্মায় দুটি সন্তান, সাদা সাহেবালি আর কালো রাহেলিল্লাহ। সাহেবালি স্কুলে যায়, রাহেলিল্লাহ যায় মক্তবে। সাহেবালি পদ্মফুল আনে, রাহেলিল্লাহ কাঁধে নিয়ে ঘোরে মরা শেয়ালের ছানা। সাহেবালি মুক্তিযোদ্ধা হয়, রাহেলিল্লাহ হয় রাজাকার। যুদ্ধে দুজনেই মারা যায়, মারা যায় দুজনের বাবাও। থাকে শুধু দুই সন্তানহারা বিধবা বোন। তারা দিনমান একটা কাঁথার দুদিক থেকে নকশি বুনতে থাকে। একজন সুতায় বোনে যা কিছু সুন্দর, আরেকজনের ফুল, লাতা–পাতা কেমন অপুষ্ট, বাঁকাচোরা, বিকট-উদ্ভট মানুষজন। তাদের সেলাই করা নকশা দুপ্রান্ত থেকে এগোতে থেকেও মিলতে পারে না।

মাঝখানে এক বোন এঁকে রাখে বিরাট এক শেকল। ওই শেকল দিয়ে দুই জীবন দুই দর্শন আলাদা করা থাকে। সন্ধ্যায় নকশা আঁকা শেষ হয়ে গেলে দুই বোন কাঁথাটা আলগোছে ভাঁজ করে কালো সিন্দুকের ডালা খুলে একেবারে তলায় রেখে দেয়।

গল্পটা এভাবে আবার ফিরে যায় আরম্ভের বিভক্ত দুনিয়ায়। এই গল্প শেষ হয় না। দুটি বিধবা এক ঘরে থেকেও যার যার কাঁথার নকশায় দুটি ভিন্ন পৃথিবী এঁকে চলেছেন। হাসানের একটি উপন্যাসের নাম ছিল ‘বৃত্তায়ন’। তিনিও যেন জাতীয়তাবাদী বিরোধের বৃত্ত এঁকে রেখে দিয়েছেন তাঁর মনের কালো সিন্দুকের একেবারে তলায়। হাসানের শৈল্পিক সর্বদ্রষ্টা মনের গহিনে যে বিভক্ত পৃথিবীর দুটি অর্ধবৃত্ত, নকশিকাঁথার দুটি বিপরীতচিত্র, তা জড়াজড়ি করে আছে বটে, দুটি অর্ধবৃত্ত মিলে বৃত্তায়ন সম্পূর্ণ হয় বটে, কিন্তু দেশভাগের যন্ত্রণার মতো, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির মতো, সমাজবাস্তবের মেরুকরণের মতো তারা দ্বন্দ্বরতই আছে। হাসানের সাহিত্য রাঢ় ও অ-রাঢ়ে বিভক্ত হয়েও এক; অথচ এক বাংলাদেশে সেই সাহিত্য চালিয়ে যাচ্ছে ভাগের সংসার।