কয়েক রকম বাংলাবাজার

>
বইয়ের গন্ধে এখন যেন ম-ম করছে বাংলাবাজার। ছবি: খালেদ সরকার
বইয়ের গন্ধে এখন যেন ম-ম করছে বাংলাবাজার। ছবি: খালেদ সরকার
কদিন বাদেই বইমেলা। বই-বই গন্ধ বাংলাবাজারে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বই-বাজারের লোকজনের সময় এখন কাটছে তুমুল ব্যস্ততায়। কেমন ছিল এই বইয়ের মুলুকের পুরোনো দিনগুলো?

অনেক দিন পর বাংলাবাজার গিয়েছি। তাও বেশ কয়েক বছর আগে। ইচ্ছে হলো, দেখি ফুটপাতে বইয়ের দোকানগুলো আগের মতো আছে কি না। কলেজিয়েট স্কুলের উল্টোদিককার ফুটপাতে দেখি কিছু দোকান আছে। তবে আগের মতো গল্প-উপন্যাসের কালেকশন নেই। বেশির ভাগই পাঠ্যবই। আগে পাঠ্যবইয়ের তুলনায় গল্প-উপন্যাস-কবিতা-প্রবন্ধ-বিজ্ঞান-ইতিহাস-জীবনী ইত্যাদিই বেশি থাকত। এখন উল্টো হয়ে গেছে। মস্কো থেকে আসা প্রগতি প্রকাশনীর কী অসামান্য সব বই এই ফুটপাতে পড়ে থাকত, কলকাতার বিখ্যাত লেখকদের বই থাকত। সেই সব মহৎ পুরোনো বইয়ের গন্ধে অন্য রকম হয়ে থাকত এখানকার হাওয়া, সেই অবস্থাটা নেই। তবু দোকানগুলো দেখে ভালো লাগল। কত স্মৃতি এই ফুটপাতে আমার। বই দেখছি, দোকানিদের দেখছি। বইয়ের মতো দোকানিরাও বদলে গেছেন। কাউকেই চিনতে পারি না। একজন বৃদ্ধ মানুষ বসে আছেন দেয়ালে হেলান দিয়ে। চুল-দাড়ি সবই সাদা। চোখে নড়বড়ে ফ্রেমের মোটা কাচের চশমা। শরীরে ভাঙন ধরেছে। বসার ভঙ্গি দেখে চিনতে পারলাম। সেই বাহাত্তর-তিয়াত্তর সাল থেকে এভাবেই তাঁকে বসে থাকতে দেখেছি। সামনে ছড়ানো-ছিটানো কত মূল্যবান বই। তিনি উদাস হয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছেন। মুখে পান। বইপ্রেমীরা বই কিনছেন। দামদস্তর নিয়ে তিনি তেমন বাড়াবাড়ি করতেন না। চার আনা-আট আনা লাভ পেলেই বই ছেড়ে দিতেন।

আমার মিনু খালার খুব বই পড়ার অভ্যাস। প্রায়ই দু-চার-পাঁচ টাকা দিয়ে আমাকে বাংলাবাজারে পাঠাতেন। এই ভদ্রলোকের তখন মধ্যবয়স। মোটা মোটা উপন্যাস বেশি বিক্রি করতেন। সস্তায় মিনু খালার জন্য আমি নীহাররঞ্জন-ফাল্গুনীর বই কিনতাম, আশুতোষ যাযাবরের বই কিনতাম। ভদ্রলোক উদাস হয়ে থাকতেন আর সেই ফাঁকে একটা-দুটো বই কোমরের কাছে গুঁজে ফেলতাম। সেগুলো একটু রোগা ধরনের বই। সমরেশ বসুর বিবর ওইভাবে সরিয়েছিলাম।
এত দিন পর সেই মানুষটাকে দেখে খুব ভালো লাগল। দু-এক কথার পরই তিনি আমাকে চিনতে পারলেন। ফোকলা মুখে হাসি ফুটল। কী কও মিয়া, তোমারে চিনুম না? কত বই আমার এখান থিকা মারছ! দুইটা কিনলে একটা মাইরা দিতা।
আমি অবাক। আরে, কোনো দিন তো কিছু বলতেন না!
কী বলুম? ছাত্র মানুষ। বই পড়ার শখ। পয়সা পাইবা কই? বই দুই-চাইরটা ছাত্ররা মারবই। তোমার কারবারটা আমি দেখতাম। কিছু কইতাম না। ভালো আছো, বাবা?
আমার চোখে পানি এসে গিয়েছিল। ফুটপাতে বসে থাকা মানুষটিকে হিমালয়ের মতো মনে হয়েছিল।
আমরা থাকতাম জিন্দাবাহার থার্ড লেনে। ষাট-একষট্টি সালের কথা। আমার মায়ের মামাবাড়ি গেন্ডারিয়ায়। মা, বাবা, ভাইবোনদের সঙ্গে গাদাগাদি করে রিকশা কিংবা ঘোড়ার গাড়িতে গেন্ডারিয়া যাচ্ছি। সদরঘাটের উত্তরদিককার মুখ থেকে পুব দিকে ঢুকে গেল রাস্তা। রাস্তার মুখে একটা বটগাছ, ব্যাপ্টিস্ট মিশন, পোস্ট অফিস আর কিছু বইয়ের দোকান। বাংলাবাজার। কী বিস্ময় নিয়ে বইয়ের দোকানগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকেছি!
আমি থাকি বিক্রমপুরে, নানির কাছে। স্কুল ছুটিতে ঢাকায় এসেছিলাম। একা একা ফিরে যাচ্ছি। ক্লাস ফোরের ছাত্র। আব্বা আমাকে লঞ্চে চড়িয়ে দিতে এসেছেন। লঞ্চে এতটা সময় কী করে কাটবে? বাংলাবাজারের ফুটপাত থেকে চার আনা না ছয় আনা দিয়ে আব্বা আমাকে একটা বই কিনে দিলেন—সিন্দাবাদের সাত অভিযান। জীবনের প্রথম গল্পের বই। লঞ্চের পুরো সময়টা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে থাকলাম সেই বইয়ে।
তারপর শুরু হয়েছিল গেন্ডারিয়ার জীবন। লোহারপুল পার হয়ে শ্যামবাজারের ওদিক দিয়ে সদরঘাটে আসতাম। শ্যামবাজারের উল্টো দিকে জমিদারবাড়ির মতো এক বাড়িতে সাইনবোর্ড ঝুলছে, ‘পুঁথিঘর’। আমাদের ব্যাকরণ ও রচনা বইয়ে লেখা থাকত, ‘পুঁথিঘর, চৌমোহনী, নোয়াখালী। আরে, সেই ‘পুঁথিঘর’ দেখছি এইখানে!
মিন্তির মাথায় চাঙারিভর্তি বই যাচ্ছে-আসছে, ঠেলাগাড়িতে করে বই যাচ্ছে, বই আসছে। এত বই কোথায় তৈরি হয়, কোথায় যায়!
জিন্দাবাহারের ওদিকে অনেক প্রেস ছিল। কিছু বড় বড় বইয়ের দোকান ছিল। চকবাজারেও ছিল বেশ বড় একটা বইয়ের বাজার। বেশির ভাগই ধর্মীয় বইয়ের দোকান, পাঠ্যবইয়ের দোকান। গল্প-উপন্যাস-কবিতা-ইতিহাস-প্রবন্ধ—এসবের দোকান ছিল বাংলাবাজারে। পাঠ্যবই ও ধর্মীয় বই তো ছিলই। অর্থাৎ বাংলাবাজারে পাওয়া যেত সব ধরনের বই। প্রেসও ছিল অনেক। শ্রীশদাস লেন, প্যারিদাস রোড, ওদিকে পাটুয়াটুলির গলির ভেতর দিনরাত ঘটাং ঘটাং করে চলছে ট্রেডেল মেশিন, ফ্ল্যাট মেশিন।
এসব ছাড়িয়ে বইয়ের সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে গড়ে উঠল বাংলাবাজারে। স্বাধীনতার আগে, আমার মনে পড়ে কয়েকটি প্রকাশন সংস্থার কথা। আহমেদ পাবলিশিং হাউস, বইঘর, চলন্তিকা, নওরোজ কিতাবিস্তান, মল্লিক ব্রাদার্স, খোশরোজ কিতাব মহল, স্টুডেন্ট ওয়েজ, মাওলা ব্রাদার্স, খান ব্রাদার্স, বুক সোসাইটি...ওদিক দিয়ে যাওয়া-আসার পথে এসব দোকান চোখে পড়ত। রেকভর্তি বই, আলমারিভর্তি বই। মালিক-ম্যানেজার বসে আছেন। দোকানের কর্মচারীরা ব্যস্ত হাতে রেক থেকে বই নামাচ্ছেন, তুলছেন। কেটলিতে করে চা নিয়ে এল অল্প বয়সী একটা ছেলে। মালিক-ম্যানেজারের টেবিলের সামনে বসে আছেন দু-একজন। হয়তো তাঁরা কেউ লেখক। চায়ের সঙ্গে তুমুল হাসিগল্প চলছে।
এ রকম দৃশ্য দেখতে দেখতে আমি বড় হচ্ছিলাম। বাংলাবাজারের সঙ্গে জড়িয়ে গেলাম স্বাধীনতার পর। জগন্নাথ কলেজে পড়ি। তিয়াত্তর সাল। প্রথম গল্প ছাপা হয়েছে। দিনরাত পাগলের মতো যা মনে আসে লিখি। বিভিন্ন পত্রিকা অফিসে গিয়ে লেখা দিয়ে আসি। বেশির ভাগই ছাপা হয় না।
বাংলাবাজারে একটা পত্রিকা অফিস ছিল। জোনাকী। মাসিক পত্রিকা। ডাবল ক্রাউন সাইজ। জোনাকীর মালিক-সম্পাদক ছিলেন আবদুল মতিন নামের বিনয়ী একজন মানুষ। তাঁর বইয়ের ব্যবসাও ছিল। বোধ হয় স্কুলের দ্রুত পঠন ধরনের বই ছাপতেন। ৩৮ নম্বর বাংলাবাজারে অফিস। রাস্তা থেকে বেশ ভেতরের দিকে। জোনাকীর অফিসটা আসলে বেশ বড় সাইজের একটা বইয়ের দোকান। সামনের দিকটায় বইপত্রের রেক, ভেতরের দিকটায় পত্রিকার অফিস। উল্টো দিকে মতিন সাহেবের প্রেস। বিশাল মেশিনে বই ছাপা হচ্ছে, পত্রিকা ছাপা হচ্ছে।
জোনাকীর দায়িত্বে ছিলেন আহসান হাবিব নামের এক ভদ্রলোক। তাঁর ছদ্মনাম আহমেদ আনবির। ঢাকা ইউনিভার্সিটির তরুণ শিক্ষক। দেখতে ফুটফুটে সুন্দর, স্মার্ট। থ্রিলার আর ছোটদের জন্য নানা রকমের লেখা লিখতেন। অনুবাদও করতেন। বেশ স্পিডে মোটরসাইকেল চালাতেন। পরে রোকেয়া হলের সামনে মোটরসাইকেল অ্যাকসিডেন্টে মারা যান। সেসব অনেক পরের কথা।
জোনাকীতে লেখা দিতে গিয়ে পরিচয় হয়েছিল বুলবুল চৌধুরীর সঙ্গে। বুলবুল তখন উঠতি তরুণ গল্পকার। তিনিও গিয়েছিলেন লেখা দিতে। এ পত্রিকার দায়িত্বে থাকা আহসান হাবিব আমাকে একদমই পাত্তা দেননি। ঢাকা ইউনিভার্সিটির লেকচারার, একটা পত্রিকার দায়িত্বে তার ওপর ‘মুক্তধারা’ থেকে বই বেরিয়েছে। আমাকে পাত্তা দেবেন কেন?
‘মুক্তধারা’ যাত্রা শুরু করেছিল কলকাতা থেকে। মুক্তিযুদ্ধের সময়। স্বত্বাধিকারী চিত্তরঞ্জন সাহা, পুঁথিঘরের মালিক। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পুঁথিঘরের ব্যাকরণ রচনা-নোটবই ইত্যাদি তো আগের মতো চলছিলই, চিত্তদা বিশালভাবে শুরু করলেন মননশীল বইয়ের প্রকাশনা। একই বাড়িতে ‘পুঁথিঘর’ ও ‘মুক্তধারা’র অফিস। দেশের প্রায় সব লেখকের বই দেদারসে বেরোতে লাগল। কী সুন্দর প্রচ্ছদ, কী সুন্দর ছাপা বাঁধাই। কী যত্নে বেরোচ্ছে একেকটা বই। শ্যামবাজারের ওদিক দিয়ে বাংলাবাজার যাওয়ার সময় তাকিয়ে তাকিয়ে ‘মুক্তধারা’র সাইনবোর্ড দেখি। কোনো কোনো লেখককে তত দিনে চিনতে শুরু করেছি। তাঁদের আসা-যাওয়া দেখি। অনেক পরে চিত্তদার সঙ্গে পরিচয় হলো। আমার প্রথম উপন্যাস যাবজ্জীবন বেরোল ‘মুক্তধারা’ থেকে। প্রথম কিশোর উপন্যাস চিতা রহস্য বেরোল।
’৭৯ সালে জার্মানিতে যাওয়ার আগে যাবজ্জীবন দিয়েছিলাম চিত্তদার হাতে। তাঁর সম্পাদনা পরিষদ ছিল। পরিষদ প্রধান আবদুল হাফিজ, প্রাবন্ধিক। আমার উপন্যাস নির্বাচিত হলো। খুব শখ প্রথম উপন্যাসের প্রচ্ছদ করবেন কাইয়ুম চৌধুরী। চিত্তদা রাজি হলেন। দুই বছর পর জার্মানি থেকে ফিরে দেখি বই বেরোয়নি। কী কারণ? কাইয়ুম ভাই কাভার এঁকে দেননি। আমি কাইয়ুম ভাইয়ের কাছে দৌড়াদৌড়ি করে আরও বছরখানেক পর কাভার পেয়েছিলাম।
তার আগে ’৭৭ সালে আমার প্রথম গল্পের বই ভালোবাসার গল্প বেরিয়ে গেছে। ‘বুক সোসাইটি’ থেকে। জার্মানিতে থাকা অবস্থায় ওখান থেকেই বেরিয়েছে দ্বিতীয় গল্পের বই নিরন্নের কাল।
তখন পশ্চিমবঙ্গের বইয়ের খুবই রমরমা অবস্থা। বাংলাবাজারের কোনো কোনো প্রকাশক নিউজপ্রিন্টে অবিরাম ছেপে যাচ্ছেন নীহাররঞ্জন, ফাল্গুনী, আশুতোষ, নিমাই ভট্টাচার্যের বই। সমরেশ বসুরও কোনো কোনো বই ছাপা হচ্ছে। কোনো কোনো বইয়ের দোকান ও ফুটপাতভর্তি ওসব লেখকের বই। বাংলাদেশি লেখকদের বই ছাপছে মুক্তধারা, নওরোজ কিতাবিস্তান, স্টুডেন্ট ওয়েজ, মাওলা ব্রাদার্স বা খান ব্রাদার্স। বুক সোসাইটি তো ছাপছেই। তবে বিক্রিবাট্টা সুবিধার না।
বাংলাবাজার বদলাতে লাগল আশি-একাশি সালের দিকে।