ব্যাংকের ডেস্কে বসে কাজ করছি। জিয়া হোসেন সাহেব এসেছেন। সালাম দিয়ে সামনে রক্ষিত চেয়ারে বসলেন। আমাদের একজন বড়সড় ক্লায়েন্ট। সবাই খাতির–যত্ন করে। সেই হিসেবে আমি একটু বেশিই করি। যেদিনই আসেন, শুধু বায়না ধরেন, ‘ভাই আপনি থাকেন ইন্দিরা রোডে, আমি থাকি গ্রিন রোডে, এত কম দূরত্ব! বাসায় এসে তো এক কাপ চা খেতে পারেন। আসেন একদিন।’
আমি বললাম, ‘যাব ভাই, দেখবেন একদিন হুট করে হাজির হয়ে গেছি।’
তিনি যখনই ব্যাংকে আসেন, তখনই একই আবদার ধরেন, ‘কই গেলেন না তো!’
আমি বলি, ‘ভাই, সময় মেলাতে পারছি না। সপ্তাহে এক দিন ছুটি পাই। কাজ করতে করতে সময় ফুরিয়ে যায়। দেখি, আগামী সপ্তাহে অবশ্যই যাব। বাড়ির নম্বর যেন কত?’
বাড়ির নম্বর দিয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে, আজ উঠি।’
আমি বললাম, ‘জি ভাই, আবার দেখা হবে।’
ডিসেম্বরের সকাল। রোদটা দারুণ মিষ্টি লাগছে! আমি গেলাম গল্পকার সাকি মোহাম্মদের হাতিরপুলের বাসায়। একটা লেখার ফাইনাল প্রুফ দেখে দিলেন তিনি।
হাতিরপুল থেকে ঢিমেতালে হাঁটতে হাঁটতে বাসার দিকে রওনা হলাম। গ্রিন রোডের চৌরাস্তায় এসে দেখলাম, একটি বাড়ির নাম ‘খুশবু মহল’। রোড নম্বরটা আমার মানিব্যাগে রাখা একটি চিরকুটে লেখা আছে। মিলিয়ে দেখলাম, জিয়া সাহেবের বাড়ি এটাই। এখন হাতে সময় আছে। দেখি, শুধু এক কাপ চা কেন! নাশতা-পানি দিলে সেটাও খাওয়া যাবে। সকাল নয়টার মতো বাজে। এখন নাশতা খাওয়ারই সময়। বাড়ির বহিরাঙ্গের কাঠামো দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। বিশাল জায়গা নিয়ে আধুনিক স্থাপত্যশৈলীতে বাড়ি বানিয়েছেন জিয়া সাহেব। বাড়ির মেইন গেট থেকে ভেতরের দরজায় পৌঁছানোর আগে লম্বা একটি রাস্তা। বেশ রাজকীয় আবহ। মেইন গেটের একটু দূরে বেরসিক মিউনিসিপ্যালিটির একটি ময়লার ডিপো। এটা এখানে কেন? বাড়ির মালিক চাইলেই তো সিটি করপোরেশন এটা সরিয়ে ফেলতে পারে। তবে কোনো এক বিচিত্র কারণে এটা সরানো হচ্ছে না। ওটা ওদের ব্যাপার। তবে কী অদ্ভুত কাণ্ড! বাড়ির নামের দিকে তাকানোর পর নাকে আর ময়লার গন্ধ আসছে না। খুশবু মহল থেকে সুগন্ধ বের হচ্ছে। ঘ্রাণেন্দ্রিয়তে ময়লা এবং বাড়ির নাম—এই দুটোর প্রতিযোগিতায় ময়লার হার হয়েছে। জয়ী হয়েছে বাড়ির নামটি। যার দরুণ ময়লার গন্ধ নয়, নাকে লাগছে সুগন্ধ। বাড়ির গেটে দুজন দারোয়ান। আমি বললাম, জিয়া হোসেন সাহেব কি বাড়িতে আছেন?
দারোয়ান বললেন, ‘আপনি কি অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে এসেছেন?’
আমি বললাম, ‘না, এ পথ দিয়ে যাচ্ছি তো, ভাবলাম ওনার সঙ্গে একটু দেখা করি।’
দারোয়ান আমতা–আমতা করে বললেন, ‘তাহলে আপনি একটু অপেক্ষা করুন। আমি ইন্টারকমে জিজ্ঞেস না করে সরাসরি যাব। সকালবেলা তো, ঘুম থেকে উঠেছেন, না ওঠেননি ঠিক নেই। টেলিফোনের আওয়াজে ঘুম ভাঙলে আমার আর রক্ষে নেই। বড়লোক মানুষের মতিগতির ঠিক থাকে না। আমি ভেতর থেকে আসছি। আপনি একটু দাঁড়ান।’
আমি দাঁড়ালাম। দারোয়ানটা খানিক বয়স্ক। দাড়িতে তাকে বেশ লাগছে। মনে মনে আমি ভাবছি, সকালবেলায় যখন এসেছি, জিয়া সাহেব চা তো এক কাপ খাওয়াবেনই। তার ওপর বাড়ির যে শানশওকত, নাশতার মেনুও বেশ সমৃদ্ধ হবে। ভাবতে ভাবতে আমার জিবে জল এসে গেল। সকালে হাঁটাহাঁটি করাতে ক্ষুধা লেগেছে বেশ। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলাম আমি।
একটু পর ভেতর থেকে নামলেন বুড়ো দারোয়ান, তার মুখের অভিব্যক্তিটা এবার কেমন যেন, মুখটা একটু গম্ভীর। এসে গেট খুলে গেটের বাইরে এলেন তিনি। আরও একজন দারোয়ান আছেন। ওই দারোয়ান যেন আমাদের কথোপকথন না শোনেন, এতটুকু দূরত্বে এসে আমাকে বললেন, ‘চাচাজি, আপনার কথা শুনে বেশ ভালো লাগছিল। তাই আসল কথাটি বলার জন্য একটু দূরে সরে এলাম।’
আমি বললাম, ভাইসাহেব কি বাড়িতে আছেন?
আমতা–আমতা করে দারোয়ান বললেন, ‘কীভাবে যে বলি! তবে আপনাকে আমি বলতেও চাই...’
কী? কোনো সমস্যা? আপনি সরাসরি বলতে পারেন। কোনো অসুবিধা নেই বলুন, উনি কী বলেছেন, যেতে বলেননি?
দারোয়ান এই প্রথম মুখে একটু তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটিয়ে তুললেন। তারপর বললেন, ‘চাচাজি, তিনি বাড়িতে আছেন। আমাকে বলেছেন, উনি বাড়ি নেই—এটি বলতে।’
আমার কার্ড দেখাননি?
অবশ্যই দেখিয়েছি। কার্ডের ওপর চোখ রেখে বললেন, তুমি বোলো আমি বাড়ি নেই।
আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম, যে লোক ব্যাংকে গেলেই বাড়ি আসতে বলেন, এখন এই আচরণ করলেন কেন! মনটা একেবারেই খারাপ হয়ে গেল। মানুষগুলো এমন হয় কেন? এরা কী লেখাপড়া শিখেছে? এভাবে মানুষকে কষ্ট দেয়। আমি আবার ‘খুশবু মহল’ নামটির ওপর চোখ রাখলাম। সঙ্গে সঙ্গে নাক চেপে ধরতে হলো। মিউনিসিপ্যালিটির ময়লার ডিপো থেকে এবার কি উৎকট গন্ধ আমার নাকে এসে লাগল!