
তলকুঠুরির গান
ওয়াসি আহমেদ
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: সব্যসাচী হাজরা
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ফেব্রুয়ারি ২০১৫
২৫৬ পৃষ্ঠা
দাম: ৪৫০ টাকা।
ইতিহাসের অন্তর্গত ঘটনা বা ঘটনাপরম্পরাকে কথাসাহিত্যের বিষয় করা, বিশেষত উপন্যাসের, এক দুরূহ প্রয়াসের নামান্তর। একদিকে যেমন বাস্তবের ডালপালার সঙ্গে কল্পনার মিশেলে চিত ঘটনার নব রূপায়ণে সচেষ্ট হতে হয়, তেমনি তা সীমা অতিক্রম করে বিকৃতির শিকার হয়ে পড়ল কি না, শিল্পীকে সেদিকেও রাখতে হয় প্রখর নজর। শুরুতেই বলি, এ বইয়ের জনক ওয়াসি আহমেদ উল্লিখিত বৈচারিক পরীক্ষায় সর্বতোভাবে উত্তীর্ণ হয়েছেন।
নানকার প্রথা, যা চরম দাসত্বেরই আরেক নাম, প্রচলিত ছিল সেই কালের বৃহত্তর সিলেট জেলার বিশেষ কয়েকটি এলাকাজুড়ে। এই অমানবিক প্রথার বিরুদ্ধে কালক্রমে গড়ে ওঠে আন্দোলন। শেষ পর্যন্ত তা উঠেও যায়। কিন্তু এই প্রথায় পিষ্ট মানুষেরা, নর-নারী তথা মানব-মানবীরা দুঃখ-কষ্টের, বিরহ-বেদনার, বিচ্ছেদ ও স্থানচ্যুতির যে মর্মচেরা ঘটনাজাত কাহিনির জন্ম দিয়ে যান, তার বিবরণ, তার পাঠ এক অর্থে শ্বাসরুদ্ধকর। পাঠকমাত্রেই এই মতো প্রশ্নে আলোড়িত হবেন যে নানকার প্রথা, তথা নানকারদের এই ছিল জীবন! ঔপন্যাসিক ওয়াসি আহমেদ এই উপন্যাস লিখতে গিয়ে তাঁর ভূমিকায় বলেছেন, ‘ইতিহাসের ধারাকে আবছাভাবে ধরার চেষ্টা থাকলেও এ রচনা সর্বতোভাবেই একটি আখ্যান। নানকাররা যে তাদের দীর্ঘ ও অসম সংগ্রামে এক বিস্তৃত জনপদকে আলোড়িত করেছিল তার বিশদ বর্ণনা এটি নয়, কোনোক্রমেই নয়’। লেখকের এই উচ্চারণ সূত্রে তাঁর সততাকে সাধুবাদ না জানিয়ে পারি না।
আগেই বলা হয়েছে, তলকুঠুরির গান-এর পটভূমি বিস্তৃত। চরিত্রের সংখ্যাও কম নয়। ওয়াসি এই সব নিপীড়িত নানকারের প্রতিনিধি হিসেবে বেছে নেন তকবির চান, তার ছেলে শুকুর চান, তার মেয়ে আম্বিয়া খাতুন, শুকুর চানের ছেলে শরীফ এবং বামপন্থী সংগঠনের আরও কিছু চরিত্রকে। এই সব চরিত্রের সুবাদেই গড়ে ওঠে পুরো উপন্যাসের আদল ও পটভূমি—কাহিনিও পায় বিস্তৃতি।
নানকারদের আন্দোলন গড়ে উঠেছিল কীভাবে, সংগঠিত রূপই-বা পেয়েছিল কীভাবে, এই উপন্যাসে জীবন্ত হয়ে উঠেছে তা-ও। নানকার মেয়েদের ঘরের বাইরে, রাজপথে নেমে আসা, তাদের দিয়ে হারিকেন মিছিল করা—এসব ঘটনার বর্ণনা উপন্যাসে সত্যিই জীবন্ত। জীবন্ত তকবির চানসহ অন্যদের রক্তাক্ত অত্যাচারের বর্ণনাও। পরবর্তীকালে তকবির চানের ছেলে শুকুর চানের নানকার প্রথা-বিরোধী আন্দোলনে যোগদান, তার অবিশ্রান্ত পরিশ্রম, শুধু প্রতিশোধ নয়, এই অমানবিক প্রথার উচ্ছেদ যে তার অঙ্গীকার হয়ে ওঠে, ওয়াসি সেই বর্ণনাতেও নিখুঁত। এ বইয়ের সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায় নানকারদের আন্দোলনে বামপন্থীদের অংশগ্রহণের পর্বটি। তাদের নিজেদের মধ্যকার দ্বিধাদ্বন্দ্ব, দোদুল্যমানতা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের পলায়নপরতাও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আসলে নানকারদের আন্দোলন ছিল নানকারদেরই। বাইরে থেকে যাওয়া কারও প্রয়াসে এ আন্দোলন শেষ পর্যন্ত তার কাঙ্ক্ষিত মঞ্জিলে পৌঁছায়নি। কিন্তু কথা সেখানে নয়, ঔপন্যাসিক ওয়াসি আহমেদ পাঠককে শেষ পর্যন্ত কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন, প্রশ্ন সেখানেই।
বলা হয়েছে, এই উপন্যাস তিন প্রজন্মকে ঘিরে আবর্তিত। তকবির চানের ছেলে শুকুর চান, শুকুর চানের ছেলে শরীফ। সেই শরীফের শরীরে নানকার বাপ-দাদার রক্ত। সে তার নামের সঙ্গে যোগ করে ‘নানকার’ শব্দটি। এবং পদবি হিসেবেই। কিন্তু তার গতায়াতের সীমা ও পরিবেশ বদলেছে। স্থানচ্যুতির দৌলতেই। শিক্ষিত সে। শেষে বলা হচ্ছে, ‘দীর্ঘদিন পর শুকুর চানের শহরবাসী শিক্ষিত সন্তান শরীফ অতীত খুঁড়ে খুঁড়ে এক অবোধ্য গানের মধ্য দিয়ে পূর্বপুরুষের সঙ্গে একাত্ম হতে চায়। হয়তো পারেও খানিকটা। কিন্তু করপোরেট সংস্কৃতিতে লালিত শরীফ কত দূর যাবে!’
আমরা এই প্রশ্নে আবদ্ধ হব না। এ উপন্যাসের আদ্যোপান্ত পাঠ এই অনিবার্য প্রতীতি দেবে যে, ওয়াসি আহমেদের তলকুঠুরির গান বাংলা কথাসাহিত্যের বিস্তৃত পটভূমিতেই এক সেরা উপন্যাস। সার্বিক বিচারেই।