
উইকিলিকসে বাংলাদেশ
সংকলন, অনুবাদ ও সম্পাদনা
মশিউল আলম
প্রচ্ছদ: অশোক কর্মকার
প্রথমা প্রকাশন
৩৪৪ পৃষ্ঠা
দাম: ৫২০ টাকা
অনুসন্ধানী ওয়েবসাইট উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের মতো এক ঘটনা ঘটিয়ে সারা দুনিয়া কাঁপিয়ে দেন ২০১০ সালে। বিভিন্ন রাষ্ট্রের গোপন নথি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয় তাঁর প্রতিষ্ঠিত উইকিলিকস। আড়াই লাখের বেশি ফাঁস করা গোপন বার্তার মধ্যে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস থেকে ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে পাঠানো হয় প্রায় আড়াই হাজার তারবার্তা। তার থেকে ৭৩টি তারবার্তার অনুবাদ সংকলন উইকিলিকসে বাংলাদেশ। বার্তাগুলোর অনুবাদ, সম্পাদনা ও সংকলন করেছেন মশিউল আলম।
বইয়ের প্রথম লেখাটি ‘জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ও উইকিলিকস’ একটি মূল্যবান গবেষণামূলক প্রবন্ধ। ৫০ পৃষ্ঠাব্যাপী তথ্যবহুল এই প্রবন্ধ থেকে অ্যাসাঞ্জ ও তাঁর উইকিলিকস সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘকাল থেকেই বিভিন্ন দেশের রাজনীতিতে নাক গলায়, কখনো হস্তক্ষেপ করে। বহুকাল থেকেই বাংলাদেশের নেতারা মার্কিনদের মুখাপেক্ষী। কিন্তু তার পরিমাণ যে কতখানি, তা উইকিলিকসের নথি ফাঁস হওয়ার আগে ধারণা করা যায়নি। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এবং বিপদে আত্মরক্ষার জন্য নেতারা ধরনা দিয়েছেন মার্কিন দূতাবাসের কূটনীতিকদের কাছে। কাজটি সবচেয়ে বেশি হয়েছে বর্তমান শতাব্দীর প্রথম দশকে। এবং তা করেছেন মূলত দুই প্রধান দলের নেতারা।
প্রতিদিন প্রচারমাধ্যমে আমরা আমাদের রাজনীতিক ও শাসকশ্রেণির লোকদের যে মুখ দেখি, তা তাঁদের আসল চেহারা নয়; একটি মুখোশ পরে ঘরের বাইরে মানুষের সামনে বের হন তাঁরা। সভা-সমাবেশে যে কথা বলেন, তাতে উপচে পড়ে দেশপ্রেম, গণতন্ত্রের জন্য অঙ্গীকার, জনগণের জন্য গভীর দরদ; কিন্তু ওসব তাঁদের আসল কথা নয়।
বেগম খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় শাসনামলে রাজনীতিতে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। সরকারি ও বিরোধী জোট কেউ কাউকে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে ইচ্ছুক ছিল না। সেই অবস্থার সুযোগ নেয় দেশের ভেতরের তৃতীয় পক্ষ এবং বিদেশি ‘বন্ধুরা’। দেশের জন্য নয়, জনগণের জন্য তো নয়ই, রাজনীতিকেরা নিজেদের স্বার্থে কতটা নিচে নামতে পারেন, কত রকম ষড়যন্ত্র করতে পারেন, তার প্রমাণ মার্কিন দূতাবাসের এসব কূটনৈতিক তারবার্তা। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর কার্যকলাপে সাধারণ মানুষ ত্যক্ত-বিরক্ত। বিদেশিদের সহযোগিতায় সেই পরিস্থিতির সদ্ব্যবহার করতে তৎপর হয় সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের একটি গোত্র। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় শিক্ষাবিদ, এনজিও-কর্তা ও বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ। একপর্যায়ে তারা মনে করে, দুই দল শুধু নয়, দুই নেত্রীই তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাধা। তাঁদের ‘মাইনাস’ করার ফন্দি আঁটে তারা। একদিকে ভয় দেখানো এবং অন্যদিকে সুযোগ-সুবিধার প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশে পাঠিয়ে দিতে চায় তাঁদের। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দুই বড় দলের খ্যাতিমান নেতারা অনেকেই কীভাবে অংশ নেন, তা জানা যায় এই বই থেকে। আরও জানা যায় সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার ভূমিকা সম্পর্কে।
ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দীনের জরুরি অবস্থার সরকারের ‘কিংস পার্টি’ গঠনের পরিকল্পনা ছিল সবচেয়ে ঘৃণ্য এক নীলনকশা। সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায় নেতাদের রাজনৈতিক বিচক্ষণতার জন্য নয়, গণতন্ত্রকামী জনগণের সচেতনতায়। মার্কিন দূতাবাসের গোপন বার্তার একটি নমুনা:
তারিখ: ৪ জুন ২০০৭;
সময়: ০১: ৪৪ পূর্বাহ্ণ
‘সামরিক বাহিনী একটি নতুন ‘কিংস’ পার্টি গঠনের উদ্দেশ্যে প্রাথমিকভাবে বিএনপির রাজনীতিকদের টানার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ‘দুই ভদ্রমহিলা’কে সরিয়ে দেওয়ায় ব্যর্থতা, নতুন দলটির জন্য গ্রহণযোগ্য নেতৃত্বের অভাব এবং জেনারেল মইনের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে মিশ্র সংকেতের কারণে নতুন দলটির সম্ভাব্য নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিভ্রান্তি ও হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। সামরিক বাহিনীর প্রস্থানকৌশল যদি হয় দুই প্রধান দলকে প্রতিস্থাপনের উদ্দেশ্যে একটি ‘কিংস’ পার্টি গঠন করা এবং পরবর্তী সরকারের আমলে নিজের স্বার্থ রক্ষা করা, তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাস ও রাজনৈতিক বাস্তবতার নিরিখে আমাদের অনুমান হচ্ছে, নতুন দলটিকে [আগামী নির্বাচনে] বিজয়ী হতে হলে সময় এবং সামরিক বাহিনীর জোরালো সমর্থনের প্রয়োজন হবে।’ [পৃষ্ঠা: ২০৯]
বিচিত্র ষড়যন্ত্রের গোপন তথ্যে পরিপূর্ণ এই বই। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ধ্বংস হয়নি, দুই নেত্রীকে ‘মাইনাস’ করা সম্ভব হয়নি, কিন্তু সেদিনের সেই নীলনকশার ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে অভিশাপ নেমে আসে, তার ফল এ দেশের মানুষ আরও বহুকাল ভোগ করবে।
কূটনীতিকদের দ্রুত লিখে পাঠানো রিপোর্টের কেনো সাহিত্যমূল্য থাকে না; কিন্তু মশিউল আলম একজন কথাশিল্পী। তিনি যখন তারবার্তাগুলো অনুবাদ করেছেন, তখন তা তাঁর প্রাঞ্জল ভাষার গুণে সুখপাঠ্য হয়ে উঠেছে। এখন এই বইকে একটি রাজনৈতিক সাহিত্যের বই বলা যায়। বাংলাদেশে নষ্ট রাজনীতির প্রচুর উপকরণ ছড়িয়ে আছে উইকিলিকসে বাংলাদেশ-এ। ভবিষ্যতে রাজনীতির গবেষকদের প্রয়োজন পূরণ করবে এই বই।