চর্যাপদের আরও পুঁথি

প্রাপ্ত পাঁচটি পুঁথির মধ্যে এটি প্রথম পুঁথি। পুঁথিটির নাম ‘চর্যাচর্যটীকা’, যেখানে লেখা আছে ‘কাআ তরুবর পঞ্চবিডাল...’
প্রাপ্ত পাঁচটি পুঁথির মধ্যে এটি প্রথম পুঁথি। পুঁথিটির নাম ‘চর্যাচর্যটীকা’, যেখানে লেখা আছে ‘কাআ তরুবর পঞ্চবিডাল...’

চর্যাপদের সংস্কৃতি বিলুপ্ত হয়েছে বলেই ধরে নেওয়া হয়েছিল। এমন ধারণা প্রচলিত যে হাজার বছর আগে চর্যাপদ গাওয়া হতো, এখন আর গাওয়া হয় না। নবচর্যাপদ বা নতুন চর্যাপদ-এ কিছু গান প্রকাশিত হয়েছে, যেগুলোর সঙ্গে চর্যাপদের গানগুলোর ভাবগত মিল রয়েছে। তবে এগুলো রচিত হয়েছে অনেক পরে। এবার পাওয়া গেল মূল চর্যাপদের আরও অনুলিপি, অর্থাৎ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যে গান গানগুলো আবিষ্কার করেছিলেন, সেই একই গান, তবে তা ভিন্ন পুঁথিতে, ভিন্ন লিপিতে লেখা। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীও চর্যাপদের অনুলিপিই সংগ্রহ করেছিলেন। কেন না, সে সময় এই পদগুলো মূলত অনুলিপির মাধ্যমেই প্রচারিত হতো। এখন চর্যাপদের যে পাঁচটি পুঁথি পাওয়া গিয়েছে, সেগুলোও অনুলিপি। আসলে চর্যাগানের চর্চা এখনো রয়েছে। নতুন কোনো চর্যাপদ নয়, হাজার বছরের পুরোনো সেই চর্যাগান—কাহ্নপা, লুইপাদের গান—যা এখনো গাওয়া হয়।

নেপালের পাতান দরবারের কয়েকটি মহাবিহারে গাওয়া হয় চর্যাগান। দশমীর পূর্ণিমায় এটি গাওয়া হয় পবিত্র জ্ঞানে। গানের মাধ্যমে চলে সাধনা। নেওয়ার জাতির বজ্রাচার্যরা এখনো গেয়ে থাকেন এই গান। নেওয়ার হলো কাঠমান্ডু উপত্যকা ও এর আশপাশে বাস করা হিন্দু ও বৌদ্ধ সভ্যতার মিলিত সংস্কৃতি বহন করা এক জাতিগোষ্ঠী। তারা চর্যাগানকে বলে থাকে চচগান। চচগানের মাধ্যমে যে সাধনা, তা বাইরের কারও জন্য উন্মুক্ত নয়। এমনকি সাধারণ নেওয়ারিরাও এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল নয়। কেবল বজ্রাচার্য চচগান নিয়ে বলতে পারে, তবে তারা এ নিয়ে প্রকাশ করে সামান্যই। কঠোর গোপনীয়তা ও পবিত্রতা রক্ষা করে এই গীতি ও সাধনা করা হয়।

চর্যার পুঁথির খোঁজে কয়েক বছর ধরে কাঠমান্ডু উপত্যকার বিভিন্ন মহাবিহার ও সংগ্রহশালায় হাজির হয়েছি। তখন দেখেছি, কাঠমান্ডুর অনেক পুঁথির নামে চর্যা (অনেকে চারিয়া উচ্চারণ করেন) শব্দটি রয়েছে। তখন থেকেই মনে আকাঙ্ক্ষা ছিল এই পুঁথিগুলো পরীক্ষা করে দেখার। প্রথমে মনে হয়েছিল, এগুলো ভিন্ন ধরনের চর্যাগান। কিন্তু একটি পুঁথিতে চোখ আটকে যায়, ক্যাটালগে এর লিপি ও ভাষা নেওয়ারির পাশাপাশি বাংলা শব্দটির উল্লেখ রয়েছে। এসব দেখে আগ্রহ বেড়ে গেল। পুঁথির পাতার পর পাতায় সংস্কৃত শ্লোক। হঠাৎ একটি চরণ খুব পরিচিত মনে হলো, ‘কাআ তরুবর পঞ্চবি ডাল...।’ এই তো মিলে যাচ্ছে, এ তো হুবহু চর্যাপদ। ১৯০৭ সালে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর পাওয়া পুঁথির সঙ্গে এই পুঁথিগুলোর বিষয়ের কোনো পার্থক্য নেই। সেই একই সাড়ে ছেচল্লিশটি পদ। পদগুলো লুইপা, কাহ্নপা, সরহপার লেখা।

এ রকম একটি নয়, গোটা দশেক পুঁথি পাওয়া গেল। আমি বিভিন্ন সংগ্রহশালা থেকে মোট পাঁচটির অনুলিপি সংগ্রহ করলাম। তালপাতার পুঁথির অনুলিপি এই পুঁথিগুলোর মাধ্যম, আকৃতি, লেখার উপাদান ও লিপির কাল আলাদা। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যে পুঁথিটি দেখেছিলেন, সেটি ছিল তালপাতার। তবে আমরা যে পুঁথিগুলো দেখেছি, সেগুলো তুলোট কাগজে লিখিত। কাগজের এক পিঠ গাঢ় হলুদ রঙের, অপর পিঠ ধূসর। কাগজের বলেই অনুমান করা যায়, তালপাতার পুঁথির তুলনায় এগুলো অপেক্ষাকৃত নতুন।

হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর পুঁথির সঙ্গে এই পুঁথিগুলোর বিষয়ের হুবহু মিল দেখায় বিস্ময় তৈরি হয়। তৈরি হয় প্রশ্ন, আরও অদেখা বা অনাবিষ্কৃত পুঁথি থাকা কীভাবে সম্ভব?

সম্ভব, কিন্তু আমাদের বিদ্যায়তনগুলো, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিষ্ঠিত বিদ্যাকে প্রশ্ন বা সন্দেহের চোখে দেখতে অভ্যস্ত নয়। শাস্ত্রী মহাশয়ের বাইরে আরও পুঁথি আবিষ্কারের জন্য গভীরতর অনুসন্ধান কমই হয়েছে। শাস্ত্রীর পুঁথির বাইরে আরও পুঁথি থাকার কারণ হচ্ছে চর্যাপদের হাজার বছরের চর্চা। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম, প্রাচীন যুগ বা মধ্যযুগের প্রথম পর্বের চর্যাপদের সংস্কৃতির বিলোপ ঘটেছে। কিন্তু এখনো নেপালে বজ্রযান মতাদর্শী বৌদ্ধদের একটা অংশ এই সংস্কৃতি টিকিয়ে রেখেছে। ততোধিক জায়গায় সাধনা মানে ততোধিক পুঁথি। মুখস্থ করে গাইতে গেলে পবিত্র এই গানের ভাষ্য বদলে যেতে পারে। সে জন্য পুঁথিতে লিখে রাখা। পুঁথির সংখ্যা তাই একটি নয়, বেশি। নামে চর্যা শব্দ রয়েছে, এমন গানের পুঁথি দেখেছি প্রায় এক ডজন।

স্বর্ণরঙের হিরণ্যবর্ণ মহাবিহার, যেখানে চর্যাগানের সাধনা হয়। ছবি: সংগৃহীত
স্বর্ণরঙের হিরণ্যবর্ণ মহাবিহার, যেখানে চর্যাগানের সাধনা হয়। ছবি: সংগৃহীত

এত দিন পর এই পুঁথি পাওয়ার ফলে জিজ্ঞাসা তৈরি হয়েছে, পুঁথিগুলো কোন সময়ের? এদের ভাষা ও লিপি কী? আসলে পুঁথিগুলো পরীক্ষা করে এদের সময় নির্দিষ্ট করার পক্ষে সহায়ক কিছু পাওয়া যায়নি। তবে পুঁথিগুলোতে ব্যবহৃত গাঢ় হরিতাল প্রলেপ দেখে বলা যায়, এদের সময় ষোলো শতকের প্রথম দিককার। সাধারণ এই সময়ের পুঁথিতে রং হিসেবে হরিতাল ব্যবহৃত হতো। অধিকাংশ পুঁথির টীকার ভাষা সংস্কৃত কিন্তু মূল গানের ভাষা সংস্কৃত নয়। ক্যাটালগে মৈথিলি ও বাংলা বা নেওয়ার ভাষার কথা লেখা রয়েছে। লিপির কথা বলা রয়েছে দেবনাগরী ও নেওয়ারি। আদতে পুঁথিগুলোর ভাষা ও লিপি নিয়ে দীর্ঘ পরীক্ষার পর সিদ্ধান্ত দেওয়া শ্রেয়তর।

পুঁথিগুলোর সময়-লিপি-ভাষা যা-ই হোক, এই পুঁথিগুলো বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে চর্যাপদচর্চায় একধরনের পরিবর্তন আনবে। বিশেষত চর্যাপদের পাঠে ও ভাষ্যে পরিবর্তন আসবে। তালপাতার পুঁথিটির লিপিগত অস্পষ্টতার ফলে অনেক পাঠ নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ দেখা দিয়েছে। এই পুঁথিগুলোর তুলনামূলক পাঠের মাধ্যমে সঠিক পাঠে পৌঁছানো সম্ভব হবে। তালপাতার পুঁথির লিপি, বর্ণের বা হরফের পাঠগত ভিন্নতার ফলে পাঠে ও অর্থে প্রচুর মতভেদ বা পাঠান্তর সৃষ্টি হয়েছে। যেমন বারোসংখ্যক চর্যায় ‘মাদেসিরে ঠাকুর’-এর আরেকটি পাঠ হলো ‘আদেসিরে ঠাকুর’। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্​র মতে, আদেসিরে ঠাকুর মানে রাজাকে চাল দিয়ে (আদেশ+ই)। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, সুকুমার সেন, নীলরতন সেন, মৃণাল নাথ প্রমুখের মতে, ‘মাদেসিরে ঠাকুর’ একত্রিশসংখ্যক পদে ‘বট দুই মার ন দিশঅ’—এই বাক্যের অর্থ তৈরিতে বিভ্রান্তি রয়েছে। এখানে শহীদুল্লাহ্ ‘দুই মার’ না বলে বলেছেন ‘দুইআর’। মৃণাল নাথের মতে, ‘দুই আর’ মানে ‘দুইপার’। চুয়াল্লিশসংখ্যক পদে ‘জঁথা আইলেসি তথা জান/ মাঝঁ থাকী সঅল বিহণ’—এই বাক্যে কোন শব্দের মধ্যে ফাঁক হবে, তা নিয়ে ঐকমত্যে না আসতে পারার ফলে কেউ ‘সঅলবি হান’ কেউ ‘সঅল বিহন’ হিসেবে পাঠ তৈরি করেছেন। উনত্রিশসংখ্যক পদে ‘লুই ভনই বঢ দুলক্খ বিণণা’—এই বাক্যে শব্দটি বঢ়, বঢ না বট হবে, তা নিয়ে মতপার্থক্য হয়েছে। শহীদুল্লাহ্ ও পার ক্বের্ন বঢ়কে বোবা অর্থে ব্যবহার করেছেন, কিন্তু নীলরতন সেন করেছেন বটে অর্থে ‘লুই বলেন বিজ্ঞাপন দুর্লভ বটে’। এই নতুন পুঁথিগুলো এমন শত শত পাঠবিষয়ক অস্পষ্টতা ও মতদ্বৈধতা নিরসন করবে।

এই পুঁথিপ্রাপ্তির মানে হলো নেপালে বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্য বিষয়ে নতুন তথ্যের সংযোজন। আশা করা যায়, এর ফলে বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গসহ বিশ্বের অন্য একাডেমিগুলোতে চর্যাপদ পাঠে প্রভাব রাখবে। এই পুঁথিপ্রাপ্তি কেবল চর্যাপদ পাঠে নয়, হাজার বছর ধরে নেপালে বাংলা সাহিত্য কিংবা বাংলা অঞ্চল থেকে বৌদ্ধদের চলে যাওয়া বিষয়ে গবেষণায় রসদ জোগাবে।

>

পাঁচটি পুঁথির পরিচয়

১. সবচেয়ে স্পষ্ট ও ভালো অবস্থায় যে পুঁথিটি, তার নাম ‘চর্যাচর্য টীকা’। তবে ক্যাটালগের কার্ডে কেটে নতুন করে লেখা হয় ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়টীকা’। পুঁথিটির পাতার সংখ্যা ৪৫। হলুদ রঙের তুলোট কাগজের পাতা। প্রতিটি পাতার আকার দৈর্ঘ্যে ৩১ সেমি, প্রস্থে ১২.৫ সেমি। প্রতি পাতায় ৭ থেকে ১০টি লাইন রয়েছে। ক্যাটালগ কার্ড অনুযায়ী এর ভাষা সংস্কৃত, মৈথিলি ও বাংলা। এর লিপি স্পষ্টতই নেওয়ারি ও দেবনাগরী। পুঁথিটির প্রাপ্তিস্থান, সময়কাল সম্পর্কে নির্দিষ্ট কিছু উল্লেখ নেই।

২. অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন পুঁথিটির নাম ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’। টীকা শব্দটি শিরোনামে নেই। এর পাতার সংখ্যা ৭৫। পাতার এক পিঠ কড়া হলুদ, অন্য পিঠ হালকা ধূসর। পাতার আকার দৈর্ঘ্যে ২৩.৫ সেমি, প্রস্থে ১০.৪ সেমি। প্রতি পাতায় সাতটি লাইন রয়েছে। এর ভাষা সংস্কৃত, মৈথিলির সঙ্গে বাংলা বলে উল্লেখ রয়েছে। এর লিপি স্পষ্টতই নেওয়ারি ও দেবনাগরী। এই পুঁথি সম্পর্কে এর বেশি কিছু জানা যায় না।

৩. অপর পুঁথিটির নাম ‘চর্যাচর্য বিনিশ্চয় টীকা’। এর পাতার সংখ্যা ৬৯। পুঁথির পাতার রং হলুদ। প্রতিটি পাতার আকার দৈর্ঘ্যে ৩০.৩ সেমি, প্রস্থে ১১.৮ সেমি। প্রতি পাতায় আটটি লাইন রয়েছে। এর ভাষা সংস্কৃত, মৈথিলি ও বাংলা। এর লিপি নেওয়ারি ও দেবনাগরী।

৪. ন্যাশনাল আর্কাইভসে লভ্য আরেকটি পুঁথি রয়েছে। ভুক্তিতে এর নাম ‘চর্যাচর্য টীকা’। এর লিপি নেওয়ারি হিসেবে উল্লেখ রয়েছে, তবে ভাষার উল্লেখ নেই। পুঁথির প্রতিটি পাতার আকার দৈর্ঘ্যে ২৩.৩ সেমি, প্রস্থে ১৮.৬৮ সেমি। প্রতি পাতায় চরণের সংখ্যা ৬। এর সাদাকালো চিত্র সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে।

৫. ‘চর্যাগীত’ নামে আরও একটি পুঁথি রয়েছে। এর ভাষা ও লিপি নেওয়ারি বলে উল্লেখ রয়েছে। অন্যগুলো তুলোট কাগজের হলেও এই পুঁথি তা নয়। এই কাগজকে স্থানীয়রা বলে থয়াসফু। পুঁথিটির পাতার সংখ্যা ৬২। পাতার দুই পাশে কড়া হলুদের প্রলেপ রয়েছে।