চাঁইঞুরুই বাজারে কোনো মুচি ছিল না

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

‘তখন এই বাজারে কোনো মুচি ছিল না’—গল্পের প্রথম বাক্যটা সে এভাবে শুরু করল। তার বলার ভঙ্গিমা এমন, যখন সে শুরু করে তখন মনে হয়, কোন সুদূরের লোকভূমি থেকে উঠে এসে একরাশ ক্লান্তি মুছে শরতের আকাশের মতো পৃথিবীর সমস্ত বিষণ্নতাকে দূরে ঠেলে রেখে মুখে গাম্ভীর্যের তুলি দিয়ে রঙের একটা পরশ ছোঁয়ায়, তারপর মুখ খোলে। আমরা দ্বিগুণ আগ্রহে তার বয়ান শুনতে থাকি। বিশেষত গল্পটা যখন শুরু হয়েছে, চাঁইঞুরুই বাজারে মুচি থাকা না থাকা নিয়ে।
চাঁইঞুরুই চৌধুরী যখন বাজারের জন্য জমি দান করেছিলেন তখন তাঁর মনে কি মুচির কথা উঁকি দিয়েছিল? একটা বাজারে চাল-ডাল-তেল-নুনের মতো মুচির প্রয়োজনীয়তার কথাও হয়তো তাঁর মনে হয়েছিল। কারণ তখনো সে এলাকায় তিনি ছাড়া আর কারও জুতো পায়ে দেওয়ার অভিজ্ঞতা হয়নি। খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে লোকজনের পায়ের পাতা এমন শক্ত হয়ে গিয়েছিল যে অনায়াসে তারা লজ্জাবতীর কাঁটাবন মাড়িয়ে, ঘরে না ফেরা গরু-ছাগল খুঁজতে যেতে পারত। সুতরাং সাধারণ লোকের মুচির কোনো প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু জুতো মেরামতির জন্য মাঝেমধ্যে তাঁর মুচির প্রয়োজন হতো।
সরকারি লোকদের মধ্যে থানার পরিবর্তে যখন ফাঁড়ির অনুমোদন দিয়ে কিছু পুলিশকে বেগার খাটতে পাঠানো হলো তখন জুতা পালিশ করতে গিয়ে তাদেরও মুচির কথা মনে পড়ত হয়তো। আসলে সকাল-বিকেল এই কাজটি ছাড়া তাদের আর কোনো কাজ ছিল না। ‘সারা বছর বসে বসে খাই না, আমরাও কিছু কাজ করি’—কর্তৃপক্ষকে এই কথা বোঝানোর জন্য তারা মাঝেমধ্যে ফরেস্ট অফিসে যেত এবং কিছু আসামির নাম-তালিকা নিয়ে এসে সেগুনগাছ চুরির অভিযোগে গ্রেপ্তার করে চালান করে দিত।
ফরেস্ট অফিস ছিল বাজার থেকে কয়েক মাইল দূরে। তারাও জুতো পায়ে দিত। তাদেরও মুচির কথা মনে পড়া স্বাভাবিক।
সেই ফরেস্ট অফিসের এক ফরেস্টার, যার কথা সরকারি সেগুনগাছেরা অনেক দিন মনে রেখেছিল; তারপর তারা যখন উজাড় হয়ে গেল, বনের হাওয়া এবং ছায়ারাও ভুলে গেল তার কথা। কিন্তু ভুলল না একজন, যার কথা আমরা গল্পের কাহিনিতে খুঁজে পেয়েছিলাম। আর সেই ফরেস্ট অফিসারও মুচি না থাকা গল্পটির সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিল।
আমরা তখন কয়েকজন যুবা বয়সী একটু-আধটু পড়ালেখা শিখে বেকারত্বের বোঝাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে কিছু পয়সা রোজগার করে স্বাধীন থাকার আশায় একটা বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় যোগ দিয়েছিলাম। মাথায় মোটেই স্বেচ্ছায় সেবাদানের মহত্তম কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। বিএ-এমএ পর্যন্ত পড়ার যৌক্তিকতা প্রমাণ এবং স্বাধীনভাবে কিছু আয়ের আশাতেই পরাধীনতার শর্তগুলো মেনে নিয়ে দেড় শ টাকার একটা স্টাম্পে স্বাক্ষর দিয়ে হাস্যকর সেবাদান শুরু করেছিলাম। সংস্থার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য শ্রম দেব। বিনিময়ে সংস্থা আমাদের কিছু টাকা দেবে। সংস্থার উদ্দেশ্য—লৌকিক বা পারলৌকিক কল্যাণ কোনোটাই না হলেও নিজের কল্যাণ অবশ্যই ছিল। কাজের যেটুকু মান বজায় থাকলে পরের পাঁচ বছরের জন্য বিদেশি সাহায্য আবার নিশ্চিত হবে সংস্থা ততটুকু দায়বদ্ধতাই আমাদের কাছ থেকে প্রত্যাশা করত। তাই ‘স্বেচ্ছাসেবী’ এই পরিচয়টাকে মানুষের কাছে বিশিষ্ট করে তোলার জন্য দানছত্র খোলাতে আমাদের কোনো অধিকার ছিল না। বরং প্রতি মাসে কেন্দ্রীয় অফিস থেকে একটা করে রিপোর্ট পেতাম দেশের কোন অফিসের কোন কর্মীকে বিধিবহিভূর্ত ‘স্বেচ্ছাসেবী’ হতে গিয়ে পরিণামে বদলি, জরিমানা, বেতন কর্তন, ক্ষতিপূরণ এমনকি চাকরি হারানোর শাস্তিও ভোগ করতে হয়েছে।
অফিসের পাশে একটা রুম ভাড়া করে আমরা সবাই থাকি। সারা দিন ফিল্ডে ঘুরি। মাঝেমধ্যে নাইট গার্ডের গল্প শুনতে শুনতে মাঝরাত পর্যন্ত অফিস পাহারা দিই।
একদিন আধ পশলা বৃষ্টি হয়েছে। বাজারে মধ্যরাত পর্যন্ত যে চায়ের দোকানটা বন্ধ হয় না; সেখানে, ধোয়ার নামে ময়লা পানিতে চুবানো রং-ওঠা চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে ফেরার পথে আঠালো এবং ব্যাপক পিচ্ছিল এঁটেল মাটিতে আমাদের একজন পা পিছলে আছাড় খাওয়ার আগে চামড়ার চপ্পলের এক পাট্টি ছিঁড়ে ফেলল। দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে সৃষ্ট মায়ায় পড়ে হোক কিংবা বিকল্প না থাকার কারণে হোক হাতে কাদা লাগিয়ে সে জুতোজোড়া হাতে করে ফিরল রুমে।
অফিসের সামনে নাইট গার্ডের সাথে দেখা। দ্রুতগামী পৃথিবীতে মাঝবয়স পার হয়ে যাওয়া বাতিল লোক বলা যায়। জিজ্ঞাসা করে এটুকু জেনেছি, তার বউ, ছেলেমেয়ে নেই। তাকে দেখলে কোনোভাবেই বলার উপায় নেই যে, ‘মানুষ সামাজিক জীব আর কিছু পরিবার নিয়ে সমাজ গঠিত হয়’। নাইট গার্ড হলেও প্রায়ই দিনের বেলায় পূর্ণ ডিউটি দিতে তার কোনো আপত্তি ছিল না, বরং এতে সে আনন্দ বোধ করে বলে মনে হয়। ঘর-বাড়ি নেই বলে যাওয়ার প্রয়োজনও তার পড়ে না। উপরন্তু রাতের দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই মাঝমধ্যে সে সমস্যার সৃষ্টি করে।
কোনো কোনো দিন ঢুলতে ঢুলতে অফিসের বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। ভাত গাঁজিয়ে তৈরি ঝাঁঝাল বাংলা মদের গন্ধ বের হয় মুখ থেকে। তখন সে আমাদের কাউকে কেয়ার করে না। কাকে যেন উদ্দেশ করে মারমা ভাষায় গালাগাল করতে থাকে সমানে। আমরা এর এক বর্ণও না বোঝার ফলে এই ভাষাকে পৃথিবী সবচেয়ে কঠিন ভাষা বলে ভাবতে থাকি।
মদের পরিবর্তে কখনো সে তৈরি করে চুরুট। বাঁ হাতের তালুতে তামাকের পাতা ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলির চাপে গুঁড়ো করে কাগজের ওপর ঢেলে রোল করে বানাতে থাকে নিবিষ্ট মনে। সেদিন তার চোখ কেন জানি আমাদের ভয় দেখানোর জন্য লাল হয়ে যায়। লাল রং ভীতি আমাদের কারোরই নেই। কিন্তু তখন তার চোখের লাল রংটি দেখে আমরাই সবচেয়ে বেশি ভয় পাই। অথচ আমাদের দেখে সবচেয়ে বেশি ভয় পাওয়ার কথা ছিল তারই। এ সময় সে কারও সাথেই কথা বলে না। আমাদের একজন বলল, ‘তামাক নয়, গাঁজা খায়’। তার এই খাওয়াখাওয়ি নিয়ে অফিসে একটা গুঞ্জন উঠলেও দিনের ফাউ সার্ভিসের জন্য তাকে সবাই সহ্য করে।
যে রাতে সে কোনো কিছু খায় না, সে রাতে তার যেন সময় কাটে না। এসে আমাদের সাথে গল্প জুড়ে দেয়। তার গল্পে বুঁদ হয়ে আমরাও গোগ্রাসে গিলতে থাকি কাহিনিগুলো।
আমরা জানতে চাইলাম, ‘দাদা, বাজারে কি মুচি আছে?’
: এখন আছে। বিশ-ত্রিশ বছর আগেও ছিল না।
: কেন?
: মানুষ জুতো পরত না।
: তাই নাকি? অদ্ভুত তো, কেন?
: জুতো কেনার পয়সা ছিল না।
: এত গরিব ছিল?
: তখন পুরো এলাকায় সরকারি সেগুনবাগান ছিল। মানুষ খেতখামার করতে পারত না।
: এখন তাহলে পয়সা হয়েছে? বাজারে তো চার-পাঁচটা জুতোর দোকান।
: হ্যাঁ। জুতো কেনার মতো...
: সরকারি সেগুনগাছ বেচে মানুষ ধনী হয়ে গেল? বাহ্ দারুণ তো!
: পাগল নাকি? গাছ বেচবে এলাকার মানুষ? পাতা ধরারও উপায় ছিল না। মামলা হতো। পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যেত।
: তো, গাছগুলো কোথায় গেল?
: ‘ভূতে খেয়েছে’। মুখ বাঁকা করে সে জবাব দিল।
হেঁয়ালিপূর্ণ উত্তরে আমরা একে অন্যের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। বুঝলাম না কিছুই। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে।
: নিয়তির কী নিষ্ঠুর পরিহাস দেখেন, যে গাছগুলো রক্ষার জন্য বন্দুক কাঁধে পাহারা দিত, সেই গাছগুলো তারাই বেচে দিয়েছিল এবং সরকারকে না জানিয়েই। কারণ গাছগুলো একটা একটা করে তাদের মাথার ওপর পড়ছিল।
: সত্যি? কেন এমন হলো? আমাদের চোখে-মুখে অবিশ্বাস।
: অভিশাপ! অভিশাপ!! দাঁত চেপে কথাগুলো বলল সে।
: কার অভিশাপ?
: লোকজনের চোখের জল আর দীর্ঘশ্বাসের। সেই কান্না ও দীর্ঘশ্বাস থেকেই প্রতিটা গাছে একটা করে জন্ম নিয়েছিল ভূত। তারা ফরেস্টারদের তাড়া করত।
আমরা দেখলাম, তার চোখগুলো আজও লাল। ভয় লাগল। আজও শুকনা বা ভেজা কিছু একটা সে খেয়েছে।
: ‘তাহলে শুনেন, একটা গল্প বলি’।—এই কথায় আশ্বস্ত হয়ে তাকালাম তার দিকে।
সে বলতে শুরু করল, ‘লোকটার বাড়িতে কোনো টাট্টিখানা ছিল না। বাড়ির পাশে সেগুনবাগান। ভোরে উঠে কাজ সারবে বলে বাগানে ঢুকেছিল। ফরেস্টাররা তখন নাইট ডিউটি শেষে ফিরছিল অফিসে। তারা তাকে ধরে নিয়ে গেল। খবর পেয়ে তার বউ ছুটে গেল ফরেস্ট অফিসে।

>মনের ভেতর ওই নারীর গোলগাল ফরসা মুখ উঁকি দিতে লাগল বারবার। তাঁর কাছে নারীদেহের সৌন্দর্যের অর্থ ফরসা গায়ের রং। গোসলের জন্য তোলা বালতির পানিতে নারীটির মুখ তাঁর সাথে মুচকি মুচকি হেসে তামাশা করতে লাগল

ফরেস্ট অফিসার সবে হাত-মুখ ধুয়ে নাশতা করতে বসেছেন। শুনে বিরক্তিতে তাঁর মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। তিনি ভাবলেন, বউ আসুক আর মা আসুক কোনো তদবিরে কাজ হবে না। জেলের ভাত খেতেই হবে। তিনি ঘুমাতে গেলেন। সেগুনবাগানের ভেতর সারা রাত মশাদের সাথে মল্লযুদ্ধ করে ঘুম হয়নি।
ফরেস্টার সাহেব দুপুরে ঘুম থেকে উঠে গোসলের জন্য গামছা-লুঙ্গি নিয়ে চাপকলের দিকে যেতেই দেখেন বারান্দায় একজন পাহাড়ি নারী বসে আছে। বুঝলেন, ধরে আনা লোকটার বউ। তাকে দেখে নারীটি নতমুখে দাঁড়িয়ে গেল। তিনি গেলেন গোসল করতে। কিন্তু মনের ভেতর ওই নারীর গোলগাল ফরসা মুখ উঁকি দিতে লাগল বারবার। তাঁর কাছে নারীদেহের সৌন্দর্যের অর্থ ফরসা গায়ের রং। গোসলের জন্য তোলা বালতির পানিতে নারীটির মুখ তাঁর সাথে মুচকি মুচকি হেসে তামাশা করতে লাগল। মনে পড়ল, বাড়িতে কালো রঙের দুই বউয়ের কথা; যার একটি অকালে বুড়িয়ে যাওয়া এবং লইট্যা শুঁটকির মতো হাড্ডিসার, অন্যটি সামনের ঠোঁট উঁচু, নোলক পরলে নাকে নাল পরানো শুয়োরের মতো লাগে। অথচ নোলকই কি না তার পছন্দের অলংকার। পাঁচ বছর আগে দ্বিতীয় বউ ছিল তাঁদের ব্যাচেলর কোয়ার্টারে কাজের বুয়া।
যে গার্ডটা লেখালেখির কাজে একটু দক্ষ, বিকেলে সে এসে বলল, ‘স্যার, লোকটাকে না অফিসে চাকরি দেবেন বলে ছেড়ে দিলেন, আবার তার নামে কেস এন্ট্রি দিতে বলছেন...।’
ফরেস্টার জবাব দিলেন, ‘এটা বুঝলে তুমিই আজকে এ চেয়ারে বসতা।’
গার্ড আর কথা বাড়ানোর সাহস করল না।
এভাবে লোকটার জেলখানায় যাওয়ার পরিবর্তে চাকরি জুটে গেল।
সেদিন থেকে সে ফরেস্ট অফিসে ফুট-ফরমাশ খাটে। রাতে ফরেস্টার তাঁর বাহিনী নিয়ে নাইট ডিউটিতে গেলে সে অফিস পাহারা দেয়। তার বাড়িতে ফরেস্টার সাহেব দলবল নিয়ে মাঝেমধ্যে আতিথ্য গ্রহণ করেন। তার বাড়ির ওদিকে ডিউটি থাকলে খাওয়া নিয়ে ফরেস্ট অফিসের কারও আর চিন্তা করতে হয় না।
এর মধ্যে ফরেস্টার সাহেব একটু-আধটু ধেনো মদে চুমুক দেওয়ার অভ্যাসও রপ্ত করে ফেলেছেন। এক কাপ গলায় ঢেলে এক বোতলের মাতাল হয়ে যান। তিনি ভাবেন, তাঁর মাতলামির বিষয়টি একজন ছাড়া আর কেউ টের পায় না এবং মাতলামিতে সে পক্ষেরও সায় আছে।
একদিন ফরেস্টার সাহেব লোকটাকে এক জোড়া জুতা দিয়ে বললেন, ‘এগুলো তুমি ব্যবহার কোরো। সামান্য ছেঁড়া, যাও বাজার থেকে সেলাই করে নিয়ে এসো।’
লোকটা জীবনে কখনো জুতো পায়ে দেয় নাই। একটু বিব্রত হলেও খুশিই হলো। চাঁইঞুরুই বাজারে কোনো মুচি নাই। সে রানীর হাট বাজারে গেল জুতা সেলাই করতে।
পাহাড়ি মানুষের কাছে এই জুতা! গোয়েন্দারা তাকে ধরে থানায় দিয়ে দিল।
পরিচয় জেনে পুলিশ ফরেস্টার সাহেবের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বললেন, ‘এই নামে আমার অফিসে কেউ চাকরি করে না, দেখেন হয়তো মামলা-টামলা থাকতে পারে।’ পুলিশ লোকটার নামে মামলা খুঁজে পেল।
লোকটার বউ দ্বিতীয়বার ফরেস্টার সাহেবের কাছে গেল। ফরেস্টার সাহেব সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘চিন্তা কোরো না। আমি তো আছি।’
ফরেস্টার সাহেবের সাথে লোকটার বউ জীবনে প্রথমবারের মতো রাঙামাটি শহরে এল। স্বামীর সাথে সাক্ষাতের আশায় সারা দিন ডিসি অফিসের এখানে-ওখানে ঘুরে শেষে সন্ধ্যায় অনুমতি পেয়ে ভিজিটিং আওয়ারের শেষ মুহূর্তে জেলখানায় গেল স্বামীর সাথে দেখা করতে। জেলখানা থেকে বেরিয়ে দেখে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ফরেস্টার সাহেব তাঁর ব্যাগ থেকে বের করে দিলেন একটা কালো বোরকা, ‘এটা পরে নাও। গাড়ি বন্ধ হয়ে গেছে, বাড়ি ফিরতে পারব না, রাতটা হোটেলেই থাকতে হবে।’
লোকটার বউ একটু থমকে গেল। মনের যে অংশ ফরেস্টার সাহেবের প্রতি সদয় সে অংশ বলে, ঠিক আছে। যে অংশ স্বামী, পরিবার, সমাজ আর ধর্মের প্রতি সদয় সে অংশ বলে, না-না-না। শেষে ‘আমি পরিস্থিতির শিকার, আর কোনো উপায় ছিল না’—এই যুক্তি দিয়ে তার মনের দ্বিতীয় অংশটা আত্মহত্যা করল। সে বোরকাটা পরে নিল।
সেদিন থেকে তার বউয়ের জীবনযাত্রা বদলে গেল। স্বামী জেলে গিয়েই যেন প্রাচুর্যের দেবী এত দিনে তার ঘরে পা দিল। এখন সে আর মাথায় কাঠের বোঝা নিয়ে বাজারে যায় না। ফরেস্টার সাহেব বললেন, যত দিন স্বামী ছাড়া না পায় তত দিন সব দায়দায়িত্ব তাঁর।
শুধু গ্রামবাসী দেখল, মাঝেমধ্যে স্বামীর সাথে দেখা করা বা উকিলের সাথে কথা বলার জন্য তার স্ত্রীর রাঙামাটি শহরে যাওয়া-আসা।
বছর খানেক পরে ফরেস্টার সাহেব বদলি হওয়ার দুই দিন বাদে গ্রামবাসী আবিষ্কার করল, লোকটার বউ রাঙামাটি গিয়ে আর ফিরে আসেনি এবং এই সংবাদ তারা লোকটাকে জানাল পনেরো বছর পর সাধারণ ক্ষমার আওতায় মুক্তি পাওয়ার দিন।
আমরা অবাক হয়ে বললাম, ‘কী সাংঘাতিক! জীবন থেকে পনেরো বছর হারিয়ে গেল!’
: শুধু কি পনেরো বছর? সব! সব!—তাকে একটু উত্তেজিত মনে হলো।
: কী অপরাধ ছিল তার?
সে মুচকি হাসল। আমরা কেবল তার মুখের ভেতরে লুকানো হাসির গভীরে ‘হুম’ শব্দ শুনলাম।
: হাগু করে পরিষ্কার হওয়ার জন্য সেগুনপাতা ছিঁড়লে একজন ফরেস্ট গার্ড তা দেখে ফেলেছিল।
: শুধু এ জন্য?
: হ্যাঁ।
: তুমি কি লোকটাকে চেন?
: আগে চিনতাম না, এখন চিনি।
: সে কি বেঁচে আছে?
: হ্যাঁ, অর্ধেক।
: নাম কী?
: চিংহলা মং।
আমাদের আর কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করতে না দিয়ে অনেকটা তাড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে দারোয়ান বলল, ‘যান, এবার ঘুমাতে যান।’
বাধ্য ছেলের মতো চলে এলাম রুমে। তখনই মনে পড়ল, আরে, নাইট গার্ডের নামও তো চিংহলা মং।

বেরিয়ে এসে দেখি কেউ নেই। কেবল চুরুটের কিছু ছাই পড়ে আছে। ডিউটি ফেলে লোকটা কোথায় গেল?