চার বয়ানে একাত্তরের স্মৃতি

>

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আছে নানা স্মৃতিকথা ও ভাষ্য। বাংলাদেশসহ চার দেশের চারটি বই ভিন্ন প্রেক্ষাপটে তুলে ধরেছে মুক্তিযুদ্ধের কথা

বাঙালি একটি ভাষাভিত্তিক জাতিসত্তা। এই ভাষার বয়স আর এ জাতির বয়স সমান বলা চলে। কিন্তু বাঙালি একটা জাতিরাষ্ট্র পেল ১৯৭১ সালে। একাত্তরকে এড়িয়ে গিয়ে বা খাটো করে আমরা আমাদের ইতিহাস আলোচনা করতে পারি না। একাত্তর জড়িয়ে আছে আমাদের ইতিহাসে, চেতনায় এবং জীবনের প্রাত্যহিকতায়।

একাত্তরে এ দেশে একটা বড় যুদ্ধ হয়েছিল। এটা ছিল বাঙালির স্বাধীনতার লড়াই। যুদ্ধটা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যাঁরা পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থাটি টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন, তাঁরাই ছিলেন এই যুদ্ধে বাঙালির প্রতিপক্ষ।

একাত্তর এখনো আমাদের অনেকের স্মৃতিতে উজ্জ্বল। সময়টা আমাদের নানাজনের কাছে ধরা দিয়েছে নানাভাবে। আমাদের সাহিত্যে, গবেষণায় এবং নানা শিল্পমাধ্যমে আমরা নানাভাবে একাত্তরকে পাই। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বহুমাত্রিক চরিত্রের কারণেই নানাভাবে সময়টাকে দেখা যায়, ব্যবচ্ছেদ করা যায়।

এখানে আমি নানাজনের স্মৃতিকথায় উঠে আসা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটা প্রারম্ভিক আলোচনা করতে চাই। অনেকেই এই সময়টা নিয়ে লিখেছেন। আবার অনেকের লেখায় বড় ক্যানভাস থাকলেও একাত্তর এসেছে তার অংশ হিসেবে। আজকের লেখাটি আমি স্মৃতিকথায় আবদ্ধ রাখতে চাই। অর্থাৎ যাঁদের লেখায় একাত্তরের স্মৃতি উঠে এসেছে, আমি সেগুলো থেকেই চারটি বই বেছে নিয়েছি। বইয়ের সংখ্যা ও বই নির্বাচনটি নিতান্তই আমার ইচ্ছাকৃত। কোনো অকাট্য যুক্তি নেই, এটা দৈবচয়নও নয়।

তারপরও কথা থাকে। দুটো বিষয় আমি ভেবেছি। প্রথমত, লেখাগুলোতে একাত্তর কতটা নির্মোহভাবে উঠে এসেছে তা দেখা। দ্বিতীয়ত, লেখাগুলোর পরিপ্রেক্ষিত হতে হবে আলাদা। স্মৃতিকথা হলেই যে মনগড়া কাহিনির বয়ান থাকতে হবে, তা নয়। আমি বুঝে-শুনেই যে চারটি বইয়ের আলোচনা করতে চাইছি, তার লেখকেরা চারটি ভিন্ন দেশের নাগরিক। তাঁদের লেখার এবং যুক্তির প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এই চারটি স্মৃতিনির্ভর বইয়ে একাত্তরের আগুনঝরা দিনগুলোর কিছু বর্ণনা পাওয়া যায়, যাতে তথ্য আছে, আছে তথ্যমূল্য। সর্বোপরি চিন্তার খোরাক।

দুই.

মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকের একটা ছবি আঁকার চেষ্টা হয়েছে উপধারা একাত্তর: মার্চ-এপ্রিল-এ। বইয়ের নামকরণ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। এটা যদি উপধারা হয়, তাহলে মূলধারা কোনটি? এখানে বলে রাখা দরকার, মঈদুল হাসান অনেক আগেই মূলধারা ’৭১ নামে একটা বই লিখেছিলেন। আমার বিবেচনায় এ দেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যেসব গবেষণা হয়েছে, মূলধারা ’৭১-কে তার পথিকৃৎ বলা যায়। উপধারা একাত্তর বইটিকে মূলধারা ’৭১ বইয়ের সঙ্গে মিলিয়ে পড়লে পরিপ্রেক্ষিতটা বুঝতে সহজ হয়। আগের বইটি নিঃসন্দেহে একটি গবেষণাগ্রন্থ। কিন্তু উপধারা একাত্তর হলো স্মৃতিকথা। আমি কীভাবে লুকিয়ে থাকলাম, কেমন করে প্রাণটা হাতে নিয়ে আগরতলা পৌঁছালাম এবং না খেয়ে, না ঘুমিয়ে কত কষ্ট করে সময়টা পার করে যুদ্ধশেষে দেশে ফিরে এলাম। এটা তাঁর একঘেয়ে বয়ান না। এই বইয়ে লেখক মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নের নানা দিক তুলে ধরেছেন, যা ওই সময়ের টালমাটাল সময়টাকে বোঝাতে সাহায্য করে। তিনি নিজেই নানা ঘটনায় এবং প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে গিয়েছিলেন। ফলে তিনি তাঁর চোখ দিয়ে যা দেখেছেন এবং মন দিয়ে যা বুঝেছেন, তা-ই পাঠকের সামনে পরিবেশন করেছেন। এ রকম অভিজ্ঞতার বয়ান আছে অনেক। কেউ লেখেন কেউ লেখেন না। মঈদুল হাসান লিখেছেন। স্মৃতিকথা হলেও এতে ইতিহাসের উপাদান আছে।

একটা বিষয় উল্লেখ না করেই পারছি না। আমাদের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রধান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান নিছক মেঠো রাজনীতিবিদ ছিলেন না। শুধু বাঁশের লাঠি আর মশাল মিছিল করে যে দেশ স্বাধীন করা যাবে না, এটা তিনি জানতেন। তিনি আলোচনার মাধ্যমে একটা মীমাংসা চেয়েছিলেন, যেন অযথা রক্তপাত এড়ানো যায়। এ জন্য তিনি অনেকের সঙ্গেই ব্যক্তিগত পর্যায়ে যোগাযোগ রাখতেন। তিনি জানতেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আনুকূল্য পাওয়া বা না-পাওয়ার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করে। সে জন্য তিনি ঢাকায় মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাডের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন তাঁর আস্থাভাজন মার্কিন তেল কোম্পানির এসো-এর জেনারেল ম্যানেজার আলমগীর রহমানের মাধ্যমে। তিনি তাঁর কোনো রাজনৈতিক সহকর্মী বা ক্যাডারকে ওই দায়িত্ব দেননি। কাকে দিয়ে কী করানো যায়, এটা তিনি বুঝতেন। মঈদুল হাসান খুব সংক্ষেপে হলেও বিষয়টি তাঁর স্মৃতিকথায় এনেছেন।

মঈদুল হাসান সাংবাদিকতা করতেন এবং কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ফলে তাঁর পক্ষে সমমনা ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের অনেকের সঙ্গেই দিল্লিতে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে শিক্ষাবিদ, রাজনীতিক এবং আমলা—সবাই ছিলেন। একটা পর্যায়ে অন্যতম পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতের দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্য আমূল পাল্টে যায়। তাঁর স্মৃতিকথায় এই প্রেক্ষাপটটা কিঞ্চিৎ উঠে এসেছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে বুঝতে বইটি সাহায্য করবে।

তিন.

ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের একটা কনস্যুলেট বা উপদূতাবাস ছিল। ১৯৬০ সালের জুনে ডেপুটি প্রিন্সিপাল অফিসার হিসেবে মার্কিন কনস্যুলেটে নিয়োগ পান আর্চার কেন্ট ব্লাড। ঢাকা শহর তখন খুবই ছোট। ঢাকাকে তিনি ভালোবেসেছিলেন। ১৯৭০ সালের মার্চে তিনি আবার এলেন ঢাকায়। এবার তিনি কনসাল জেনারেল, কনস্যুলেটের প্রধান কর্মকর্তা। তাঁর চোখের সামনেই ঢাকার চালচিত্র বদলে যেতে থাকল। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয় দেখলেন। তারপর উত্তাল মার্চ। বাংলাদেশ স্বাধীনতার যুদ্ধের প্রতিরোধ পর্বে প্রবেশ করল। এসব কথা বিস্তারিতভাবে লিখেছেন তিনি তাঁর আত্মস্মৃতি দ্য ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ: মেনোয়ার্স অব অ্যান আমেরিকান ডিপ্লোম্যাট বইয়ে। বইয়ের ভূমিকায় তিনি একটি মাত্র বাক্যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের নির্যাসটুকু ফুটিয়ে তুলেছেন: ট্রান্সফরমেশন অব আ সিমিংলি ফোরলোর্ন ড্রিম ইন টু আ ব্রাইট শাইনিং রিয়েলিটি।

২৫ মার্চের পাকিস্তানি সামরিক অভিযান এবং গণহত্যা আর্চার ব্লাড দেখেছেন চোখের সামনে। মানুষ তখন দিশেহারা। যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে। তাঁর অনুমান, ২৫ মার্চের পরপর সামরিক অভিযানে চার থেকে ছয় হাজার মানুষ নিহত হয়েছিল ঢাকায়। তিনি এটা সহ্য করতে পারেননি। ২৭ মার্চ তিনি ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে ‘সিলেকটিভ জেনোসাইড’ শিরোনামে একটা তারবার্তা পাঠান। তারবার্তায় তিনি পাকিস্তানি সৈন্যদের নির্বিচার গণহত্যার কথা উল্লেখ করেন। মার্কিন রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন পাকিস্তানি সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের পক্ষ নিয়েছিলেন। আর্চার ব্লাডের তারবার্তা ছিল তাঁর দেশের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। জবাবে তিনি পেয়েছিলেন শুধুই নীরবতা। এবার তিনি অন্য পথ ধরলেন। কনস্যুলেটর অন্যান্য কূটনীতিকসহ মার্কিন সাহায্য সংস্থা এবং তথ্য বিভাগের ২০ জন কর্মকর্তার স্বাক্ষরসহ তিনি ওয়াশিংটন ছাড়াও ইসলামাবাদ, করাচি ও লাহোরে মার্কিন দূতাবাসগুলোতে আরেকটি তারবার্তা পাঠান। এই বার্তার শিরোনাম ছিল ‘ভিসেন্ট ফ্রম ইউএস পলিসি টুওয়ার্ড ইস্ট পাকিস্তান’। বার্তার ছত্রে ছত্রে ছিল মার্কিন সরকারের ‘পূর্ব পাকিস্তান নীতির’ কড়া সমালোচনা। এটাই পরে ‘ব্লাড টেলিগ্রাম’ নামে পরিচিতি পায়। ব্লাড টেলিগ্রাম ছিল মার্কিন নীতির বিরুদ্ধে মার্কিন বিবেকের আহাজারি। আর্চার ব্লাডকে এর মূল্য দিতে হয়েছিল। তিনি ঢাকা কনস্যুলেট থেকে অপসারিত হন এবং নিক্সন প্রশাসনের সময় ওয়াশিংটনেও তাঁর জায়গা হয়নি। আর্চার ব্লাডের বইয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ উঠে এসেছে এমন একজনের বয়ানে, যিনি নিজেই ছিলেন মার্কিন বর্বরতার শিকার।

চার.

মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরেই জড়িয়ে পড়েছিল ভারত। আওয়ামী লীগ নেতাদের ভারতে আশ্রয় নিয়ে সরকার গঠন করা, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যদের পক্ষত্যাগ করে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক দপ্তর স্থাপন ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং লাখ লাখ উদ্বাস্তুর সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার কারণে ভারতের পক্ষে নিশ্চুপ বসে থাকার উপায় ছিল না। ওই সময় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব জ্যোতিন্দ্রনাথ দীক্ষিত (জে এন দীক্ষিত) জাতিসংঘ-সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর দেখভাল করতেন। একাত্তরের জুন মাসের শেষ দিকে ‘পূর্ব পাকিস্তানসংকট’ মোকাবিলা করার জন্য ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নতুন একটা ইউনিট চালু করা হলে দীক্ষিতকে ওই ইউনিটের পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। দীক্ষিত তাঁর কাজের জন্য ভারত সরকারের পলিসি প্ল্যানিং কমিটির চেয়ারম্যান দুর্গা প্রসাদ ধর এবং পররাষ্ট্রসচিব টি এন কাউলের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করতেন। এক অর্থে বলা যায়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টা ধরে তিনি ‘বাংলাদেশ ডেস্ক’ দেখাশোনা করেছেন। ফলে মুক্তিযুদ্ধকে তিনি দেখেছেন খুব কাছে থেকে। এসব কথা তিনি লিখেছেন তাঁর স্মৃতিকথা লিবারেশন অ্যান্ড বিয়ন্ড ইন্দো-বাংলাদেশ রিলেশন্স বইয়ে। দীক্ষিতই মধ্যম পর্যায়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় আমলাদের একজন, যিনি বাংলাদেশের জন্মলগ্নের নানা বিষয়ের প্রাথমিক পর্যবেক্ষক এবং এই যুদ্ধের অন্যতম পক্ষ ভারত সরকারের রাজনৈতিক-প্রশাসনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও কার্যক্রমের একজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা বোঝার জন্য দীক্ষিতের বইটি মোটেও হেলাফেলা করা যায় না।

দীক্ষিতের ভাষ্য থেকে বোঝা যায়, ওই সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর চারপাশে পাঁচজন আমলার একটা বলয় তৈরি হয়েছিল, যাঁরা নীতিনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তাঁরা হলেন ডি পি ধর, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব পি এন হাকসার, পররাষ্ট্রসচিব টি এন কাউল, প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের সচিব পি এন ধর এবং সচিব ও গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইংয়ের (র) পরিচালক আর এন কাও। মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে সরদার শরণ সিং, ওয়াই বি চ্যাবন ও জগজীবন রাম ছিলেন বাংলাদেশ প্রশ্নে ইন্দিরা গান্ধীর ডান হাত।

বাংলাদেশ যুদ্ধে একপর্যায়ে ভারতের সরাসরি অংশগ্রহণের পটভূমিও তুলে ধরেছেন দীক্ষিত। বাংলাদেশ নিয়ে তাঁর শুধু নিছক প্রশাসনিক দায়িত্ব ছিল না, অপরিসীম আবেগও ছিল। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে তিনি ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন গড়ে তুলতে উদ্যোগী হন এবং ডেপুটি হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বুঝতে হলে এবং ওই সময়ের ভারতীয় মনস্তত্ত্বকে ছুঁতে হলে তাঁর বইটি পাঠ করা কর্তব্য বলেই মনে করি।

পাঁচ.

একাত্তরে এ অঞ্চলে যে পালাবদলের ঝোড়ো হাওয়া বয়ে গেল, তার অনিবার্য পরিণতিতে জন্ম হলো স্বাধীন বাংলাদেশের। এই পালাবদলের তিন প্রধান অনুঘটক ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান, পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং সেনাবাহিনীর প্রধান ও প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান। চূড়ান্ত বিশ্লেষণে রাষ্ট্রক্ষমতাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয় রাজনীতি। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ ও পিপলস পার্টির মধ্যে সমঝোতার সম্ভাবনা ছিল অমাবস্যার চাঁদের মতোই কষ্টকল্পিত। ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউন ছিল তারই অনিবার্য পরিণতি।

একাত্তরের মার্চ মাসজুড়েই ছিল অনিশ্চয়তা, উত্তেজনা আর ঝড়ের পূর্বাভাস। একদিকে ছিল পাকিস্তানের নাম-নিশানা মুছে ফেলে সাত কোটি মানুষের স্বাধীন জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা, অন্যদিকে ছিল রাজনৈতিক নেতৃত্বের আলোচনার মাধ্যমে রক্তপাত এড়িয়ে লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা। উল্লিখিত তিন প্রধান চরিত্রের একজন ভুট্টোর লিখিত বয়ানে ওই সময়ের একটা ছবি ফুটে উঠেছে। একাত্তরের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত তাঁর বই দ্য গ্রেট ট্র্যাজেডিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহর এবং পাকিস্তানের বিভাজনের প্রক্রিয়াটির একটা পরিপ্রেক্ষিত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ভুট্টোকে বাংলাদেশের জন্মপ্রক্রিয়ায় একজন খলনায়ক হিসেবেই দেখা হয়ে থাকে। ওই সময়ে পাকিস্তানি মনস্তত্ত্বের একটা ধারণা পাওয়া যায় ভুট্টোর বইয়ে।

মুজিব ও ভুট্টো দুজনই তত দিনে বুঝে গেছেন, পাকিস্তান ভাঙছে। কিন্তু এই ভাঙার দায় নিতে চাইছেন না কেউ। ভুট্টো কিন্তু শেখ মুজিবের অবস্থান ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন। বাংলাদেশে মুজিববিরোধীরা শেখ মুজিবকে যতই আপসকামী হিসেবে ছোট করার চেষ্টা করুক না কেন, ভুট্টো ঠিকই বুঝেছিলেন যে ছয় দফার মাধ্যমে মুজিব চেয়েছিলেন ‘সাংবিধানিক বিচ্ছিন্নতা’। ভুট্টো এই প্রক্রিয়ায় সায় দিতে চাননি বলে তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেছেন। একাত্তরের জানুয়ারিতে ঢাকায় তাঁদের সাক্ষাতের প্রসঙ্গে ভুট্টো লিখেছেন, ‘তাঁকে (মুজিব) আমার মনে হলো অসম্ভব বিনয়ী। যেসব বিষয়ে তাঁর স্পষ্ট ধারণা আছে, সে বিষয়ে তিনি সোজাসাপ্টা কথা বলেন এবং যুক্তি দিয়েই। এবং কোনো বিষয় না জানা থাকলে তিনি সেটা নিয়ে আলোচনা দীর্ঘায়িত করতেন না।’

মুজিবের সঙ্গে তাঁর ক্ষমতার দ্বন্দ্বের কথা তিনি পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন। তাঁর মতে, শেখ মুজিবের সঙ্গে তাঁর নীতিগত মতভেদ ছিল। ‘এটা ছিল ন্যায্যতার প্রশ্নে বিরোধ। মুজিবের কাছে ন্যায্যতা হলো বাংলার স্বাধীনতা আর আমার কাছে তা হলো পাকিস্তান টিকিয়ে রাখা। তিনি মনে করতেন, ছয় দফা হলো জনগণের সম্পত্তি। কিন্তু আমি মনে করি, জনগণের সম্পত্তি হলো পাকিস্তান।’ শেষমেশ ভুট্টো বলেছেন, ২৬ মার্চ সকালেই মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দিতেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। শেখ মুজিবের অবস্থান বোঝার জন্য তাঁর প্রতিপক্ষ কী ভাবছেন, তা আমলে নেওয়ার প্রয়োজন আছে বৈকি। মুজিবকে ভুট্টো ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন। অথচ মুজিবকে ভুল বুঝেছিলেন বাংলাদেশেরই একদল রাজনীতিক, যাঁরা ছিলেন তাঁর বিরোধী এবং তাঁর প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ।