চির উন্নত শির তুর্কি দৃষ্টান্ত

প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল
প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

নজরুলকে যদি একক কোনো অভিধায় চিহ্নিত করতে হয়, তাহলে নিশ্চয়ই তাঁকে বলতে হবে ‘উন্নত, চির উন্নত শির’। ‘বিদ্রোহী’র শুরুতেই কবি বলছেন: ‘বল বীর—/বল উন্নত মম শির!’ নতজানু না হওয়ার অনমনীয় দৃঢ়তার নামই কাজী নজরুল ইসলাম। ঔপনিবেশিক ভারত ও বাংলায় যিনি জন্মগ্রহণ করেছেন এবং দুটি বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে যাঁর আবির্ভাব ও বিকাশ, তিনি সেই বাস্তবতাকে এমনভাবে আত্মস্থ করেছেন যে তা তাঁকে একই সঙ্গে স্বদেশের মৃত্তিকায় গভীরভাবে প্রোথিত ও আন্তর্জাতিক চেতনায় ঋদ্ধ করেছে। এ ক্ষেত্রে তুরস্ক, তার প্রজাতন্ত্রে রূপান্তর এবং কামাল পাশা—এই ত্রয়ী উপাদান কবির কাব্য ও সাহিত্যরচনা, তাঁর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চর্চা এবং উপলব্ধিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তিনি যেমন ‘কামাল পাশা’ বা ‘আনোয়ার’-এর মতো কবিতা লিখেছেন, তেমনি লিখেছেন ‘কামাল’-এর মতো প্রবন্ধ। লিখেছেন ‘তুর্ক মহিলার ঘোমটা খোলা।’পৌরুষ ও দার্ঢ্যের যোগফল কামাল পাশাকে কবির কাছে মনে হয়েছে ‘একটা ছেলের মতো বেটাছেলে।’ কাপুরুষতা ও ভিরুতা দিয়ে ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের শৃঙ্খলমুক্ত করা যে সম্ভব নয়, সেটা কবি ভালোভাবেই জানতেন। বিশ্বের যেদিকেই তাকান ‘মাদিই দেখি’ বাস্তবতায় ‘মদ্দা পুরুষ’ কামাল যখন তাঁর ‘বিশ্বত্রাস মহা তরবারি’ নিয়ে সামাল সামাল করে ‘রোজ কেয়ামতের ঝঙ্কার, রুদ্রের মহারোষের মত’ এসে হাজির হন, নজরুলের তখন তাঁকে স্বাগত না জানিয়ে উপায় থাকে না। বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকের শুরুতে নজরুল যেমন ‘বিদ্রোহী’ লিখে বাংলা সাহিত্যে নতুন যুগের সূচনা করেন, তেমনি কামাল পাশাও তুরস্কে তাঁর ঝড়ের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে নিজের দেশের বাস্তব ও মনোজাগতিক পরিবর্তনে এক প্রবল অভিঘাতের সৃষ্টি করেন। নজরুলের মনে হয়, এ হচ্ছে বাপের সেই সুপুত্তুর ছেলে, ইংরেজের অধীনে নির্যাতিত ভারতবর্ষের জন্য যে খুবই প্রাসঙ্গিক: ‘ইচ্ছে করছে খুশির চোটে তার পায়ের কাছে বসে পড়ে নিজের বুকে নিজেই খঞ্জর বসিয়ে দিই।’ ‘আল্লার আরশ কাঁপাতে হলে হাইদরি হাঁক চাই, মারের চোটে স্রষ্টারও পিলে চমকিয়ে দেওয়া চাই,’—‘ইসলামের বিশেষত্ব তলোয়ার।’ কবির মনে হয়, স্কন্ধে হল নিয়ে বলরাম বেরিয়ে পড়েছেন। কামাল যেন ‘বিদ্রোহী’তে উল্লিখিত সেই ভৃগু—যে ভগবান বুকে পদচিহ্ন এঁকে দিতেও দ্বিধা করে না।

ফলে তুরস্কে কামালের আবির্ভাব ভারতবর্ষকেও আন্দোলিত করে, যার প্রধান নকিব অথবা তূর্যবাদক হয়ে ওঠেন নজরুল। সে কারণে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ অগ্নিবীণায় ‘বিদ্রোহী’র সঙ্গে ‘কামাল পাশা’ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কবিতা হয়ে ওঠে। ‘কামাল পাশা’য় কবি বলেন: ‘সাব্বাস ভাই! সাব্বাস দিই, সাব্বাস তোর সমসেরে।/পাঠিয়ে দিলে দুশমন সব যম-ঘর একদম সে রে।/বল দেখি ভাই, বল হ্যাঁরে/দুনিয়ায় কে ডর করে না তুর্কির তেজ তলোয়ারে!’

কিন্তু এর অধিকতর তাৎপর্য অন্যত্র, যেখানে ঔপনিবেশিক স্বদেশে তার বিরুদ্ধে লড়ার অন্যতম প্রধান প্রেরণা তুর্কি পরিবর্তন ও তার নেতা। কবিতার দুটি অংশে তা খুবই সোচ্চার ও আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক: ‘পরের মুলুক লুট করে খায়, ডাকাত তারা ডাকাত।/তাদের তরে বরাদ্দ ভাই, আঘাত শুধু আঘাত।/আজাদ মুলুক বন্দী করে, অধীন করে স্বাধীন দেশ,/কুল মুলুকের কুষ্টি করে জোর দেখালে কদিন বেশ/মোদের হাতে তুর্কি নাচন নাচলে তাধিন তাধিন শেষ!’

‘সত্যবাণী’ প্রবন্ধে তিনি যেমন ‘নব্য তুর্কি তরুণদের দেখে’ তার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করার কথা বলেছেন, বলেছেন ‘মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন’-এর দীক্ষা নিতে, সেই প্রেরণাই যেন তাঁর কবিতায় ভাষা পেয়েছে, ‘থাকলে স্বাধীন সবাই আছি, নেই তো নাই, নেই তো নাই।/এই তো চাই!!’

তাই তিনি এ প্রবন্ধে কঠোর মানদণ্ড নির্ধারণ করে বলেছেন, ‘যদিও তুমি সর্বস্বহারা হও, কোথাও তোমার মাথা গুঁজিবার ঠাঁই না থাকে, কুছ পরোয়া নেই, তোমার মাথা নত করিও না।’

দেশ যখন স্বাধীন নয়, অত্যাচারীর হাতে বন্দী; তখন ‘ধূমকেতু’তে কবি যেমন বলেছেন, নরককে ফুঁ দিয়ে নেভাতে ও মৃত্যুর মুখে থুতু দিতে হবে—তেমনি বিধি ও বিধানে লাথি মেরে বিধাতার বুকে হাতুড়ি চালাতেও বাধা নেই। পরাধীনতার জ্বালায় সত্য কবির পক্ষেই তাই বলা সম্ভব: ‘আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুনঃ মহাবিপ্লব হেতু—ওই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু।’

তুর্কি বিপ্লব ও কামালের মধ্যে নজরুল সেই উদাহরণ খুঁজে পেয়েছিলেন। সে কারণে ‘ভাববার কথা’য় তিনি মায়ের ‘ভুবনেশ্বরী মূর্তি’ নয়, তার ‘মৃত্যুরূপা কালী’ রূপ দর্শন করেছেন। এ জন্য ‘ধূমকেতুর আদি-উদয় স্মৃতি’তে তিনি এর অকল্যাণকেই প্রধান করে তুলেছেন, “ধূমকেতু” তাহাদের বাণী লইয়া আসিয়াছিল—যাহাদের গৃহী আশ্রয় দিতে ভয় পায়, গ্রহণ বলে ব্যাঘ্র যাহাদের পথ দেখায়, ফণি তাহার মণি জ্বালাইয়া যাহাদের পথের দিশারী হয়, পিতামাতার স্নেহ যাহাদের দেখিয়া ভয়ে তুহিন-শীতল হইয়া যায়।’ স্বাধীন হওয়ার জন্য কঠিনের এই সাধনা ছাড়া কোনো পথ নেই। আর যিনি নিজে স্বাধীন নন, তার পক্ষে অন্যকে কিংবা জাতিকে স্বাধীন করা সম্ভব নয়। ঔপনিবেশিক দেশে তো নয়ই, ‘স্বাধীন’ দেশেও নয়, যেখানে উপনিবেশের নানা শৃঙ্খল অথবা লক্ষণ সক্রিয় অথবা প্রচ্ছন্ন রয়েছে।

২.

কামাল আতাতুর্কের মৃত্যুর পর ১৩৪৫-এর ৬ অগ্রহায়ণ আনন্দবাজার পত্রিকায় তাঁর চরিত্রবৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে ওই নামাঙ্কিত প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ যা বলেছেন তাতে কামালের ভূমিকার অন্য অনন্যবৈশিষ্ট্যটি বোঝা যায়: ‘তুর্কিকে তিনি যে রাজনৈতিক স্বাধীনতা দিয়েছেন, সেইটেই সবচেয়ে বড় কথা নয়, তিনি তুর্কিকে তার অন্তর্নিহিত বিপন্নতা থেকে মুক্ত করেছেন। মুসলমান ধর্মের প্রচণ্ড আবেগের আবর্তের মধ্যে দাঁড়িয়ে ধর্মের অন্ধতাকে প্রবলভাবে তিনি অস্বীকার করেছেন। যে অন্ধতা ধর্মেরই সবচেয়ে বড় শত্রু, তাকে পরাভূত করে তিনি কী করে অক্ষত ছিলেন, আমরা আশ্চর্য হয়ে তাই ভাবি। তিনি যে বীরত্ব দেখিয়েছেন, সে বীরত্ব যুদ্ধক্ষেত্রে দুর্লভ। বুদ্ধির গৌরবে অন্ধতাকে দমন করা তাঁর সবচাইতে বড় মহত্ত্ব, বড় দৃষ্টান্ত।’ তিনি কখনো তাঁর ‘সংকল্পকে বিচলিত হতে দেন না।’ আমাদের ক্ষেত্রে তাঁর প্রাসঙ্গিকতাকে উল্লেখ করে কবি লিখেছেন, ‘তিনি যে কেবল তুর্কিকে শক্তি দিয়েছেন তা তো নয়, সেই শক্তিরথের চক্রঘর্ঘর ভারতবর্ষের ভূমিকেও কাঁপিয়ে তুলছেন।’ নজরুল যে বলেছেন ‘কামাল! তুনে কামাল কিয়া ভাই’ তা তিনি শুধু বাস্তবেই করেননি, বৌদ্ধিক ও মনোজগতেও কামাল করে দেখিয়েছেন।

এ ক্ষেত্রে একটা উদাহরণ দেওয়া যায়। তুরস্কে একবার একটি ভজনালয় নিয়ে সেটি গির্জা না মসজিদ, সে বিতর্ক দেখা দিলে কামাল আতাতুর্ক তাকে জাদুঘরে পরিণত করেন। রামমন্দির-বাবরি মসজিদকে রাজনৈতিক বা অন্যভাবে ব্যবহারের ভুল দৃষ্টান্ত থেকে বোঝা যায়, কামাল পাশা কতটা বাস্তবতাবোধসম্পন্ন পরিচ্ছন্ন দৃষ্টির অধিকারী ছিলেন।

এর মর্ম অনুসরণে নজরুল ‘উমর ফারুক’ কবিতায় যা লেখেন, তা থেকে বোঝা যায়, সামন্ত মানসিকতার অনেক ঊর্ধ্বে উঠে কবি এ ক্ষেত্রে কতটা স্বচ্ছ দৃষ্টির পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছিলেন: ‘সন্ধিপত্র স্বাক্ষর করি শত্রু-গির্জা ঘরে/বলিলে, “বাহিরে যাইতে হইবে, এবার নামাজ তরে।”/কহে পুরোহিত, “আমাদের এই আঙিনায় গির্জায়/পড়িলে নামাজ হবে না কবুল আল্লার দরগায়?”/ হাসিয়া বলিলে, “তার তরে নয়, আমি যদি হেথা আজ/নামাজ আদায় করি তবে কাল অন্ধ লোক-সমাজ/ ভাবিবে,—খলিফা করেছে ইশারা হেথায় নামাজ পড়ি/আজ হতে যেন এই গির্জারে মোরা মসজিদ করি। ইসলামের এ নহেক ধর্ম, নহে খোদার বিধান/কারু মন্দির-গির্জারে করে মজিদ মুসলমান।”’

৩.

রবীন্দ্রনাথ তাঁর পূর্বোক্ত প্রবন্ধে আরও বলেছিলেন, ‘এশিয়ার পাশ্চাত্যতম ভূখণ্ডে দেখলুম তুর্কি—যাকে য়ূরোপে Sick-man of Europe বলে অবজ্ঞা করত, সে কীরকম প্রবল শক্তিতে অসম্মানের বাঁধন ছিন্ন করে ফেলল।’ কিন্তু এ তো সহজে হওয়ার কথা নয়। ক্রুসেডের তিক্ত স্মৃতি ইউরোপ অথবা খ্রিষ্টান জগৎ খুব সহজে মেনে নেয়নি অথবা ভুলতে পারেনি। সে কারণে শেকসিপয়ার কিংবা আমাদের শওকত আলীর নাট্য অথবা উপন্যাসে এর স্বাক্ষর রয়েছে। শেকসিপয়ার ও শওকত আলী উভয়ই নেতিবাচক দিক থেকে নয়, বাস্তবতা হিসেবেই বিষয়টির উল্লেখ ও তার ব্যবহার করেছেন। তবু সত্য, পাশ্চাত্য দৃষ্টি ও তার উপনিবেশ। শেকসিপয়ারের ওথেলোয় ইয়াগো যে বলে—‘বিলিভ ইট, অর এলস আই অ্যাম এ টার্ক’ অথবা হ্যামলেট যে বলে—‘ইফ মাই ফরচুনস টার্ন টার্ক’—এই দুই দৃষ্টান্ত এবং শওকত আলীর প্রদোষে প্রাকৃতজন-এর চরিত্র যে বলে—‘এরা হচ্ছে তুর্ক, কখন যে তোমার বউটিকে তুলে নিয়ে যাবে, টেরও পাবে না’—তা থেকে ওই দৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায়।

নীরদচন্দ্র চৌধুরীর নজরুল-বিদ্বেষ তাঁর গুরু মোহিতলাল মজুমদারের সূত্রে ছিল যথেষ্ট দৃঢ়। কিন্তু তিনি যখন তাঁর বই দাই হ্যান্ড গ্রেট অ্যানার্ক! ইন্ডিয়া ১৯২১-১৯৫২-এর বর্ণনানুসারে কলকাতায় তাঁর ৪৯ নম্বর মির্জাপুর স্ট্রিটের বাসায় বসে কিছু লোকের কণ্ঠে ‘কামাল পাশা’ শুনে বিরক্ত বোধ করেন, তখন সাম্রাজ্যের প্রতি তাঁর দাস্য মনোভাবের সঙ্গে উপনিবেশের মোহ ও তার প্রতি তাঁর অতিভক্তিও টের পাওয়া যায়।

এই মনোভাব তাঁকে যেমন ১৯৭১-এ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের তোষামোদ করতে প্ররোচিত করেছে, তেমনি বিপরীতভাবে নিজে মূক হলেও নজরুলের রচনা মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় আমাদের ন্যায়ের যুদ্ধে অনুপ্রাণিত করেছে।

কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ভাষায় মূঢ়তা থেকে মুক্তির মন্ত্রে যে কামাল আতাতুর্কের মৃত্যুতে ছিল সমগ্র এশিয়ার শোক, বাংলাদেশের জন্মের চার দশক এবং নজরুলের মৃত্যুর তিন দশকের পর বেশ সময় পেরিয়ে আমরা কোথায় এসে পৌঁছেছি? এই জিজ্ঞাসার সৎ ও সঠিক জবাব দিতে না পারলে কোনো কবিই কি আমাদের ক্ষমা করবেন?