চেনা পৃথিবীর অচেনা রং

>

.
.

শ্রী শ্যামাচরণ কবিরাজ ভবন—আহমেদ মুনির, প্রচ্ছদ: শিবু কুমার শীল, প্রকাশক: বাতিঘর, চট্টগ্রাম, ১১৭ পৃষ্ঠা, দাম: ২২৫ টাকা।

‘মোহনলাল এই পাড়ায় থাকত। ১৭ বাই সি হলুদ চারতলা বিল্ডিংয়ের নিচতলায়। কিন্তু সে ব্যাপারে নিশ্চিত করে কেউ কিছু বলতে পারে না। এখন সোবহান সাহেবকে জিজ্ঞেস করলে তিনি কপাল কুঁচকে পাল্টা প্রশ্ন করেন, কোন মোহনলাল? ১৫ বছর ধরে এই বাড়িতে আমরাই থাকি। কই এমন নামে এখানে কেউ ছিল বলে শুনিনি তো।’

একধরনের অনিশ্চয়তার ভেতরে আহমেদ মুনিরের গল্প শুরু হয়। ‘গোলাপ ও মোহনলাল’ গল্পের শুরুতে এভাবেই অস্বীকার করা হয় মোহনলালের অস্তিত্ব। গল্পের অন্যতম চরিত্র রেশমাও পড়ে যায় দ্বিধায়। গল্প যত এগোয়, গল্পকারের হাতের জাদুতে অনিশ্চয়তা ক্রমেই নিশ্চয়তার দিকে যেতে চায়। গল্পকার নিজেই আবার সেই সম্ভাবনার দেয়াল ভেঙে দেন। বাস্তব-অবাস্তবের দেয়াল ভেঙে পড়ে পাঠকের সামনে। সৈয়দ শামসুল হকের রক্তগোলাপ-এর ফিরদাউসির অথবা চম্পার গল্পের মতো সাত শ ছিয়াশিটি গোলাপের বৃষ্টি হয় না, রক্তও ঝরে না; কিন্তু গল্পটি শেষ করে প্রশ্নাকুল হয় পাঠকের হৃদয়। মুনিরের গল্পগুলো প্রশ্নের মুখোমুখি করে আমাদের।

গল্প বলার শুরুতে মুনির যা করেন, তা হলো—চমকে দেন, একধরনের বিহ্বলতার মধ্যে নিয়ে যান পাঠককে। মাঝখানে গল্পটিকে তিনি এমনভাবে ছেড়ে দেন, যেন গল্পের কোনো গন্তব্য নেই। এরপর সেই ছেড়ে দেওয়া গল্পটি আবার নিপুণ শিল্পীর মতো করতলগত করেন। না, কোনো সরলরৈখিক গল্প বলেন না লেখক। তাঁর গল্পে বরং পাওয়া যায় বহুরৈখিক বাঁক। যেমন: সেখানে নিরেট বাস্তবতার পাশাপাশি রয়েছে জাদুবাস্তবতা, গল্পের ভেতরের গল্প, মানুষের আড়ালের গল্প—যা কখনো অস্বস্তিকরও হয়ে ওঠে।

বইয়ের নামগল্প ‘শ্রী শ্যামাচরণ কবিরাজ ভবন’ গল্পে দেখা যায় গল্পের মূল চরিত্র এমন একটি ভবনে যাতায়াত করে, যার বাস্তব কোনো অস্তিস্ত্ব নেই। ভবনের বাসিন্দা কবি শাহিদ আনোয়ার কিংবা হাফসার থাকা না-থাকা নিয়ে পাঠকের মনে সংশয় তৈরি হয়। তবে অন্য এই বাস্তবতাই যেন পাঠকের আরাধ্য হয়ে ওঠে, যেখানে শোনা যায় আঙুরবালার রেকর্ড। আর ক্রমেই আমরা টের পেতে থাকি সন্ধ্যামালতী কিংবা পুরোনো বইয়ের ঘ্রাণের মতো হাফসার গায়ের গন্ধ।

একাধিক গল্পে মুনির দেখিয়েছেন, নিজের সঙ্গে নিজের দেখা কিংবা কথা হওয়ার ব্যাপারটি। এমন নয় যে বিষয়টি নতুন। আগেও গল্প-কবিতায় ব্যবহৃত হয়েছে। এর বীজ নিহিত রয়েছে সুফিবাদে। শাহাদুজ্জামানের ‘মহাশূন্যে সাইকেল’ গল্পটিতেও আছে নিজের সঙ্গে নিজের কথোপকথন। কিন্তু একই বিষয়বস্তু নিয়ে লেখা মুনিরের ‘আমি সে ও সে’ নামের গল্পটি স্বকীয় আইডিয়া ও গল্পকথনের কারণে হয়ে উঠতে পেরেছে লেখকের নিজের গল্প।

আহেমদ মুনিরের গল্পে অসম্ভব বলে কিছু নেই। তাই হরিণের মাংস জড়ো হয়ে যখন সুন্দরী মেয়ের রূপ ধারণ করে, পাঠক অবাক হন না; বরং গোপন এক হাহাকারে সিক্ত হয়ে ওঠে তাদের হৃদয়।

লেখকের গল্পের চরিত্ররা সংবেদনশীল। সবকিছুর ভেতরে তাদের সংবেদনশীল মন গল্প বলার একটি ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেয়। ‘শিয়াল’ গল্পের উদহারণ দেওয়া যাক। এ গল্পের আবদুর রহমান শিয়াল হত্যার প্রতিবাদশেষে নিজেই একা হয়ে পড়েন, একা হয়ে যান তিনি। একসময় শত শত শিয়ালের ডাকে আর সাড়া না দিয়ে তিনি পারেন না। একটি গভীর প্রশ্নের সামনে শেষ হয় গল্পটি। আবার ‘যখন বৃষ্টি নামল’ কিংবা নিছক হাস্যরসের মাধ্যমে শুরু হওয়া ‘আত্মজা ও আর্জেন্টিনা’—এই দুই গল্পের যে পরিণতি—বিশেষত ‘আত্মজা ও আর্জেন্টিনা’য় মৃত্যুর সরল অথচ মর্মান্তিক আগমনে আমাদের মন সংগতভাবেই সিক্ত হয়ে ওঠে।

শেষে বলি, গল্প বলতে বলতে মুনির কী করেন। পাঠককে প্রশ্নাকুল করে তাদের সামনে তিনি মেলে ধরেন ভাবনার রাজ্য, ‘কোনো এক বোধ’। ‘বড় মাছটা তখনো তার বুকের ভেতর তড়পায়’—‘মাছের জ্বর’ গল্পের সজলের মতো এক অনুচ্চারিত বোধের সামনে পাঠক এসে উপস্থিত হন মুনিরের গোটা গল্পগ্রন্থটি পড়তে পড়তে। গল্পকারের ভাষাটি বড় কোমল, ক্লান্তি আসে না পাঠে। কিন্তু তাঁর গল্পগুলো একেবারে গড়গড় করে পড়ার গল্পও নয়; এগুলো ভাবাবে এবং নতুন এক বোধের সামনে এসে উপস্থিত করবে পাঠককে।