জন্মশতবর্ষে কামরুল হাসান: সেকালের হাতিয়ারে সমকালের বয়ান

‘পটুয়া’ নামে পরিচিত হতে ভালোবাসতেন তিনি। আজ ২ ডিসেম্বর সেই কিংবদন্তি চিত্রশিল্পী কামরুল হাসানের জন্মশতবর্ষ। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমাদের আয়োজন।

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের পরই আমাদের চিত্রশিল্পজগতে সবচেয়ে খ্যাতিমান শিল্পী কামরুল হাসান। এটি কৌতূহলোদ্দীপক যে আমাদের অগ্রণী দুই শিল্পীর প্রধান পরিচিতি তাঁদের রেখার শক্তিমানতার কারণে। যদিও কামরুল হাসানের পরিচিতি আরও ব্যাপকতা পেয়েছে সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রায় সব কর্মকাণ্ডে তাঁর সক্রিয় সম্পৃক্ততার কারণে। জীবনের প্রথম পর্যায়ে গুরুসদয় দত্ত প্রতিষ্ঠিত ব্রতচারী আন্দোলনের সদস্য, মুকুল ফৌজের সর্বাধিনায়ক, পুরস্কারজয়ী শরীরচর্চাবিদ ইত্যাদি পরিচয় শিল্পকলার বলয়ের বাইরেও তাঁর একটি অনুরাগী শ্রেণি সৃষ্টিতে সহায়তা করেছে। পরবর্তীকালে জীবন ধারণের তাগিদে তিনি শিল্পকলার শিক্ষক, জাতীয় নকশাকেন্দ্রের পরিচালক, রূপায়ণ নামের নিজস্ব শাড়ি বিপণন কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা, প্রচ্ছদশিল্পী, কার্টুন-আঁকিয়ে প্রভৃতি বিভিন্ন ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে এবং রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সব আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকায় থেকে সমাজ-জীবনের সঙ্গে অনেক ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত হয়েছেন। এই অগ্রগামিতাই কামরুল হাসানের অনন্যতা, বিশিষ্টতা এবং তাঁর শিল্পকর্মের পর্যালোচনায়ও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় বটে।

তাঁর চিত্রকর্মের আলোচনা এখানে আমরা ততটা করব না, বরং আমাদের শিরোনামের অর্থময়তাকে অধিক পরিস্ফুট করবে তাঁর রেখাচিত্র, সেটি মনে রেখে এ আলোচনা তাঁর রেখাচিত্রে সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করা হবে। কামরুল হাসান অবিরাম–অবিশ্রান্ত এঁকেছেন স্কেচ বা রেখাচিত্র পেনসিলে, কলমে, কাঠকয়লায়, তুলিতে, প্যাস্টেলে, ছোট-বড় কাগজে, কার্ডে, বোর্ডে, সিগারেটের প্যাকেটে, যখন হাতের কাছে যা পেয়েছেন, তাতে। রেখায় আঁকা এসব স্কেচ বা খসড়া শিল্পীরা সাধারণত করে থাকেন মূল শিল্পকর্মের পরিকল্পনা বা ধারণা নির্মাণের প্রয়োজনে। তবে কখনো কখনো কোনো কোনো শিল্পীর ক্ষেত্রে রেখায় ধরা এসব তাৎক্ষণিক সৃষ্টিই হয়ে ওঠে অধিক গুরুত্ববহ, তাৎপর্যপূর্ণ, এমনকি অধিকতর সৃজনশীল। কামরুল হাসানের বেলায়ও হয়তো আমরা এমন একটি তাৎপর্যের কথা ভাবতে পারি।

কামরুল হাসান (২ ডিসেম্বর ১৯২১-২ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮)। ছবি: সংগৃহীত

যামিনী রায়ের সম্যক প্রভাব স্বীকার করেই কামরুল হাসানের যাত্রা শুরু। প্রথম পর্বে যামিনী রায় ছাড়াও লোককারুশিল্পীর তৈরি মাটির পুতুলের গড়ন, কালীঘাট পট তাঁকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে। পঞ্চাশের দশকের শুরু থেকে তাঁর ছবিতে নারীদেহ পুতুলের মতো ভরাট, গ্রীবা অতিরঞ্জিতভাবে দীর্ঘ, চোখ-নাক লৌকিক আদলে রীতিবদ্ধ এবং পটজুড়ে নকশাধর্মী দ্বিমাত্রিকতা স্থান পেতে শুরু করে। ‘তিন কন্যা’, ‘গুনটানা’ এ রীতির কাজ। ষাটের দশক থেকে কামরুল হাসানের সৃষ্টিকর্ম পরিমাণে ও বৈচিত্র্যে বৃদ্ধি পেতে থাকে।

বিষয়বস্তুর দিক থেকেও কামরুল হাসান ক্রমশ পরিত্যাগ করছিলেন প্রথাবদ্ধ আদর্শ গ্রামীণ দৃশ্যপটকে, হয়ে উঠছিলেন অনেক বেশি সমসাময়িক, সমাজসচেতন ও উচ্চকণ্ঠ। স্বাধীনতা-পরবর্তী বিভিন্ন পর্যায়ে স্বপ্নভঙ্গ ও হতাশা তাঁর সৃজনকর্মে নানা প্রতীকে রূপায়িত হয়েছে, ঘুরে ঘুরে এসেছে প্যাঁচা, শেয়াল, কঙ্কালের ব্যবহার। কমনীয় ও সুখপ্রদ বিষয়ের চেয়ে কর্কশ ও ভয়াল বিষয়ে তাঁর পক্ষপাত বাড়তে থাকে। ‘চন্দ্রালোকে হতভাগ্য ঘোড়া’, ‘ইমেজ’, ‘শেয়াল’, ‘গণহত্যার পরে’ প্রভৃতি চিত্রে এর উদাহরণ দেখা যেতে পারে।
বলা যেতে পারে, কামরুল হাসানের রেখাচিত্র মোটামুটি তাঁর চিত্রভাবনার সমান্তরালেই বিকশিত হয়েছে। তবে যেমনটি আগে উল্লেখ করা হয়েছে, রেখাশিল্পে তাঁর শক্তিময়তা ও বৈচিত্র্যের নিদর্শন পাওয়া যাবে অনেক বেশি পরিমাণে। বস্তুতপক্ষে তাঁর সৃজনশীলতা সবচেয়ে স্ফূর্তি পেয়েছে তাঁর রেখাচিত্রে। রেখার বৈশিষ্ট্যে যেমন পটচিত্র ও লক্ষ্মীর সরার আদল পাওয়া যাবে, তেমনই নৈকট্য পাওয়া যাবে মাতিস কিংবা পিকাসোর। ছোট–বড় শত শত রেখাচিত্রে কামরুল হাসান বাংলার জনজীবন ও ঘটনাপ্রবাহের একটি রোজনামচা যেন লিপিবদ্ধ করেছেন। স্বতঃস্ফূর্ত খেলাচ্ছলে আঁকা এসব রেখাঙ্কনে এক দেশজ স্বকীয়তা কিন্তু বৈশ্বিক প্রাণময়তা যেন অনুভব করা যায়।

কামরুল হাসানের অবিশ্রাম রেখাঙ্কনের জোয়ার আসে ষাটের দশকে। এ সময়ের বিস্ফোরণোন্মুখ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তাঁকে অন্য যেকোনো শিল্পীর চেয়ে অধিক আলোড়িত করে এবং তাঁর চিত্রভাবনায়ও নিয়ে আসে ব্যাপক পরিবর্তন। ক্রমশই তাঁর রেখা হয়ে উঠতে থাকে তীক্ষ্ণ ও পরিমিত, প্রথম দিকের লীলায়িত ভাব কেটে গিয়ে রেখা ক্রমশ হয়েছে সংক্ষিপ্ত, কিন্তু অর্থবহ ও বক্তব্যবাহী। লোকশিল্পের শৈলীর ভাব বজায় রেখেও নানা নিরীক্ষায় নিজস্ব এক সংশ্লেষিত রূপ ক্রমশ অবয়ব পেতে শুরু করে। বিষয়বস্তুতে আসে ব্যাপক পরিবর্তন, কল্পজগৎ ছেড়ে সমকালের রূঢ় বাস্তবের প্রতিচ্ছবি দেখা দিতে শুরু করে। সরাসরি কথনের পরিবর্তে প্রতীকী রূপায়ণের ঝোঁক দেখা দেয়। উনসত্তরের গণ-আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে কামরুল হাসান অক্ষরবৃক্ষ, ব্রতচারী কর্মকাণ্ডে পুনরুজ্জীবন, পটুয়া পদবি ধারণ প্রভৃতি কার্যক্রম গ্রহণ করে গণ-অভ্যুত্থানে সামনের সারিতে অংশগ্রহণ করেন, যেটি চূড়ান্ত রূপ পায় মুক্তিযুদ্ধে তাঁর আঁকা পোস্টার ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’র ব্যাপক জনপ্রিয়তায়।

স্বাধীনতা-পরবর্তীকালের বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতে কামরুল হাসানের রেখাশিল্প সবচেয়ে বাঙ্‌ময় রূপ পরিগ্রহ করে। অতিরঞ্জন, প্রতীকায়ন, ফ্যান্টাসি, কৌতুক, পরিহাস, ধিক্কার—সব যেন মিশ্রিত হয়ে এক স্বতঃস্ফূর্ত নিজস্ব ভাষায় রচনা করেছে সমকালের আলেখ্য। প্রতীক নির্বাচনে তিনি শরণ নিয়েছেন বাংলার চিরায়ত লোকগল্পগাথার সব চরিত্রের—শেয়াল, প্যাঁচা, হাতি, কুমির, পাখি, ঘোড়া, মাছ, গরু, সাপ, শকুন ইত্যাদি।
কামরুল হাসানের চিত্রকর্ম ‘তিন কন্যা’

স্বাধীনতা-পরবর্তীকালের বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতে কামরুল হাসানের রেখাশিল্প সবচেয়ে বাঙ্‌ময় রূপ পরিগ্রহ করে। অতিরঞ্জন, প্রতীকায়ন, ফ্যান্টাসি, কৌতুক, পরিহাস, ধিক্কার—সব যেন মিশ্রিত হয়ে এক স্বতঃস্ফূর্ত নিজস্ব ভাষায় রচনা করেছে সমকালের আলেখ্য। প্রতীক নির্বাচনে তিনি শরণ নিয়েছেন বাংলার চিরায়ত লোকগল্পগাথার সব চরিত্রের—শেয়াল, প্যাঁচা, হাতি, কুমির, পাখি, ঘোড়া, মাছ, গরু, সাপ, শকুন ইত্যাদি। কখনো কখনো অতিরঞ্জন ছাপিয়ে কিম্ভূত অবয়বে পৌঁছে যায় কোনো কোনো প্রাণী, স্তনধারী পাখি বা দুই পায়ে দণ্ডায়মান ঘোড়ার ফ্যান্টাসি, যেন অবয়বহীন অসম্ভব এককালের রূপকল্প। সমকালের আর্তি ও সংক্ষোভকে প্রবলভাবে প্রকাশমান করবার জন্য রেখাঙ্কনের সব সম্ভাবনাকে যেন শিল্পী নিংড়ে ব্যবহার করেছেন। সূক্ষ্ম লীলায়িত রেখা থেকে সংক্ষিপ্ত ক্যালিগ্রাফিক রেখা, তুলির মোটা পোঁচের রেখা, ফুটকিফাটকায় ভঙ্গুর রেখা—নানাভাবে তিনি প্রকাশ করেছেন রেখার বাঙ্‌ময়তাকে। তবে সেকালের লোকচিত্রের কাণ্ডটিকে ঘিরেই ডালপালা বিস্তার করেছে কামরুল হাসানের চিত্রকর্মই বলি, কি রেখাচিত্রের সমকালীন রূপ বলি—তার অবয়ব। তাঁর পরবর্তী সব শিল্পপ্রয়াসও কি আসলে মূলত লোকচিত্রেরই রকমফের নয়?

নিরপেক্ষ সমতল পটে রেখার সামান্য সুদক্ষ আঁচড় সাদা বনাম কালো, অবয়ব বনাম শূন্যতা, ধনাত্মক বনাম ঋণাত্মক অনুভূতিসমূহের পাল্টাপাল্টি সংঘাতে যে তীব্র বোধের উদ্বোধন ঘটাতে পারে কামরুল হাসান, তা সঠিক বুঝেছিলেন। তাঁর তীক্ষ্ণ-তীব্র রেখার আঁচড় তাই কখনো লতিয়ে ওঠে ছন্দে, কখনো দুমড়েমুচড়ে পাক খেয়ে ফণা তুলে দাঁড়ায়, আবার কখনো হঠাৎ থমকে গিয়ে অবয়বের ডৌল ভেঙে দিয়ে দর্শককে অস্বস্তিতে রেখে দিয়ে যায়, কখনোবা শুভ্র–শূন্য পরিসরের বিপরীতে যেন তেড়ে আসে পুঞ্জিত কালোর জান্তব মুখব্যাদান। আমাদের সার্বিক অবক্ষয় ও বিপর্যয়ের তমসঘন কালে কামরুল হাসান তাঁর শাণিত রেখায় যেন লিখে রেখে গেছেন সেই ভাঙনের ইতিহাস।

কামরুল হাসানের রেখাচিত্র

তাঁর অগণন রেখাচিত্রের সম্ভার তাঁর ক্লান্তিহীন সচেতনতা ও শিল্পনির্মাণের রোজনামচা যেন। বস্তুত এসব রেখাচিত্রের মধ্যেই তাঁর সম্মুখবর্তী সম্ভাবনার একটি দিকনির্দেশনাও দৃষ্ট হয়। তাঁর শেষজীবনের রেখাচিত্র সংশ্লেষণ, অতিরঞ্জন, রূপান্তরকরণ ও কল্পনার ব্যবহারে এক নতুন মাত্রা অর্জন করতে যাচ্ছিল বলে ধারণা হয়। লোকচিত্রকলার দার্ঢ্য ও প্রাণবন্ত বলশালিতার এক সমকালীন প্রতিরূপ যেন দৃশ্যমান হতে চলছিল তাঁর সর্বশেষ পর্বের রেখাচিত্রগুলোতে, তাঁর জীবনব্যাপী শিল্পযাত্রার নির্যাস যেন স্বকীয় ভাস্বরতায় প্রকাশ হতে শুরু করেছিল। সেই সময় আকস্মিক ও অকালমৃত্যু এসে যবনিকা টেনে দিল সব প্রয়াসের ওপর। তা না হলে হয়তো আমরা কামরুল হাসানের হাত দিয়েই পেতে পারতাম রেখার সংকেতে রচিত অধিকতর প্রাসঙ্গিক সৃষ্টির সম্ভার।