জরুরি গবেষণা, প্রয়োজনীয় ইতিহাস

মুহম্মদ শাহজাহান মিয়া প্রধানত প্রাচীন ও মধ্যযুগের পাণ্ডুলিপি নিয়ে কাজ করেন। পাণ্ডুলিপির তত্ত্ব প্রণয়ন, পুরোনো গ্রন্থ ও দলিল-দস্তাবেজ সম্পাদনা এবং এসব উপকরণ ঘেঁটে ইতিহাসের সূত্র অনুসন্ধান—এই ক্রমে তাঁর গবেষণার এলাকা চিহ্নিত করা যায়। এ এলাকায় পঞ্চাশ থেকে আশির দশক পর্যন্ত যথেষ্ট কাজ হয়েছে। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে এ কাজে আগ্রহ-উদ্দীপনা বিশেষ দেখা যাচ্ছে না। প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগও নেই, আগ্রহী-কুশলী ব্যক্তিরও অভাব। শাহজাহান মিয়াকে এ ক্ষেত্রে প্রায় একমাত্র ব্যতিক্রম বলা যায়। বিদ্যাটা তিনি রপ্ত করেছেন নিপুণভাবে। বিরামহীন উদ্যমেরও পরিচয় দিয়েছেন। ইতিমধ্যে তিনি দশের অধিক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। এর মধ্যে সাহিত্য থেকে শুরু করে পুরোনো চিকিৎসাশাস্ত্র, বৃক্ষনামের ব্যুৎপত্তি থেকে শুরু করে ‘বাংলা অনির্দেশক সংখ্যাশব্দ’ পর্যন্ত বিচিত্র বিরল বিষয় অন্তর্ভুক্ত।
সম্প্রতি তিনি প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের সামরিকপদবিযুক্ত গ্রামনাম নামাঙ্কিত জরুরি গ্রন্থ। গ্রন্থটির উপশিরোনাম ‘“বাংলাদেশ সামরিকবাহিনী”র অকথিত ইতিহাস’। নাম থেকেই বোঝা যায়, অন্তত বাংলাদেশের বিদ্যাজগতে এ এক বিরল প্রকৃতির গবেষণাকর্ম। ১৯৭৪ সালের তালিকা থেকে গবেষক ১০১৬টি গ্রামনাম আলাদা করেছেন, যেগুলোর সঙ্গে সামরিক পদবি যুক্ত আছে। গ্রন্থকার অন্তত ৪৭ প্রকার ‘সামরিক পদবি’র সন্ধান পেয়েছেন। এগুলো শনাক্ত করা খুব সহজ কাজ নয়। প্রায় আড়াই হাজার বছর ধরে নামগুলো দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে বিভিন্ন ভাষার শব্দ আছে। এর অনেকগুলো আজ আর পরিচিত নয়। তা ছাড়া অনেক শব্দ যুগান্তরে এমনভাবে বদলে গেছে যে ‘মূল’ শব্দের সঙ্গে মেলানো দুরূহ হয়ে উঠেছে। সেদিক থেকে বইটিতে লেখকের প্রথম কৃতিত্ব সংশ্লিষ্ট শব্দগুলো শনাক্ত করা এবং পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্তের সহায়তায় ব্যুৎপত্তি নির্দেশ করা।
শুধু এটুকু করলেও কাজটা গুরুত্বপূর্ণ হতো। কিন্তু লেখক আরও অনেক দূর গেছেন। সংশ্লিষ্ট শব্দগুলোকে স্থাপন করেছেন সামরিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে। বাংলার ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বইগুলো থেকে প্রয়োজনীয় অংশ উদ্ধৃত করে দিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে একদিকে তাঁর নিজের অনুমানগুলো প্রয়োজনীয় সমর্থন পেয়ে জোরালো হয়েছে, অন্যদিকে এভাবেই আসলে কথিত ‘সামরিক ইতিহাস’ ধীরে ধীরে মূর্ত হয়ে উঠেছে। প্রভাবশালী ইতিহাসগ্রন্থ থেকে প্রাসঙ্গিক অংশগুলোর সার-সংকলন পরিশ্রমসাধ্য কাজ, কিন্তু অনেকের পক্ষেই সম্ভব। শাহজাহান মিয়ার বিশেষজ্ঞতা বিশেষভাবে প্রকাশ পেয়েছে অন্যত্র। মধ্যযুগের বিপুলসংখ্যক কাব্য থেকে প্রয়োজনীয় উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি সামরিক পদবিবাচক শব্দগুলোর পুরোনো ব্যবহার চিহ্নিত করেছেন। এর মধ্য দিয়ে শব্দগুলোর সচলতার প্রমাণ মেলে। অর্থ এবং অন্যবিধ তাৎপর্য নিরূপণের জন্যও পদ্ধতিটি উত্তম। বাংলাদেশের সামরিকপদবিযুক্ত গ্রামনাম গ্রন্থটি ইতিহাস-প্রণয়নে সাহিত্যিক উৎস ব্যবহারের ভালো নমুনা হয়ে রইল।

>
.
.

বাংলাদেশের সামরিকপদবিযুক্ত গ্রামনাম
শাহজাহান মিয়া
প্রচ্ছদ: মুহম্মদ শোয়েব-আল-কাদরী
বিনোদ * প্রকাশক: জ্যোতিঃপ্রকাশ, ঢাকা
* প্রকাশকাল: জানুয়ারি ২০১৬
* ৪১২ পৃষ্ঠা * দাম: ১২৮০ টাকা

অনেক শব্দের অর্থ বাংলা বা সংস্কৃত অভিধানে নেই। গ্রন্থকার তুলনামূলক ও ঐতিহাসিক পদ্ধতিতে এ ধরনের শব্দের অর্থ নির্ধারণ করেছেন। যেমন ‘হাতিয়া’ শব্দটি। তালিকা অনুযায়ী বাংলাদেশে এ নামের অন্তত আঠারোটি গ্রাম আছে। এর মধ্যে নোয়াখালী জেলাধীন একটি থানার নামই ‘হাতিয়া’। গ্রন্থকার অনুমান করেছেন, এই থানা-নামও প্রথমে একটি গ্রাম-নামই ছিল। তিনি শব্দটির অর্থ করেছেন: হস্ত্যারোহ; হস্ত্যারোহী যোধ; নিষাদী; গজারোহী সৈন্য। ব্যুৎপত্তি সম্পর্কে তাঁর মত হলো, সংস্কৃত ‘হাস্তিক’ থেকে বাংলা ‘হাতিয়া’ শব্দটি এসেছে। অভিধানে সরাসরি ভুক্তি না থাকায় তিনি তাঁর মতের সমর্থনে তিন দফায় অনেক তুল্য-নজির পেশ করেছেন। ফলে তাঁর এই প্রত্যয় ও ঘোষণা—শব্দগুলোকে ‘বাংলা অভিধানের অন্তর্ভুক্ত করা যুক্তিসংগত’ বৈধ বলেই মনে হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ পদ্ধতিতেই তিনি এগিয়েছেন। তাই, যদি কখনো ভিন্নতর প্রমাণ সাপেক্ষে শব্দগুলোর অন্য অর্থ নির্ধারিত হয়ও, তাঁর বিশ্লেষণ গুরুত্ব হারাবে না।
এখানে একটা ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। সংস্কৃত শব্দ, অভিধান এবং ব্যাকরণের প্রতি শাহজাহান মিয়ার বিশেষ পক্ষপাত আছে। বইয়ের শুরুতেই তিনি ‘অ্যাবস্ট্রাক্ট’ শব্দের বাংলা করেছেন ‘সংক্ষিপ্ত নিষ্কর্ষ’। সরল চলতি বাংলা ‘সারসংক্ষেপ’ তিনি গ্রহণ করেননি। এই ঝোঁক তাঁর বিশ্লেষণেও বেশ প্রবল। মুশকিল হলো, বাংলা শব্দের ব্যুৎপত্তি-প্রণয়নে, এবং একই কারণে, ইতিহাস প্রণয়নে সংস্কৃত উৎসের প্রতি অন্যায্য নির্ভরতা বেশ প্রবল। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বা সুকুমার সেনসহ বহু বিশ্লেষক দেখিয়েছেন, এ প্রবণতার ফলে বাংলা অভিধানে বহু শব্দ জোর করে সংস্কৃতের সঙ্গে মিলানো হয়েছে; অসংস্কৃত উৎস এবং অন্য ব্যবহারিক কারণগুলো বাদ পড়েছে। বর্তমান গ্রন্থর কোথাও কোথাও সে রকম ঘটেছে কি না তা খতিয়ে দেখার অবকাশ আছে।
শাহজাহান মিয়ার গদ্য প্রাঞ্জল ও পরিচ্ছন্ন। তাঁর বয়ানরীতি—টীকা, নজির ও প্রমাণ সংযোজন—খানিকটা পুরোনো ধাঁচের, কিন্তু নিখুঁত, সুখপাঠ্য এবং দারুণ কার্যকর। কৃতী গবেষক হিসেবে তিনি আগেই খ্যাতিমান হয়েছেন। এ বই তাঁকে আরেক কদম এগিয়ে দিল।