জোছনায় হই ধোঁয়া আর আঁধারে আগুন

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

গভীর হয়ে আসা রাতে কেউ রূপগঞ্জ হাটের সড়কে দাঁড়ালে দেখবে, থিকথিকে জোছনা-দুধের নহর যেন বয়ে যাচ্ছে বজরার চক থেকে কালিগঙ্গা নদীর দিকে আর চকের ভিটার ওপর দাঁড়ানো তালগাছটাকে ঘিরে আছে দুটো দীর্ঘ ছায়ামূর্তি৷ তারা ক্রমেই বদলে যেতে যেতে পেঁচিয়ে উঠছে তালগাছটাকে৷ ছায়ামূর্তির দৃশ্য হয়তো নিছক দেখার ভুল৷ কিন্তু চালতেডাঙার হাটে গিয়ে যারা রাত করে ফেলে, তারা কালিগঙ্গা পার হয়ে চকের ভেতর দিয়ে যেতে গিয়ে ভিটািটকে সত্যি সত্যি এড়িয়ে যায়৷ রাতের বেলায় কেউ এই ভিটার তাল কুড়াতেও যায় না৷ ছায়ামূর্তি দুটির শাসন এতই দাপুটে যে মাঝরাতে ভিটার জঙ্গলে একটা শিয়াল ডেকে উঠলে অন্য শিয়ালগুলো তার সঙ্গে ঐকমত্য ঘোষণার সাহস করে না৷ যারা একেবারেই কিছু জানে না, এমন ভিনগ্রামবাসী রাত-বিরেতে বজরার ভিটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় নানা কিছু দেখে ভয় পায়৷ যদি হয় জোছনার রাত, তারা ছায়ামূর্তি দুটিকে বদলে যেতে দেখে সাদা ধোঁয়ায়, আর যদি হয় ঘন আঁধার রাত, তবে তারা দেখে আঁকাবাঁকা আগুন৷ সবই হয়তো ঘোরগ্রস্ত মানুষের দেখা অলীক ছবি৷ তবু গ্রামবাসীর কেউ কেউ ভানুডাঙার সীমানায় দাঁড়িয়ে বাতাসের শব্দের সঙ্গে সত্যি সত্যি ভেসে আসতে শোনে কিংবা ভিটার তালগাছের ছায়ামূর্তি দুটিকে মিলিত কণ্ঠে বলতে শোনে, আমরা জোছনায় হই ধোঁয়া আর আঁধারে আগুন৷
ভাদ্র মাসের গরমে বেশ রাত অবধি জেগে আছে ভানুডাঙা গ্রাম৷ দক্ষিণের মৃদু বাতাসের ভেতর সরকারবাড়ির আঙিনায় অনেকে বসে আছে কাছারিঘরের সামনে আর বারান্দায়৷ সাহার সরকারের কামলা আর প্রতিবেশীদের কেউ কেউ নির্বোধ সোনাই মাধবকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করছে৷ কীভাবে তাকে হাটের ভেতর গায়ের জামা খুলিয়ে নাকাল করেছিল খরাতিবাড়ির মোংলা, সেই গল্প স্মরণ করে হাসিতে ফেটে পড়ছে কেউ কেউ৷ এমন সময় মসজিদের পাশ দিয়ে বজরার চকের দিক থেকে উঠে আসে একটা লোক৷ তার বাড়ি হয়তো গাড়ুদহ কিংবা পূর্ব শুকদেবপুর৷ জোছনায় স্পষ্ট দেখা যায় না মুখ৷ সে ইঙ্গিতপূর্ণভাবে, হয়তো নিজেকেই শোনাতে, নয়তো আঙিনায় উপস্থিত লোকদের উদ্দেশ্য করে বলে, বজরার চকে তাল পড়ে, ছুলের চুল আর মাথা নড়ে৷
অচেনা লোকের এই কথার ইঙ্গিত সহজে বুঝে যায় ভাদ্রের গরমে কাতর লোকগুলো৷ তারা সোনাই মাধবকে নিয়ে তামাশা বন্ধ করে কিছুক্ষণের জন্য৷ তাদের সেই নিশ্চুপতার ভেতর বারান্দায় বসা সাহার সরকার একটা বাজির দান ছুড়ে দেয়, ‘ক্যারে হানিফ, তোর না বেমক্কা সাউস৷ যাবু নেহি তাল কুড়াইব্যার?’
‘যামু৷ কী দিব্যা?’
‘যুদিচ তাল আনব্যার পারস, এক স্যার সন্দেশ পাবু৷ পুরা এক মাসের খোরাকিও দিমু৷’
আঙিনায় খড়ের গাদার ওপর বসে থাকা কোনো অর্বাচীন ফোঁস করে প্রশ্ন তোলে, ‘আর হানিফ যুদিচ তাল আনব্যার না পারে?’
‘তালি অর এক মাস কামলা খাটা নাগব৷ কুনো খোরাকিও দিমু না, মজুরিও না৷’
‘ক্যারে হানিফ, রাজি আছু নিহি?’ কামলাদের কেউ তাকে জিজ্ঞেস করে৷
‘রাজি৷’
হানিফ সর্দার সাহার সরকারের বাজিতে রাজি হয়ে যায়৷

এলেম পাগলার মন্ত্র ও ছায়ার খেলা
বারান্দায়, আলো-আঁধারির ভেতর বসা সাহার সরকারের মুখ স্পষ্ট দেখা না গেলেও আঙিনায় চাঁদের আলোতে বসা লোকগুলো বুঝতে পারছিল তার মুখে মৃদু হাসির রেখা৷ কারণ, যে বাজি ধরেছে সে, তার ফলাফল আগেই সবার জানা, জানে সাহার সরকারও, এখন বাকি শুধু ঘটনাটাকে ঘটতে দেওয়া৷ তবে বাজি ধরেই হানিফ সর্দার বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় কোমরে গামছা বাঁধতে বাঁধতে আর অশরীরীদের হাত থেকে নিজের শরীর বন্ধ করতে পড়তে থাকে এই মন্ত্র-উদয়া বাঁধম উদয়া বাঁধম, হাত নাড়স তো হাত বন্ধন, পা নাড়স তো পা বন্ধন...৷ উপস্থিত সবার মধ্যে বেশ একটা উত্তেজনা ছড়িয়ে যায়৷ হানিফ সর্দার ভেতর বাড়িতে গিয়ে বৌ-ঝিদের কারও কাছ থেকে সরষের তেল আনে বাটিতে করে৷ ভাদ্রের গরম অগ্রাহ্য করে সে মন্ত্র পড়া তেল মাখতে থাকে গায়ে আর শরীরে শক্তি ধরে রাখতে বিড়বিড় করে জপতে থাকে আরও মন্ত্র-ইর কাছ কাছুম, বীর কাছ কাছুম, কাছুম যমের দূত৷ আমি মইষ্যা চোরের পুত, মইষ্যা নিজে কাছুমের পুত৷
সব প্রস্তুতি শেষ করে হানিফ মসজিদের পাশের ঢালু রাস্তা ধরে নেমে যায় বজরার চকের দিকে, অবিচল ভঙ্গিতে৷ অন্যদিকে, চকের ভিটাতে কী ঘটে, তা-ই দেখতে সবাই ছোটে ভানুডাঙা গ্রামের শেষ মাথায় ইয়ার বক্স প্রামাণিকের বাড়ির উঠানে৷ সেখানে সাহার সরকার না গেলেও তার কামলারা হাজির৷ সবাই দেখছে, ধানখেতের আইল ধরে জোছনায় ভিজতে ভিজতে চকের ভিটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে হানিফ সর্দার৷ তারা দেখতে পাচ্ছে তালগাছটাকে ঘিরে থাকা ছায়ামূর্তি দুটি ক্রমেই বদলে যাচ্ছে ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে, যেন দুই অশরীরীও জেনে গেছে বাজি ধরার খবর৷ হানিফ সর্দারকে ভিটায় উঠে তালগাছের দিকে এগিয়ে যেতে দেখা গেল৷ তখন সবাই দেখল, ছায়ামূর্তি দুটোর মধ্যে যেটি পুরুষ, সেটি হানিফ সর্দারকে শূন্যে তুলে ছুড়ে দিল নারী ছায়ামূর্তিটির হাতে৷ নারী ছায়ামূর্তিটি তার মাথার চুলের সঙ্গে হানিফকে বেঁধে ঘোরাতে লাগল শূন্যের ওপর৷ ইয়ার বক্স প্রামাণিকের বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে সবাই যা যা দেখে, তার সবই হয়তো যৌথ দৃষ্টিভ্রম৷ কিন্তু ভিটার দিক থেকে সত্যি সত্যিই হানিফ সর্দারের ভয়ার্ত চিৎকার শোনা যায়৷ একটু পরে ধোঁয়ার কুণ্ডলীর ভেতর হারিয়ে যায় সে৷ এ সময় ছায়ামূর্তি দুটির ছায়াবাজির খেলা কোন দিকে গড়ায়, তা দেখতে উঠানের লোকগুলো যখন সূক্ষ্মতর দৃষ্টি নিয়ে উন্মুখ তাকিয়ে ভিটার দিকে, তখনই কেউ বলল, এলেম পাগলারে দেখা যায়৷ ভিটার ওপর এলেম পাগলার মতোই কাউকে হাঁটতে দেখা গেল৷ ছায়ামূর্তি দুটি তখন তালগাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসেছে৷ এলেম পাগলা জ্ঞান হারিয়ে ফেলা হানিফ সর্দারকে কাঁধে নিয়ে হাঁটছে সরকারবাড়ির দিকে৷
যত্রতত্র বিবস্ত্রপ্রায় হয়ে ঘুরে বেড়ানো এলেম পাগলা হয়তো ছিটগ্রস্ত; হয়তো ভীষণ কোনো গূঢ়ৈষা তাকে শাসন করে আর সে সূর্য, চাঁদ কিংবা বাতাসের সহচর হয়ে ঘুরে চলে সারাক্ষণ৷ তবে গ্রামের লোকেরা তাকে বলে এলেম পীর, কেউ বলে এলেম ফেরেশতা৷ সারাক্ষণ বিড়বিড় করে কথাবার্তা বলে৷ তার অসংলগ্ন কথাবার্তায় কেউ কান দেয় না৷ কিন্তু একদিন ভানুডাঙার রফিক জমাদারের মরিচখেতের ভেতর দিয়ে দৌড়ালে সে এলেম পাগলার গালে একটা থাপ্পড় মেরেছিল৷ এ ঘটনার পর যখন তখন এলেম বিড়বিড় করত-এজাজিল জেলাতিল তে তে ফট ফট, ভেল ভেল হায়সর ভেল, রফিকক্যারে শোয়ায়া দিলাম, হক্কেল হক্ক মালকুল৷ এলেমকে চড় দেওয়ার দুদিনের মাথায় রফিক জমাদার কঠিন ব্যারামে বিছানায় পড়ল৷ তবে কয়েক দিন রোগে ভুগে সে প্রাণে বেঁচে যায়৷ এর পর থেকে এলেম পাগলাকে কেউ ঘাঁটায় না আর বিড়বিড় করে সে কী কী বলে, তার দিকে সবাই খেয়াল রাখে৷ এই এলেম পাগলা যখন হানিফ সর্দারকে কাঁধে করে বজরার চকের ভিটা থেকে নিয়ে এল, তখন বাজির শর্তগুলো পাল্টে গেল৷ তাল আনতে না পারায় হানিফ বাজিতে হেরে গিয়েছিল, কিন্তু সাহার সরকার বিনা মজুরিতে এক মাস কামলা খাটার দায় থেকে তাকে মুক্তি দিল৷ যারা সে রাতে এসব ঘটনা ঘটতে দেখেছিল, তারা বুঝতে পারে, এলেম পাগলার উপস্থিতিই অমোঘ অধিশাস্তার মতো শাসন করেছিল সাহার সরকারকে৷

আজিজ ডাকাত ও তার ঘোড়া
বজরার চকে, ভিটার ওপর পরের বর্ষাকালেই একটা নতুন বাড়ি উঠল৷ কিছু বাড়ি উঠল বিলের ধারেও৷ পদ্মার ভাঙনে যারা উদ্বাস্তু হয়েছিল, তারাই ছড়িয়ে পড়েছিল নানা দিকে৷ কিন্তু ভিটার ওপর কে বাড়ি তুলতে সাহস করল, তা নিয়ে ভানুডাঙাবাসীর কৌতূহলের শেষ নেই৷ অচিরেই তারা শুনল, ভিটায় বাড়ি তুলেছে আজিজ ডাকাত৷ ডাকাতি করে বলেই তার নাম আজিজ ডাকাত৷ তবে যতই কিনা হোক সে ডাকাত, চকের ভিটায় বাড়ি তোলাটাকে তারা মূর্খের সাহস বলে গণ্য করল৷ যে ঘোড়া দাবড়িয়ে আজিজ ডাকাত দূর-দূরান্ত থেকে ডাকাতি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

করে ফিরত, সেই লাল ঘোটাটাকেও দেখা গেল ভিটার ওপর৷
কোনো কোনো রাতে চাঁদ উঠলে ঘোড়াটাকে দেখা যায় তালগাছটার সঙ্গে বাঁধা৷ বৃষ্টি-ধোয়া জোছনা তখন এত ফরসা ফিনফিনে আর এত বিষাদ লাগা যে তা স্পৃষ্ট করত ঘোড়াটাকে৷ যেন কিছুটা ক্রুদ্ধ সে, অকস্মাৎ হ্রেষাধ্বনি দিয়ে উঠত, যেন সে চায় না আঁধারের ভেতর আরও আঁধার দিয়ে অধিকৃত হতে, আলোর ভেতর আরও আলোর ধাঁধায় অন্ধ হতে৷
পরের ঘটনাটা নদীভাঙা উদ্বাস্তুদের কাছ থেকে ভানুডাঙাবাসীর মধ্যে ছড়িয়ে গেল৷ ঘটনা এই যে একদিন আজিজ ডাকাত পদ্মা নদীর পাড় ধরে কোথাও যাচ্ছিল৷ হঠাৎ দেখল, হাবুডুবু খেতে খেতে একটা মাথা ভেসে যায় পদ্মার স্রোতে৷ তা দেখে আজিজ ডাকাত ঝাঁপিয়ে পড়ে নদীতে আর তুলে আনে লোকটাকে৷ পরে দেখা গেল, ডুবে যেতে থাকা লোকটা ছিল এলেম পাগলা৷
এলেম পাগলার বায়োস্কোপ 

যেদিন এলেম পাগলা উদ্ধার হলো, সেদিন রাতেই আজিজ ডাকাত একটা স্বপ্ন দেখল৷ এই স্বপ্ন দেখার ঘটনাটা গ্রামবাসী জেনেছে বহুকাল পরে, কিংবা তারা আসলে আগে থেকেই জানত, স্বপ্নটা রয়ে গিয়েছিল তাদেরই নির্জ্ঞানের ভেতর৷ কেননা, তারাই ছিল সময়ের মুখ, একই সঙ্গে বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল নিবিড় চিহ্নগুলো নিজেদের ভেতর৷ হয়তো এলেম পাগলা নয়, গ্রামবাসী যারা ভয় পায় এবং তালগাছ ঘিরে দুটি ছায়ামূর্তিকে দেখে তারাই এলেমকে নিয়ে স্বপ্নটা দেখিয়েছিল৷
এলেম পাগলা উদ্ধারের পর সেদিন রাতেই আজিজ ডাকাত স্বপ্নে দেখল, হাসি হাসি মুখে এলেম পাগলা এগিয়ে আসছে তার দিকে৷ হাতে ছোট একটা বাক্স৷ বাক্সটা কাছে এনে খুলে ধরতেই তার ভেতর থেকে বুদ্বুদের মতো কথা বের হতে থাকল৷ কথাগুলো বুদ্বুদের মতো ভাসছিল আর মুহূর্তে ভাসতে থাকা ছবি হয়ে যাচ্ছিল৷ দেখতে দেখতে বড় একটা বজরা ভাসতে দেখা গেল কালিগঙ্গা নদীর ওপর৷ কথাগুলো বলতে থাকল যে বজরাটি আসছে যমুনা নদী থেকে কালিগঙ্গা নদী ধরে আর পড়বে গিয়ে ধলেশ্বরীতে৷ কাঠের কামরা থেকে বাইরে এসে দাঁড়ালেন নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ৷ মুর্শিদাবাদ থেকে আসছেন৷ বজরাটি কালিগঙ্গা নদী ধরে যেতে যেতে একটা বাঁকে হারিয়ে গেল৷ বাক্সের ভেতর থেকে বেরোতে থাকল আরও কথা৷ সেই কথাগুলোও ছবি হতে হতে ভাসতে থাকল চোখের সামনে৷ দেখা গেল, আরেকটি বজরা ভেসে আসছে কালিগঙ্গা নদীতে, যার ওপর দাঁড়িয়ে আছেন নবাব মীর কাশিম৷ পেছনে অনেকগুলো নৌকার একটি বহর৷ বজরাসহ পুরো বহরটি কালিগঙ্গা নদী থেকে বজরার বিলে এসে নোঙর করল একটা ঘাটে৷ বজরার বিলের ধারেই নবাব মীর কাশিমের বানানো কেল্লা৷ তিনি ঘাটে নেমে ঢুকে গেলেন কেল্লার ভেতর৷ ছবিগুলোতে রাত নামল৷ ফলে, কারও মুখ আর চেনা গেল না, তবে দেখা যাচ্ছিল কয়েকজন লোক এসে নৌকার বহর থেকে একটা নৌকাকে ডুবিয়ে দিল বিলের ভেতর৷ দ্রুত পাল্টে যেতে থাকল ছবিগুলো৷ বিচারসভা বসেছে৷ ষড়যন্ত্র করে সোনার মোহরভরা নৌকা ডুবিয়ে দেওয়ার জন্য এক রাজকর্মচারী ও তার স্ত্রীকে ফাঁসিতে ঝোলানো হচ্ছে৷ কিছু কর্মচারী বিলের পানিতে ডুবে সোনার মোহর খুঁজছে কিন্তু পাচ্ছে না৷ এলেম পাগলা বাস্তবে বিড়বিড় করে কথা বললেও স্বপ্নে স্পষ্ট করে জানাল, ধনরত্নগুলো রাজকোষে জমা দিতে নিয়ে যাচ্ছিলেন নবাব মীর কাশিম৷ এগুলো কৃষকদের খাজনার টাকা৷ তাদের সঞ্চিত শ্রম৷ মোহরগুলো এখন আছে তালগাছটার গোড়ায়৷ এসব পেয়েই যেন সে নিজের মনে না করে৷ নিজের জন্য খরচ সে অবশ্যই করবে৷ তবে তার আগে প্রজাদের জন্য কিছু করা লাগবে৷ আসছে শীতে সে যেন পদ্মার বাঁধ নির্মাণে কিছু অর্থ খরচ করে, তাহলে আর পরের বর্ষায় কেউ ভিটাছাড়া হবে না৷ কথাগুলো বলার সময় এলেম পাগলার মুখটাকে বেশ কঠিন দেখাল, যেন সে বহুকালের কোনো প্রতিজ্ঞাকে ধরে আছে মুখে৷ অল্পক্ষণ পরেই স্বপ্ন থেকে বেরিয়ে গেল এলেম পাগলা৷ আজিজ ডাকাত দেখল, বড় একটা বায়োস্কোপের কোটরে সে চোখ রেখে ছবিগুলো দেখছিল৷ এলেম পাগলাকে কোথাও না দেখতে পেয়ে সে চিৎকার করে ডাকল৷ কিন্তু নিজের কণ্ঠস্বরটাকে খঁুজে পেল না৷ আতঙ্কে তার ঘুম ভেঙে গেল৷
ঘুম ভাঙার পর আজিজ ডাকাত বাইরে এসে দেখল, ভোর হচ্ছে আর তালগাছের গোড়ায় বাঁধা ঘোড়াটা তখনো ঘুমাচ্ছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে৷

ফিরে আসে একটি লাল ঘোড়া
আজিজ ডাকাত ভাবল, জানাজা না পড়িয়েই রাজকর্মচারী আর তার স্ত্রীর মৃতদেহকে হয়তো ফেলে দেওয়া হয়েছিল বিলের পানিতে৷ তাই এখনো শান্ত হয়নি তাদের আত্মা৷ কিন্তু তারা তালগাছে বসে ভয় দেখানো ছাড়া কীই-বা আর করতে পারবে তার৷ সোনার মোহরগুলো একটা পিতলের কলসিতে ভরতে ভরতে সে ভাবল, এলেম পাগলাই বা কী ক্ষতি করতে পারবে তার মতো দুর্ধর্ষ ডাকাতের৷ আজিজ ডাকাত পদ্মার পাড়ে বাঁধ দেওয়ার শর্তের কথা শিগগিরই ভুলে গেল৷ তারপর শীত-গ্রীষ্ম গিয়ে আবার বর্ষাকাল এল৷ একদিন আজিজ ডাকাতের বাড়িটাকে রহস্যজনকভাবে শূন্য পড়ে থাকতে দেখা গেল৷
আজিজ ডাকাত ও তার স্ত্রী কোথায় গেল, কী ঘটেছে তাদের ভাগ্যে, তা নিয়ে নানা গল্প ভানুডাঙার লোকেরা বহুদিন শোনে এবং বলাবলি করে৷ কেউ বলে, প্রমত্তা পদ্মা নদী সাঁতার কেটে পার হতে গিয়ে আজিজ ডাকাত তার ঘোড়াসহ ডুবে মরেছে৷ কেউ বলে তালগাছের ছায়ামূর্তিগুলোই ভয় দেখিয়ে তাদের তাড়িয়ে দিয়েছে৷ আবার এমনও শোনা যায় যে এলেম পাগলা তার দৈব ক্ষমতাবলে এক রাতে বাঘ হয়ে তাড়া করেছিল আজিজ ডাকাতকে৷ বাড়ির আঙিনায় বাঘ দেখে ভীত ও বিহ্বল আজিজ ডাকাত ও তার স্ত্রী ঘোড়ায় চড়ে পালাতে চেষ্টা করেছিল৷ কিন্তু বাঘটি তাদের পিছু ছাড়েনি৷ বহুদূর পর্যন্ত তাড়া করে তাদের নামিয়েছিল পদ্মা নদীতে৷ পরে তারা সাঁতার কেটে নদী পার হতে গিয়ে ডুবে মারা যায় ৷

ভানুডাঙার লোকেরা কখনো কখনো লাল ঘোড়াটিকে ফিরে আসতে দেখে৷ তারা দেখে, চাঁদের আলোয় বজরার চকের খেত-খামারের ওপর দিয়ে নিঃশব্দে দৌড়ে বেড়াচ্ছে একটি খ্যাপাটে ঘোড়া৷