ঠার: বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা ও বাঙালির ভাষা আন্দোলনের চেতনা

বর্তমান পৃথিবী পুঁজি আর প্রতিষ্ঠার পৃথিবী। দিন দিন কোটি কোটি মানুষের পৃথিবী কিছু মানুষের পৃথিবী হয়ে উঠছে। প্রান্তিক হচ্ছে অধিকাংশ মানুষ; উৎখাত হচ্ছে অযুত-নিযুত অগণ্য। শুধু অর্থনৈতিকভাবে প্রান্তিক হওয়ার কথা বলছি না। বলছি না শুধু অধিকারের দিক থেকে প্রান্তিক হওয়ার কথা। এ তো রীতিমতো গা সওয়া বাস্তবতা। বলছি সাংস্কৃতিকভাবে, ভাষিকভাবে প্রান্তিক এবং উৎখাত হওয়ার কথা। শুনে বুকের মধ্যে ছ্যাঁৎ করে উঠবে যে, ‘পৃথিবী থেকে... প্রতিবছর পঞ্চাশটির বেশি ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে...।’ তথ্যটি দিলাম বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে রচিত একটি গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘ঠার: বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা’ বই থেকে। বইয়ের লেখক হাবিবুর রহমান।

ভাষার মৃত্যু মানুষের মৃত্যুর চেয়ে বেদনার। মানুষ মরলে তবু তার চিহ্ন থাকে; পরম্পরা থাকে। যেমন ঘর পুড়ে গেলে তবু থাকে ভিটেমাটি। কিন্তু ভাষা মরলে কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। কিছুই অবশিষ্ট থাকে না বলতে কী বোঝায়! আসলে একটা ভাষা মানে তো খালি একটা ভাষা নয়। একটা ভাষা মানে একটা জনগোষ্ঠী, একটা সংস্কৃতি, একটা রুচি, একটা বিশেষ কায়দার স্বর ও সুর; একটা বিশেষ জনগোষ্ঠীর স্মৃতি, অভিজ্ঞতা, আবেগাকুলতার গুঞ্জরণ; কর্ণেন্দ্রিয়ের বহু বিচিত্র পিপাসার এক জলাধার। তাই একটি ভাষার মৃত্যু মানে এসবেরই মৃত্যু। সব মিলিয়ে একটি সভ্যতারই অপমৃত্যু। এ কারণেই এটা অতল বেদনার ব্যাপার। পৃথিবীর মানুষের জন্য ভাষাবৈচিত্র্য জীববৈচিত্র্যের চেয়ে কম গুরুত্বের নয়।

তবু ভাষারা মরে যাচ্ছে। মরে যাচ্ছে কখনো অবহেলায়, কখনো আগ্রাসনে। এই অবহেলা আর আগ্রাসন আবার পরস্পর যুক্ত। অবহেলা মূলত আগ্রাসনেরই রূপভেদমাত্র। বড় বড় মাছ যেমন ছোট ছোট মাছকে গিলে খায়, তেমনি পৃথিবীর বড় বড় ভাষা ছোট ছোট ভাষাকে গিলে খায়। ইংরেজি দিয়ে সবচেয়ে ভালো বোঝা যাবে। অনেকে মনে করেন, এ হলো এক ‘রাক্ষুসে ভাষা’। এর উদরে অসংখ্য ভাষার ইতিহাসের ফসিল আছে। ইংরেজ একদা ঔপনিবেশিক শক্তি থাকায় তার উপনিবেশগুলোর ভাষাকে উৎখাত করে বা প্রান্তিক বানিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছে নিজের আধিপত্য। এ হলো শাসকের ভাষার আধিপত্য শাসিতের ভাষার ওপর।

ঠার: বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা
হাবিবুর রহমান
প্রকাশক: পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স, ঢাকা
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২২
প্রচ্ছদ: রাজীব রাজু
পৃষ্ঠা: ৩৫২
দাম: ৮০০ টাকা।

একই ব্যাপার ঘটতে বসেছিল বাংলাদেশে। ‘বড়লোক’ শাসকের উর্দুর আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হতে বসেছিল শাসিত ‘গরিব’ বাংলার ওপর। কিন্তু সেই আধিপত্য বাঙালি মানেনি। ফলে বাঙালির কাছে ভাষার মানে আরও গভীরই হওয়ার কথা। ভাষার মৃত্যু বা কোণঠাসা হয়ে যাওয়ার ঘটনায় বাঙালির উদ্বেগাকুল হওয়ার কথা একটু বেশিই। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের হৃদয়ে ভাষার মৃত্যু বা প্রান্তিক হওয়ার বেদনা কতটা গভীরভাবে বাজে জানি না। কিন্তু ব্যক্তির হৃদয়ে ও মননে যে গভীর আলোড়ন তোলে, তার প্রমাণ পাই সম্প্রতি প্রকাশিত হাবিবুর রহমান রচিত ‘ঠার: বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা’ থেকে। বইটি প্রান্তিক হতে বসা, লুপ্ত হতে বসা ‘ঠার’ ভাষার এক অনন্য দলিল। লেখকও এই বইয়ের ভূমিকায় ‘ঠার’ ভাষা নিয়ে কাজ করার কারণ সম্পর্কে ওই উর্দুর একক আধিপত্য রুখে দেওয়ার সঙ্গে যুক্ত ভাষা আন্দোলনের প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, ‘ভাষার অধিকার অর্জনের জন্য রক্ত দিয়ে জাতি হিসেবে আমরাই পৃথিবীতে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি। ফলে আমাদের দেশের ভাষাবৈচিত্র্য রক্ষার জন্য আমার পেশাগত দায়িত্বের বাইরেও এটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করি।’

বইটি হতে পারত ‘ঠার’ ভাষার শুধু কিছু শব্দের সংগ্রহ; শব্দকোষ। আরেকটু এগিয়ে হতে পারত ওই সব শব্দের পাশে বাংলা বিকল্প শব্দসমাবেশে রচিত একটি ভালো অভিধান গোছের কিছু একটা। আর এর সঙ্গে এক চিমটি বেদে জীবনের আলেখ্য রচিত হতে পারত বইটিতে। এসব ক্ষেত্রে সাধারণত এটাই হয়ে থাকে। কিন্তু এসব অনুমানকে তুচ্ছ করে এই বই পা বাড়িয়েছে প্রায় অসম্ভবের পথে। কী সেই অসম্ভবের পথ? সেই অসম্ভবের পথটি হচ্ছে, হাবিবুর রহমান এই বইয়ে ‘ঠার’ ভাষার একটি ফরমাল ব্যাকরণ রচনার প্রয়াস পেয়েছেন। এই ভাষার ধ্বনিতত্ত্ব, শব্দতত্ত্ব, বাক্যতত্ত্ব আর অর্থতত্ত্বের একটা কাঠামো দাঁড় করাতে চেয়েছেন। এই কাজ করতে গিয়ে গবেষক ‘ঠার’ ভাষার একটা বড় শব্দভান্ডার গড়ে তুলে বাংলা ভাষার সঙ্গে এই ভাষার মিল-অমিলও দেখিয়েছেন। এই মিল-অমিল আবার ধ্বনিতাত্ত্বিক, রূপতাত্ত্বিক ও বাক্যতাত্ত্বিক কাঠামোর আওতায় দেখিয়েছেন। রীতিমতো বিস্ময়কর! হাবিবুর রহমান কাজটি এত শ্রমনিষ্ঠা আর পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে করেছেন যে এই গবেষণা থেকে বোধ করি ‘ঠার’ ভাষা শেখার কাজটিও যে কেউ বহুদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন।

‘ঠার’ ভাষার ব্যাকরণ আর ভাষাতাত্ত্বিক আলোচনা এই বইয়ের প্রধান কীর্তি। ভাষাতাত্ত্বিক আলোচনা করতে গিয়ে তিনি ভাষাটির কুল–ঠিকুজি বের করে আনার দুঃসাধ্য কাজটি করেছেন। শুধু তা–ই নয়। আরও আছে। আছে ভাষার ইতিহাসের অলিগলিতে স্বচ্ছন্দ বিচরণ। আছে ভাষাতত্ত্বের আধুনিকতম শাখা-প্রশাখার প্রাথমিক কাজ চালানোর পরিচয়। এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বোধ করি এই বইয়ের দশম অধ্যায়। ভেতরবাড়ির গোশত কষানোর গন্ধ পাওয়ার জন্য অধ্যায়ের নামটি দেখা যেতে পারে, ‘ভাষা সংরক্ষণে গৃহীত পদক্ষেপ ও ঠার ভাষার উন্নয়ন ভাবনা শীর্ষক প্রস্তাবনা’। এই অধ্যায়ে গবেষক ‘ঠার’ ভাষাকে রক্ষার জন্য বেশ কিছু বাস্তবসম্মত প্রস্তাবনা হাজির করেছেন। কারণ তিনি জানেন যে ‘ভাষার উন্নতি ও অগ্রগতি মূলত মানবসভতার উন্নতি ও অগ্রগতির একটি নির্দেশক। মানবজীবনে ভাষার ভূমিকা অনস্বীকার্য। কেননা, মানবসত্তার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সভ্যতা-সংস্কৃতি, ধর্ম, দর্শন, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ইতিহাস ভাষার মাধ্যমে মানুষ পৃথিবীর বুকে স্থায়ীভাবে রেখে যেতে সক্ষম হয়েছে।’ এ কারণে হাবিব মনে করেন, ‘আমাদের সকলের উচিত ভাষাকে আগ্রাসন, বিলুপ্তি ও বিচ্যুতির হাত থেকে রক্ষায় সজাগ ও সচেতন থাকা।’

হাবিবুর রহমান ভালো করেই জানেন যে শুধু প্রয়োজনের কথা বলে কোনো ভাষাকে রক্ষা করা যায় না। এর জন্য দরকার হয় রাষ্ট্রের তরফ থেকে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়ার। তিনি ‘ভাষা সংরক্ষণে গৃহীত পদক্ষেপ ও ঠার ভাষার উন্নয়ন ভাবনা শীর্ষক প্রস্তাবনা’ উপশিরোনামের অধ্যায়ে রাষ্ট্রের করণীয় সম্পর্কে নানা প্রস্তাব হাজির করেছেন। একই সঙ্গে তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর ‘আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার’ প্রতিষ্ঠার ওপর। তিনি গুরুত্ব আরোপ করেছেন, অর্থনৈতিক মুক্তির ওপরও। কারণ তিনি জানেন, ভাষার আধিপত্য এবং বিলুপ্তির সঙ্গে টাকাকড়ির ঝনঝনানির একটা গভীর যোগ আছে। আমরা শুরুতে যে ইংরেজি ভাষার আধিপত্যের কথা বলেছি, তা তো আসলে অর্থনৈতিক দাপটেরই ভিন্ন প্রকাশমাত্র।

বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম ভাষাবৈচিত্র্যের দেশ। ‘ঠার: বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা’ বইয়ে গবেষক জানাচ্ছেন, ‘বাংলাদেশের প্রধান ভাষা বাংলা ছাড়া আরও ৪০টি মাতৃভাষা রয়েছে।’ তিনি আরও জানিয়েছেন, কারও কারও মতে, ‘বাংলাদেশে বসবাসরত প্রায় ৬৬টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী বাংলা ভাষা ব্যবহারের পাশাপাশি তাদের স্ব স্ব মাতৃভাষা ব্যবহার করছে।’ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের চেতনাপুষ্ট হাবিবুর রহমান এসব ভাষাকে তাদের স্বমহিমায় টিকিয়ে রাখার জন্য শুধু প্রস্তাব দিয়েই ক্ষান্ত হননি। তাঁর গবেষণা-ভাষা ‘ঠার’ সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করতে ২০২০ সালের ২০ নভেম্বর ‘ঠার’ ভাষাবিষয়ক সম্মেলনও করেছেন বলে বইয়ের ‘পরিশিষ্ট ১’ অংশে জানতে পারি। এই উদ্যোগ এবং এর ধারাবাহিকতা নিঃসন্দেহে তাঁর গবেষণাকে ভিন্ন তাৎপর্যের সঙ্গে যুক্ত করেছে ও করবে। বাংলাদেশের গবেষণা অধিকাংশ ক্ষেত্রে দুই মলাটের মধ্যেই সীমাব্ধ থাকে বলে একটা কথা চালু আছে। কিন্তু হাবিবুর রহমানের ওই সম্মেলন এবং বেদেদের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য নেওয়া নানা পদক্ষেপ (আলোচ্য গ্রন্থসূত্রে জানতে পারলাম) সেই অপবাদের অপনয়ন ঘটাবে বলে মনে করি। কারণ, অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া ভাষার অস্তিত্ব রক্ষা করা প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার।

বাংলাদেশ একটি রক্তাক্ত সংগ্রামের ভেতর দিয়ে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সমুন্নত রাখতে পেরেছিল। আগেই বলেছি, সেদিন বিষয়টা ছিল ‘বড়লোক’ শাসকের ভাষার আধিপত্য ‘গরিব’ শাসিতের ভাষার ওপর। ফলে, এই রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব বেশি এর সীমানার মধ্যকার ‘ছোট ছোট’ জাতিগোষ্ঠীর ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করা। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলো যেন তাদের নৃতাত্ত্বিক ও ভাষাতাত্ত্বিক পরিচয়কে অটুট রেখে সাংস্কৃতিক স্বায়ত্তশাসন ভোগ করতে পারে, সে ব্যাপারে রাষ্ট্রের কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া উচিত। সেটা যেন এনজিওর মাধ্যমে করা দেখনদারি কিছু না হয়ে সত্যিকারের কিছু হয়। কারণ, সাংস্কৃতিক স্বাধিকারের জন্য আন্দোলন-সংগ্রামের একটা বড় অবদান আছে বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পেছনে—এ কথা ভুলে গেলে চলবে না। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নাগরিক—এ কথা যেমন সত্য, তেমনি এ কথাও সত্য যে তাদের স্বতন্ত্র আত্মপরিচয়ও আছে। এদিকে লক্ষ রাখাই ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঠিক প্রকাশ বলে মনে করি। হাবিবুর রহমানের ‘ঠার: বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা’ গ্রন্থের মূল স্পিরিটের মধ্যে এ কথার নির্যাস আছে বলেই এই বই আমাদের কাছে আদরণীয় হওয়া উচিত।