
ডুবোচর
পারভেজ হোসেন
প্রকাশক: শুদ্ধস্বর
প্রচ্ছদ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
৬৭ পৃষ্ঠা
দাম: ১৫০ টাকা
মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর সময়খণ্ডে নবীন প্রবংশের যেসব কথাকার বাংলাদেশের গল্পসাহিত্যে বিশিষ্টতার স্বাক্ষর রেখেছেন, পারভেজ হোসেন তাঁদের অন্যতম। বিষয়াংশ নির্বাচন, আখ্যান নির্মাণ এবং বয়ান কৌশল—যেকোনো প্রান্তেই ইতিমধ্যে তিনি রেখেছেন প্রাতিস্বিকতার স্বাক্ষর। কাহিনিকে কীভাবে ছোটগল্প করে তুলতে হয়, সে কৌশল পারভেজের করতলগত। ফলে অনায়াসেই একটি ছোটগাল্পিক পরিস্থিতির মধ্যে তিনি আনতে পারেন বহুমাত্রিকতা। চরিত্রের অন্তরতল উন্মোচনেও তিনি কুশলী শিল্পী। আশির দশকে আবির্ভূত হয়ে ৩০ বছরের নিরন্তর সাধনায় পারভেজ ইতিমধ্যে নিজস্ব একটা ভাষারীতির সন্ধান পেয়েছেন। পারভেজ হোসেনের গল্প বিষয়ে যেমন ভাবনা-জাগানিয়া, বয়ানরীতিতেও তেমনি চিত্ত-আকর্ষণীয়।

পারভেজ হোসেনের ডুবোচর (২০১৩) গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে মোট ছয়টি গল্প। সূচনাসূত্রে তাঁর গল্প সম্পর্কে সাধারণভাবে যা বলা হয়েছে, ডুবোচর-এ তা সামান্য মনোযোগেই আবিষ্কার করা সম্ভব। লক্ষ করা যাবে, বক্ষ্যমাণ গ্রন্থে, পারভেজ কী অনায়াস কৌশলে একটি পরিস্থিতি থেকে বের করে নিয়ে আসতে পারেন অনেক পরিস্থিতি। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যায়, বক্ষ্যমাণ গ্রন্থের ‘ডুবোচর’ গল্পটি। সন্দেহ নেই ‘ডুবোচর’ গল্পটিই আলোচ্য গ্রন্থের শ্রেষ্ঠ রচনা। পদ্মার ডুবোচরে আটকে যাওয়া এক ফেরিতে বসে আকবর-জ্যোৎস্নার কথা বলতে বলতে লেখক সমকালীন বাংলাদেশটাকেই যেন পাঠকের চোখের সামনে তুলে ধরেছেন। স্বল্প-পরিসরেই পারভেজ যেভাবে অনুষঙ্গগুলোকে ছোটগাল্পিক কাঠামোতে আটকে দিয়েছেন, তা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়! কী নেই ডুবোচরে আটকে যাওয়া জ্যোৎস্নার দৃষ্টিকোণে—ঘটনাগুলো একে একে এসেছে, কিন্তু সবটাই ধরা দিয়েছে জ্যোৎস্নার কেন্দ্রীয় দৃষ্টিকোণে। প্রকৃতি, পরিবেশ, রাজনীতি, সংস্কৃতি, প্রেম—কী নেই ডুবোচরে আটকে যাওয়া লোকসকলের ভাবনায়-সংস্কৃতিতে? এবার পর্যবেক্ষণ করা যাক পারভেজের কৌশলটা। রাজনীতিটাকে তিনি তুলে আনলেন এভাবে:
‘ভরদুপুরে সূর্য একেবারে আকাশের মাঝখানটায় টাটাচ্ছে। এই ডুবোচরের ভয়েই শুকনো মৌসুমে বড় ফেরিগুলো বিশাল শরীর নিয়ে অনেক দূর ঘুরে তবে পদ্মা পার হয়। ড্রেজারগুলো রাতদিন অনবরত খুঁজেখুঁজে জমাটবাঁধা পলির ডিপি কেটে চলে। কিন্তু বিস্তৃত জলের তলায় তারা কী কাটছে না-কাটছে সে হিসাব কে রাখে? ইতিমধ্যে এই নিয়ে খণ্ড খণ্ড তর্ক শুরু হয়েছে। সে তর্ক ভারত-বাংলাদেশের পানিবণ্টন, পানিচুক্তি, ট্রানজিট, করিডর হয়ে দু-তিন দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে।’
পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ছোটগাল্পিকের বিশেষ শিল্পবৈশিষ্ট্য। পারভেজ হোসেনের পর্যবেক্ষণক্ষমতা তীক্ষ এবং সৃষ্টিমুখী। ফেরির ছোট্ট হোটেলটার সামনে এনে জ্যোৎস্না আর আকবরের দৃষ্টিকোণে ধরা এই ছবিটায় পারভেজের পর্যবেক্ষণ লক্ষ করার মতো: ‘গোগ্রাসে গিলে গিলে গাওগেরামের যাত্রীরা মাছের কাঁটা, মুরগির হাড্ডি, থকথকে ঝোল আর ছিটকে পড়া ডাল দিয়ে এমন নোংরা বানাচ্ছে টেবিলগুলো, মাছি ভনভন করছে। বোটকা গন্ধভরা ভেজা ত্যানা দিয়ে মুছেটুছেও তেমন জুত করতে পারছে না ছেলে-ছোকরাগুলো। একধরনের ঘিনঘিনানিসহ জ্যোৎস্নাকে নিয়ে ওরই মধ্যে এক কোনায় জানলার পাশে বসে পড়ে আকবর।’
পারভেজের গল্পের একটা সাধারণ প্রবণতা, সুযোগ পেলেই তাঁর ছোটগাল্পিক সত্তা সন্ধান করে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে কোনো দার্শনিক প্রতীতি। সহজ কথা—পারভেজ হোসেনের সব গল্পেই আছে একটি দার্শনিকতার ছোঁয়া। ফেরিতে উদাস বাউলের গান শুনে জ্যোৎস্নার মনোলোক উদ্ভাসিত হয় যে-দার্শনিকতায়, লেখকের সর্বজ্ঞ দৃষ্টিকোণে তা ধরা দেয় এভাবে: ‘গান আর হচ্ছে না দেখে মুহূর্তে দর্শক পাতলা হয়ে এসেছে। সঙ্গিনীসহ ধীরে ধীরে উঠে পড়ল লোকটি। অচঞ্চল চোখে চেয়ে থেকে কোমল গলায় বলল, তেষ্টা নেই যে মা জননী। চারদিকে অফুরান জল আর কী খোলা হাওয়া, সম্মতি দেন তো ঘুরে দেখি। শুনে ওর সমস্ত হূদয় কেঁপে উঠল যেন। ওদের দিকে আনমনে নির্নিমেষ তাকিয়ে থেকে জ্যোৎস্নার মনে হলো, সৃষ্টি পথে পথে যে বিরাট সুন্দর আর বিস্ময় তারই অন্য এক আরাধনায় মজে আছে এরা। এদের স্বাভাবিক গতি আর সহজ চলাচলে জীবনের সাড়া আছে ঠিকই, কিন্তু কোথাও কোনো তাড়া নেই।’
‘শাদা বেড়াল’ একটি প্রতীকাশ্রয়ী গল্প। আধুনিক জীবনের প্রেম আর প্রেমহীনতার গল্প ‘শাদা বেড়াল’, মানুষের অন্তর্গত যন্ত্রণার শিল্পকথা ‘শাদা বেড়াল’। মা আর মেয়ের এই গল্প মানুষের অন্তর্গত নৈঃসঙ্গ্য-যন্ত্রণা আর অনন্বয়ের অনুপম এক শিল্পভাষ্য—একই সঙ্গে এ গল্প সঙ্গলাভের বাসনায় উন্মুখ আধুনিক মানুষের অনন্ত আকুতিরও শিল্পকথা। গল্পের সমাপ্তিতে একটি প্রতীকের সহায়তায় লেখক তুলে ধরেছেন আধুনিক মানবচৈতন্যের এই দ্বিমুখী স্বভাব: ‘বেড়ালটা আবারও লাফিয়ে উঠেছে টেবিলে। ক্ষুধার্ত সে, তাই নিষেধ মানছে না।’
ডুবোচর গ্রন্থের ‘নষ্ট সময়’ গল্পে শিল্পিতা পেয়েছে নিষিদ্ধ রাজনীতির অর্থহীন পরিণতির কথা, পক্ষান্তরে ‘কারিগর’ গল্পে আছে পাহাড়ঘেরা অরণ্য-জনপদের নানামাত্রিক অনুষঙ্গ। আদিবাসীদের সংস্কৃতি সম্পর্কে লেখকের পর্যবেক্ষণ ‘কারিগর’ গল্পের উজ্জ্বল এক প্রান্ত। ‘কড়ির বাজার’ গল্প গড়ে উঠেছে শেয়ারবাজারের বাস্তবতা নিয়ে। এ গল্পে পরাবাস্তববাদী পরিচর্যা পারভেজের শিল্পপ্রতিভার বিশিষ্টতার পরিচয়বাহী। ‘ফাঁদ’ গল্পে পারুলের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণেও আছে পরাজয়ের নিপুণতার পরিচয়। প্রতিটি গল্পেই পারভেজ হোসেন শব্দ-ব্যবহার, ভাষা-নির্মাণ, অলংকার সৃজনে দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন।
পারভেজ হোসেন নিরন্তর লেগে থাকলে ছোটগাল্পিক হিসেবে নিজের আসনটি পোক্ত করতে পারবেন বলে আমি আশাবাদী। তাঁর ডুবোচর আমাকে আশান্বিত করেছে—প্রত্যাশা করি, এবার তিনি উপনীত হবেন নতুন কোনো স্বপ্নের দারুচিনি দ্বীপে।