তিনি এবং গৌরীপুর জংশনের মানুষজন
>এখনো প্রবলভাবে জীবন্ত হু্মায়ূন আহমেদ। ১৯ জুলাই ছিল নন্দিত এই কথাসাহিত্যিকের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁকে নিয়ে আয়োজন

গৌরীপুর জংশন বাস্তববাদী সাহিত্যকর্মের উল্লেখযোগ্য নমুনা। এক উপন্যাসতাত্ত্বিক একবার লিখেছিলেন, উপন্যাস লেখা এক অর্থে গবেষণাকর্মের মতো। সাহিত্যের বাস্তববাদী ঘরানার জন্য কথাটা খুব সত্য। নিপুণ মাঠ সমীক্ষা, প্রতিনিধিত্বশীল চরিত্র বাছাই আর স্থান-কালের নির্বাচিত পটভূমিতে নির্বাচিত ঘটনার বিস্তার। সৃষ্টিশীলতার রহস্যময় ভুবনে কথাগুলো যান্ত্রিক শোনায় বটে। কিন্তু দুনিয়ার গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাসের বড় অংশই তো আসলে তথ্য-উপাত্তের নজরকাড়া প্রদর্শনী। তবে হ্যাঁ, তথ্যগুলো রেখে-ঢেকে প্রকাশ করতে হয়। চরিত্রের আড়াল, কাহিনির আড়াল আর ভাবের মোড়কে তথ্য-উপাত্তের কর্কশ কিনারাগুলো চাপা পড়ে যায়। হু্মায়ূন আহমেদও তা-ই করেছেন। তাতে অবশ্য ওই রেলস্টেশন আর সংশ্লিষ্ট মানুষগুলো আবছা হয়ে যায়নি। বরং আরও প্রগাঢ় হয়ে উঠেছে এক জংশন আর মানুষের যৌথ মুখ।
স্টেশনটি আকারে ছোট। কিন্তু নানা স্তরের যে মানুষগুলো সেখানে জীবন আর মৃত্যুর খেলা জমিয়ে রাখে, তাদের কাহিনি তো ছোট নয়। কাঠামোটা হুমায়ূন পরিচ্ছন্ন করেই আঁকেন। একদিকে থিতু রেললাইন আর গতিশীল ট্রেন, অন্যদিকে মালঘর, অফিসঘর, ওভারব্রিজ আর দোকানঘর থেকে বাজারি মেয়েদের আখড়া পর্যন্ত বড় অঙ্গনের নিখুঁত ছবি আঁকেন লেখক। পাঠককে দেখতে দেন এই বিরাট অঙ্গনের সুনসান পরিসর। ঘোর বর্ষায় বা প্রচণ্ড কুয়াশায় বা শেষ রাতে পুরো স্টেশনটির মুখ ঝাপসা হয়ে এলে কেমন রহস্যময় হয়ে ওঠে প্রাঙ্গণটি, তার একাধিক ছবি বয়ানের ভাঁজে ভাঁজে নিপুণ বিরাজমান থাকে। এবার বিরান ছবিগুলো ভরে তোলা যাক মানুষের আনাগোনায়। তাহলে বোধ হয় স্টেশনের অফিসার, মালবাবু, ঘণ্টিওয়ালা, পাহারাদার, যাত্রী—এদের দেখা পাওয়ার কথা। এরা সবাই আছে। আছে কুলির দল আর কুলি-সরদার। এমনকি স্টেশনের পাশের হিন্দু আর মুসলমান চা-দোকানদারকেও পরিষ্কার চেনা যাচ্ছে।
এ রকম ন্যাড়া বাস্তবে এসে কোনো লেখকই থামেন না। হুমায়ূনও থামেননি। স্টেশনে জীবন-কাটানো মানুষজনই হয়েছে তাঁর প্রধান অবলম্বন। যারা কাজকাম সেরে চলে যায় অন্য কোথাও, তারা নয়; যাদের গতি-স্থিতি চিহ্নিত হয়ে আছে এই স্টেশনের সীমায়, তাদের গল্প গৌরীপুর জংশন। কিন্তু এদের কথা শুধু এদের কথাই নয়। কাউকে তো চিনতে হয় অন্যদের দিয়েই। শ্রেণিকাঠামো আর ক্ষমতাকাঠামোর বড় মানচিত্রের মধ্যেই চেনা যায় ব্যক্তিকে। হুমায়ূন তাঁর স্বভাবসুলভ নিস্পৃহ-নিম্নকণ্ঠে এঁকে গেছেন এই বড় কাঠামোর নিখুঁত ফর্দ। ইট-কাঠ-পাথরের অবকাঠামোটিকে প্রাণ দিয়েছেন মানুষের স্পর্শে। জায়গাটা রেলস্টেশন হওয়ায় চলমান ট্রেন আর দ্রুত সঞ্চরণশীল মানুষসকল তাদের আবছা মুখ নিয়ে হাজির হয়েছে ক্ষণিকের জন্য। আবার ট্রেন চলে যাওয়ার পরও যে চলিষ্ণুতা স্টেশনকে জমিয়ে রাখে, তার মূর্তিও অঙ্কিত হয়েছে। উৎপাদন আর বিলি-বণ্টনের ব্যাপারে লেখক পর্যাপ্ত পরিমাণে সজাগ ছিলেন। ক্ষমতার বিচিত্র ধরনও তাঁর বিবেচনায় ছিল। সবচেয়ে বড় কথা, স্টেশনের উৎপাদনব্যবস্থা আর ক্ষমতা-সম্পর্কের নিরিখে মানুষগুলোর আচার-আচরণ নিরূপিত হয়েও ব্যক্তির বিশিষ্টতা মোটেই ক্ষুণ্ন হয়নি। নিপুণ গল্প-বলিয়ে হুমায়ূন জংশনের এই নাতিদীর্ঘ গল্প বলায়ও বেশ মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। যথেষ্ট কারিগরি দেখিয়েছেন কাহিনির সময়-ব্যবস্থাপনায়। পুরো গল্পটি আঁটিয়ে নিয়েছেন এক দিন সময়ের মধ্যেই। গৌরীপুর জংশন উপন্যাসটি এভাবে ধ্রুপদি ‘বাস্তববাদী’ রচনার অনেকগুলো গুণ বেমালুম হজম করে নিয়েছে।
কিন্তু, সত্য হলো, ওপরের পরিচিতিমূলক বয়ানে উপন্যাস বা উপন্যাসিকাটির মর্মের হদিস পাওয়া যাবে না। সত্য হলো, ওপরে বর্ণিত কাঠামো রচনাটির কাঠামোই কেবল, সার নয়। প্রকৃত সত্যের গোড়ায় আছে এ তথ্য যে উপন্যাসটি জয়নালের মুখ দিয়ে বলা, তার চোখ দিয়ে দেখা, তার নিজেরই গল্প। গল্প বলায় লেখকও অংশ নিয়েছেন। বলা যায়, এটা একটা যৌথ প্রযোজনা। তাতে অবশ্য জয়নালের চোখ-গলা-চিন্তার নিঃসংশয় কর্তৃত্ব ক্ষুণ্ন হয়নি। এ গল্প ষোলো আনাই তার নিজের; কিন্তু তাতে স্টেশনের ভাগে একটুও কম পড়েনি।
জয়নাল স্টেশনের এক মাজুল কুলি। সেই ছোটকালে এসেছিল এখানে। সম্প্রতি কোমরে বস্তা পড়ে তার পা অচল হয়েছে। চেয়ে-চিন্তে বা ছোটখাটো চুরি-বাটপারি করে এখন তার দিন কাটে। আগে তেজি শরীর ছিল। বিস্তর মাল বইত। বাইরে অন্য কাজও করেছে। অল্প কিছুদিনের সংসারজীবনের অভিজ্ঞতাও আছে তার ঝুলিতে। এখন সেসব শুধুই স্মৃতি। এক দিনের এই গল্পে জয়নাল যখন আমাদের সঙ্গী হচ্ছে, তখন তার তিনটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। এক. সে আগাগোড়া স্টেশনের মানুষ। তার অভিজ্ঞতায় দূরের কোনো বাস্তব নেই। ‘সুষ্ঠু’ সামাজিক-পারিবারিক সম্ভাবনা নেই। স্টেশনের সীমায় তার স্থিতি ও পরিমিতি। দুই. সে দুরারোগ্য শারীরিক অক্ষমতায় আক্রান্ত। তার সমগ্র চিন্তা আর তৎপরতায় সেই অক্ষমতার চিহ্ন। তিন. সে সব অর্থেই অ-ভদ্রলোক। হতদরিদ্র, নিম্নবিত্ত বা নিম্নশ্রেণির মতো পরিচিত বর্গগুলোয় তাকে আঁটানো যায় না। ‘টোকাই’ শব্দটি চলতে পারত। কিন্তু তার বয়স আর চিন্তাধারা শব্দটির প্রচলিত ব্যঞ্জনার সঙ্গে যায় না।
এ তিন বৈশিষ্ট্যকে গভীর ‘বাস্তববাদী’ মর্যাদা দিয়ে গল্পটি বলা হয়েছে। কাজটা কঠিন। কঠিন কাজটা হু্মায়ূন এত অবলীলায় করেছেন যে চটজলদি তা চোখেই পড়ে না। কথাটা খুলে বলা যাক। আমাদের পরিচিত কাহিনির জগৎ আসলে ভদ্রলোকদের জগৎ। হয় ভদ্রলোকের কাহিনি, নয়তো ভদ্রলোকের দৃষ্টিতে দেখা ছোটলোকের কেচ্ছা। ছোটলোকের কাহিনি বলার ক্ষেত্রে লেখকের অভিজ্ঞতার বর্ণাঢ্যতা এবং সহানুভূতি আমাদের বিস্ময় জাগাতে পারে। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বহু রচনায় এ বস্তুর দেখা মেলে। কোনো বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির জিম্মায় নিখাদ বাস্তববাদী বয়ানেও গরিব মানুষের গল্প বলা যায়।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ধরন অনেকটা এ রকম। গৌরীপুর জংশনে ঘটেছে একেবারেই উল্টো ঘটনা। এখানে গল্প বলা হয়েছে জয়নালের মাপে। জয়নালের স্মৃতি-সত্তা-ভবিষ্যতের মাপে। বলা যায়, গল্পে জয়নালের এজেন্সি বা কর্তাসত্তা রক্ষিত হয়েছে। সে নিজেকে দেখেছে; অন্যকেও দেখেছে। তার জীবনদৃষ্টির ছাঁচে-মাপে অন্যরা উপস্থাপিত হয়েছে। সে-ই সিদ্ধান্তসূচক মন্তব্যগুলোর কর্তা। অত্যন্ত প্রান্তীয় মানুষের ‘ছোট’ আওতার মধ্যে কাহিনি আঁটিয়ে ফেলা কঠিন। সাহিত্যের বাজারে এ বস্তু খুব সুলভ নয়।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘নয়নচারা’ গল্পও একই টেকনিকে লেখা। আমু আর লেখকের যৌথ বয়ানে। ওয়ালীউল্লাহ অবশ্য আমুর দৃষ্টিকোণ নিখুঁতভাবে রক্ষা করেছেন। লেখকের স্বরকে প্রকাশ্যে আনেননি। ফলে তাঁকে মনোলগের আশ্রয় নিতে হয়েছে; চেতনাপ্রবাহরীতির অনুরূপ ভঙ্গিতে যেতে হয়েছে। হুমায়ূন কৌশলটাকে খানিকটা সরল করে এনেছেন। জয়নালের কথকতা প্রকাশ করেছেন লেখকের নিজের বয়ানে। এটা হুমায়ূনের একধরনের সমঝোতা—পাঠকের জন্য বর্ণনাকে অপেক্ষাকৃত আরামদায়ক করে নেওয়া। কিন্তু এ সারল্য তারল্যকে প্রশ্রয় দেয়নি। লেখক বর্ণনাটা করেছেন, কিন্তু কোথাও সবজান্তা লেখকসত্তার সুবিধাটা নেননি। পুরো উপন্যাসটি বর্ণিত হয়েছে এমনভাবে যে সর্বনাম আর ক্রিয়াপদ পাল্টে নিলেই তা সরাসরি জয়নালের স্বগতোক্তিতে পরিণত হবে। জয়নালের নিচু অবস্থান থেকে, পাশ থেকে ঘটনাগুলো বর্ণিত হয়েছে। লেখকের অবস্থান বা ওপর থেকে নয়; জয়নালের অনুপস্থিতিতেও নয়। যেমন চুরির ঘটনার পর স্টেশনে পুলিশ আসে। চুরি করেছে এ অঞ্চলের বিখ্যাত ঠগ ইয়াদ আলি। ঘটনাটা বর্ণনা করেছেন লেখক। বলেছেন : ‘এই ভীড় এবং হট্টগোলের মাঝে ইয়াদ আলির সাগরেদ কনের দু’টি স্যুটকেস নামিয়ে ফেলল। নামাল সবার চোখের সামনে কেউ তা দেখলও না। জয়নাল শুধু বলল, ব্যাটা। সাবাস।’ অর্থাৎ লেখক আমাদের নিশ্চিত করলেন, জয়নালের দেখা ঘটনাই তিনি তাঁর পক্ষ থেকে বর্ণনা করলেন মাত্র। ইয়াদ আলিকে সবাই চেনে। সে যখন স্টেশনে আসে, তখন কোনো না কোনো ঘটনা ঘটবেই। কাজেই জয়নাল তাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করছিল। সে যতটা দেখেছে, ততটাই বর্ণনার সীমা।
কিন্তু জয়নালের সঙ্গে জংশনের ছবিটাও আঁকতে হবে। সে ছবিতে সামগ্রিকতার বোধও চাই। হুমায়ূন ব্যাপারটা সম্ভবপর করেছেন জয়নালের দুই গুণের বরাতে। এক. জয়নালের বয়স হয়েছে। দীর্ঘদিনের পরিচয় স্টেশনের অস্তিত্বের সঙ্গে তাকে একাকার করে দিয়েছে। বাইরের কাঠামো তো বটেই, ভেতরের অপ্রকাশ্য কাঠামোগুলোর সঙ্গেও তার পরিচয় অতি নিবিড়। দুই. জয়নালের স্বভাবে একটা স্বাভাবিক চিন্তাশীলতা আছে। তার ব্যক্তিত্বে এমন একটা ব্যাপার আছে, যা তার ‘ছোটলোকি’ দূর করেনি, কিন্তু সংশ্লিষ্ট অনেকের কাছে তাকে প্রয়োজনীয় পরিমাণে গ্রহণীয় করেছে।
জীবনের অভিজ্ঞতার কারণেই জয়নালের দৃষ্টিভঙ্গিতে একটা ঔদার্য এসেছে। এ ঔদার্য আসলে লেখক হুমায়ূনেরই বৈশিষ্ট্য। ভালো-মন্দের প্রচলিত-প্রতিষ্ঠিত ছকে তিনি কথা সাজান না। চরিত্র বা ঘটনাকে নিজের কবজায় এনে একস্বরী করে ফেলেন না। জয়নালের মধ্যে তিনি নিরীহ ভালো মানুষ আবিষ্কার করেননি; আবার ধূর্ত শয়তানরূপেও তাকে দেখেননি। একই ধরনের ‘লিবারেল’ দৃষ্টিতে জয়নাল তার চারপাশকে দেখেছে। মালবাবু, কুলি-সরদার মোবারক বা হাশেম, সিগন্যালম্যান রমজান, নিজের সাবেক স্ত্রী অনুফা—প্রত্যেকেই নিজ নিজ অবস্থা আর অবস্থান বজায় রেখে তার সঙ্গে মিশেছে; ঘটনা ও পরিস্থিতি অনুযায়ী কাজ করেছে। জয়নাল তাদের দেখেছে নিজের অবস্থান থেকে। আবার সাধ্যমতো ওদের অবস্থানকে মূল্য দিয়েই ঘটনাগুলো বর্ণনা করেছে। উপন্যাসের শিল্পরীতির দিক থেকে এর মূল্য অনেক। একজন ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গির প্রবল প্রতাপের মধ্যেও এ উপন্যাসে যে বহুজনের স্বর শোনা যায়, তার মূলে আছে জয়নালের দৃষ্টির ঔদার্য।
এখানে আবার জয়নালের কর্তাসত্তার কথা টানা দরকার। ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ভিখু-পাঁচীর প্রেম-সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছিলেন। তাঁর ওই অবস্থানের ভিত্তি ছিল নিম্নশ্রেণির মানুষ সম্পর্কে তাঁর সে সময়ের দার্শনিক সিদ্ধান্ত। সিদ্ধান্তটি এই যে নিম্নশ্রেণির মানুষের দেহাতিরিক্ত কোনো অস্তিত্ব থাকতেই পারে না। জয়নাল সম্পর্কে হুমায়ূনের সিদ্ধান্ত কিন্তু একেবারেই বিপরীত। জয়নাল সব-অর্থেই সীমিত জীবন যাপন করে। কিন্তু তার জীবনযাপনের সীমার মধ্যেই সে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে পরিপূর্ণ স্বাধীন দৃষ্টিভঙ্গিও লালন করে। দৃষ্টিভঙ্গিটি তার অভিজ্ঞতার মাপে গড়া। কিন্তু তাতে কোনো অপূর্ণতা নেই। তাকে ছেড়ে গিয়ে অনুফা যে অন্য একজনকে বিয়ে করেছে, সেখানেও টিকতে না পেরে তার ঠাঁই হয়েছে পাড়ায়—তার জন্য সে অনুফার প্রতি কোনো ধরনের বিরাগ পোষণ করে না। নিজের অক্ষমতাকে সে মেনে নেয়। জীবন রক্ষার জন্য যেমন, তেমনি বাসনার আংশিক পরিপূরণের জন্যও সে নানা ধরনের সমঝোতার মধ্য দিয়ে যায়। তার শ্রেণির প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রেই অস্তিত্ব রক্ষার প্রাথমিক দায় সে অনুমোদন করে। এমনকি তার নিজের ক্ষেত্রেও। এই বাস্তবতা তার দেখা ভদ্রলোকদের বিপরীত। ফলে তার নৈতিকতা ও মূল্যবোধে একটা বিশেষত্ব আছে। গরিবি, অসামর্থ্য আর অনিশ্চয়তা সে নৈতিকতার ভিত্তি। এর মধ্যেই মানুষ সম্পর্কে, জীবন সম্পর্কে একটা দার্শনিক বোধ তার মধ্যে জমতে থাকে। কোনো আরোপিত বোধ নয়, বৃহৎ-মহৎ কোনো ব্যাপার নয়। খুব বাস্তবসম্মত আর পূর্ণাঙ্গ। এ উপন্যাসে হুমায়ূনের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব এই বোধের সীমা-সম্পন্নতাকে পূর্ণ মূল্য দিয়ে এক পূর্ণাঙ্গ জীবনালেখ্য নির্মাণ করতে পারা। কথাসাহিত্যে লেখকের ‘সহানুভূতিশীলতা’ বলে যে বস্তুর কথা আমরা কোনো কোনো লেখকের ক্ষেত্রে উচ্চারণ করে থাকি, এ তার এক নতুন মাত্রা।
এ কারণেই লোহার রড হাতে কুলি-সরদার যখন এগিয়ে যায় রমজানের ঘরের দিকে, যখন আসন্ন খুনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজের অক্ষমতার মধ্যে জয়নাল মানুষের সার্বিক নিয়তির এক ছোট্ট টুকরা অভিনীত হতে দ্যাখে, তখন তার অস্ফুট বিলাপকে আমাদের অতিশয় ন্যায্য বলেই মনে হয়। জংশনের ক্ষমতা-সম্পর্কের ব্যাকরণগুলোকে আমরা এ ঘটনায় প্রত্যক্ষ করি; আর জয়নালের কান্না মানুষের কান্না হয়েই দিগন্তবিস্তারি হয়ে ওঠে। তার যাবতীয় গরিবি আর নীচতা অতিক্রম করে সে মানবসমাজের একজন প্রতিনিধিই হয়ে ওঠে। হুমায়ূন ‘অপর’ জয়নালের মুখ দিয়ে, চোখ দিয়ে, অনুভূতি দিয়ে ‘মানুষে’র গল্পকেই সম্ভবপর করেন।
গৌরীপুর জংশনের আরেকটি দিক খুবই উপভোগ্য। লেখকের সুমিতি। পাঠককে আবেগে ভাসিয়ে দিয়ে লেখক যে নির্মমভাবে নিরাসক্ত থাকতে পারেন, আর সেই নির্মম নিরাসক্তিকে যে বেমালুম ঢেকেও রাখতে পারেন, তার ভালো উদাহরণ এ ছোট্ট উপন্যাস। অবশ্য হুমায়ূনের সব গুরুত্বপূর্ণ রচনারই এ এক ঈর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য।