তৈমুর, ব্ল্যাক উইডো এবং আমাদের শেয়ার্ড সিনেম্যাটিক ইউনিভার্স

অলংকরণ: মনিরুল ইসলাম

‘শোনো মিয়া, অ্যাকট্রেস হিসেবে স্কারলেটের একটা হেডম আছে, কী কও?’

মেসেঞ্জারের জানালায় ভেসে ওঠা শব্দগুলোর দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকার দরকার পড়ল না তৈমুরের। স্মার্টফোনের টাচপ্যাডে তার অভ্যস্ত আঙুল নাচতে শুরু করল, ‘হ, ঠিকই বলছ। সু করাই ঠিক হইছে ডিজনিরে।’

এরপর বন্ধু বিকনের সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে এ নিয়েই কথাবার্তা চালাচালি হতে থাকল তার।

‘স্কারলেটের সঙ্গে চুক্তিতেই ছিল কম পারিশ্রমিক এবং রেভিনিউ শেয়ার। আর ডিজনি করল কী? সিনেমা হলের সঙ্গে সঙ্গে ওটিটিপিতেও ছবি রিলিজ দিয়ে দিল!’

‘এই কাজ করায় স্কারলেটের কত লস হইল অনুমান করো।’

‘আরে জানি তো, ফিফটি মিলিয়ন ডলার, ক্যান ইউ ইমাজিন?’

‘হ্যাঁ। সিনেমা খাইছে ফ্লপ। ওটিটিপিতে এক স্ক্রিনে ১০ জন মিলে দেইখা নিতে পারে কনটেন্ট। এই কোভিড টাইমে হলে যাওয়া এমনিতেই কমায়ে দিছে মানুষ।’

কফির মগে চুমুক দিয়ে তৈমুর কথা শেষ করল, ‘যা-ই বলো, ডিজনির মনপোলি কিন্তু ভয়ানক। ওই দিন কে জানি কইতেছিল যে ডিজনি হলিউডের দখল তো নিয়াই নিছে লাস্ট ১০ বছরে। একসময় নাকি ইউএসের দখলও নিয়ে নেবে। হা হা হা।’

ওপাশ থেকে বিকনের জবাব এল, ‘শুধু ইউএস? দুনিয়ার দখল না নিয়া নেয় দেখো আগামী ৫০ বছরে। হালারা নিও ইলুমিনাতি।’

ফোনটা বালিশের পাশে রেখে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল তৈমুর। দেয়ালে ঠেস দিয়েই সে বসে ছিল। রাত পৌনে তিনটার মতো বাজে। ওয়াশরুমে যাওয়া দরকার। ঘর থেকে বের হওয়ার আগে কি-বোর্ডের স্পেস বাটনে দুবার চাপ দিতেই জ্বলে উঠল ২৪ ইঞ্চির মনিটর। হাত বাড়িয়ে বিছানার মাঝখান থেকে কফির মগটা তুলতে গিয়ে কাত হয়ে পড়ে গেল। অর্ধেকটা ভরা ছিল মগ। আকাশি বিছানার চাদরের কী হাল হয়েছে, তা জানতে দ্রুত আলো জ্বালাল সে। অন্ধকার-সওয়া চোখ দুটোয় ব্যথা করে উঠল। যেখানে পড়েছে কফি, সেখান থেকে সরু কয়েকটা ধারা নালার মতো ছড়িয়ে গেছে। শুষে নিতে সময় লাগবে। কী ভেবে সে ডান হাতের তালু দিয়ে ঝেড়ে ফেলতে চেষ্টা করল সবটা। এবার ক্ষতিটা বিকট আকার নিল। কফি পুরো চাদরে বিচ্ছিরিভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে বড় বড় ফোঁটায়। আম্মা কাল সারা দিন চেঁচাবে!

বিরক্ত হয়েই সে ডাইনিংরুমে এসে পানি গিলল। ফ্রিজ খুলে দেখল খাওয়ার মতো কী আছে। প্লাস্টিকের বাটিতে নুডলস দেখা যাচ্ছে। সেটা বের করে বাটিসহই দিল ওভেনে ঢুকিয়ে। তারপর ওয়াশরুমে ঢুকে প্রস্রাব করতে গিয়ে মনে পড়ল আগামীকাল সন্ধ্যায় তাদের ফুটবল গ্রুপে একটা লাইভ আছে। বার্সেলোনা এই ট্রান্সফার উইন্ডোতে সিবি হিসেবে কাকে কিনতে পারে, সে বিষয়ে আলোচনা।

আয়নায় নিজের চেহারার দিকে তাকিয়ে বেশ লাগল। দিন দুয়েক আগে শেভ করেছিল। হালকা দাড়ি গজিয়েছে। চুলগুলো বেড়ে এলোমেলো হয়ে থাকায় আরেক রকম সৌন্দর্য তৈরি হয়েছে।

নুডলসের বাটি হাতে কম্পিউটারের সামনে বসল সে। ইউটিউব অন করে অনেকক্ষণ ধরে মর্টাল কমব্যাট ইলেভেনের গেমপ্লে দেখল। নতুন অনেকগুলো ক্যারেক্টার এসেছে। যেমন রবোকপ। অটোমেটিক স্পাইক বের করে যেভাবে সে অপোনেন্টের এবডোমেন আর কণ্ঠা ছিঁড়ে আনে, দেখলে একটা আলাদা উত্তেজনা কাজ করে। প্রায় সব কটি নতুন ক্যারেক্টারের ফেটালিটি সিনগুলো টেনে টেনে দেখল তৈমুর। কেমন চাপা একটা আনন্দ আছে এতে। এই গেম গ্রাফিকসকার্ডের অভাবে সে খেলতে পারছে না। বাবার কাছ থেকে টাকা চাওয়ার দৃশ্যটা কল্পনা করেও তার ক্লান্ত লাগল।

ওসব দেখতে দেখতেই এলাকার মসজিদগুলোয় ফজরের আজান পড়ে। তারপর একসময় আলো ফোটে বাইরে। ঘরে মশা কোত্থেকে ঢুকল কে জানে। ঢাকায় আজকাল ডেঙ্গুর প্রকোপ। তৈমুরের মনে পড়ল, ডেঙ্গু কামড়ায় ভোরে নইলে সন্ধ্যায়। এসবের মাঝখানেই সে ফেসবুকে উঁকি মেরেছে একেকবার। মার্ভেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্সের সহ-অভিনেতারা কেন স্কারলেটের পক্ষে এখনো কথা বলেনি, এ নিয়ে কমেন্ট চালাচালি হচ্ছে গ্রুপে। স্কারলেট না হয়ে রবার্ট ডাউনির সঙ্গে এমন করলে লোকটা সাপের পাঁচ পা দেখিয়ে দিত প্রডিউসারদের। তার নিজেরও ইচ্ছা করল কমেন্ট করে একটা। ইনবক্সে অনেকেই নক দিয়ে রেখেছে, সে সিন করেনি। এখন কমেন্ট করলে অনেকেই বুঝে নেবে যে সে জেগে আছে।

ব্ল্যাক উইডো এখনো দেখা হয়নি তার। আজ দেখলে কেমন হয়? বাইরে বৃষ্টি নামল। জমজমাট পরিবেশ।

দুই.

ঘুম থেকে উঠতে দেরি হওয়ায় ডেইলি মিটিং মিস হয়েছে দস্তগীরের।

ক্লান্ত চোখে ল্যাপটপের পর্দায় রানিং স্প্রিন্টের আপডেট চেক করতে করতে তার মনে হলো, দু-এক দিন মিটিং মিস হতেই পারে। এই ওয়ার্ক ফ্রম হোম ভারি যন্ত্রণার।

নাশতার টেবিলে ডাক পড়ল এরপর। ডিমভাজা, আলুর ঝোল, লাল আটার রুটি। সঙ্গে কলা আছে। দস্তগীর তার কাপে চা ঢালতে ঢালতে তাপসীকে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার ছেলে উঠছে ঘুম থেকে? ওর ভার্সিটির কী অবস্থা? পড়ালেখা সব চুলায় গেল নাকি?’

তাপসী কিছুটা বিরক্তি নিয়ে উত্তর দিল, ‘রিমোট কাজ করতেছ এত দিন হলো, ছেলের খোঁজখবর জানো না। ও ঘুম থেকে উঠবে এখন? ঘুমাইতেই যায় বেলা ১০টায়।’

‘সারা রাত করে কী? পড়ালেখা নেই?’

‘ভার্সিটি তো বন্ধ। সেই গত বছর লকডাউন দিল, ভার্সিটি কি আর খুলেছে?’

‘বন্ধ তো কী? ঘরে বইসাও পড়ালেখা করা যায়। করে কী?’

‘কী করে আমি বুঝি না। রাতভর জেগে থাকে। খুটখাট করে। সারা দিন উল্টায়-পাল্টায় ঘুমায়। দুপুরে ওঠে। সন্ধ্যায় আবার ঘুমায়।’

দস্তগীর কিছুটা মন খারাপ নিয়ে নাশতা শেষ করল। শোয়ার ঘরের এক কোনায় সেট করা ওয়ার্কস্টেশন এখন তার পৃথিবী। রিমোট অফিসের পর যা হয়েছে, ২৪ ঘণ্টাই যেন কাজ। আরেক রকম নাগপাশ।

কিছুটা অপরাধবোধ নিয়ে তৈমুরের রুমে নক করল দস্তগীর। দরজা ভেজানো ছিল। ঠেলে ভেতরে ঢুকল। কেমন একটা দমবন্ধ করা ভ্যাপসা দুর্গন্ধ এল নাকে। বিছানা খালি। টয়লেটের দরজাও খোলা। উঁকি দিয়ে দেখল কেউ নেই ভেতরে। কয়েকবার ছেলের নাম ধরেও ডাকল সে।

তাপসী ছুটে এল কিছু সময় পরে। ফ্ল্যাটের দরজা ভেতর থেকে লকড। তারা কেউই বাইরে যায়নি এর ভেতরে। বাকি টয়লেটগুলোয় চেক করার পর কী করবে ভেবে পেল না ওরা। তৈমুরের রুমের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে রইল দুজন। বোকার মতো।

তাদের সামনে কম্পিউটারের স্ক্রিন জ্বলজ্বল করছে। সেখানে সিনেমা চলছে। লাল কস্টিউম পরা বিশাল এক সুপারহিরো সাদা কস্টিউমের এক সুন্দরী মেয়েকে জিজ্ঞাসা করছে, ‘নাতাশা, ক্যাপ্টেন আমেরিকা কি আমাকে মনে রেখেছে এখনো?’