
চুপ করে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি। মাথাটা ওর এক্বেবারে গেছে। পড়াশোনা কিচ্ছু করে না, পাগলি শুধু ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। অথচ এমনিতে সে ভালো ছাত্রী ছিল, এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে, ক্লাসেও ভালো রেজাল্ট করছিল। আর এখন আমি আসার পর থেকেই এই অবস্থা। তো, আমার বদনাম হবে কি না? অথচ আমার কীই-বা করার আছে! কী করে বোঝাই, আমার মতো একটা মানুষকে...আসলে আমি তো মানুষই না, যোগ্য-অযোগ্য তো দূরের কথা।
মোটে নিজের যন্ত্রণায় বাঁচি না! সত্যিই, ভয়ংকর রকম অশান্তিতে আছি। আমার সব রকম স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে। কোনো এক অজানা পাপে আমার মগজ ধোলাই করা হয়েছে, মেমোরি সেলগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে। অপরাধটা কী ছিল—তাও জানি না, মানে, মনে করতে পারছি না। কে আমার বাবা-মা, কোথায় আমার পরিবারের আর সবাই, কী আমার পরিচয়—কিচ্ছু মনে করতে পারছি না। শুধু জানি আমি মানুষ নই, জিনসন্তান। কিন্তু আর কিছুই মনে নেই। আমরা কোথায় থাকি, আমাদের ফ্যামিলি স্ট্যাটাস কী রকম, কেমনই বা আমাদের বাড়িঘর—কিছুই যেন জানি না। আমার জাতির কাউকে আমি দেখি না। তবে ওদের আনাগোনা টের পাই, শুনি হালকা কথাবার্তা-ফিসফিসানি, বিশেষ করে কোনো একজনের হিসহিসানি—আমার ছাত্রীর দিকে বেশি তাকালে।
সব মিলিয়ে উৎকট ঝামেলা। আর তার মধ্যে এই বালিকার এহেন অগ্রহণযোগ্য অসংলগ্ন অবিবেচক আচরণ।
টিউশনিটা ছাড়তেও পারি না, না পড়িয়ে পারা যাবে না, তা না হলে মিষ্টি খাব কী করে! এমনিতে আমি একদম কিছু না খেয়েও থাকতে পারি, দিনের পর দিন হাওয়া খেয়ে পার করে দেওয়া কোনো ব্যাপারই না। কিন্তু মিষ্টি? টাকা না হলে চমচম খাব কী করে? ক্ষীর-হালুয়া কিংবা মোয়া-লাড্ডু ছাড়া আমি এক দিনও থাকতে পারব না। অথচ চুরি করতে গেলেই খবর হয়ে যাবে, বেজে উঠবে পাগলাঘণ্টা।
খুব সম্ভব এখন আমি কোনো শুদ্ধিপ্রহর পার করছি এখানে, কোথাও কোনো উল্টোপাল্টা হয়ে গেলেই অদৃশ্য স্পিকারে তুমুল সতর্কসংকেত বেজে ওঠে, যা কেবল আমিই শুনতে পাই। ঝনঝন করে ওঠে শৃঙ্খলের হুঁশিয়ারি। আবছা শোনা যায় ঘোড়ার হ্রেস্বা, সিপাহিদের দুদ্দাড় পদশব্দ। অনুভব করি যেন ঘিরে ফেলা হয় আমাকে। তখন দ্রুত আত্মসংবরণ করে শাস্তি এড়াই। ভয়ে দম বন্ধ হয়ে আসে। জীবন এখন বড়ই কঠিন রে বাবা।
তো, এই হচ্ছে অবস্থা।
এভাবেই যাচ্ছে দিন—আমি এবং আমার ছাত্রীর। ছাত্রী। কী পড়ে সে? এদের কিছু অদ্ভুত নিয়ম আছে পড়াশোনার। সারা বছর স্কুল কিংবা কলেজে যাওয়া-আসা করে, বাসায় এবং বিভিন্ন কোচিংয়ে দিনরাত পড়াশোনা করে তারপর এক নির্দিষ্ট তারিখ থেকে কয়েক দিনে সেটার পরীক্ষা দেয়, মানে এত দিনে কী শিখল, তার প্রমাণ দেয়। পরীক্ষার নিয়মটিও জটিল। কেউ একজন একটি প্রশ্নমালা তৈরি করে, সেই প্রশ্নপত্র একটি সরকারি ছাপাখানায় ছাপা হয়ে সারা দেশে বিলি হয়। সেই একই প্রশ্ন দেখে দেশের সব ছাত্রছাত্রী পরীক্ষা দেয়। আর মাত্র দুই দিন পরই শুরু হতে যাচ্ছে সেই রকম একটি পরীক্ষা। তার মানে প্রশ্নমালা তৈরি হয়ে গেছে, ছাপাও হয়ে গেছে। সব রেডি। মঞ্চ প্রস্তুত। এখন শুধু নির্দিষ্ট ক্ষণে কুশীলবদের আনুষ্ঠানিকতা। সারা বছর যা পড়েছে, সেসব উগরে দিয়ে আসবে পরীক্ষার খাতায়।
কিন্তু আমার ছাত্রী তো কিছুই পারে না। পেটে কিছু না থাকলে ওগরাবে কী? কোনো কিছুই সে পারে না।
পারবে কী করে, চূড়ান্ত অমনোযোগী। কিন্তু মুশকিল হলো, আগে তো সে ভালো ছাত্রী ছিল, আমি আসার পরই তার এই অবস্থা। পড়াশোনায় মন নাই, শুধু একভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। কেমন চোরের মতো ভাবভঙ্গি করে। ধমক দিলে একটুখানি বইয়ের দিকে তাকায়, কিন্তু একটু পরেই আবার আড়চোখে তাকাতে শুরু করে। কী দেখে কে জানে! নাকি আমাকে তার সুপারম্যান মনে হয়? সিনেমার নায়ক? হয়তো তার কাছে সালমান খানকে আমার তুলনায় পানসে লাগে, আমি নিশ্চয়ই আরও অনেক আকর্ষণীয়। হাহ্ বয়স, ছেলেমানুষি করার এই তো সময়। এই বয়সটা সত্যিই খুবই বিপজ্জনক।
আচ্ছা, আমার বয়স কত? আমি যখন অ্যানথ্রোপলোজি পড়তাম...আরে, কোথায় পড়তাম আমি? কবে? হঠাৎ হঠাৎ সিনেমার মতন কিছু ছবি ঝিলিক দিয়ে যায়: বইপত্র বুকে ধরে কুঁজো হয়ে চলমান একজন, হাঁটছে আলখেল্লা গায়ে, পোশাক উদ্ভট, আপেল বাগানে দৌড়াচ্ছে, স্ট্রবেরি কুড়াচ্ছে, মাড়াচ্ছে টমেেটা কিংবা আঙুর...বালিয়াড়ি ধূলিঝড় আবার বরফে মোড়া দুর্গম পথপ্রান্তর...কিন্তু কিছুই ঠিক ঠাহর করতে পারি না, পারম্পর্য খুঁজে পাই না। তার আগেই সব মিলিয়ে যায়।
জানি না এভাবে আরও কত দিন কাটাতে হবে!
কিন্তু আমার ছাত্রী?
কাল বাদে পরশু ওর এইচএসসি পরীক্ষা। অথচ অবস্থাদৃষ্টে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, কিছুই সে লিখতে পারবে না খাতায়। এবং যথারীতি সব দোষ পড়বে আমার ওপর। শুধু যে টিউশনিটা হারাতে হবে তা নয়, মানসম্মানেরও তো একটা ব্যাপার। আমার একটা দায়িত্ব আছে না! হোক না এক উটকো দায়।
কিন্তু কী করা যায়!
উপায় কী!
ভাবতে ভাবতে হঠাৎ একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। খুব সহজ একটা কাজ করতে হবে। করতেই হবে। এ ছাড়া আর কোনো রাস্তা খোলা নেই।
ওদের বাসা থেকে বের হয়ে সিঁড়িতেই নেই হয়ে গেলাম আমি। তারপর যা করলাম, সেটা আগে কখনো করিনি, আর করতে চাইও না, মনেও আনতে চাই না, চিরতরে ভুলে যেতে চাই।
এই লেখাগুলো আমার স্যারের ডায়েরিতে পেয়েছি। আমার বেভুলো টিচার একদিন ভুল করে তার ডায়রিটা ফেলে গিয়েছিল, তখন তার মধ্যে আমাকে নিয়ে লেখা এই পাতাগুলো পাই, সেটাই হুবহু টুকে নিয়েছি আবার আগের জায়গায় রেখে দেওয়ার আগে। আমি কখনই ডায়রি লিখি নাই, স্যারেরটা দেখে এখন লিখছি। আমাকে নিয়ে স্যারের ধারণা আগাগোড়াই ভুল। পড়া তো পারতাম না আসলে ভয়ে। আমি প্রথম থেকেই জেনে গেছি, লোকটা মোটেও কোনো মানুষ নয়। এমনকি একদিন সে ভুল করে দরজা না খুলেই ভেতরে ঢুকে পড়েছিল, তারপর প্যাসেজ ঘুরে আমাকে দেখে উল্টো আমাকেই দোষারোপ করল বাইরের দরজা খোলা রাখার জন্য। কিন্তু সে জানে না, সেই দিনই একটা ডোর চাইম লাগানো হয়েছিল দরজায়, খুললে বা বন্ধ করলে নাড়া খেয়ে বেশ জোরেই টুংটাং শব্দ করে। অথচ স্যার যখন ঢুকলেন, তখন কোনো রকম শব্দ শুনিনি আমি। কিন্তু কাউকে সে কথা বলতেও পারি নাই, কারণ সবাই ভাববে আমি পাগল। সত্যি বলতে কি, হয়তো পাগলই হয়ে যাব আমি। ওকে দেখলে ভয়ে নিশ্চল হয়ে তাকিয়ে থাকি, কিসের লেখা কিসের পড়া! ও যতক্ষণ থাকে, আমার হাত-পা শক্ত হয়ে আসতে থাকে, কী পড়ায় মাথামুণ্ডু কিছুই শুনি না, সারাক্ষণ শুধু কী করা যায়—ভাবতে থাকি।
তবে যা হোক, একটাই সান্ত্বনা—পরীক্ষার এক দিন আগে ওর এনে দেওয়া প্রশ্নগুলো পেয়ে আমি এবং আমার বন্ধুদের সবার গোল্ডেন জিপিএ কনফার্ম। ওগুলো সে কোথায় পেল জানি না। তা সে যা-ই হোক না কেন, পরীক্ষার হলে গিয়ে হুবহু সেই একই প্রশ্নপত্র পেয়েছি; একদম দাঁড়ি, কমাসহ।
পুরোনো খবরের কাগজ বেচতে গিয়ে হঠাৎ চোখে পড়ল, লোকটার ঝুড়িতে এটা-সেটার সঙ্গে সুন্দর একটা ডায়েরি। কৌতূহলবশত হাতে নিয়ে মনে হলো, হয়তো কেউ কুড়িয়ে পেয়ে বেচে দিয়েছে এটাকে। কারণ, অসম্পূর্ণ ডায়েরির মাত্র কয়টি পাতা লেখা হয়েছে। এবং আরও একটি বিষয় বেখাপ্পা লাগল, সেটি হচ্ছে, যেকোনো ডায়েরি শুরুই হয় নাম-ঠিকানা এবং ফোন নম্বর দিয়ে, কিন্তু এইটিতে সেসব কিছুই নেই। যা হোক, কিছুক্ষণ ইতস্তত করলেও অবশেষে কৌতূহলেরই জয় হলো, লিখিত পৃষ্ঠাগুলো না পড়ে পারা গেল না। এবং পড়ার পর...বিচলিত শিহরিত হয়েছি আমি। বেশ কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে থাকলাম ডায়েরিটার দিকে। হাতে ধরা জিনিসটাকে যেন কুড়ানো মানিকের মতো লাগল আমার কাছে।
কিন্তু, আমারও তো কিছু দায়বদ্ধতা আছে! আজগুবি অবিশ্বাস্য অধ্যায়টুকু তাই আমার পাঠকদের জন্য ‘হুবহু’ তুলে দিলাম, বিশ্বাস করা বা না করা আপনাদের নিজস্ব দায়দায়িত্ব। তবে ডায়েরিটা এখনো আমার কাছেই আছে, কেউ দেখতে চাইলে যোগাযোগ করতে পারেন।