তাঁদের জন্য শোকগাথা
দুটি দুঃসহ মৃত্যু: বড় কষ্টের, বড় বেদনার
‘কালি ও কলম’ সম্পাদক আবুল হাসনাত ও নাট্যব্যক্তিত্ব আলী যাকের। দুজনই ছিলেন লেখকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাঁদের প্রয়াণের পর এ লেখায় তাঁদের স্মৃতিচারণা করেছেন ফারুক আলমগীর।
দুটি মৃত্যু প্রায় নিকট সময়েই ঘটল, যা বড় কষ্টের, বড় বেদনার। প্রথিতযশা সাহিত্য সম্পাদক, বন্ধু আবুল হাসনাতের আচানক চলে যাওয়ার ক্ষতের ওপরেই চলে গেল আরেকজন প্রথিতযশা নাট্যাভিনেতা, বাচিক শিল্পী, লেখক, বন্ধু সতীর্থ আলী যাকের। জানি, মৃত্যু এখন প্রতিদিন ধাবিত হচ্ছে আমাদের বয়সী মানুষের পশ্চাতে। বয়স হচ্ছে, প্রাতরাশ টেবিলে প্রায়ই বিলম্ব ঘটছে আর তারই মধ্যে অনেকটা নিয়মিত নিষ্ঠুর সংবাদ পাই স্বজন হারানোর।
সংবাদ পাই বন্ধু, শুভানুধ্যায়ী, স্বজন, সতীর্থ আর এককালীন সহকর্মীÑসবার নীরব নির্গমনের। জানি, এখন যাওয়ার বয়স। কিন্তু এ কেমন যাওয়া? এমন যাওয়া যখন আমরা কেউ তাদের কাছে যেতে পারি না। এ যাওয়া তো যাওয়া নয়। কষ্টেরই প্রাকার যেন গড়ে তোলা হৃদয়ের নিষ্ঠুর সময়ের মধ্যখানে!
ভালো থাকো আবুল হাসনাত
কেমন নিঃশব্দে চলে যেতে হলো কবি, সাংবাদিক ‘কালি ও কলম’-এর সম্পাদক আবুল হাসনাতকে। বন্ধু ও প্রথিতযশা সম্পাদক মতিউর রহমানের কাছ থেকে জানতে পারি, হাসনাত নাকি প্রায় সুস্থ হয়ে উঠেছিল। দুই দিন আগে বোধ করি শুক্রবার বিছানায় উঠে বসেছিল। বলেছিল স্ত্রী মিনুর (নাসিমুন আরা হক) কাছে শরীর ভালো লাগার কথা। হাসপাতালে থাকার ইচ্ছা নেই। আগামীকাল বাসায় ফিরে যাওয়ার ইচ্ছাও ব্যক্ত করেছিল। একটা আশাবাদ জেগেছিল সবার মনে। কিন্তু দুই দিন পর সবাইকে বিষাদগ্রস্ত করে চলে গেল।
আবুল হাসনাতকে আমি জানি ষাটের দশকের প্রারম্ভকাল থেকে। তবে আবুল হাসনাত নয়, তাকে জানতাম কবি মাহমুদ আল জামান নামে। খুবই মৃদুভাষী ও স্বল্পবাক ছিল মাহমুদ আল জামান। আমাদের পরিচয়ের প্রথম সূত্রটা অন্যত্র এবং অন্য ধরনের। আমরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম পাঠ নিচ্ছি, তার কিছুদিন পরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গন রুদ্ররূপ ধারণ করে। শুরু হয় বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ দিনগুলো। আমতলায় প্রতিদিন ছাত্রসমাবেশ হতো, যেখানে ঢাকার বিভিন্ন কলেজের ও শিক্ষাঙ্গনের ছাত্রছাত্রীরা শামিল হতো। আবুল হাসনাত এবং আমি উভয়ে তখন বাম ধারার প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন তথা এপসুর সদস্য ছিলাম। হাসনাতকে ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় কর্মী হিসেবে দেখেছিলাম, যেমন দেখেছিলাম তার বন্ধু মতিউর রহমানকে। মতিউর রহমানও তখন একজন উঠতি কবি। প্রকৃতপক্ষে হাসনাত তথা মাহমুদ আল জামান, মতিউর রহমান ও আমি ছাত্র ইউনিয়নের, অর্থাৎ বাম ধারার মার্কামারা কবি হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে পরিচিতি পেয়েছিলাম। বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনের সময় যদিও আমরা নবীন, তবু সক্রিয় কর্মী হিসেবে সুনাম ছিল। বিশেষ করে মতিউর রহমান ও আবুল হাসনাতের।
এ সময় বাম ধারার কবি-লেখকদের একটি সংগঠন ছিল, যা তখনো আমার অজ্ঞাত। একদিন বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে এই সংগঠনের একটি সুশোভন সংকলন আমার হাতে এল, নাম শান্তির সপক্ষে আমাদের কবিরা। অবাক হয়ে দেখলাম, সেখানে আমার অগ্রজ কবি ও বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই বছরের সিনিয়র কবি আসাদুল ইসলাম চৌধুরী থেকে মাহমুদ আল জামানের কবিতা রয়েছে। খুবই রুচিশীল, পরিচ্ছন্ন একটি কবিতা সংকলন, সম্পাদনা করেছিলেন নিয়ামত হোসেন ও অজয় গুপ্ত। প্রকাশক ইমরুল চৌধুরী, সৃজনী লেখক গোষ্ঠীর পক্ষে, ২৫ দীননাথ সেন রোড, ঢাকা ৪। সৃজনীর সঙ্গে আমার পূর্বপরিচিত খেলাঘর, কচি-কাঁচার আসর ও মুকুলের মহফিলের ছোটবেলার লেখক কবি ইমরুল চৌধুরী খুব ঘনিষ্ঠ থাকায় ইমরুলের মাধ্যমে এক সন্ধ্যায় সৃজনীর দপ্তরে গিয়ে অনেকের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও পরিচিত হলাম। তাঁদের মধ্যে ‘শান্তির সপক্ষে আমাদের কবিরা’ সংকলনের দুই সম্পাদকসহ মোহাম্মদ মোস্তফা, আবু নাহিদ, শুভ রহমান, মনজুর আহমদ, ওয়াজেদ মাহমুদ, গোলাম মোহাম্মদ মাস্তানা, ইউসুফ পাশা, শহীদুর রহমান, মুহম্মদ আখতার, জিয়া আনসারী, টুটু রহমানসহ আরও অনেকের দেখা পেলাম। তাঁদের সবাই প্রগতিশীল সাহিত্যের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং মোটামুটি তাঁদের লেখা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ায় একটা পরিচিতি পেতে শুরু করেছে। কবি মাহমুদ আল জামানের সাক্ষাৎ আমি এখানেও পেয়েছিলাম। সুতরাং আবুল হাসনাত তার রাজনীতির দর্শন থেকেই প্রগতিশীল সাহিত্যের দিকে ঝুঁকেছিল।
পরবর্তীকালে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ‘কণ্ঠস্বর’ পত্রিকা ঘিরে আমাদের সাহিত্য আড্ডায় অনিয়মিতভাবে নিয়মিত তার উপস্থিতি ছিল। তখনকার পাবলিক লাইব্রেরির (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার) সামনের দিকে সবুজ লনে আমাদের সেই সাহিত্য আড্ডায় ‘স্বাক্ষর’ গোষ্ঠীর কবি-লেখকদের উপস্থিতিই ছিল সর্বাধিক। ‘স্বাক্ষর’ গোষ্ঠীর লালন-পালন করেছিলেন কবি সিকদার আমিনুল হক, ইমরুল চৌধুরী ও প্রশান্ত ঘোষাল এবং যার মাধ্যমে কবি রফিক আজাদের উত্থান ও প্রসিদ্ধি অর্জিত হয়েছিল।
মৃদুভাষী, বিনয়ী ও সজ্জন এই মেধাবী সম্পাদকের তিরোধানে আমাদের সাহিত্যাঙ্গনের অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হলো। বস্তুত তার লোকান্তর আমাদের একজন শ্রেষ্ঠ সাহিত্য সম্পাদকের মেধা, কর্তব্যনিষ্ঠা ও দক্ষতা থেকে বঞ্চিত করল। ব্যক্তিগতভাবে আমিও একজন পুরোনো, একই মতাদর্শী শুভানুধ্যায়ী বন্ধু হারালাম। পুরোনো লেখা, পুরোনো কোনো সংকলন এবং পুরোনো কবি-লেখক ও মানুষ নিয়ে আলাপচারিতা করার মানুষটি চলে গেল। ভালো থাকো, যেখানেই থাকো কবি মাহমুদ আল জামান ও সম্পাদক আবুল হাসনাত।
তার রাজনৈতিক দর্শনের মতোই আবুল হাসনাতের কর্মজীবনও শুরু হয়েছিল একটি প্রগতিশীল পত্রিকা দৈনিক ‘সংবাদ’-এ। ‘সংবাদ’-এর বার্তাকক্ষে দীর্ঘদিন কাজ করে সে এবং একসময় তার ওপর সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্ব অর্পিত হয়। সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে আবুল হাসনাত অনন্যসাধারণ দক্ষতা দেখান। আমি ‘সংবাদ’–এ তার দপ্তরে অনেক দিন গেছি। সেখানেই একই কক্ষে সন্তোষদা (সন্তোষ গুপ্ত) ও মনীরুজ্জামানকে পেয়েছি এবং তাঁদের সঙ্গে পরিচয় ও আলাপ হয়েছে।
তার সাহিত্য সম্পাদকরূপে অসামান্য দক্ষতা ও পরিমিতিবোধের কারণেই অধ্যাপক আনিসুজ্জামান আবুল হাসনাতকে ‘কালি ও কলম’-এর সম্পাদকরূপে বেছে নেন। ‘কালি ও কলম’-এ এসে তার দুটি লাভ হয়েছে। একটি হলো অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তা আর অন্যদিকে একটি মাসিক সাহিত্য পত্রিকাকে মননশীলভাবে সাজানোর নিজস্ব উদ্ভাবনী শক্তির ব্যবহার। এই কাজে আবুল হাসনাতের অনন্য সৃজনী শক্তির পরিচয় কবি-লেখক থেকে সর্বস্তরের পাঠকমাত্রই স্বীকার করবেন। শুধু কবি-লেখক হিসেবে নয়, পাঠকরূপে আমার ধারণা, আবুল হাসনাতের মতো একজন নিপুণ সম্পাদকের হাত ধরে গত কয়েক বছরে ‘কালি ও কলম’ উভয় বাংলার শ্রেষ্ঠ সাহিত্য পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়েছিল। বুদ্ধিবৃত্তিক পাঠকমহলে ‘কালি ও কলম’-এর সমাদর ও জনপ্রিয়তা বেড়ে গিয়েছিল।
মৃদুভাষী, বিনয়ী ও সজ্জন এই মেধাবী সম্পাদকের তিরোধানে আমাদের সাহিত্যাঙ্গনের অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হলো। বস্তুত তার লোকান্তর আমাদের একজন শ্রেষ্ঠ সাহিত্য সম্পাদকের মেধা, কর্তব্যনিষ্ঠা ও দক্ষতা থেকে বঞ্চিত করল। ব্যক্তিগতভাবে আমিও একজন পুরোনো, একই মতাদর্শী শুভানুধ্যায়ী বন্ধু হারালাম। পুরোনো লেখা, পুরোনো কোনো সংকলন এবং পুরোনো কবি-লেখক ও মানুষ নিয়ে আলাপচারিতা করার মানুষটি চলে গেল। ভালো থাকো, যেখানেই থাকো কবি মাহমুদ আল জামান ও সম্পাদক আবুল হাসনাত।
আমাদের বন্ধু-সতীর্থ ছোটলু
প্রথমেই উল্লেখ করেছি, হাসনাতের আচানক চলে যাওয়ার ক্ষতটাকে আরও দগদগে করে চলে গেল সবার সুপরিচিত প্রখ্যাত নাট্যাভিনেতা, বাচিক শিল্পী ও লেখক আলী যাকের, আমাদের বন্ধু-সতীর্থ ছোটলু।
আমাদের কাছে একদার, এমনকি আমৃত্যু ছোটলু নামে পরিচিত অনুজ প্রজন্মের কাছে শ্রদ্ধাভাজন এবং অগ্রজদের প্রিয়ভাজন আলী যাকেরকে এই বক্ষ্যমাণ লেখায় সংগত কারণেই আমি ‘ছোটলু’ বলে সম্বোধন করব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোটলু আমার সতীর্থ হিসেবে অতিপরিচিত হলেও তার সঙ্গে সাক্ষাৎ তারও আগে হয়েছিল। তার ছোট বোন দৈনিক ‘সংবাদ’-এ ছড়া/কবিতা লিখত এবং অনেক সময় খেলাঘরের পরিচালক ভাইয়া (কবি, সাংবাদিক হাবিবুর রহমান) আমাদের ডাকতেন দপ্তরে এবং পরামর্শ দিতেন। গেন্ডারিয়া থেকে ছোটলুর ছোট বোন ও ইমরুল চৌধুরী আসত এবং কোনো একদিন ছোটলুও তাদের সঙ্গে এসেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমরা একই ছাত্রসংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য ছিলাম এবং সংগত কারণে একই মতাদর্শ ও রাজনৈতিক চিন্তাধারায় বিশ্বাসী ছিলাম। ছোটলু ভালো ক্রিকেটও খেলত। আমরা পরস্পরের বিপরীত দলের হয়ে ক্রিকেট খেলেছি। যে আলী যাকের তার জীবনের পরবর্তী একটা দীর্ঘ সময়ে অভিনয়ের জন্য স্বনামধন্য ও বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল, আশ্চর্যের বিষয়, বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে তাকে আমি নাট্যাভিনয় ও নাটকের প্রতি আগ্রহী হতে দেখিনি। বরং তার গভীর আগ্রহ ছিল সংগীতের প্রতি। তার বন্ধু ও আরেক সতীর্থ মাহমুদুর রহমান বেণুর বাড়িতে প্রায়ই সন্ধ্যায় ছোটলু ও কামাল সিদ্দিকী উচ্চাঙ্গসংগীতের আসরে মধ্যযামিনী কাটিয়ে দিত। তার নাটক ও অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ ও ভালোবাসা বহু পরে জন্মেছিল এবং প্রকৃতপক্ষে সত্তরের দশকে।
কী করে ভুলি ‘গ্যালিলিও’র উপস্থাপনার অনন্যতা, ‘দেওয়ান গাজীর কিসসা’, সৈয়দ শামসুল হকের অমর কাব্যনাটক ‘নূরুলদীনের সারাজীবন’-এ তার অসাধারণ অভিনয়শৈলী! এমনকি টেলিভিশনে হুমায়ূন আহমেদের নাটকের সিরিয়ালে যে বিশেষ চরিত্র, তা যেন আলী যাকেরকে চিন্তা করেই সৃষ্টি হয়েছে।
জীবন ধারণের জন্য স্বল্পকাল ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করলেও বিজ্ঞাপনী সংস্থার কর্মকাণ্ড তাকে আকৃষ্ট করেছিল জীবিকার মূল লক্ষ্যরূপে। বন্ধু ইমরুল চৌধুরী করাচির বেতারের কেন্দ্রীয় বার্তা ডেস্কে সংবাদ পাঠক হিসেবে যোগ দিলে তারই সহযোগিতায় ছোটলু করাচিতে একটি নামী বিজ্ঞাপনী সংস্থা জে ওয়াল্টার থমসনে যোগ দেয়, যেখানে ইমরুল চৌধুরীও চাকরি করত। তবে করাচিতে বেশি দিন তার মন টেকেনি আর দেশের পরিস্থিতি দিন দিন উত্তাল হয়ে পাল্টে যাচ্ছে দেখে ঢাকায় ফেরার মনস্থ করে। ঢাকায় ছোটলু একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থা এশিয়াটিকে যোগ দেয়। এই বিজ্ঞাপনী সংস্থাটির মালিক ছিল একজন উর্দুভাষী। আগেই বলেছি, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হচ্ছিল দেখে ছোটলু ঢাকায় ফেরার জন্য অস্থির ছিল। একজন প্রগতিশীল দেশপ্রেমী হয়ে ওই সময়ে ছোটলু বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিতে বিলম্ব করেনি। ২৫ মার্চের পাকিস্তানি বাহিনীর ইতিহাসের জঘন্য গণহত্যার নারকীয় কালরাতের পর ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ ছোটলু দেশ ত্যাগ করে কলকাতায় চলে যায়। এ সময় তার মনের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল এবং মানসিকভাবে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলে এই মানসিক অবস্থা দূরীভূত হবে মনে করে যখন যুদ্ধে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল, তখন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও পরে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবিরের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ঘটে। আলমগীর কবির তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ইংরেজি সংবাদের দায়িত্বে ছিলেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ইংরেজি জানা লোকের অভাব ছিল। ছোটলু ইংরেজি-বাংলা দুটো ভাষাই অনর্গল বলতে পারত এবং সাপ্তাহিক ‘হলি ডে’তে কলামও লিখেছে ইংরেজিতে। আলমগীর কবির তাকে স্বাধীন বাংলা বেতারে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে বলেছিলেন, যুদ্ধক্ষেত্রের চেয়ে বরং এখানেই তার পক্ষে দেশকে বেশি সেবা দেওয়া সম্ভব। ছোটলু স্বাধীন বাংলা বেতারে সংবাদ পাঠ ও ইংরেজিতে অনুষ্ঠান উপস্থাপন ছাড়াও রণাঙ্গনের প্রতিবেদক হিসেবে দায়িত্বের সঙ্গে কর্তব্য পালন করে একজন প্রকৃত শব্দসৈনিক মুক্তিযোদ্ধায় পরিণত হয়েছিল।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আলী যাকের ফিরে এসে তার পুরোনো কর্মক্ষেত্র বিজ্ঞাপনী সংস্থায় যোগ দেয়। এশিয়াটিকের উর্দুভাষী মালিক পলাতক হওয়ায় সরকারি নিয়ম অনুযায়ী পরিত্যক্ত সংস্থাটির প্রশাসক হিসেবে তাকে নিযুক্তি দেওয়া হয়। একসময় সরকার এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাঙালি উদ্যোক্তাদের কাছে অর্থের বিনিময়ে হস্তান্তরের ব্যবস্থা করে। আলী যাকের সেই ব্যবস্থাধীনে এশিয়াটিক বিজ্ঞাপনী সংস্থাটির মালিকানা অর্জন করে। দিলকুশায় তার অফিস আমার টেলিভিশন দপ্তর ডিআইটি ভবনের (বর্তমানে রাজউক) কাছে হওয়ায় সে আমাকে প্রায়ই বাংলা কপি রাইটিংয়ের জন্য ডেকে পাঠাত। মনে পড়ে, ১৯৭২ সালে স্বাধীনতার পর প্রথম একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে সংবাদপত্রের বিশেষ সংখ্যার বিজ্ঞাপনের সব কপি রাইটিং আমি এককভাবে করেছিলাম। এই জন্য ছোটলু আমাকে বেশ ভালো পারিশ্রমিক দেয়। এই কথা বহুদিন আমি মনে রেখেছি। কারণ, আমার নতুন বিবাহিত জীবন তখন চলছে আর ঘরে সদ্যোজাত একটা কন্যাসন্তান এসেছে। বস্তুত ছোটলু আমাকে সেই সময়ের যুদ্ধ-পরবর্তী নানা অনটনের কথা ভেবেই ভালো পারিশ্রমিক দিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিল।
বিজ্ঞাপনী সংস্থায় ব্যবসায় মোটামুটি একটা স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরে ছোটলু এবার ধীরে ধীরে তার নতুন আগ্রহ ও আবেগ নিয়ে থিয়েটার তথা নাট্যান্দোলনের দিকে ঝুঁকে পড়ল এবং কিছু সমমনা তরুণ-তরুণী নিয়ে ‘নাগরিক’ প্রতিষ্ঠা করল। এ সময় সম্ভবত ১৯৭২-এর শেষ কিংবা ১৯৭৩-এর প্রারম্ভে একদিন আমি তাকে টেলিভিশনে নাট্যাভিনয় তথা নাটকসংক্রান্ত শিক্ষাবিষয়ক অনুষ্ঠান করতে দেখলাম, যেখানে সে স্তানিস্লাভস্কি ও মেথড অ্যাক্টিং নিয়ে আলোচনা করেছিল। অনুষ্ঠান শেষে আমি তাকে এই বিশেষ পদ্ধতিগত অভিনয় সম্পর্কে টিভিতে আলোচনার জন্য ধন্যবাদ জানালাম এবং বললাম, আমি ইতিপূর্বে চলচ্চিত্র সংসদের পত্রিকা ‘ধ্রুপদী’তে সোভিয়েত ফিল্ম ‘হ্যামলেট’ নিয়ে একটি লেখায় এই বিশেষ ধরনের অভিনয় নিয়ে লিখেছি। ছোটলু অবাক হলো যে আমি ১৯৬৮ সালে সোভিয়েত অভিনেতা ইনোকন্তির ‘হ্যামলেট’-এ অসাধারণ অভিনয়ের প্রশংসা করে মেথড অ্যাক্টিংয়ের কথা বলেছিলাম। এরপর থেকে সে অনেক সময় নাটকের নানা অগ্রযাত্রা নিয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা করত এবং কলকাতায় থাকতে তার নাটক বিষয়ে আগ্রহ ও আবেগের কথা অবহিত আমাকে করে। এমনকি সে বাদল সরকারের ‘টিনের তলোয়ার’ একাধিকবার দেখে।
আমাদের দেশে ছোটলুর নাটকে ও নাট্যশিক্ষায় অবদানের কথা বলে শেষ করা যাবে না। বলা ভালো, এ কথা বলার জন্য আমি এ মুহূর্তে কলম ধরিনি। তবে দর্শনীর বিনিময়ে নাটক দেখার প্রথা নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় প্রথম শুরু করেছিল এবং মহিলা সমিতি মিলনায়তনে সেই নাটক দেখার জন্য আমি, আমার স্ত্রী পিনকি প্রথম দর্শকদের সঙ্গে ভিড় করেছিলাম। তবে নাটক আর নাট্যাভিনয়ে তার ব্রের্টল্ড ব্রেশটের নতুন করে অনুকৃতির কথা ভোলার নয়। কী করে ভুলি ‘গ্যালিলিও’র উপস্থাপনার অনন্যতা, ‘দেওয়ান গাজীর কিসসা’, সৈয়দ শামসুল হকের অমর কাব্যনাটক ‘নূরুলদীনের সারাজীবন’-এ তার অসাধারণ অভিনয়শৈলী! এমনকি টেলিভিশনে হুমায়ূন আহমেদের নাটকের সিরিয়ালে যে বিশেষ চরিত্র, তা যেন আলী যাকেরকে চিন্তা করেই সৃষ্টি হয়েছে। আলী যাকের ছাড়া নির্মাতা আর কারও কথাই যেন ভাবতে পারেননি। এসব ভুলি কী করে?
আমার ভীষণ কষ্ট হয়, এত কাছের হয়ে আমাদের মধ্যে সুদীর্ঘকাল দেখা নেই, যদিও মাঝেমধ্যে ফেসবুকে আমাদের আলাপ হয়েছে, বিশেষ ‘ঢাকা ফোরটি ইয়ার্স হিস্ট্রোরি অব ফটোগ্রাফি’ নামে একটি গ্রুপে সে উপস্থিত হতো মন্তব্য নিয়ে এবং তার সঙ্গে আমিও যোগ দিতাম। কেননা, আমরা দুজনেই পুরান ঢাকায় বেড়ে উঠেছি আর তাই পুরান ঢাকার প্রতি আমাদের আবেগ আর ভালোবাসা অটুট রয়েছে। মনে পড়ে, দুই-তিন বছর আগে সে হঠাৎ করে আমার কবিতার কথা জিজ্ঞেস করে জানতে চেয়েছিল, আমার লেখা কেমন চলছে। আমি তাকে বললাম, ২০১২-এর পর কোনো কবিতার বই বের হয়নি; তবে লিখি, যদিও বিরলপ্রজ। পরে আমি তাকে ‘আমার কবিতা একশত পঞ্চাশ’ গ্রন্থটি পাঠালে সে খুব খুশিমনে আমাকে প্রাপ্তিস্বীকার করেছিল। সে নিজের অসুস্থতার কথা বলত না। একবার জিজ্ঞেস করায় বলেছিল, তার শরীর ইদানীং ভালো যাচ্ছে না।
আলী যাকের চিরদিন নিকট বন্ধু ও সতীর্থদের কাছে ছোটলু ছিল। বন্ধুবান্ধবের কাছে এই পরিচয় দিতেই পছন্দ করত, যার ব্যত্যয় কোনো দিন হয়নি। এই প্রসঙ্গেই আমার মনে পড়ছে নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে তার বিজ্ঞাপনী সংস্থা ইস্ট এশিয়াটিক একটি বড় ধরনের জাতীয় ক্রীড়ানুষ্ঠানের প্রচার ও বিজ্ঞাপন কর্মের সুযোগ পায়। ওই সময়ে তার একটি দাপ্তরিক অনুরোধের অনানুষ্ঠানিক পত্র নিয়ে প্রখ্যাত অভিনেতা ও বাচিক শিল্পী আসাদুজ্জামান নূর (পরবর্তী সময়ে জাতীয় সংসদের মাননীয় সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী) আসেন শাহবাগে আমার তৎকালীন সরকারি দপ্তরে। পত্রটি কোনো দাপ্তরিক নয়, ইস্ট এশিয়াটিকের প্যাডেও নয়। বন্ধুর কাছে বন্ধুর সাদামাটা অনুরোধপত্র, যার নিচে স্বাক্ষর ছিল ‘তোর ছোটলু’। আমি যেন ওই জাতীয় ক্রীড়ানুষ্ঠানের বিশদ টিভি কাভারেজ দিই। আমি তার অনুরোধ রেখেছিলাম। আসলে এই অনুরোধ রক্ষা করে আমি আমার সেই ১৯৭২ সালের ঋণ শোধ করেছি, যখন সে আমার নব্যবিবাহিত জীবনে আমাকে তার বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজের বিনিময়ে অর্থসাহায্য করেছিল।
বিদায়, বন্ধু ছোটলু। ক্যানসারকে কিছুটা পর্যুদস্ত করে চার বছর বেঁচেছিলে। আরও হয়তো বাঁচার সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু নির্মম করোনা টেনে নিয়ে গেল ওপারে। এই নিদারুণ সময়ে আমরা কাছের মানুষেরা, অনেকে শেষ দেখা পেলাম না। এটাই সবচেয়ে কষ্টের, সবচেয়ে বেদনার।
অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: info@onnoalo.com